কাজী জহিরুল ইসলাম
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কলকাতা থেকে কবিদের নিয়ে আসা হত ঢাকায়। টিএসসিতে বিশাল মঞ্চ। ঢাকার ডাকসাইটে কবিরা মঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কলকাতার কবিদের তারা সসম্মানে মঞ্চে তোলেন। কলকাতার বড়ো কবি, ছোটো কবি, মাঝারি কবি মঞ্চে উঠেই এদিক-ওদিক তাকান। মঞ্চে কবিদের ভিড়, সারি সারি কবি কিন্তু তারা কবি খুঁজে পাচ্ছেন না। ঢাকার লম্বা দাড়ি, বড়ো গোঁফ, কামানো মুখ, চৌকোনো, গোল সচকিত হয়, কাকে খুঁজছেন? কলকাতার কবিরা বলেন, কবি কোথায়? ঢাকাদের একজন বলেন, মঞ্চে যাদের দেখছেন, এরা সবাই কবি। কলকাতারা কোরাস বাক্যে বলেন, আরে না, না, আমরা কবিকে খুঁজছি, কবি কোথায়? ঢাকারা বিরক্ত হয়। কি বলছেন দাদা, এরা সবাই কবি, এদের মধ্যে, এই যে ইনি সফেদ চুল, লিখতে লিখতে সব শাদা করে ফেলেছেন, ইনি হচ্ছেন মঞ্চপতিকবি, মানে আমাদের কবিরাজ, আর ইনি, এই যে বড়ো জুল্ফি, গদ্যেও খুব ভালো তবে ইনিও কবি, খুব বড়ো কবি। আর এই যে ইনি, লম্বা দাড়ি প্রায় রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি, ইনি তো ভীষণ জনপ্রিয় কবি। এই যে শুভ্র গোঁফ দেখছেন, ইনি তো ভীষণ অসাম্প্রদায়িক কবি, বাপ-মায়ের দেয়া নামই বদলে ফেলেছেন, আপনাদের নাম রেখেছেন, এরা সকলেই একাডেমি পদক, একুশে পদক আরো কত কত পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতারা এবার রেগে যায়, ধ্যাৎ মশাই, এদের কথা বলছি না-কি, আমরা তো কবিকে খুঁজছি, কবি আসেনি?
ঢাকারা এবার বেশ বিরক্ত হয়, বেশ বিরক্ত। কি মুশকিলে পড়া গেল। এই হাড়কিপটে বজ্জাতগুলো কাকে খুঁজছে! তখন লাল পোশাক পরা এক যুবক কবি আসেন, তিনি আবার মারদাঙ্গা কবি হিসেবে খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন, তার পেছনে ছোটোখাটো আরো একজন, দা-এর চেয়ে আছাড়ি বড়ো টাইপ কবি কিংবা ছড়ালেখক, এই দুজন এসেই কলকাতাদের ওপর বেশ হম্বি-তম্বি করেন, এই যে দাদারা, আপনারা বসুন তো, মঞ্চে বিশৃঙ্খলা করবেন না প্লিজ। কিন্তু কলকাতাদের ঘাড়ের রগ খুব মোটা, শত হলেও বাংলা ভাষাটা তো ওদেরই, আমাদের ওরা ধার দিয়েছে ব্যবহার করবার জন্যে, অন্যের সম্পদ ধার নিয়ে এতোটা ঔদ্ধত্য! খুব রেগে যায় কলকাতা। ভাষাটা যে ওদের, তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। এই তো ক’দিন আগে আমাদের কবি ফজল শাহাবুদ্দীন গেছেন কলকাতায়, সঙ্গে তরুণ কবি শাকিল রিয়াজ। আজকাল পত্রিকা অফিসের একজন সহকারী সম্পাদকের সামনে ওরা বসে আছেন। ফজল ভাই খুশিতে গদগদ হয়ে ভাষাপ্রভূর হাতে নিজের লেখা সদ্য প্রকাশিত কবিতার বইখানি তুলে দিলেন। ভাষাপ্রভূ কিছুটা ভ্রূ কুঁচকালেন। বুঝি প্রচ্ছদ পছন্দ হয়নি। এরপর পৃষ্ঠা ওল্টান। নিজের সম্পাদকীয় কলমখানা কর্তৃত্বের ভাষায় আঙুকের ফাঁকে তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে। কর্তৃত্বের একটা দায়িত্ববোধও তো থাকে। তিনি সেই দায়িত্ববোধের দায় থেকেই বইটাকে দাগাতে থাকেন। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে পুরো বইটাকে একটা দেখার মত বস্তু বানিয়ে ফেললেন, এবং তা করলেন অনপনেয় কালি দিয়েই, যাতে বাঙালদের গায়ে দাগটা স্থায়ী হয়েই বসে। এবার বইটা ফজল ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “এতো ভুল! সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়ে তো দেশ স্বাধীন করে দিলাম, এখন কি লোক পাঠিয়ে ভাষাটাও শিখিয়ে দিয়ে আসতে হবে?”
তো সেই প্রভূকে মঞ্চে তুলে এতো বড়ো কথা? লাল শার্টের আবার মাথা গরম, সে হয়ত ধাক্কা-টাক্কা দিতেই যাচ্ছিল তখন অন্য এক যুবক কবি, তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাকে ধরে ফেলেন। শত হলেও অতিথি, অপমান তো আর করা যায় না। এইটুকু শিষ্টাচার কি আর আমরা শিখিনি?
তখন একজন নারী কবি, ক্যানসারের সঙ্গে সংগ্রাম করে বিজয়ী, পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসেন। অনেকক্ষণ ধরেই তিনি এই গোলমেলে ভাবটা অবলোকন করছিলেন। কাছে এসে বেশ বিনয়ের সঙ্গে কলকাতার কবিদের বলেন, দাদারা, আপনারা একটু নামটা বলবেন কি কাকে মঞ্চে আশা করছেন? কলকাতাও তখন একটু নরোম হয়, কাকে আবার, ঢাকায় তো এই মুহূর্তে ওই একজনই কবি আছেন, যার কবিতা কলকাতার ছেলে-বুড়ো সকলেই পড়ছে। আমাদের নারী কবি আরো অধিক বিনয়ের সঙ্গে বলেন, কিন্তু তার নামটা কি দয়া করে বলবেন? কলকাতারা তখন বেশ অবাক হয়। কী আশ্চর্য! কবি তো এখানে একজনই আছেন, এরা বুঝি তার নামটাও জানে না! কেন যে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাটা ওদের ধার দিতে গিয়েছিলাম, ভাষার মান-সম্মান বুঝি কিছুই আর থাকলো না, কি-সব লোকজন এনে মঞ্চে তুলেছে, অথচ আমরা এসেছি কবিতার সম্মেলনে, কী দুর্দশা করেছে এরা বাংলা কবিতার।
কলকাতাদের মধ্যে যিনি কিছুটা বয়োজ্যেষ্ঠ, যদিও তখনও প্রায় যুবকই, হালকা-পাতলা কালো শশ্রু, লেখেন খুবই ভালো, মেঘটেঘ নাকি তার পকেটেই থাকে, কলকাতার তরুণরা খুব পড়ে তার কবিতা, তিনি বলেন, তার নাম আল মাহমুদ, আমরা তো তাকেই দেখতে এসেছি।
সঙ্গে সঙ্গে যেন মঞ্চে একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। ঢাকার কবিরা একেকজন একেক দিকে ছিটকে পড়লেন। ছি ছি ছি, আপনারা কার নাম নিলেন, দয়া করে গোমূত্র মুখে দিয়ে মুখখানা আগে পবিত্র করুণ, না হলে এই মঞ্চে আপনাদের কবিতা পড়তেই দেয়া হবে না। কলকাতার কবিরা তো অবাক, বলে কী এরা! বাংলা কবিতার এতো অধঃপতন!
কলকাতার কবিরা তখন ছুটে যায় মগবাজারে, কোনো বছর গুলশানে, তারা যায় একজন কবির সঙ্গে দেখা করতে। প্রকৃত কবিরা তো একজন প্রকৃত কবির সান্নিধ্যই চায়, মঞ্চ আর হৈ হুল্লোড় কি কবির প্রাণের ক্ষুধা মেটায়?
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২১ মে ২০২৪