প্রচ্ছদপ্রবন্ধকাজী নজরুল ইসলামের ঈদের গান : ইসলামের মৌলিক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ

লিখেছেন : এ কে আজাদ

কাজী নজরুল ইসলামের ঈদের গান : ইসলামের মৌলিক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ


এ কে আজাদ

ইসলাম শান্তির ধর্ম, সাম্যের ধর্ম, পরম সেবার ধর্ম, বিশ্ব ভালবাসার ধর্ম, বিশ্বভ্রাতৃত্বের ধর্ম। এখানে দীনতা নেই, হীনতা নেই, নেই হিংসা বিভেদ। ইসলাম ধর্মে মানুষের জন্মের পূর্ব অবস্থা থেকে শুরু করে পার্থিব জীবন, জীবনাচার, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর সার্থে সম্পর্ক, মৃত্যু এবং পৃথিবীর ধ্বংস ও মৃত্যুর পরে কিংবা পৃথিবী ধ্বংসের পরে কি অবস্থা তৈরী হবে তার বিশদ বিবরণ দেয়া আছে। এ কারণেই ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বলা হয়। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভেব মধ্যে একটি স্তম্ভ হলো রমজান মাসের রোজা পালন।

[বুখারী শরীফের ইমান অধ্যায়ে রমজান মাসের রোজাকে পঞ্চম নং-এ উল্লেখ করা হয়েছে:

حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ مُوسَى، قَالَ أَخْبَرَنَا حَنْظَلَةُ بْنُ أَبِي سُفْيَانَ، عَنْ عِكْرِمَةَ بْنِ خَالِدٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ ‏

ইবন ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি।

১. আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রসূল-এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা।
২. সলাত ক্বায়িম করা।
৩. যাকাত আদায় করা।
৪. হাজ্জ সম্পাদন করা এবং
৫. রমযানের সিয়ামব্রত পালন করা (রোজা রাখা)।]

আর রোজা শেষে আসে ঈদুল ফিতর। মুসলিম সংস্কৃতির প্রধান উৎসব হলো ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। পূর্ণ এক মাস সিয়াম সাধনার শেষে মুসলিম সমাজের পশ্চিম আকাশে চিলমিল করে হেসে উঠে ঈদুল ফিতরের বাঁকা চাঁদ। মানুষ এবং মানবতার কল্যাণের এক মহান শিক্ষা নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর। পবিত্র শাওয়ালের চাঁদ পশ্চিম আকাশে উদিত হওয়ার সাথে সাথেই পুলকিত হয়ে ওঠে প্রতিটি মুসলিমের মন। দুলে ওঠে প্রকৃতির পত্র-পল্লব। সে অনুরণন ছুঁয়ে যায় কবির স্পর্শকাতর কোমল মন। হৃদয়ের পরতে পরতে জেগে ওঠে শিহরণ। আর তখনই সৃষ্টি হয় কালজয়ী কবিতা ও গান। তেমনি এক অমর গান সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং চির মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার খাতায়। আর সে গান কালজয়ী রূপ ধারণ করেছে তাঁর সুললিত কণ্ঠের মূর্ছনায়ঃ

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাকিদ ॥
তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে জাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ ॥
তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ ॥
আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন হাত মিলাও হাতে
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরীদ ॥
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত্য উপবাসী
সেই গরীব এতিম মিসকিনে দে যা কিছু মফিদ ॥
ঢাল্ হৃদয়ে তোর তশ্তরীতে শিরণী, তাওহীদের
তোর দাওত্ কবুল করবেন হযরত, হয়ে মনে উমীদ ॥
তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোল্ রে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ ॥

তথ্য মতে ১৯৩১ সালে গানটি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। গ্রামাফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর গান ছিল কবির ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর। হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানির রেকর্ড নম্বর এন‌- ৪১১১। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ।

যা হোক, সে গান শুধু বিনোদনের উপকরণ নয়, ঢোল তবলার সুরেলা ধ্বনি নয়, শিল্পীর কন্ঠের মায়াবী কোন সুর লহরী নয়, সে গান ইসলাম ধর্মের প্রকৃত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ।

ইসলাম ধর্ম মতে সকল সম্পদের মালিক আল্লাহ্। ইসলাম পঞ্জিভূত সম্পদে বিশ্বাস করে না। বরং ইসলাম বিশ্বাস করে সাম্যে। পানি যেমন উঁচু স্থান থেকে নীচের দিকে প্রবাহিত হয়, মানুষের সম্পদও তেমনি ধনীদের নিকট থেকে গরীবদের দিকে প্রবাহিত হবে- এই হলো ইসলামে সম্পদের নীতি । ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম। পবিত্র কুরআনের সূরা আয্ যারিয়াতের ১৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- “এবং তাদের ধন সম্পদে প্রার্থী এবং বঞ্চিতদের অধিকার আছে’’। ধনীরা যে দান খয়রাত করবে এটা গরীবদের প্রতি ধনীদের দয়া বা করুণা নয়, এটা ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার। এ অধিকার কেবল তিনিই দিয়েছেন, যিনি সকল সম্পদের মালিক। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা শুরা এর ৪৯নং আয়াতে বলা হয়েছে- “আকাশমন্ডলী এবং পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব কেবল আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন ….।’’ সূরা বাকারার ২৮৪নং আয়াতে আল্লাহ পাক আরও বলেন- “আসমান ও জমীনে যা কিছু আছে সমস্তই আল্লাহর …।’’ শুধু তাই নয়, মানুষ যে ফলমূল-শস্য উৎপাদন করে, তার পেছনে রয়েছে এক মহান শক্তি। আর সেই শক্তির ফলশ্রুতিতেই মানুষ ফসল উৎপাদন করে আহার যোগানের ব্যবস্থা করে, সম্পদশালী হয়। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা ইবরাহীমের ৩২নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন – “তিনিই আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে তদ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন, যিনি নৌযানকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তাঁর হুকুমে তা সমুদ্রে বিচরণ করে এবং যিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন নদীসমূহকে।’’ যে সম্পদের মালিক মানুষকে সম্পদ দিয়েছেন তিনি সেই সম্পদে গরীব দুঃখীর অধিকারও সৃষ্টি করেছেন। সে অধিকার আদায় না করলে সম্পদ পবিত্র হয় না, হালাল হয় না। তাই তো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের সূরা তওবার ১০৩নং আয়াতে বর্ণনা করেন – “তুমি এদের সম্পদ থেকে যাকাত নাও। এর মাধ্যমে এদের পবিত্র কর, এদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তি স্বরূপ।” সেই সাথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছুই গরীব দুঃখীদের মাঝে দান করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন শরীফে সূরা বাকারার ২১৯নং আয়াতে বলা হয়েছে – “(হে রাসূল) লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে যে, তারা কিভাবে ব্যয় করবে? বলে দাও- তারা যেন উদ্বৃত্ত সবকিছু দান করে দেয়।’’ আসমানী কিতাব পবিত্র কুরআন শরীফের উক্ত শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
………………………………………………………….
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাকিদ ॥
তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ, ।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. . . .. .. .. .
কুরআনের শিক্ষার পাশাপাশি ঈদুল ফিতরের মহান শিক্ষা ফিতরা প্রদানের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন কবি। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস এখানে বিশেষভাবে স্মর্তব্য। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে- “রাসূল (সাঃ) মুসলমানদের প্রত্যেক গোলাম, স্বাধীন ব্যক্তি, নারী-পুরুষ ছোট-বড় সকলের উপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ করে দিয়েছেন।” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুজ জাকাত, হাদীস নং ১৬৩৬)। এ থেকে বুঝা যায় ইসলাম দারিদ্র বিমোচনে এক যুগান্তকারী জীবন বিধান যা মানুষের কল্যাণের জন্যই আল্লাহ পাক প্রেরণ করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর খোলাফায়ে রাশেদার যুগ পর্যন্ত তৎকালীন মক্কা মদীনায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো যে, সারাদেশ খুঁজে জাকাত গ্রহণকারী কাউকে পাওয়া গেল না। মুসলমানরা ধনসম্পদে শক্তিশালী হয়ে উঠল। তাদের রাজকোষে জমা হতে লাগলো সম্পদের পরে সম্পদ। দারিদ্র বিদায় নিলো। গরীবের মুখে হাসি ফুটলো। আর রসূল (সাঃ) বলেছেন- “উপরের হাত নীচের হাতের চেয়ে উত্তম।” অর্থাৎ দান গ্রহণকারীর চেয়ে দানকারী উত্তম। ইসলামের সেই সুমহান শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত করেই বোধ করি কবি গেয়েছেন –

দে জাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙ্গাইতে নিদ ॥

কেননা মুসমানেরা আজ মুর্দা বা মৃত জাতিতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানেরা আজ ভুলে গেছে যে তারা এক সময় শ্রেষ্ঠ সম্পদের অধিকারী ছিল। তারা এখন আর জাকাত দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। তারা জাকাত খায়। তাদের অন্তর মরে গেছে। তারা ঘুমন্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে। তারা ভুলে গেছে কিভাবে মানব কল্যাণে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়।

মুসলমানেরা দুশমনী বোঝে না, অত্যাচার-নিপীড়ন করতে জানে না। হিংসা বিদ্বেষ ইসলামে জায়েজ নেই। হিংসা মানবিকতাকে নষ্ট করে দেয়।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাক। কেননা হিংসা মানুষের ভালো গুণসমূহ এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেমনভাবে আগুন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। (আবু দাউদ)

হজরত যুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে (অজ্ঞাতসারে) আগেকার জাতিসমূহের রোগ, অর্থাৎ হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা সংক্রমিত হয়ে গেছে। এসব রোগ ন্যাড়া করে দেয়। আমার কথার অর্থ এই নয় যে, তা চুল ন্যাড়া করে দেয়, বরং দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। (মুসনাদে আহমাদ)।

এমনকি কি কোন খারাপ মানুষ মারা গেলেও তাকে গালমন্দ করে না মুসলমানেরা।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মৃত ব্যক্তিদের গালমন্দ করো না। কারণ তারা যা করেছে তার প্রতিফল পাওয়ার স্থানে তারা পৌঁছে গেছে। (বুখারি)

মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করে। একমাত্র ভালবাসা দিয়েই জয় করা সম্ভব গোটা বিশ্বকে। পুরো বিশ্বকে শিষ্য বানাতে, বন্ধুর চেয়েও আপন বানাতে প্রয়োজন ভালবাসা, মমতা এবং গভীর প্রেম। ভালবাসার সেই শিক্ষা বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা হামীম আস-সাজদার- ৩৪ ও ৩৫নং আয়াতে। মানবতার পরম বন্ধু হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ্ পাক শিখিয়েছেন ভালবাসার মহান ছবকঃ
“হে নবী সৎ ও অসৎ কাজ সমান নয়, তুমি অসৎ কাজকে সেই সৎকাজ দ্বারা নিবৃত করো, যা সবচেয়ে ভাল। তাহলে দেখবে যে, যে ব্যক্তি তোমার সাথে চরম শত্রুতা করত সেও পরম অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে। ধৈর্য্যশীল ছাড়া এ গুণ কারও ভাগ্যে জোটে না, আর অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা কেউ লাভ করতে পারে না।” তাছাড়াও মানুষের প্রতি কোমল আচরণ করার ব্যপারে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দিয়েছেন। বোধ করি সে কারণেই মহানবী (সাঃ) তাঁর কোমল আচরণের সম্মোহনী শক্তির মাধ্যমে সকল মানুষকে কাছে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর কোমল আচরণে মানুষ যেমন বিমুগ্ধ হয়েছে, তেমনি পুলকিত হয়েছে। একটি ফুলের চারপাশে সবুজ পত্র-পল্লব যেমন ঘিরে থাকে, তেমনি মহানবী (সাঃ) এর চারপাশেও গড়ে উঠেছে চির সবুজ মানুষদের ভীড়। তাঁর চরিত্রের কোমলতার কারণে‎ কেউই তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তাঁর চরিত্রের অপূর্ব সম্মোহনী শক্তির বলয়ে জড়িয়ে গেছে সকলেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র ঐশী বাণীর মাধ্যমে সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা আল ইমরানের ১৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন ‘‘ফা বিমা রহমাতিম মিনাল্লাহি লিনতা লাহুম ওয়ালাও কুন্তা ফাজ্জান গালিজাল বলবে লান ফাদ্দু মিন হাওলিক’’ অর্থাৎ – “আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল দিল এবং সহৃদয় হয়েছেন। যদি বদমেজাজী ও কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে লোকেরা আপনার নিকট থেকে দূরে সরে যেতো।” পবিত্র কুরআনের এ মহান শিক্ষা পুরো দস্তুর মত ছিল মানবতার মহান কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যেও। তাই তো তিনি লিখেছেনঃ –

আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন হাত মিলাও হাতে
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ ॥
…………………………………………………… .. .. .. ..
তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ ॥

রমজান মাস আসলে রোজা পালন মুসলিমগণ। রোজার মাসে রোজার নিমিত্তে না খেয়ে থাকে ধনীরা। কিন্তু রমজান মাস না থাকলেও সারা বছর যারা অনাহারে থাকে, সেই গরীব মিসকীনদের রোজা তো সারা বছর। আর যারা এতিম ও অনাথ, যাদের মা-বাবা নেই, সম্পদ নেই, তাদের কষ্টের তো সীমা নেই। তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে কুরআন শরীফে বহুবার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ইমানদার মাত্রই গরীব মিসকিনকে অন্ন প্রদান করতে হবে। এমিতদেরকে সহযোগিতা করতে হবে। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা মাউন-এ বলা হয়েছে – “১) আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচার দিবসকে অস্বীকার করে? ২) সে হলো সেই ব্যক্তি যে এতিমকে গলা ধাক্কা দেয় ৩) এবং মিসকিনকে অন্ন দিতে মানুষদেরকে আহ্বান করে না।’’ অর্থাৎ তারাই হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী এবং যারা বিচার দিবসকে অস্বীকার করে, তারা তো ইমানদারই নয়। তাদের অবস্থান জাহান্নামে আর তাদের জন্য আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে রয়েছে কঠিন শাস্তি। এখানে এ প্রসংগে কুরআনের আরও কয়েকটা আয়াত উদ্ধৃত না করলেই নয়। সূরা আল মুদ্দাসির এর ৪২ থেকে ৪৭নং পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে – “(৪২) তারা (জান্নাতবাসীরা) প্রশ্ন করবে, তোমাদের কিসে জাহান্নামে নীত করেছে? (৪৩) তারা (জাহান্নামীরা) বলবেঃ আমরা নামাজ পড়তাম না, (৪৪) অভাবগ্রস্থকে আহার্য দিতাম না, (৪৫) আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম, (৪৬) এবং প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম, (৪৭) আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত।”
আর মিসকিন কারা, তাদেরকে কিভাবে চেনা যায় এবং সাহায্য করা যায় তা ব্যাখ্যা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“দান খয়রাত ঐ সমস্ত গরীব লোকদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে- জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরা ফেরা করতে সক্ষম নয়। তারা মানুষের কাছে হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে ধনী বলে গণ্য করে। তুমি তাদের চেহারা দেখেই (ভেতরের অবস্থা) আঁচ করতে পারো। তারা মানুষের কাছে কাকুতি মিনতি করে ভিক্ষা চায় না।” (সূরা বাকারাঃ ২৭৩)।

উপরোক্ত আয়াতগুলো বিশ্লেষণ করলে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, অনাথ, এতিম ও অভাবগ্রস্থদেরকে দান খয়রাত না করাটা একটা গুরুতর অপরাধ। এমনকি এই অপরাধ মানুষকে জাহান্নামেও নিমজ্জিত করতে পারে। আর এ শিক্ষা কাজী নজরুল ইসলাম অর্জন করেছিলেন পাকাপোক্তভাবেই। তাই তো তিনি তাঁর গানও সাজিয়েছেন সেই শিক্ষার অমর বাণী দিয়ে। তিনি লিখেছেন-

যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত্য উপবাসী
সেই গরীব এতিম মিসকিনে দে যা কিছু মফিদ ॥

আল কুরআনের সেই শিক্ষাকে বুকে ধারণ করতে পারলেই তাওহীদের শিরনী সাজানো হবে হৃদয়ের আসনে। এমনি করেই রসূলের শেখানো সে দ্বীনের পরিপালন করা হবে। তাই তো কবি লিখেছেন-

ঢাল্ হৃদয়ে তোর তশ্তরীতে শিরণী, তাওহীদের
তোর দাওত্ কবুল করবেন হযরত, হয়ে মনে উমীদ ॥

ইসলামের সেই গৌরবোজ্জবল ইতিহাসের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মুসলমানেরা কখনো আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জানে। প্রতিবাদ করতে জানে। প্রয়োজনে বিলিয়ে দিতে পারে নিজের জীবনও। তারা শহীদ হতে জানে, কিন্তু মাথা নত করতে জানে না দূরাচার ও দূবৃত্তায়নের কাছে। ইসলামের মুসলমানদের সেই সৌর্য বীর্যের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ঈদের গানে। তাই তো তিনি লিখেছেন –

তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ ॥

এমনিভাবে আলোচনা পর্যালোচনা করলে কাজী নজরুল ইসলামের ঈদের সেই ঐতিহাসিক গান কেবল ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্যেরই প্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়। গানটির আঙ্গিক সৌন্দর্য মানুষের মনকে যেমন দোলায়িত করে, তেমনি ইসলাম ধর্মের প্রকৃত ধর্ম-দর্শনও এই গানটি ধারণ করে। সারা রমজান মাস জুড়ে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে যে মহান শিক্ষা আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শিখিয়েছেন এবং ঈদের আনন্দের মাঝে ইসলামের যে গভীর জীবন-দর্শন লুকিয়ে আছে তা পূর্ণরূপেই প্রতিফলিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ঈদের গানে। কেবল মাত্র চোখ-কান খোলা রাখলেই বুঝা যায় যে, কাজী নজরুল ইসলামের ঈদের গান দিজিবিজয়ী সুমহান আদর্শ ইসলামের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যেরই প্রকাশক।

[লেখক : এ কে আজাদ কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল : akazadkobi@gmail.com]

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা