আবু রাইহান
কবি জীবনানন্দ দাশ যেভাবে তাঁর ব্যক্তিগত বরিশালকে নিখুঁত অনুবাদ করেছিলেন রূপসী বাংলার কবিতায়। কবি শ্যামলকান্তি দাশও বাংলা কবিতায় স্থাপন করেছেন কবিতার চিত্ররূপময়তায় মেদিনীপুর নামে এক আশ্চর্য মায়াপৃথিবীকে। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার সঙ্গে শ্যামলকান্তীর মেদিনীবাংলার এক মৌলিক তফাৎ তৈরি হয়েছে সময়ের ব্যবধানে। কবি শ্যামলকান্তি দাশ মেদিনীবাংলার শালুক, শাপলা, গেঁড়ি,গুগলি তুলে এনেছেন কাদা মলিন জল থেকে এবং তা সাবলীল কাব্যিক দক্ষতায় বসিয়ে দিয়েছেন কবিতার অন্দরে।
“আমি নশ্বর কবি মালাচন্দনের গন্ধে
মুহুর্মুহ ডুবে যায় আমাদের সামান্য জীবন-
কী করে জানাব এই প্রতিবন্ধী চাঁদের কাহিনী।
আমাদের ঘুম পায়,প্রতীকের অন্ধকারে ঘন ঘন হাই ওঠে,
আমাদের কবিজন্ম ঢেকে রাখে
শালুক পদ্মের কিছু পাতা।”
(আমাদের কবিজন্ম)
সত্তর দশকে যে ক’জন কবি তাঁদের নিজস্ব কাব্য প্রতিভায় ভাস্বর হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কবি শ্যামলকান্তি দাশ অন্যতম।সহজ সরল শব্দে তিনি কবিতায় যে দৃশ্যকল্প সৃষ্টি করেন, তা পাঠকের মনে অদ্ভুত এক অণুরণন সৃষ্টি করে। তাঁর কবিতার মেজাজ তাঁকে অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা করেছে।তিনি শব্দকে অনায়াসে করায়ত্ত করতে পারেন।
“খুঁজতে খুঁজতে এড়িগোপাল গেঁড়িগোপাল
দিগনগরে আমরা ক’জন চাঁদ হয়ে যাই
চাঁদের সঙ্গে ভাদর মাসে ফিরছি বাড়ি—
মেঘ জমেছে গায়ের নীচে পায়ের নীচে
উলটে যাচ্ছে কালাশশীর রসের হাঁড়ি….
তারপরে আর ?
গাঁইতি শাবল উঠছে নামছে
আর কিছু নাই আর কিছু নাই আর কিছু নাই।”
(এড়িগোপাল, গেঁড়িগোপাল)
কবি শ্যামলকান্তি দাশের বেশিরভাগ কবিতাতেই ছুঁয়ে আছে প্রান্তিক মানুষ আর গ্রামীণ মানুষের যাপিত জীবনের চিত্রকল্প। তাই তাঁর কবিতার ভাষায় উঠে আসে অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞানের মায়াময় ভুবন। তাঁর কবিতাগুলি আপাত দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও, তার গভীরতা কিন্তু বহুদূর বিস্তৃত। পাঠকের অনুভূতির গভীরে খুব সহজেই নিজস্ব কাব্য ভাষার মাধ্যমে তিনি তাঁর বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন।
“পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আমি গ্রামের ছেলে,
আমি যাকে বিয়ে করেছি তার চিন্তা ভাবনা একটু নগরমুখী হলেও
সেও আসলে গ্রামেরই মেয়ে। বিয়ের পর আমরা দুজনেই শহরে চলে এলাম।
তারপর একদিন রতিমিলনের একটু আগে
আমরা ভেবে দেখলাম
সংসারে তাপ উত্তাপ বড় কম নয়, সেই তাপ উত্তাপে গ্রামজীবনের একটু শীতলতা লাগানো দরকার।”
(গ্রামজীবনের হাওয়া)
পঞ্চাশের তাপ আর ষাটের হিম একেবারে অগ্রাহ্য করে সত্তরের যে সব কবি বাংলা কবিতাকে মুক্তির বাতাস দিয়েছিলেন,কবি শ্যামলকান্তি দাশ তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতা নাগরিকতার পরুষ চাপের পাশে এক সবুজ সজল মৃত্তিকায় আমূল প্রোথিত। অথচ গ্রাম আদতে তাঁর কবিতার বিষয় নয়। তা আসলে জড়িয়ে থাকে তাঁর সামগ্রিকতায়-শব্দে, প্রতীক, রূপকে, ছন্দে, অলংকারে, আবহে। বস্তুত যেন কোনো সীমারেখা নেই তাঁর কবিতায়। সব এক আশ্চর্য ইন্দ্রজালে মিলেমিশে যায় তাঁর কবিতাসমগ্রে।কবি শ্যামলকান্তি দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতার মুখবন্ধে তাঁর কবিতার নির্মাণকে এভাবেই বিশ্লেষিত করা হয়েছে।
“আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই। হাত জোড় করি।
মাথা ঠেকাই আয়নার পায়ে।
আমার কবিতার মতোই সত্য আর পরিপূর্ণ এই আয়না।
আয়নার মতোই বিকশিত আর সত্য এই আমার শরীর।
শরীর থেকে টেনে হিচড়ে বের করে আনি কথা।
অন্ধকার ঘরে হাজার হাজার কথা ছড়িয়ে আছে।
পিঁপড়ের মতো। মাকড়শার মতো। চিনির মতো।
অশ্রুর মতো। বেদনার মতো।’
(কথা সাজিয়ে নিচ্ছে আমাকে)
মেদিনীপুর জেলা নন্দীগ্রামের সত্তর দশকের বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি তপন কুমার মাইতি অখন্ড তমলুক মহকুমার সাহিত্যচর্চার ইতিহাস “স্মৃতির জানালা” গ্রন্থে লিখেছেন- ‘কবি শ্যামলকান্তি দাশের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় মহিষাদল রাজ কলেজে লাইব্রেরীতে। শ্যামলদার কাছ থেকে আমি প্রথম কবি জীবনানন্দ দাশের নাম শুনি। শ্যামলদা মহিষাদল রাজ কলেজে আমার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়তো। তাঁর কাছ থেকে সমস্ত আধুনিক কবিদের নাম জানি, বই পত্র নিয়ে পড়ি এবং ধীরে ধীরে বুঝতে পারি সেই ১৯৭১ সালে শ্যামলকান্তি দাশ বাংলার তরুণ কবিদের মধ্যে অন্যতম। সারা বাংলা থেকে কত পত্রিকা আসে তাঁর কাছে। কত সম্পাদক তাঁর কবিতা চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে, রীতিমতো বিখ্যাত সে। শ্যামলদারা তখন সুতাহাটার দোরোকৃষ্ণনগর গ্রামে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। শ্যামলদারা সুতাহাটার বিভিন্ন জায়গায় বাসা ভাড়া করে থেকেছে বিভিন্ন সময়ে। তমলুক থেকে দুর্গাচক গোটাটাই শ্যামলদার আধিপত্য ছিল। যেখানে সাহিত্য সেখানে সে। আর তাঁকে ঘিরেই গড়ে উঠতে সাহিত্য। চরকির মতো ঘুরে বেড়াতো। একবার চিরঞ্জিবপুরে জীবনানন্দের জন্মদিন পালন করার উদ্যোগ নেয় শ্যামলদা। তমলুকে তখন বাসুদেব দেব ও শুধেন্দু মল্লিক ছিলেন। শ্যামলদার নিত্য আড্ডা ছিল সেখানে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে কলকাতা থেকে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে এসেছিলেন লাবণ্য দাশ, সুচরিতা দাশ,মঞ্জুশ্রী দাশ,বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। অনেকগুলি সাহিত্য পত্রিকা শ্যামলদা বের করেছিলেন, কিন্তু কোন পত্রিকাই বেশি দিন টেকেনি। জনপদ, আত্মজ, সাহিত্য সংবাদ। একমাত্র ‘বররুচি’ পত্রিকা বেশ কিছুদিন টিকে ছিল এবং এই পত্রিকাটি প্রত্যাশিতভাবে উন্নতমানে পৌঁছেছিল। শ্যামলদা কলেজ জীবনেই খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিল। একেক দিন তিনটা থেকে চারটে করে কবিতা লিখতো।কবিতা ছিল তাঁর রক্তের ভেতর। ১৯৭৪ সালের পর থেকে তাঁর কবিতা প্রত্যাশিত ভাবে আলাদা মোড় নেয়, যা একজন ভালো জাতের কবির জাত চিনিয়ে দেয়। শ্যামলদার লেখা কবিতা গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ আমাদের কবিজন্ম। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে একজন মহৎ কবির নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়।”
“বোন তোর ক্ষীরে ক্ষারে আছে
মাকে তোর কাগাবগা খায়
মিছিলের আগে আগে বাবা
স্বপ্নের পতাকা ওড়ায়।”
(বাবা)
কবি ও সাহিত্য সমালোচক গৌতম ঘোষ দস্তিদার শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন-‘সত্তর দশকে শ্যামলকান্তি সেই দুর্লভতম কবি, যিনি বাংলা কবিতার সীমারেখা ব্যপ্ত করেছিলেন অনেকটাই। তাঁর কবিতায় গ্রাম্যতা কোনও স্মৃতিকাতরতা নয়, তাঁর সামগ্রিক ভাবনার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। সূচনা থেকেই তাঁর শব্দ ব্যবহারের প্রতীকী ব্যঞ্জনার যে বিশিষ্টতা আমরা লক্ষ্য করেছিলাম, তা তাঁর সমকালে ছিল দুর্লভই। ছন্দ, প্রধানত মাত্রাবৃত্ত নিয়ে তিনি সত্তরের কবিতা এনেছিলেন অসামান্য ঝিলিক। গ্রাম তাঁর কবিতার অন্যতম বিষয় হলেও তা কখনোই আক্রান্ত নয় বিন্দুমাত্র গ্রাম্যতায়। বিদ্রুপ পরায়ণতা, আত্মজিজ্ঞাসা, তীক্ষ্ণ অবলোকন তাঁর কবিতার নিহিত শক্তি ও প্রাণবায়ু হিসেবে ক্রিয়া করেছে। নাগরিকতার পৌরুষ চাপের বিরুদ্ধে কবিতাকে স্থাপন করেছেন। এক স্থির মৃত্তিকায়, জলজ ঘ্রাণে। প্রেমের ছদ্মবেশে প্রকৃতি, প্রকৃতির অনুষঙ্গে যৌনতা, যৌনতার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, চোরের সঙ্গে সন্ন্যাসী, বাঘের সঙ্গে হরিণ, শব্দের সঙ্গে ছবি, ছবির সঙ্গে ছন্দ— শ্যামলকান্তি দাশের কবিতায় সব একঘাটে জল খায়। এখানেই তাঁর ব্যাপ্তি, তাঁর কবিজন্ম। প্রত্যক্ষ নয়, তাঁর কবিতায় যৌনতা এসেছে একেবারেই ছদ্দবেশে।’
“লোভ আছে, আছে বলে পাত পেড়ে বসে আছি কতকাল
যেন মাছি, মনচোর, যেন ভাগাড়ের খিন্ন কঙ্কাল।
সেভাবে পাইনি বলে বহুদিন
আজ খুব খেতে ইচ্ছা হয়-”
(রসুই ঘরের বাঘ)
সাহিত্যিক সুধীর চক্রবর্তী কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন-‘নিজেকে সে তাঁর কবিতায় আত্মপরিহাসের ছলে মেদিনীপুরিয়া বলে চিহ্নিত করেছে এবং রচনার মধ্যে সাবলীল অনায়াসে বহু গ্রামীণ শব্দ ও অনুষঙ্গ ভরে দিতে পারে। কিন্তু কিছুতেই সে আড়াল করতে পারে না তাঁর অন্তর্লীন কবিতার দক্ষতা ও অন্তঃশীল আধুনিকতা। তাঁর কবিতার প্রধান লক্ষণ হল নিজস্ব কবি ভাষার স্বাবলম্বিতা। তার কবিতা তাই কারোর মতো নয়, তার কারণ কবিতার স্বায়ত্ত দৃষ্টিকোণ তাঁর সযত্ন অর্জন। তাঁর জানা আছে-
“এখনও দিনের শেষে গান হয়।
ভাতের অপূর্ব গান।
ব্যঞ্জনের আরও আরও গান।
দুয়ারে ধানের ছায়া। ধান গম।
উড়ে চলো ও শ্যামল।
আরও আরও পঞ্চাশ বছর।”
এতো পঞ্চাশ বছরের জন্যে বাঁধা গান নয়, একে বলে শতঞ্জীব কবিতা-জরা মৃত্যুত্তীর্ণ।
এ জীবনে এ সমাজে দ্রষ্টার আগন্তুক বিস্ময়ে কত যে আবিষ্কার তাঁর এবং ক্ষণে ক্ষণে। ভূতপ্রেত রাক্ষসেরা সেখানে কিলবিল করে কিন্তু তাতে কত যে মজা আর কী অবগাঢ় প্রতীকায়ন। সে দূরদেশি গেঁয়ো রাখালের ঢঙে মাত্রাছন্দে হাততালি দিয়ে গায়-
“তোমাদের দেশে এত ধাঁধা মজা, এত প্ৰহেলিকা
গাছে পাকা পেঁপে, ফল খায় পাখি বিকেলবেলায়
চাষের জমিতে জল জমে আছে, এত আনন্দ-”
আনন্দকে এত নিরায়োজনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া এ তো সহজ সাধন নয়। শ্যামলকান্তি এক শোভন সুন্দরের নান্দীপাঠ দিয়ে শুরু করে হঠাৎ দেখতে পায় মানুষের নিরবধি যাত্রাপথ-
“চোখে ঘষা কাচ, হাতে ছাতা নেই, শূন্য মানুষ
মাঠপ্রান্তর পেরিয়ে এখন কোথায় যাচ্ছে
এত মেয়েছেলে, এত যৌনতা, সব ফেলেফুলে
শূন্য মানুষ কাদা মাখা পায়ে কোথায় যাচ্ছে…”
শ্যামলকান্তি দাশ এখনকার বাংলা কবিতায় এক দৃঢ়প্রোথিত নাম, লিখছে বহুদিন থেকে, এবং কবিতা তাঁর কাছে কখনই বিনোদনের মুখশ্রীতে ধরা দেয়নি। তাঁর কবিজন্ম তাঁকে দিয়ে অনন্য মেধা ও দর্শনে ভরে যে একান্ত বিশ্বটি আড়ে আড়ে দেখিয়ে দিয়েছে তাঁকে প্রকাশক্ষম দ্যোতনায় ভরে দিতে শব্দ ও ছন্দে একপ্রকার নিরঙ্কুশ আধিপত্য অর্জন করতে হয় এবং সেই তাঁর নিজস্ব কবিতার প্রাণ আবিষ্কার করতে পাঠককে বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করবার প্রয়াস লাগে।’
সাহিত্যিক সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুভবে কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা আশ্চর্য স্বতন্ত্র এক পটভূমি-‘বাংলা কবিতায় সম্ভবত অমিয় চক্রবর্তীই প্রথম পিঁপড়েকে বিষয় মর্যাদা দিয়েছিলেন।জীবনানন্দে ছিল বাদুর-চিল-শকুন,মাছরাঙা-চড়াই-শালিখ-গঙ্গাফড়িং-কাঁচপোকা,দাঁড়কাক-লক্ষ্মীপেঁচা-হরিণ-চিতা-ইত্যাদি বনপ্রকৃতির অজস্র সম্ভার। নীরেন্দ্রনাথ মানুষের গলায় কুকুরকে দিয়ে বলাতে চেয়েছিলেন ‘হ্যালো দমদম, হ্যালো দমদম, হ্যালো’, শুনেছিলেন ঊর্ধ্বচারী মানুষের প্রতীকী অনুষঙ্গে কলঘরে চিলের কান্না। সুনীল কবিতায় কুকুরকে এনে ফেলতে চেয়েছিলেন মানুষের ভেতরকার কুকুরকে দেখাবেন বলে। আর ভাস্করকে বুঝে নিতে দেখেছিলাম জিরাফের ভাষা। কবিতায় জীবজগতের এই দীর্ঘকালীন ও ধারাবাহিক পরম্পরা থেকে এতটুকু দূরে দাঁড়িয়ে নেই শ্যামলকান্তির বিষয় ভাবনার জগৎ, বরং তা আরও বেশি ব্যাপক, আরও প্রসারিত, আরও অন্যমাত্রিক।রসুইপুরের বাঘের দেখা তো মেলেই,উঁকি দিয়ে যায় রক্ত খেকো ভাম, বাদুর-ব্যাঙ-ভোঁদড়-বালিহাঁস-পায়রার সঙ্গে তুচ্ছাতিতুচ্ছ পিঁপড়ে, ‘দুইটা ফড়িং’-ও।
“পিঁপড়েও আমাদের সঙ্গে সারাদিন কবিতার ভাষায় কথা বলছে,
অন্ধকারে দরকষাকষি করছে, ঘাড়ে টুসকি মারছে,
গালে গালে ঘষছে…
লক্ষ লক্ষ মরণজয়ী পিঁপড়ে আমাদের ঘুম ভাঙাচ্ছে,
বলছে, ওঠো, দাঁড়াও।
জাগো, জাগ্রত হও।” (পিঁপড়ে সংহিতা)
সত্তর দশকের শ্যামলের সমকালীন আর কোনও কবির পরিবেশনায় এত অবিচ্ছেদ্যভাবে চর্চিত এমন একটা জগতের দেখা পাইনি আমরা, জোরের সঙ্গে বলতে পারি; বস্তুত আমি বিশ্বাস করি, অন্য আর সব বৈশিষ্ট্য ছেড়ে দিলেও এই আশ্চর্য স্বতন্ত্র পটভূমিই শ্যামলের কবিকৃতির সবচেয়ে জোরের জায়গা,প্রবল কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলার সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত মাধ্যম।
কিন্তু এখানেই কলম তুলে নেন না শ্যামল, এই পর্যন্ত এসেই দাঁড়িয়ে পড়তে দেখি না তাঁকে, পটভূমি রচনায় আরও কিছু সংযোজনের কথা নিশ্চয়ই তাঁর মাথায় ছিল, আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা পেলাম আরও এক অত্যাশ্চর্য অলৌকিক অভাবিত জগতের সন্ধান, প্রাণী ও জন্তুজগতের সঙ্গে যোগ করেন তিনি রাক্ষসের মায়াবী এক বাতাবরণ, যা তাঁর একান্ত নিজস্ব ভাবনায় জারিত, বাস্তব থেকে পরাবাস্তবের দিকে হেঁটে যাওয়ার সুবাদে। লৌকিক সংস্কার থেকে, পৌরাণিক ও মহাকাব্যিক অনুষঙ্গ থেকে এর উঠে আসা; কবির সঙ্গে অনায়াস সাক্ষাৎ ঘটে যায় এই রাক্ষসের, বংশ পরিচয় এবং গোত্রনিবাস সমেত যে রাক্ষসের কুহকী অস্তিত্বকে তিনি চিনে নিতে জানেন নিজের হাতের তালুর মতো।’রাক্ষস’ যে বারবার কবিতার বিষয় হতে পারে, এবং তা যে হয়ে উঠতে পারে এক আশ্চর্য প্রতীক, অসামান্য শক্তিমত্তায় শ্যামলকান্তি তাঁর পরিচয় কবিতার পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।
“রাক্ষস আমাদের বাবার বন্ধু। অনেকদিনের পুরনো।
সেই বন্ধুতা প্রতিদিন ঘষে মেজে
বাবা নতুন করে তোলেন-”
(বাবার বন্ধু)
“এখনও আমি রাক্ষসের ছেলে
কাদায়-জলে আমার চোখ কাঁপে।”
(রাক্ষসের ছেলে)
কবিতা বোদ্ধারা কবি শ্যামল কান্তি দাশের কবিতায় গ্রাম জীবন, সাধারণ মানুষের ক্লিষ্ট সমস্যা সংকুল জীবনের কথা, রূপকথার আবেশ,প্রেম ও যৌনতা, রহস্যময় দুরূহতাও খুঁজে পেয়েছেন। সেই সঙ্গে আমি বিশ্বাস করি তিনি একজন রাজনীতি সচেতন প্রতিবাদী কবিও। তাঁর কবিতায় রূপকথার আবেশ মিশিয়ে দেশে ক্রমবর্ধমান বেড়ে চলা সাধারণ মানুষের সংকটের কথা কাব্যিক ভাষায় তুলে ধরেন রম্য কটাক্ষের আড়ালে।
‘আপনাদের দেশে মানুষের কান্না খুব দামি,
মানুষের কান্না ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না।
প্রাণভরে সেই কান্না শুনব বলে
আমরা এতগুলো গঙ্গা ভাগীরথী
কৃষ্ণা গোদাবরী পেরিয়ে এলাম।’ (মানুষের কান্না)
‘রাক্ষস আমাদের বাবার বন্ধু, কিন্তু মায়ের সঙ্গে
একটাও কথা বলেন না।
মা বলেন, উনি দেবতা, ভুল করে মাটিতে নেমেছেন,
ওঁকে প্রণাম করো।
মায়ের চোখে টলমল করে কান্না, ঠোঁটে রক্ত,
বুকে নখের আঁচড়।
আমরা রাক্ষসদেবতার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।’ (বাবার বন্ধু)
‘বাঘের সঙ্গে কথা বলছি দেখে সকলের খুব রাগ হয়ে গেল
লোকে বুঝতে পেরে গেল, গন্ধটা বড়ো সন্দেহজনক
আমি আর আগের মতো লোকালয়ে থাকব না
এবার আমার জামাতেও রক্তের ছিটে লাগবে…’ (বাঘের সঙ্গে)
কবি শ্যামলকান্তি দাশ এই সময়ের একজন অন্যতম প্রধান কবি, যিনি ছোটদের সাহিত্য রচনাতেও সমান দক্ষ। ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘এরোপ্লেনের খাতা’ পেয়েছে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার।মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আপনার জন্ম, সেখান থেকে নিজের সময়ের একজন প্রধান কবি হয়ে উঠলেন আপনি কিভাবে, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান- ‘কবিতা লিখব ছোটবেলায় এমন ভাবনা কখনও আসেনি মাথায়। আমি ভাবতাম পাইলট হব, উড়োজাহাজ চালিয়ে বিশ্বজয় করব। গ্রামের ছেলে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতাম, আর আকাশে উড়ে যাওয়া এরোপ্লেন দেখতে পেলে দৌড়োতাম, যেন পাল্লা দিতে চাইতাম। আকাশের গায়ে কাল্পনিক রেখা টেনে ভাবতাম ওই পথ দিয়েই বিমান চালাবো আমি। ছেলেবেলায় সত্যি সত্যি একটা খাতা ছিল আমার, নাম ছিল উড়োজাহাজের খাতা। গ্রামে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিলে আমরা আমাদের বইখাতাগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলে যেতাম কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে। এবং অবশ্যই সঙ্গে থাকত সেই খাতাটি। একদিন নলিনী নামে এক বন্ধুর লেখা একটি কবিতা পড়ে আমার মাথা থেকে পাইলট হওয়ার পাগলামি দূর হয়ে যায়।যে গ্রামে আমি বড় হয়েছি সেখানে কবিতার কোনও পরিবেশ ছিল না। তবে আমাদের বাড়িতে কবিতার একটা পরিমণ্ডল ছিল। ঠাকুরদা কবিতা লিখতেন, বাবা কবিতা লিখতেন, জ্যাঠামশাই কবিতা লিখতেন, এক জেঠতুতো দাদা কবিতা লিখতেন—তিনি পরবর্তী সময়ে খুব বিখ্যাত হন। সর্বোপরি ছিল ওই নলিনীর অবিরাম তাড়না। ১৯৬৫ সালে আমার প্রথম কবিতা ‘এই তো আমার পণ’ কলকাতার একটি কাগজে ছাপা হল। বাবা কবিতা লেখা খুব একটা পছন্দ করতেন না, বলতেন কবির জীবন খুব দুঃখের জীবন। বাবা স্বপ্ন দেখতেন আমি অধ্যাপক হই। তারপর তো স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ভরতি হলাম এবং ছোটবেলার গ্রাম ছেড়ে আমরা চলে এলাম বাবার পৈত্রিক ভিটেয়। সেটা হলদিয়ার কাছাকাছি একটি গ্রাম। কলেজে অনেক অধ্যাপককে পেলাম যাঁরা সাহিত্যমনষ্ক। এইসময় একজন কবির সঙ্গে আলাপ হল, তার নাম অমিতাভ দাস। অমিতাভদার সূত্রে আরও এক কবির সঙ্গে পরিচয়, তিনি বিশ্বেশ্বর সামন্ত। সেসময় বড়বড় কাগজে তাঁর লেখা ছাপা হত। আরও অনেক কবি লেখককে বন্ধু হিসেবে পেলাম। সিরিয়াসলি কবিতা লেখা শুরু হল। কবিতা প্রকাশিত হতে থাকল অনেক অনেক ছোটকাগজে। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রথম আমার কবিতা বেরোল—’ছেলেবেলার পদ্মবীজ’। মনে আছে, সে-সংখ্যার কবিতার পাতায় অন্য দুই কবি ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং দেবারতি মিত্র।কবি শ্যামল কান্তি দাশের প্রায় প্রতিটি কবিতাই যেন এক এক খন্ড জলকাদা বনবাদাড়ময় গ্রাম। তাঁর কবিতায় ছায়া ফেলা এই অফুরান গ্রাম জীবন নিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি আমাদের সময়ের এক প্রতাপশালী কবি বন্ধু বললেন, চল্লিশ বছর ধরে আপনি তো শুধু গ্রামের কথাই লিখলেন। আমি বললাম, আমি তো গ্রামের মানুষ। আমার গায়ে এখনও পানাপুকুরের গন্ধ, এখনও আমার গায়ে শ্যাওলা, আমি কি করে গ্রামকে অস্বীকার করব। এসব লিখে আমার কবিতায় কোনো উত্তরণ হয়েছে কিনা, তা বিচার করবেন পাঠক। শৈশব কৈশোরের প্রভাব আছে আমার লেখায়। যে গ্রামে বড় হয়েছি তা দুর্গম হলেও আশ্চর্য সুন্দর সুজলা সুফলা। একটা মস্ত বড় ভীম মেলা বসতো সেই গ্রামে। মেলায় এক ম্যাজিকের দলে দেখেছিলাম নররাক্ষস। সে এক বীভৎস ব্যাপার। এরকম নানা বিষয়ের উল্লেখ আমার অনেক লেখাতেই রয়েছে। আমার লেখায় দুরূহতা হয়তো আছে। ছোটবেলায় আমি খুব রূপকথার গল্প পড়তে ভালবাসতাম। সেসব এর প্রভাব আমার লেখায় পড়ে থাকতে পারে। সত্তরের দশকে আমার এই ধরনের লেখা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল একথা বলতে পারি।কবি শ্যামল কান্তি দাশের কবিতায় ছন্দ ব্যবহারের জ্ঞান অসাধারণ। তারপরেও তিনি বিনয়ের সঙ্গে জানান- ‘ছন্দের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যে ব্যাকরণ আমি তা জানি না, তবে আমার ছন্দে কোনও ভুল থাকে না। আগেই বললাম যে আমার বাবা কবিতা লিখতেন, ছন্দোবদ্ধ কবিতা। আমি একটি সভায় একবার বলেছিলাম—বাবা কবিতা লিখলে অনেক কবিকেই কলম ফেলে দিতে হত। তাই ছন্দের দোলাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একটা কথা বলতেন—ছন্দটাকে প্রথমে ভালো করে জেনে নাও, তারপর ভুলে যাও। ভুলতে না পারলে ছন্দের একটা ধাঁধা বা আবর্ত আছে, যার মধ্যে তুমি আটকা পড়ে যাবে। এ শিক্ষা আমি নীরেনদার কাছ থেকে পেয়েছি।’ কবি শ্যামলকান্তি দাশের- ‘আমাদের কবিজন্ম’, ‘খড়ের মানুষ’, ‘ছোট শহরের হাওয়া’, ‘সরল কবিতা’, ‘রাক্ষস’, ‘ভাঙ্গা বাড়ির জানালা’, ‘ডাইনোসরের অমর কাহিনী’ তাঁর পাঠক প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। যদিও কবির নিজের পছন্দের দুটি বই হলো ‘আমাদের কবিজন্ম’ এবং ‘রাক্ষস’।
‘কবি সম্মেলন’ নামে একটি উচ্চমানের মাসিক কবিতাপত্রের সম্পাদক কবি শ্যামলকান্তি দাশ।এই শতকের প্রথম দশকে এক আশ্চর্য পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন, যা প্রকৃত অর্থেই একটি উদার কবিসম্মেলনের চেহারা নিয়েছে।কবির নিজের কথায়- ‘নিজেরই অন্তরের তাড়নায় এমন একটি কাগজের কথা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, যা হবে শুধু কবিতারই কাগজ, যেখানে কবিতার সমস্ত দিকের ওপর আলোকপাত করা হবে। কোনও গুরুগম্ভীর তত্ত্বকথা নয়, নির্ভার অন্তরঙ্গ গদ্যলেখা থাকবে কবিতার পাশাপাশি। সে কাগজে কোনও ছুতমার্গ থাকবে না দলাদলি থাকবে না। এই শুনে প্রথমে কেউই আমাকে খুব একটা উৎসাহ দেয়নি, বরং অনেকে নিরুৎসাহিতই করেছে। শেষমেশ আমারই জেদে এবং দুচারজন বন্ধুর সাহচর্যে ‘কবিসম্মেলন’ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, হাতে মাত্র দু’হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে।’ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রায় ৫০টি কবিতা ও ছড়ার বই। সম্পাদনা করেছেন নানা ধরনের পত্র-পত্রিকা এবং সংকলন গ্রন্থ। কবিতা ও ছড়া চর্চার জন্য বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তারপরেও বাংলা ভাষার এই গুরুত্বপূর্ণ কবি নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনের ভূমিকায় বিনয়ের সঙ্গে লিখতে পারেন- ‘প্রতিদিনই লিখি একটু একটু। প্রতিদিনই কাটি তারও বেশি। লিখি আর কাটি, কাটি আর লিখি। তিন দশক ধরে অবিশ্রান্ত চলেছে এই কাটাকুটির খেলা। অনেক রাত্রে যখন চোখ জ্বেলে বসি এইসব বাতিল, ব্যর্থ ছেঁড়া ভাঙ্গা অক্ষর সমষ্টি আর শব্দপুঞ্জের কাছে, অদ্ভুত এক শূন্যতায় বুক ভরে ওঠে। কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু হয়নি এতদিন। এই যে কিছুই হয়নি,কবিতার সার্থকতার ছিটেফোঁটাও এলোনা কখনও জীবনে, বিষাদে আর মনস্তাপে দিন যায়।এই সত্যটুকু কাউকে বোঝাতে পারি না।’
“ঘোড়া নিয়ে আমি এক সময় দুহাতে কবিতা লিখতাম।
বিষয় ঘোড়া বলে কবিতাগুলির উড়ানক্ষমতাও ছিল চমৎকার।….
জীবনমুখী এই কবিতা গুলি নিয়েই আমি একটি বই লিখেছিলাম
একবার :আমাদের ঘোড়াজন্ম।
প্রচার উন্মুক্ত তরুণ কবিরা এই লম্বাটে, ঘোড়ামুখো বইটি পড়েই
জানতে পেরেছিলেন অশ্বশক্তির প্রকৃত উৎস
বুঝতে পেরেছিলেন জরাগ্রস্থ,ধর্মভীরু ঘোড়াই কালে কালে গাধা হয়ে ওঠে
আর গাধার জ্যোতিপুঞ্জ থেকেই একদিন তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসে খচ্চর।”
(আমাদের ঘোড়াজন্ম)