প্রচ্ছদগদ্যকাব্যজীবনকথা

লিখেছেন : রফিক উল ইসলাম

কাব্যজীবনকথা

রফিক উল ইসলাম 

জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে এক অস্পষ্ট বর্ণময় রূপরেখা নিয়ত লালন করে আমাকে। আমার ভাষা জুগিয়ে দেয়। ফলে ‘মৃত্যু’ শব্দটির আভিধানিক তাৎপর্য নতুনতর সব সব মাত্রা নিয়ে জাগ্রত থাকে আমার জীবনে। কাব্যজীবন বর্ণনার সূচনায় তাই বারংবার এসে পড়ে ‘মৃত্যু’ নামক এক ঘোর পারপার-এর কথা। ওপার জানা নেই ঠিকঠাক। কোনো এক স্বপ্নময় ডানায় হঠাৎ সেই ওপারে চলকে ওঠা। যা উঠে আসে, সেইসব রং ছবি এপারের জন্যে প্রাণপণে কুড়িয়ে আনা। পথে ছড়িয়ে যায় বেশ কিছু। কিছুটা আবছা, আর কিছুটা ধরা পড়ে মাধুকরীর মতন। এসব কবিতা কিনা জানি না। এপার ওপারের মধ্যবর্তী সেই বর্ণময়তা… এপার থেকে নিজেকে মুছে ওপারের বাসিন্দা করে তোলা… আবার ওপারের ডুব থেকে এপারের ভূমিতে জেগে ওঠা— এমন সব বিচিত্র আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাই বারংবার লিখে ফেলতে চাই। যদি কেউ কান পেতে শোনেন, তো ফিসফিস করে বলি।

২. 

আাঁধার কালের অতীত কোনো বিন্দু থেকে জীবন শুরু করেছিলুম। তারপর কত জন্ম এবং জন্মান্তর। এক প্রাণ থেকে কোটি কোটি প্রাণের ভেতর উড়ে উড়ে চলা। এতসব ভ্রমণকাহিনী লিখে ফেলি, তার সাধ্য কই! আমার তো সমাপ্তি নেই, অবকাশও নেই। শেষ গোধূলির পারে ফিরে যাওয়ার আগে আরো কত কত জন্ম পার হতে হবে! আর এই পৃথিবীর জীবন, এ যেন সামান্য জিরিয়ে নেওয়া। যেন এই জীবনে দাঁড়িয়ে পূর্বকালের জন্মগুলির হিসেব বুঝে নেওয়া। যেন এই জীবনে দাঁড়িয়ে আগামী জন্মগুলির বিস্তারিত ছক কষে ফেলা। আমার নিজের তো পাওয়ার কিছু নেই, হারাবারও নেই কিছু। নিঃসংশয় গভীর যাত্রাপথে একাকী নিঃশেষিত হতে থাকা, পূর্ণ হতে থাকা, উদ্ভাসিত হতে থাকা। এতসব বিচ্ছুরণের দাগ থেকে যদি কোনো মঙ্গল ঘটে যায়, সে জয় কবিতার, আর কিছু না।

হে পলকের মতন ক্ষণজীবন আর জীবনের যত ক্রোধ, লিপ্সা, অহংকার আর বাধ্যতা ক্ষমা করো আমাকে। মানুষ কীভাবে এমন অসহিষ্ণু হয়! আমি তার যথার্থ বুঝি না। এই-ই আমার মূর্খতা। আমার চিরন্তন প্রবাহমানতা থেকে অবনত শাখাটির কাছে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখি, কতখানি গান জমা হল। আমি কি অতখানি অবনত হতে পারি? আপন পাথরের স্তর দু-হাতে সরাই। ভেতরের লাভামুখ প্রাণপণে চেপে ধরে চিৎকার করি– আমাকে নির্ভার হতে দাও। এই-ই আমার সিদ্ধি। পৃথিবীর যতকিছু “না” আছে, একদিন সব ছুঁয়ে দিয়ে যাব। এই-ই আমার পথশ্রম। ঘর আর বাহির কে যে মহিমান্বিত, আমি তার হিসেব পাই না। আমার মাতা কিংবা প্রেয়সীরা কি বালুকণায় গড়া, আমি তার হিসেব পাই না। অসহিষ্ণু এই পারে শুধু অতলান্ত ঢেউ, আর দূরে জেগে থাকা বাতিস্তম্ভ। আমি এদের চিনি, আর শ্যাওলার মতন তীর ছুঁয়ে থাকা নুড়িদের ভেতর যতটুকু পারি তাৎপর্য লিখে যাই।

কোন সে অধীর বয়সে প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলুম, মনে পড়ে না। তারপর এই ঘোর অসংসার। এও যে ভালবাসা হয়ে যায়, কেমন করে বুঝবো! পরম যত্নে অসংসারও নির্বাহ করে কেউ, আমাকে প্রশ্রয় দেয়, সন্ততি লালন করে। আমি তার কাছে, তাঁদের কাছে আকণ্ঠ ঋণী হয়ে থাকি। মাথা ঝুঁকিয়ে আমার যাবতীয় দায়ভার বহনের মূর্ছনা পরখ করি। একদিন জেগে উঠেছিলুম জল থেকে, আবার বিলীন হব জলে। এর ভেতরেই লীলাচঞ্চল পলক তুলে দেখা। এ-দেখার শেষ নেই কোনো। পথের দুপাশে অন্যরকমের নারী, লতা, ফুল, পাখি আমার আত্মীয় হয়ে ওঠে। এটুকুই নিজের বলে বিবেচনা করি, আর সব মিথ্যে। এই গৃহ আর কথপোকথন, এই কান্না হাসি অভিমান, ব্যবহৃত জীবনপ্রণালী সবকিছু অকারণ মনে হয়, আর ক্রমশ নিঃসঙ্গ হতে থাকি। সমাজ ভেঙে পড়ে, বর্ণ ভেঙে পড়ে, ক্ষত্রিয়নাম ভেঙে পড়ে। গভীর রাতে একাকী বাড়ি ফেরার পথে স্পষ্ট অনুভব করি, সামনে অন্য কেউ হাঁটছেন। তিনি আমার পথের রক্ষী। খুব অচেনা গম্ভীর কোনো স্থানে ভীতু আমি পৌঁছানোর আগেই অন্য কেউ সেখানে পৌঁছে যান আমার আপ্যায়নে, ফলত ঠিকঠাক একা নই কখনও— এটুকুই আমার বিশ্বাস। এইসব মূর্খতা, সিদ্ধি, সম্পদ, বিশ্বাস আর পথশ্রমে আমার যা-কিছু আহরণ। তার যতটুকু পারি লিপিবদ্ধ করি, যা পারি না, সেসব আমার অক্ষমতা।

এই-ই আমার জীবন আর কাব্যজীবনকথা। ভ্রমের ভিতর, বুদবুদের ভিতর, স্বপ্নের ভিতর আমাদের ঘরবাড়ি, প্রজাবর্গ আর অরণ্যসকল। বারংবার ফিরে যাই তাদের কাছে। কতরকমের গল্পগাথা আর লুকোচুরি।  সেসব অনুবাদ করে আনি। প্রকৃতই আনতে পারি কি? আমি তো নুব্জ পথিক, মাটির অবাধ্য না। জীবনে জীবন যুক্ত করে যাব বিমূঢ় অন্ধ সমর্পণে। আর যতটা পারি অনুবাদ করে যাব নিজেকেই।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. আমার প্রিয় একজন কবি রফিক উল ইসলাম। তাঁর ‘কাব‍্য জীবনকথা’ পাঠ করে মুগ্ধ হলাম। গদ‍্যের কাব‍্যময় ভাষা,অকপট অনুভূতি হৃদয় ছুঁয়ে গেল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা