প্রচ্ছদপ্রবন্ধকবি তৈমুর খানের কবিতা ও তার কারুসুন্দরতা নিবিষ্টপাঠ

লিখেছেন : পারমিতা ভৌমিক

কবি তৈমুর খানের কবিতা ও তার কারুসুন্দরতা নিবিষ্টপাঠ

পারমিতা ভৌমিক

তৈমুর খানের কবিতায় মিশ্র সৌন্দর্য ও সুবৃহৎ আয়তন না থাকলেও যা আছে তাকে দীর্ঘই বলা যেতে পারে। সেখানে আছে তীব্র অন্তর্গতি ও চৈত্যসত্তার নিষ্ঠগতি। কবির মতে দীর্ঘ অভিজ্ঞানের বাকচিত্রই দীর্ঘকবিতা। এইসব অভিজ্ঞান বিভিন্নসময় ধরে সঞ্চিত হতেই পারে। কবির মতে মধুসূদনের “রাবণ” সমগ্ৰজাতির হাহাকারে পূর্ণ,সে ক্রান্তদর্শী। তবুও সে ব্যর্থ এক ট্রাজিক নায়ক। আবার মহাজন পদকর্তা চণ্ডীদাস কখন যেন রাধায় রূপান্তরিত হয়ে গেছেন, কেবল রয়েছে তাঁর চিরন্তন বিরহীরূপ। তাহলে আমরাও কি ভাবতে পারি যে কবি তৈমুরের ভেতরের কবির হাহাকার এভাবেই ধ্বনিত হয়েছে তাঁর দীর্ঘকবিতাতে?
মস্তিষ্কের আবরণ গাঢ় হয়ে গেলে উপরের আলোর অবতরণের পথ রূদ্ধ হয়ে যায়। তখন প্রয়োজন হয় মস্তিষ্কগত একটা বিপুল চঞ্চল্যের। সেই চাঞ্চল্যই অবতরণের পথে এনে দেয় নতুন আলো। এই আলো-ই শিল্পীর প্রেরণা। এ যেন এক দ্বাপরশিল্প যেখানে অশান্তির ধর্ম হয়ে উঠল শিল্পের ধর্ম। ফলত মানুষ পেল উদ্বেগ। শিল্পে আনলো তরঙ্গ কম্পন। এভাবেই didactic poetry-কে পিছনে ফেলে চলে এল মানুষ।
তৈমর খান যেন তাঁর সংহত আবেগের তীব্রতার মধ্যেই ধরে রাখলেন মহত্ব‌। তাঁর কবিতার অধিবাচনের নির্বাচনগুলোতে চোখ রাখলেই দেখব সেখানে পলাশ রঙের মাঠ রয়েছে পাশেই। কী অসাধারণ বর্ণক্ষেপণ ! মাঠ কি পলাশ রঙের হয় নাকি পলাশের ফুটে ওঠা অলৌকিক সৌন্দর্যে মাঠেরই হৃদয়খানা যায় পাল্টে? সবচেয়ে বড় কথা সেখানে সেই মাটির শস্য ফলে পলাশের মতো সুন্দর হয়ে , আর মানুষ তখন বাঁচে তার শুশ্রূষায়।
কী অলৌকিক উড়ানে তৈমুর উৎসর্পিত গতিতে আঁকেন অক্ষরছবি! সেখানে প্রতিটি বাঁচা জীবন্ত হয়ে সুর তোলে। চারপাশের অনুষঙ্গগুলো প্রতিবেশীর মতো এসে ভিড় করে তৈমুরের কবিতায়—
“হলুদ ক্রিয়ার বিবর্ণ ফুল
বাঁশবন ঘরবাড়ি জল স্থল
মায়াময় হয়ে যায় আর তখন চরাচর কেঁপে ওঠে ঝড়ে”
অথচ এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও তো সহজ বাঁশি বাজে!
কবি-প্রাণের তূরীয় স্তরে এসে পড়তে থাকে তূর্যাতীতের আলো। তখন মায়াচর ও অচর সব কাঁপে, কেবল সরে যায় অচর অন্ধকারটি। unveiled হতে থাকে বৃত্তের পৃথিবী। একটা সহজতার বোধ সে শক্তিস্তরের বাঁশির সুরে তখনই বোধে এসে ধরা দেয়―
“কষ্ট তোমার জীবন কাহিনি
দুঃখ তোমারই উত্তাপ পাওয়া চাঁদ
রক্তক্ষরণ তোমারই নীল মহোৎসব”
অবাক হই যখন তৈমুর পড়ি, এভাবেও ভাবা যায় ? আমরা অবাক হই আর দেখি
সাধক সত্তার অনিবার্য স্ফুরণ তৈমুরের কাব্য ভাবনাতে জড়িয়ে আছে।
বস্তুত এত মধুর এত গভীর এত মোলায়েম উচ্চারণ কম পড়েছি। মেলডি আর তার রেজোনেন্স আমাদের মনে ধরিয়ে দেয় একটা অলৌকিক ঘোর। অন্তিম উপলব্ধির দিকে এগোতে এগোতে কবিও যেন বলতে থাকেন― “আমাকে যেতে দাও
এই সব আলো ঘুম মৈথুনের সমাধান থেকে
আমাকে যেতে দাও মৃত্যু-সংগ্রাম
একটাও পেরোতে পারিনি নদী”
কবিকে ব্যথিত করে তোলে—
“বিষাদ-স্নেহের কোলে বেড়ে ওঠা
পিতৃভূমি, এই চোখ টনটন করে
মাটির বাড়ির দাওয়া, ছায়াপাত
সময়-যাপনে সহস্র ক্ষুধার হাত
টেনে আনে বারবার ব্যর্থতায় অপমানে”
এই ভাবেই অসহন বেদনায় বিদ্ধ হতে হতে ‘গোপনে ঘাতক আসে’ আর কবি একদিন নিঃস্ব হন আর ‘নিজের কুকুর মুখ’ ভেসে উঠতে দেখেন আয়নায়।
কবির একান্ত ভাবনায় ধরা পড়ে অন্যতর বেদনা। রক্তমৈথুন ক্রমাগত চলতে চলতে কবির আন্তরচেতনার হাঁসফাঁস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে―
“এখানে সৃষ্টির বারো মাস, আয়ুষ্কাল কাটে
তবু গন্তব্যে পৌঁছানো গেল না
কেবলই রক্তপাতে ভিজে যাচ্ছি,
কেবলই রক্ত গন্ধ, কসাই দৃশ্য
ভয়ংকর চোখ রাঙায় আর্তচিৎকার'”
কবির পংক্তি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে―
“মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছি মৃত স্বপ্নের ভিতরে একটু বিশ্রাম চাই।”
কবির কলমে উঠে এলো বেদনার আঁচ―সে বেদনা চলেছে কোথাও অন্তহীন আরও এক বেদনার পথে যেখানে আমাদের নিয়তি দাঁড়িয়ে আছে তবুও কিন্তু সবশেষে তা বেদনাহীন। সেই পথটাও চিহ্নিত হয়েছে তৈমুর এর কবিতাতে….. পংক্তিতে…..শব্দে…. শব্দবন্ধে―
“আমাদের নবান্ন-দেশ মৃত্যুরজলের বিভীষিকা
স্বপ্নচোর―হন্তারক―অসুখ―বিসুখ”…..
অথবা
“হলুদ বাসরে ক্ষয় বুকের পাঁজর”….
কিম্বা
“…ঘুমের মধ্যেই কুয়াশায়
মানুষের আর্তরব, হাহাকার ওঠে”…

.”প্রেম অথবা প্রেমহীনতায়
বেঁচে থাকে; বেঁচে থেকে মনে হয়।”
সব শিল্পই মূলত প্রাণের মধ্যে অন্তর আত্মার রূপায়ণ। অন্তরাত্মার সঙ্গে প্রাণের উদ্বাহু। তৈমুরখানের কবিতা পড়লে এ কথার সত্যতা মর্মমূলে ঝংকার তোলে।
প্রাণের ধর্ম গতি , আর অন্তরাত্মার ধর্ম শান্তি।
এ দুয়ের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে তৈমুরের কবিতা জগৎ।
Classic-এর দূরবীক্ষণ আর আধুনিকের অণুবীক্ষণ―এই দুইয়ে মিলে যে ভাবজগৎ তৈরির সুষমতা গড়ে ওঠে তৈমুরের কবিতায় তা দুর্লক্ষ নয়।
তাঁর কবিতা ও গদ্য দুটোই পড়ে মনে হয়েছে আধুনিকের সূক্ষ্মতা আর প্রাচীনের বিপুলতা এক রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে।
Wordswarth এ শুনেছি এমনটাই—
“The gods approve
The death and not the tumult of the soul”
আমার মনে হয়েছে তৈমুর আধুনিক হয়েও শান্তরসের কবি। এটাই তাঁর কবি সত্তার মূল পরিচয়। প্রায়শই আমাদের বিক্ষিপ্তচিত্তে তাঁর কবিতারা আনে উপশম । সে-সব পথ্যের মতো কবিতা।
তৈমুর খানের কবিতায় রয়েছে বিচিত্র ভাব ও গতি। কোনো উন্মাদ আবেগ তাঁর প্রেরণাকে গ্রস্ত করতে পারেনি। একটা উত্তুঙ্গ ভাবনাকেই ধারণ করে আছে তাঁর কবিতা—
“তারপর আজও দূর হেঁটে আসি
অনেক জ্যোৎস্না ছিল কেবলই সমুদ্র
কেবলই উদ্দাম প্রাণের উপমা
কালস্রোত মুছে যেতে যেতে
তোমার নীরব বেলা পড়ে যায়
স্পষ্ট অক্ষরের পাশে মানব মিছিল”
অমোঘ অবশ্যম্ভাবী কোলাহল এগিয়ে আসে আগুনের মতো। আগুনের ফুলকির মতো
প্রতিটি প্রাণকণা পৃথিবীর দ্বীপময় জেগে ওঠে—
“এত বিবর্ণ আকাশ কেন আজ?
কোনো ফুলেই ভাষা নেই!
শুধু একা চাঁদ ক্ষুধিত মানুষের হাতে শুয়ে আছে
বাতাসে এখন কোথাও উড়ে যাচ্ছে ছাই
মেঘে মেঘে ভাসে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন নজরুল!”
সংবেদনশীল তৈমুর বলেন—
“আমার কান্নার শব্দ, আমার মর্মরিত প্রেমসমূহ, শ্রদ্ধার গান, চেতনা, নব-উত্থান সব লিখে রাখি।
সব বেদনার পরাভব অজর অক্ষর নীলাভ আকাশ আর নিরুচ্চার অভিমান, বিশ্বাস আর বিস্ময় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির সোপান।
দূরদৃষ্টি জেগে ওঠা ‘দূর্বা’র কাছে নিজেকে পাঠাই আমি নিরন্তর মুখর আলোকে
এই নাও ফেব্রুয়ারি সোনালি সকাল বিনম্র মহিমার একটি সুচারু ত্যাগ উষ্ণ উল্লাস প্রাচুর্যের অন্তহীন ব্যক্ত ক্রিয়ায় মগ্ন যাপনের দিন ফিরুক আবার”
আসলে কবি তৈমুর খানের লেখায় তাঁর অন্তরাত্মার যে ছায়া পড়েছিল তাতেই গড়ে উঠেছিল একটি ইতি-নেতিমূলক জীবনদর্শন সেখানে আমরা শুনেছি কান্নার শব্দ ।
তাঁর মর্মরিত প্রেম শ্রদ্ধার গান চেতনার নব উত্থান যা যা তিনি পেয়েছিলেন জীবন মথিত করে , তা যেন কী এক অপূর্ব উৎসর্পিনী ঘোরে পরাজিত হয়ে গেছে তাঁরই বেদনার প্রসারে। ঠিক তখনই কি , সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নীলাভ আকাশ,নিরুচ্চার অভিমান?
বিষ্ময় আর বিশ্বাস, এমন সমস্ত কাঙ্ক্ষাগুলো মুক্তির সোপানের মতো করে সাজানো। এবং ফুটেছে তাঁর শেষ অভিলাষ‍ও—
“একটি সুচারু ত্যাগ, উষ্ণ উল্লাস
প্রাচুর্যের অন্তহীন ব্যাপ্ত ক্রিয়ার
মগ্ন যাপনের দিন ফিরুক আবার”
এভাবে অন্যত্রও আমরা আবিষ্কার করেছি মানুষ তৈমুরকে। সমাজনীতি রাজনীতি মানবনীতি এমনকি প্রথাবদ্ধ চিরাচরিত ধর্মনীতিও তাঁকে বিব্রত করেছে। তবুও তো মানুষই পরমসত‍্য হয়ে প্রতিভাত তাঁর কবিতায়। একটা অসাম্প্রদায়িক মনোভূমিতে ফুলের মতো ফুটে ওঠা মানবতাবোধ, সনিষ্ঠ পূজারী কবির কিছু অভিমান তাঁর লেখায় ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠতে দেখেছি আমরা।
কেন বারবার এমনটাই হয়েছে তাঁর?
তাঁর মনে হয়েছে—
“এখনও কৈশোর এসে সামনে দাঁড়ায়।
যৌবনকে ফালাফালা করে। যে মেয়েটি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ফুল দিয়েছিল, যে মেয়েটি প্রথম চুমু খেয়েছিল বসন্তের বিকেলে, যে মেয়েটি কথা দিয়েছিল ফিরে আসবোই— এখনো আকাশে বাতাসে তার কথা শুনতে পাই।”
আশ্চর্য মায়াঘনতায় তাই কি কবির মনে ভেসে উঠেছে—
“তার স্নিগ্ধ মুখ মনে পড়ে । সে আসতে পারেনি। সমাজ এসেছে। হাতে অস্ত্র নিয়ে।”
জগতের ক্ষেত্রেই দিয়েছে কি নিয়মের শৃংখলবন্ধন?
কবি দেখেছেন, ভীরু মেয়েটিকে—মেয়েটির চোখ শুকিয়ে গেছে। মুখে শব্দ ফোটেনি ।আজও সে নাড়া দেয় কবিকে, কেন? কী সেই বেপথু বেদনায়, না লিখে পারেন না কবি ওকে?
এখন আসুন পাঠক, প্রসঙ্গ পাল্টে অন‍্যত্র যাব যেখানে তৈমুর একটি জীবনজার্নিকেই সামগ্রিকভাবে দীর্ঘকবিতা বলে আখ‍্যায়িত করেছেন।
তৈমুর খান তাঁর ‘প্রত্নচরিত’ কাব্যগ্ৰন্থটিতে আমাদের স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘দীর্ঘ অভিমানের বাকচিত্রই দীর্ঘকবিতা’।
দীর্ঘকবিতা সম্পর্কে এইটিই বোধকরি কবির শ্রেষ্ঠ অবলোকন ।
প্রতিটি একক অস্তিত্বের টানাপোড়েন উপজাত হয় একটা বিশ্বমানবিকবোধ এবং তাই-ই একসময়, দীর্ঘকবিতার অভিযাত্রা রূপে চিহ্নিত হয়।
জীবনের ছোট ছোট ক্ষয়ক্ষতি অর্থ-অনর্থের সংঘাত, মন ও অ-মনের দ্বন্দ্ব এসবকিছু থেকে ক্রমাগত গলে যেতে থাকে প্রাত্যহিকতার বন্ধন। সেইসব কুড়িয়ে নিয়ে ব্যঞ্জনাময় অনন্য এক দীপ্রতায় কবির জীবনে কবিতা, শিল্পরূপ লাভ করে।
এক দিকে প্রবৃত্তিগত জৈবক্রিয়া আর অন্যদিকে উৎস বিচ্যুতির বেদনা —- এরই মিথষ্ক্রিয়ায় জমে ওঠে মর্মন্তুদ দীর্ঘশ্বাস।
বলাবাহুল্য এই অনুভূতিই দেশকাল নিরপেক্ষ শাশ্বতের সীমানায় তবুও শেষপর্যন্ত মানুষকে পৌঁছে দেয়।
তৈমুর খান নিশ্চিতভাবে জেনেছেন মানুষের মনটিকে, আর সেইসঙ্গে জেনেছেন যে, এই মনই প্রজ্ঞার আলোকে উদ্ভাসিত হয় এবং সেখান থেকেই হয় কবিতার জন্ম।
সেই মনে প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির পূর্ণতা ও শূন‍্যতা দুইই থাকতে পারে। আনন্দ ও হাহাকার দুইই বাজতে পারে। নঞর্থক বা সদর্থক যেকোনো প্রত্যয় জাগতে পারে। কিন্তু এসব কিছুরই উৎসে থাকে একটি নির্বর্ণ সত্তা।
ঐতরেয় উপনিষদ বলছেন , সমস্তই প্রজ্ঞারূপী , সমস্তই আমারই উপলব্ধির দ্বার। কাজেই প্রজ্ঞাতেই কবিকে ফিরতে হয়। তবে একথা ঠিক যে এই চলা সৃষ্টিসমুদ্রের ঢেউ-এর মতো, তা অন্ধকার ও জটিল এবং অস্থির। ঋষিকবিরা সেইখানেই হাতড়ে বেড়ান আদিম সত্তাকে। এই সত্তা স্বরূপত খণ্ডিত নয় , ভূমাতে তা এক।
ঋষিকবির কণ্ঠে শুনি—
“মোর চক্ষে এ নিখিলে
দিকে দিকে তুমিই লিখিলে
রূপের তুলিকা ধরি রসের মুরতি।
সে প্রভাতে তুমিই তো ছিলে এ বিশ্বের বাণী মূর্তিমতী”
(ছবি: বলাকা/রবীন্দ্রনাথ।)
তৈমুর যখন বলেন
” অশোক গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রোজ শুনি।
বেজে যায় পায়ের নূপুর”
তখন মনে হয়, এখানে কৃষ্ণ নান্দনিক। এই এখানেই, সেই বিরহপুর। এখানেই তবুও থাকে হাতের তলায় বিষ। বিষে বিষে নীলবর্ণ অক্ষরের মাস— আর তৈমুরের মনে হয় সে বিষ নিজের ভেতরে থাকে, যদিও নেই সাপ তবুও—
“সাপের দো-ফলা জিভে কলুষ বাতাস
হাহাকার উঠে যায়—অশোক গাছের পাতায় নামে রাত্রির চাঁদ
হরিসংকীর্তন নিয়ে জেগে ওঠে ঘর
মৈথুন বিরহ পূর্বরাগে

এ কেমন পদাবলি ?”

কবিতাটি তাঁরই ‘মায়াপ্রত্ন রাধাচরিত কথা’ অংশ থেকে নেওয়া। বিষয় নির্বাচনটি আকর্ষণ করে—
“অশোক গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রোজ শুনি বেজে যায় পায়ের নূপুর।”
কী আশ্চর্য কুশলতায় দুটো মিথকে কবি মিশিয়ে দিয়েছেন। তাতে কিন্তু ভাবনার পথে পাঠককে হোঁচট খেতে হয়নি। অশোকগাছ এসেছে সীতার অনুসঙ্গ হিসাবে আর পায়ের নূপুর এসেছে শ্রীরাধার অনুষঙ্গ হিসেবে। উৎসের দিকে তাকালেই দেখা যাবে এই দুই-এরই প্রজ্ঞাক্ষেত্রে রয়েছেন লক্ষ্মীসত্তা। যে কৃষ্ণ নান্দনিক ছিল সেও অনুসৃত হয়ে আছে সর্বকালের কবিসত্তায়। আর সেখানেই তো উৎসবিচ্যুতির বিরহ কবি তৈমুরকে রাধাত্মা করে তুলছে।
সত্তা যখন খণ্ডিত, মহাপ্রাণ থেকে অনেক দূরে, তখনই তার হাতের তলায় থকে বিষ। তখনই বিষে নীল হয়ে যায় ক্ষরণহীন কোনো মাহেশ্বরচেতনা।
কিছু খণ্ডিত সত্তার ভেতরে তবুও বেঁচে থাকে দো-ফলা জিভের কলুষ বাতাস। তারপর মুছে যায় বেদনার শেষ দাগটুকু। আশ্চর্য সহনে তখন , অশোকগাছের পাতায় নামে রাত্রির চাঁদ।
কবির প্রশ্ন— এ কেমন পদাবলি যেখানে হরিসংকীর্তনে জাগে মৈথুন বিরহ?
পূর্বরাগে জেগে ওঠে অন্য পদাবলি?
এই সেই শিকড়ের কথা চারিয়ে গেছে আধিভৌতিক জীবনের দোমড়ানো মোচড়ানো শিরা-উপশিরায়। আচ্ছা, তার নামও কি প্রজ্ঞা?
নাকি প্রজ্ঞাই প্রজ্ঞানের অন‍্য কোনও অনুকল্প ?
তৈমুরের বহু কবিতায় নির্বাচিত জীবনের ছায়াভাস থাকলেও মৃত্যু-চেতনাতেই কোথাও একটা বেদনামথিত সৌন্দর্য আগলে আছে কবির কবিতা।
যেন সেসব কবিতা আদিম প্রকাশের দ্বার খুলে দেবে অথবা তাকে মেলে ধরবে অসীমার চিরন্তন বোধে।
কবিকে পড়ে নেব আবার—
“পর্ব ভেঙে উঠে আসছে যত মেঘমেয়ে
দেশলাই জ্বলে উঠছে বারুদ স্তূপে
কেবল হারাছে সময়
আমাদের উজ্জ্বল সময়”
জীবনে স্মৃতি-বিস্মৃতির গর্ভ থেকে কবিসত্তায় বেয়ে আসে সবকিছু ভাঙার যত ইতিকথা। কখনও আকাশের নীলব্যাপ্তির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে মেঘমেয়েরা। বারুদ স্তূপের সঞ্চিত ইন্ধনে জ্বলে ওঠে কেবল অহেতুক প্রতিবাদী আগুন আর এভাবেই আমাদের উজ্জ্বল সময় কেবল হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধ অবচেতন ফুঁড়ে আরও অন্ধকারময় কোনো রুদ্ধ স্মৃতির টানেলে।
তৈমুর খানের কবিতায় যে পীড়িত আর্তনাদ আছে তা রসিকগণের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। তার এক্সপ্যানশন শূন‍্য দশক থেকে আজ অবধি অনুবর্তিত।
কবির বেদনার সুতীক্ষ্ণ সুর ও স্বরায়ণ কর্ণভেদ করে মর্মে আঘাত করে—
“পাশের বস্তি থেকে উঠছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী
ছেঁড়া জামা রক্তাক্ত শাড়ি উড়ে যাচ্ছে
কান্না হয়ে ফিরে আসছে নদী।”
একটা নিপুণ বাস্তবতা অবিকৃতভাবে মাথাতুলে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিবাদী তৈমুরের কবিতাভূমিতে। পাশের বস্তির ধোঁঁয়ার কুণ্ডলী, ছেঁড়াজামা, রক্তাক্ত শাড়ি, সব যেন উড়ে যাচ্ছে কান্না হয়ে। কান্নার মেঘ হয়ে, কান্নার বৃষ্টি হয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে ফিরতি পথের নদী। তৈমুরের কথাতেই মনে হয় এইসব আশপাশ চৌহদ্দির ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে তিনি শুনতে পেয়েছেন মহাশূন্যের নিবিড় আর্তনাদ, যা এক অতি বিস্ময়কর সৌরমণ্ডলকে ছাড়িয়ে, কোটি কোটি নক্ষত্রপুঞ্জের জন্মকে পাশে রেখে কী এক মহাজাগতিক সৌরশক্তির ঘটমান ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। কবি সেখান থেকেই গড়ে তুলেছেন তাঁর কবিতারাজ্যের ভাষিক ঐশ্বর্য।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা