বাছিত ইবনে হাবীব
একটি নূতন গ্রন্থ মানে কিছু নূতন আলোকসম্পাত। নূতন চেতনার উদ্যান। কিছুক্ষণ নূতন সৌন্দর্য দীঘিতে অবগাহন। শব্দের লাল নীল পদ্ম অবলোকন, উপভোগ। তথ্য, তত্ত্বমাখা সত্যের সুনিপুণ ঠিকানায় বিচরণ। কে যেন বলেছিলেন : whenever we collect books,we collect pleasure.আসলেই তাই–নূতন গ্রন্থ নিয়ে আসে আনন্দের ঢেউ। মনে প্রাণে জাগায় নূতন প্রাপ্তির শিহরণ। আজকের আলোচ্য গ্রন্থ বিশিষ্ট কবি জাকির আবু জাফরের ‘ আল মাহমুদ : যেমন দেখেছি তাঁকে ‘। স্মৃতিকথন গ্রন্থটি।
ব্যতিক্রম লেখকহৃদয়ে ফোটে অনুপম গ্রন্থগোলাপ। ব্যতিক্রম চেতনার কারিগর তারুণ্যের কবি জাকির আবু জাফর।
অমর একুশে বইমেলা ২০২০। কবি আল মাহমুদ’র স্মৃতিসম্ভার নিয়ে ব্যতিক্রম সুবাস সুরভি মাখা ২৬২ পৃষ্ঠার একখানা ঢাউস গ্রন্থের নিঃশ্বাস ছেড়েছেন এই কবি, গুণী গদ্যশিল্পী।
আধূনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুঁজি আল মাহমুদ। তাঁর কবিতার বিস্তৃত আকাশ ও গদ্য- শস্যসম্ভার ছেঁকে নির্যাস গ্রহণ করে তুষ্ট নন জ্ঞানপিপাসু লেখক জাকির আবু জাফর। আল মাহমুদকে দেখা, তাঁর কাছে শোনা ‘সোনালী স্মৃতির দ্যুতি’ অত্যন্ত কোমল ভাষার পোশাকে সমগ্র গ্রন্থে ছড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু তো দেখেননি। পর্যবেক্ষণ করেছেন। শোনেননি শুধু নোট করেছেন। সুবিন্যস্ত করে গ্রন্থবদ্ধ করেছেন।
কত বড়ো কাব্য মনীষার স্মৃতিচারণ করেছেন একজন তুখোড় কবি জাকির আবু জাফর । স্বরচিত কবিতা পাঠশেষে যার চোখ থেকে অকাতরে ঝরে পড়তো ঝলমলে অশ্রুর মুক্তা।
লেখক বলেন : একজন কবি যখন নিজের কবিতা শুনে নিজেই ঢালেন অশ্রুর বান, তিনি কবিদের থেকে এগিয়ে থাকা একজন কবি। তিনি জানেন কবিতার অন্তর্গত সৌন্দর্য ও তৃষ্ণার আকুতি। কবিতার দেহে বন্ধনের রহস্য তিনি জানেন। জানেন বলেই তাঁরই রচিত শব্দমালা হৃদয়ে তুলে দেয় স্মৃতির ঝড়। পৃ-১৯
গোটা বিশ্বের নিরিখে একজন মহান কবি আল মাহমুদ। বিশেষ করে লোকজ বাংলার ঐতিহ্যের ধারক বাহক। স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি অবিচল বিশ্বাসের কবি। তাঁর গভীর জীবনবোধ, প্রতীতি, দর্শন,অভিজ্ঞতা, সমাজচেতনা তুলে ধরতে গিয়ে লেখক দক্ষতা ও দরদের সাথে এঁকেছেন ঐ সময় ও সমাজের বাস্তবচিত্র। উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের পরিচয়, বৈশিষ্ট, আমাদের জাতীয় সাহিত্য-চেতনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
গ্রন্থটির কল্যানণ একজন প্রকৃত কবির কাব্যবোধ আমাদের বোধে আয়নার মতো পরিস্কার। জানা গেলো নবীন কবিদের প্রতি আল মাহমুদের ভালোবাসা– সমুদ্রের অপরিমেয় গভীরতা। দেখা গেলো কবি’ র অহংকারের প্রয়োজনীয়তা : ‘ যদি সত্যিকার কবি হোন তার কিছু কাব্যিক অহংকার থাকে, যা তার ব্যক্তিত্বকে উন্নত করে। সুন্দর করে।আর দশজন থেকে আলাদা করে। (পৃ ১৩১)
তুমুল আড্ডাপ্রিয় এই কবির আড্ডায় যখন হাজির হোন সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আফজাল চৌধুরী, আসাদ চৌধুরীর মতো একেকজন দিকপাল , আমাদের বুঝতে বাঁকী থাকে না এগুলো নিছক আড্ডা নয়, আড্ডার আবরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতার ক্লাস।আল মাহমুদকে ঘিরে কতগুলো দশক আনন্দে কেটেছে নবীন প্রবীন তরুণ কবিদের। কবি আবদুল হাকিম যেমনটি বলেছিলেন– সুধাকর বেড়ি যেন তারাগণ মেলা।
বইটি পড়ে আরো বুঝা গেলো কবিতার জগতেও রয়েছে অনেক অকবির অনাহুত বসবাস। আল মাহমুদ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন –মহাকাল সেই কবিকেই মনে রাখে যিনি লিখে রেখে যান কালের অক্ষর।
প্রকৃতপক্ষে প্রকৃত কবিকে আবিষ্কার করতে হয়। এর মাধ্যম দুটো। কবিকে সময় দেয়া। তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা। প্রথম প্রক্রিয়াটি অধিক কার্যকর। এতে বেরিয়ে আসে স্বতঃস্ফূর্ত কবিসত্তার নির্ভেজাল হৃদয়। তার স্বপ্ন, চিন্তা, অভিজ্ঞান, দর্শনের খুঁটিনাটি সবটুকু। জাকির আবু জাফর আল মাহমুদকে তাঁর বাসায় প্রচুর সময় দিয়েছেন। ব্যক্তিগত সুখেদুখেও তার পাশে ছিলেন। সময় দিয়েছেন ঢাকা শহরে বিভিন্ন উচ্চমার্গীয় সাহিত্য–অনুষ্ঠানে। ঢাকার বাইরে তাঁর সফরসংগী হয়েছেন বহুবার। এবং তাঁর সাথে ছিলেন তার সমাহিতকরণ পর্যন্ত। বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে একজন মহান কবির জীবনে এরকম মেধাবী সংগীর অতীব প্রয়োজন। মনে হয়েছে এই মানের কবিকে সঙ্গ দেয়া মানে নিজের সৃজনী উচ্চতাকে আরো প্রোজ্জ্বল করা। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এই গ্রন্থ রচয়িতার ক্ষেত্রে তা ই হয়েছে।
আজ এ গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে অজানা আল মাহমুদ নূতন রূপে উদ্ভাসিত হলেন গোটা জাতির সামনে।
আল মাহমুদ–বলা যায় দুই হাতে কলম চালিয়েছেন আজীবন। তবু তাঁর যে এত বলার বাঁকী ছিল বইটি হাতে নিলেই পাঠকের বোধে আসবে। যেন আল মাহমুদ বলতে চান — সব কথা বলা হলো বাঁকী রয়ে গেলো শুধু বলিতে বলিতে। কবি এস. টি. কোলরিজ বলেছিলেন : A poet is a man speaking to man.
সত্যিইতো আল মাহমুদ অনেক বচন তৃষ্ণা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাঁর এ তৃষ্ণা নিবারণে সার্থক সচেষ্ট হয়েছিলেন একজন পাকাপোক্ত তরুণ কবি জাকির আবু জাফর। এ সুন্দর গ্রন্থটি তারই প্রমাণবাহী।
বইটি আগাগোড়া স্মৃতির অবিরাম ঝর্ণাধারা। ছেচল্লিশ টি ছোট-বড় পর্বে সু-সজ্জিত। লেখক বলেছেন–আল মাহমুদকে নির্মোহভাবে আবিষ্কার করার এক তীব্র নেশা থেকে বইটি রচিত। আর আল মাহমুদ যখন বলেন ‘কবিতা তারুণ্যের মুখাপেক্ষী ‘ তখন জাকির আবু জাফরের মতো কাব্য–পিপাসাকাতর তরুণ আল মাহমুদকে সঙ্গ না দিয়ে পারেন?
বলা হয় শাহেদ আলী’ র গল্প পড়লে দেওয়ান আজরফের দর্শন বুঝা যায়। আহমদ ছফা’ র ‘যদ্যপি আমার গুরু ‘ পাঠ করলে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে চেনা যায়। অনুরূপভাবে এই গ্রন্থটি পড়লে সংক্ষেপে আল মাহমুদকে জানার সুযোগ পাবেন আগ্রহী পাঠকবৃন্দ।
চাঁদের আলো সূর্যের দান না চাঁদের অর্জন। আমার মনে হয় দুটোই। আল মাহমুদ ও জাকির আবু জাফর দুই ভিন্ন প্রজন্মের দুজন সাহিত্য জহুরী। প্রমাণ করেছেন–রতনে রতন চিনে। মানিকে মানিক।
আল মাহমুদকে লেখকের যে নিগুঢ় মূল্যায়ন তার সাথে একাত্ম হয়ে আমিও বলতে চাই : ‘দিন যত গড়াতে থাকবে তাঁর( আল মাহমুদ) এ উচ্চতা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে।… একটি সময় এমন আসবেই যেদিন ডান বাম আর পক্ষ-বিপক্ষের রেখা মুছে কবিতাই দাঁড়িয়ে যাবে ঋজুতায়।’ পৃ- ২৬২
একটি সুলিখিত গ্রন্থ কালজয়ী হয় দুটো কারণে। ভাষার বিদ্যুৎ বা বর্ণনার চমৎকারিত্ব। আর লেখকের স্টাইল বা কৌশল। এ দুটো গুণের উপস্থিতিতে গ্রন্থটি অনন্য। শিল্পীত শব্দমালার পরিশিলিত বিন্যাসে সুবিন্যস্ত। যে কোনো পাঠকের রকমারী বিনোদনের পসরায় গ্রন্থটি সমৃদ্ধ। যারা আল মাহমুদকে মোটেই জানে না তারাও বইটি পাঠে ব্যাপক উপকৃত হবেন আশা করি।
বইটিতে কবির সাথে কবির আলাপচারিতার দিনক্ষণ তারিখের উল্লেখ নেই। এতে মোটেও ম্লান হয়নি বইটির শিল্পমান। নূতন এই কৌশলের জন্যে লেখক আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি আলাদা ধন্যবাদ পাওয়ার দাবী রাখেন।
বইটির চঞ্চল ভাষা স্রোত, ঘটনার আকর্ষণীয় বর্ণনা, নান্দনিক উপস্থাপনা সারা দেশে লেখকের গ্রহণযোগ্যতার আয়তন বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে বলে মনে হয়। তা-ই হোক।
আল মাহমুদের জীবনগোধূলিলগ্নের ছবিসহ সাদাকালো অনুপম প্রচ্ছদের জন্যে শিল্পীকে অশেষ ধন্যবাদ।
অত্যন্ত শ্রমলব্ধ শিল্পবিন্যাসের এ বিশাল শব্দ বিতানের জন্যে লেখকের প্রতি নিবেদন করছি এক বুক প্রাণময়তা। জাকির আবু জাফর সদরদ বলেছেন– আল মাহমুদ এখন কেবলি স্মৃতি। বইটি সেই স্মৃতির স্বচ্ছল শিখা। আমরা চাই এই শিখা অনির্বান হোক।
সরলরেখা প্রকাশনা সংস্থাকে ধন্যবাদ। বিরাট কলেবরের এই গ্রন্থটিকে প্রায় নির্ভুলভাবে প্রকাশ করার জন্যে। এর ঝকঝকে মুদ্রণ পাঠককুলের চোখ কাড়ার মতো।
বইটির বিনিময় মূল্য অত্যন্ত যুগোপযোগী ও যৌক্তিক। লেখকের দীর্ঘ সুস্থ জীবন ও গ্রন্থটির ব্যাপক পাঠ ও প্রচার কামনা করি।