প্রচ্ছদপ্রবন্ধকুসুমকুমারী দাসের কবিতা এবং দিনলিপি

লিখেছেন মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ 

কুসুমকুমারী দাসের কবিতা এবং দিনলিপি

মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ 

এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাস। কবি জীবনানন্দ দাশের মা, এটা যেমন একটা বড় পরিচয় তাঁর, তেমনি আরও একটি বড় পরিচয় কুসুমকুমারী দাস নিজে ছিলেন একজন কবি। স্ত্রী শিক্ষার প্রথম যুগে যে দু-একজন বাঙালি মহিলা পড়াশোনায় স্কুল কলেজের পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এগোতে পেরেছিলেন এবং নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পেরেছিলেন সংস্কৃতি চর্চায়, কুসুমকুমারী দাস তাঁদের মধ্যে অন্যতম। উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে শুরু করে বিশ শতকের তিরিশ-চল্লিশের দশক অবধি কুসুমকুমারী দাসের কবিতা নানা পত্র-পত্রিকায় কম-বেশি প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য ছেদও পড়েছে কখনো কখনো সে আত্মপ্রকাশে। গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু, প্রিয়ংবদা দেবী, কামিনী রায় উনিশ শতকের বাংলার এইসব মহিলা কবিদের নামের তালিকার সঙ্গে আরও একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন কুসুমকুমারী দাস। বাঙালি পাঠক তাঁর জনপ্রিয় একটি কবিতা মনে রাখলেও কবিকে বিস্মৃত হয়েছেন। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ (আদর্শ ছেলে)।

কুসুমকুমারী দাস সেই ‘আদর্শ ছেলে’-র কবি।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালে জন্ম। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে উনিশ বছর বয়সে সত্যানন্দ দাসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কবি জীবনানন্দ দাশ কুসুমকুমারীর জ্যেষ্ঠ সন্তান। কুসুমকুমারী পারিবারিকভাবে ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত সুনিপুণ সংসারী এবং সমাজকর্মী। পিতৃকুল এবং স্বামীগৃহ উভয় দিক দিয়ে ব্রাহ্ম সমাজের নানাবিধ সামাজিক ধর্মীয় প্রকল্পনায় সক্রিয় ব্যক্তিত্ব। মা কুসুমকুমারীর তত্ত্বাবধানে জীবনানন্দের বাল্যের পড়াশোনা ও শৈশবের যাবতীয় নীতিনিষ্ঠ জীবনপ্রণালী গড়ে ওঠে। খুব ভোরে উঠে তিনি শিশু পুত্রকন্যাদের শোনাতেন ব্রহ্ম সংগীত:

‘মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে

তোমার বিশ্বের সভাতে

আজি এ মঙ্গল প্রভাতে…’

একান্নবর্তী পরিবারের যাবতীয় পরিশ্রম সাপেক্ষ সাংসারিক খুঁটিনাটি সমস্ত কাজকর্ম তিনি নিজেই করতেন, স্মৃতিচারণায় লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ। রাত্রে শেষ মানুষটির খাওয়া দাওয়া অবধি জেগে বসে থাকতেন কুসুমকুমারী। আর বিছানায় শুয়ে থাকা শিশুপুত্রটির ঘুম আসতো না মায়ের আগমনের অপেক্ষায়। শীতের রাত্রির অঘ্রান পৌষের শীত নিথর স্তব্ধতায় মায়ের অপেক্ষায় জেগে থাকতেন শিশু জীবনানন্দ। অতঃপর মা এসে সারা দিনের পড়াশোনা ইত্যাদির খোঁজ নিতেন। সারাদিনের সাংসারিক ব্যস্ততার মধ্যেই মা পুত্রের স্কুলের পড়াশোনার তদারকি করতেন এবং দিতেন নীতিশিক্ষার পাঠপ্রণালী। জীবনানন্দের ভাষায় মা কুসুমকুমারীর সেই শিক্ষাদান ‘সেটা স্কুল কলেজের কারিকুলম-এর সঙ্গে খাপ খেয়ে চলে না শুধু —সদর্থ আবিষ্কার করে চলতে থাকে সংসারের, সমাজের, দেশের, জীবনের।’ (আমার মা-বাবা – জীবনানন্দ দাশ)। মা কুসুমকুমারীর নিপুণ তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠেছিলেন জীবনানন্দ। খুব ছোটোবেলায় জীবনানন্দ কঠিন এক অসুখে পড়লে কুসুমকুমারী ব্যয়বহুল একচিকিৎসাপদ্ধতি অবলম্বন করে মুমূর্ষু সন্তানকে নিয়ে একটির পর একটি স্বাস্থ্য নিবাসে লক্ষ্ণৌ, আগ্রা, গিরিডি ঘুরে বেড়িয়েছেন। যে পদক্ষেপ তাঁদের পারিবারিক অনেক সদস্যের মতে ছিল ‘আত্মঘাতী’ এক পদক্ষেপ। ঋষিকল্প পিতা সত্যানন্দের আত্মানুসন্ধানী ধার্মিকতা-সংযম আর সর্বংসহা মায়ের ধৈর্য ও স্নেহচ্ছায়ায়, অতিনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে বড় হয়েছিলেন জীবনানন্দ। সুচরিতা দাশ লিখেছেন ‘বাবা যদি দিয়ে থাকেন তাঁকে সৌরতেজ, প্রাণবহ্নি, তবে মা তার জন্য সঞ্চয় করে রেখেছেন স্নেহ মমতা বনচ্ছায়া, মৃত্তিকাময়ী সান্ত্বনা। তাঁর জন্য মা একটি নিরিবিলি পরিবেশ, শান্ত মধুর আবহাওয়া রচনা করে দিতেন সর্বক্ষণ।’ শুধু শৈশবেই নয় মায়ের প্রতি এই নির্ভরতা জীবনানন্দের ছিল আমৃত্যু। কলেজ জীবনে কলকাতায় বাসকালেও দূর থেকে মায়ের প্রতিটি উপদেশ নির্দেশের উপর জীবনানন্দ ছিলেন নির্ভরশীল। এখান থেকেও কুসুমকুমারীর কর্মতৎপরতা ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। মাকে লেখা জীবনানন্দের চিঠিগুলি অন্তত তাই প্রমাণ করে। এমনকি বিবাহ পরবর্তী জীবনেও মায়ের উপর নির্ভরতা কোনো অংশে কমেনি। কিন্তু মাকে নির্ভর করার উপযুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতির অভাবে জীবনানন্দের বিবাহ পরবর্তী জীবনে বেড়েছে অস্বস্তি। শৈশবের মাকে খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা। বিবাহিত জীবনানন্দের কাছে পরিবেশ ততদিনে বহু রকমভাবে বদলে গেছে। এ সময়ে বোন সুচরিতা দাশকে চিঠিতে লিখছেন জীবনানন্দ – ‘তোমরা কয়েকদিন এখানে ছিলে—বেশ বাড়ির atmosphere বোধ করেছিলাম, বিশেষত সেই অনেক আগের বরিশালের মতন। এখন আবার সেই সেই; দিনরাত অমানুষিক বকাবকি …’ (সুচরিতা দাশকে লেখা চিঠি। ‘বিভাব’ জীবনানন্দ সংখ্যা পৃ ৪৫৫)। কুসুমকুমারীর মৃত্যুর পর জীবনানন্দের কাছে এই বোনই ছিলেন যেন ‘জননীর প্রতিনিধি’।

ছোটোবেলা থেকেই জীবনানন্দের সাহিত্য ও কাব্যবোধ গড়ে উঠেছিল মায়ের প্রত্যক্ষ প্রণোদনায়। সাহিত্যপাঠে, আলোচনায় মা সেই বয়স থেকেই পুত্রের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন। নবীনচন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ সেন, গোবিন্দচন্দ্র দাস এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের কবিতা মা আবৃত্তি করে শোনাতেন।

কবি হিসেবে কুসুমকুমারী দাস উনিশ শতকীয় শান্ত-রসাম্পদ গার্হস্থ্য জীবনে কবি।

জীবনের শাশ্বত সুন্দর ও চিরকালীন সুনীতি বোধে জাগ্রত কুসুমকুমারী দাসের কবিতা। শিশুতোষ কাব্যবানীই তাঁর কবিতার আলম্বন বিভাব। কবি হয়ে ওঠার নিরন্তর চর্চা থেকে কুসুমকুমারী কবিতা লেখেন নি। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতেই তিনি কলম ধরেছিলেন। তাই কবিতা রচনাকর্মে তাঁর কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। মূলত ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ‘ব্রহ্মাবাদী’ পত্রিকার প্রয়োজনে তিনি কলম ধরেছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর কবিতা ছাপা হত ‘মুকুল’, ‘বামাবোধিনী’, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। ‘ব্রহ্মবাদী’ ছাড়া ‘মুকুল’-এ তাঁর অধিকাংশ কবিতা ছাপা হয়। ‘মুকুল’ পত্রিকাটিও ছিল সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের রবিবাসরীয় নীতিবিদ্যালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিত বালক-বালিকাদের উপযোগী সচিত্র মাসিক পত্রিকা। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ৬ষ্ঠ বর্ষ থেকে (১৩০৭) পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা হেমলতা দেবী। ২৪ বছর ধরে কাগজটি প্রকাশিত হয়। ১৩৩৫ সালের বৈশাখ মাস থেকে ‘মুকুল’-এর নব পর্যায় শুরু হয় সম্পাদিকা শকুন্তলা দেবী। নব পর্যায়ে তৃতীয় বর্ষ থেকে সম্পাদনা করেন বাসন্তী চক্রবর্তী। ১৩৪৮ সাল অবধি তিনি সম্পাদনা করেন। এই কাগজেই কুসুমকুমারীর অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়।

‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকাটি ছিল ব্রাহ্মসমাজের বরিশালের মুখপত্র। ব্রাহ্মসামাজিক দায়িত্বে অন্বিষ্ট এই পত্রিকার লেখার প্রয়োজনে কুসুমকুমারী সাংসারিক কাজকর্মের ফাঁকে কলম ধরেছেন। জীবনানন্দ দাশ মায়ের কবিতা লেখা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “সব সময়ই নয়, কোনো কোনো সময় বেশ ভালো কবিতা বা গদ্য খুব একান্ত মনে তাড়াতাড়ি রচনা করে দিচ্ছেন দেখতে পেতাম। সংসারের নানা কাজকর্মে খুবই ব্যস্ত আছেন— এমন সময় ‘ব্রহ্মবাদী’-র সম্পাদক আচার্য্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বলেন ‘এখুনি ব্রহ্মবাদীর জন্যে তোমার কবিতা চাই, প্রেসে পাঠিয়ে দিতে হবে, লোক দাঁড়িয়ে আছে।’ শুনে মা খাতাকলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে এক হাতে খুন্তি আর এক হাতে কলম নাড়ছেন দেখা যেত; যেন তিনি চিঠি লিখছেন, বড় একটা ঠেকছে না কোথাও; আচার্য্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখুনি তখুনি কবিতা দিয়ে দিলেন!’ (আমার মা বাবা- জীবনানন্দ দাশ। মূল পাণ্ডুলিপি থেকে ‘বিভাব’ জীবনানন্দ সংখ্যা)। মা কুসুমকুমারীর এইসব স্বতস্ফুর্ত কবিতার রচনাকর্মকে জীবনানন্দের মনে হয়েছে স্বভাবকবিত্ব। লোককবির স্বভাবী সহজতাকে আত্মস্থ দেখেছিলেন তাঁর মায়ের কবিতাকর্মে।

কুসুমকুমারী সহজ কবি এবং স্বভাবকবি। কিন্তু কবিতার সৃজনপ্রক্রিয়ায় কোনো ধারাবাহিকতা তাঁর ছিল না। কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং সক্রিয়তা তাঁর ছিল না। তবু তিনি তাৎক্ষণিক তাগিদে যেটুকু সময় কলম ধরেছিলেন তার মূল্য কম নয়। উনিশ শতকীয় বাংলা কবিতার যে উপাদান-বৈশিষ্ট্য, পূর্ণমাত্রায় তা কুসুমকুমারীর কবিতায় উপস্থিত। শান্ত নির্বিবোধ নিস্তরঙ্গ গার্হস্থ্য জীবন, প্রকৃতি, দেশাত্মবোধ, শিশু-কিশোরতোষ সুনীতিবোধের জাগৃতি এবং ঈশ্বর-উপাসনা কুসুমকুমারীর কবিতার প্রধান বিষয়।

শিশু-কিশোর মনের বিকাশ দেশাত্মবোধের জাগৃতি এবং কর্মের মন্ত্রে উজ্জীবন তাঁর অনেক কবিতায়—

‘বঙ্গের ছেলেমেয়ে জাগো জাগো জাগো

পরের করুণা কেন শুধু মাগো, 

আপনারে বলে নির্ভর রাখ হবে জয় নিশ্চয়।

তোমরা জাগিয়া দুঃখ ঘুচালে, সকলের ব্যথা সকলে বুঝিলে ত্যাগ, একতায় জাগিয়া উঠিলে তবে বঙ্গ রক্ষা পায়।’

(উদ্বোধন)

দেশের তরুণ যুব সমাজকে তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার, যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন:

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে 

কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে 

মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন,

‘মানুষ হইতে হবে’— এই তার পণ।’

(আদর্শ ছেলে)

জনপ্রিয় এই কবিতাটি ১৩০২ পৌষ সংখ্যা ‘মুকুল’-এ ছাপা হয়। পরে নানা শিশুপাঠ্য সংকলনে কবিতাটি গৃহীত হলে বাঙালি শিশু-কিশোর পাঠকের প্রায় মুখে মুখে ফেরে। যদিও কবিতাটি কার লেখা অনেকেরই অজানা। কবিতাটি প্রসঙ্গে জীবনানন্দ লিখেছেন: ‘অনেক অপ্রত্যাশিত জায়গায় মার কোনো কোনো কবিতা কেউ কেউ আবৃত্তি করেছে, শুনেছি; লেখিকার নাম হয়তো জানা নেই। ‘ছোটনদী দিনরাত’, ‘আমাদের দেশে হবে’, ‘দাদার চিঠি’ ইত্যাদি কয়েকটি কবিতার কথা মনে পড়ছে।’ কুসুমকুমারী দাসের কবিতায় দেশাত্মবোধ যেমন বিষয় তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিশুকিশোর মনে নীতিশিক্ষার সঞ্চারণ: কখনোবা স্বদেশের পরাধীনতাজনিত বেদনাবোধ। দেশবাসীর অলসতা কর্মবিমুখতা তাঁকে পীড়িত করেছে। যেমন তিনি দেশের সেই ‘আদর্শ ছেলে’-র খোঁজ করেছেন কথায় বড় না হয়ে যে কাজে বড় হবে— সেই সাথে তিনি পরক্ষণেই আক্ষেপ করে লিখেছেন —

‘একদিন লিখেছিনু আদর্শ যে হবে,

‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ 

আজ লিখিতেছি বড় দুঃখ লয়ে প্রাণে, 

তোমরা মানুষ হবে কাহার কল্যাণে?

মানুষ গড়িয়া ওঠে কোন উপাদানে 

বাঙালি বোঝেনি তাহা এখনও জীবনে।’

(মনুষ্যত্ব)

কুসুমকুমারী দাসের কবিতা কখনোবা ঈশ্বর-উপাসনায়, সুন্দরের অভ্যর্থনায় আত্মমগ্ন। সহজ শান্তসুরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা আর প্রণতি জ্ঞাপন। এই প্রণতি জ্ঞাপনে কোথাও কোনো পরিপ্রশ্ন নেই, সংশয় নেই। সহজ আত্মনিবেদন আর অপার আনন্দময় সত্তার অনুভব:

‘সকল ব্যথা ছড়ায়ে দাও তোমায় শুধু ডাকি আনন্দময় রূপে তোমার ভুবন রাখ ঢাকি।’

জীবনানন্দ গবেষক সুমিতা চক্রবর্তী কুসুমকুমারী দাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন ‘কুসুমকুমারী খুব বড় লেখিকা নন, কিন্তু স্ত্রী শিক্ষার প্রথম যুগে যে মেয়েরা সারাজীবন সাহিত্য সাধনার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রেখেছিলেন— তিনি তাঁদেরই একজন।’ সুমিতা চক্রবর্তী আরও মন্তব্য করেছেন কুসুমকুমারীর কবিতা রচনার ক্ষমতা যতটা ছিল, আগ্রহ ছিল তার চেয়ে কম।’ কুসুমকুমারী দাসের দু-একটি বইয়ের নামোল্লেখ করেছেন জীবনানন্দ গবেষকদের কেউ কেউ। সুমিতা চক্রবর্তীর প্রবন্ধ থেকে জানা যায় ‘কবিতা মুকুল’ নামের একটি কবিতা সংকলনের কথা। যদিও সংকলনটি তিনি চাক্ষুষ করেন নি। ‘পৌরাণিক আখ্যায়িকা’ নামে একটি গদ্যগ্রন্থেরও উল্লেখ করেছেন তিনি। মায়ের কবিতা সংকলন প্রসঙ্গে জীবনানন্দ লিখেছেন: ‘মার কয়েকটি কবিতা গ্রথিত করে রামানন্দবাবু ‘কাব্যমুকুল’ নামে কবিতার বই বের করেছিলেন। সেই বইটি আজকাল কোথাও পাওয়া যায় না। আমাদের কাছেও নেই। বইয়ের কটা সংস্করণ হয়েছিল জানি না। শেষ সংস্করণ বিক্রি হয়ে গেলে রামানন্দবাবুর কাছেও আর কোনো কপি ছিল না।’ ‘কবিতা মুকুল’ বা ‘কাব্য মুকুল’ যাইহোক না কেন কুসুমকুমারী দাসের কোনো বইয়ের খোঁজ জীবনানন্দ গবেষকরা উদ্ধার করতে পারেন নি। জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় তাঁর মায়ের অপ্রকাশিত কিছু কবিতা তাদের কাছে দীর্ঘদিন থাকলেও পরবর্তী সময়ে বরিশাল ত্যাগ করে কলকাতায় স্থানান্তরিত হলে সে সব পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেন। আশার কথা সাম্প্রতিককালে সেসব কবিতার অনেকাংশ উদ্ধার করেন সুমিতা চক্রবর্তী। শুধু কবিতা নয় উদ্ধার হয় কুসুমকুমারী দাসের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর দু-একটি পৃষ্ঠা এবং দিনলিপি। পঁচাত্তরটি কবিতা সংকলিত করে সুমিতা চক্রবর্তীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কুসুমকুমারী দাসের কবিতা’। এই সংকলনে লক্ষ্য করা যায় কুসুমকুমারী দাসের অধিকাংশ কবিতা প্রকাশিত হয় ‘মুকুল’ এবং ‘ব্রহ্মবাদী’র পাতায়।

‘প্রবাসী’ সম্পাদক ‘রামানন্দ বাবু’ অর্থাৎ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শুধু কুসুমকুমারীর কবিতা ছেপেছেন তা নয়, ছেলেবেলায় কুসুমকুমারীর কলকাতায় থেকে পড়াশোনার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। সময়টি ১৮১২ সাল। প্রায় একবছর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে থেকে বেথুন স্কুলে পড়াশোনা করেন কুসুমকুমারী। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে কুসুমকুমারী লিখেছেন: ‘বরিশালের পাঠ সাঙ্গ করিয়া আমি যখন কলিকাতার বেথুন স্কুলে ভর্তি হইলাম, আমাদের পরমাত্মীয় কলিকাতার অভিভাবকরূপে পাঠক ইন্দুভূষণ রায় তাহার পরম স্নেহভাজন রামানন্দবাবুর গৃহে আমার বাসের স্থান নির্দেশ করিয়া দিলেন।’ তাঁর কবিতা রচনাকর্মেও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহ দান ছিল নিরন্তর। রামানন্দবাবু প্রবাসী প্রেস থেকে শিশুদের উপযোগী সচিত্র একটি বই বের করেন। যে বইয়ের প্রথম ভাগেই রেখেছিলেন কুসুমকুমারী দাসের কবিতা:

‘ছোটো নদী দিনরাত বহে কুলুকুল 

পরপারে আমগাছে থাকে বুলবুল।’

কুসুমকুমারী দাস শুধু কবিতা লিখেছেন এমন নয়। তাঁর দু-একটি গদ্য রচনারও সন্ধান পাওয়া গেছে। এমনকি তিনি প্রবন্ধও রচনা করেছেন। গুরুসদয় দত্তের স্ত্রী সরোজনলিনী দেবীর স্মৃতিতে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় কুসুমকুমারী দাস ‘নারীত্বের আদর্শ’ নামে প্রবন্ধ রচনা করে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। এছাড়া আরও দু-একটি প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া গেছে ‘ব্রহ্মবাদী’ ও ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্য সংবাদ থেকে। এসব প্রবন্ধগুলি অনেক সময় ব্রাহ্ম সমাজের নানা সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে লিখিত ও পঠিত। বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের নানা ধর্মীয় সামাজিক অনুষ্ঠানে, নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ব্যয় করেছেন। এ ব্যাপারে ছিল তাঁর স্বামী সর্বানন্দ দাসের অকৃপণ সহযোগিতা। কুসুমকুমারী দাসের দিনলিপি থেকে জানা যায় তাঁর যাবতীয় কাজকর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাঁর স্বামী সর্বানন্দ দাস, ছিলেন জীবনের ‘পরম শিক্ষক’। বরিশাল ছিল তার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে। চল্লিশের দশকে জীবনের শেষ সময়ে কুসুমকুমারী কলকাতায় বাস করতেন, কখনো অশোকানন্দের বাসায়, কখনো জীবনানন্দের বাসায়। তখনো বরিশাল যাতায়াত অব্যাহত ছিল। ১৯৪২-এ স্বামীর মৃত্যুর পর এবং ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর বরিশাল যাওয়া আর সম্ভব হয়নি। দিনলিপিতে কুসুমকুমারী লিখেছেন স্বামীর বিয়োগ যন্ত্রণার কথা, দেশভাগ আর বরিশালের কথা।

‘৩০ অক্টোবর ১৯৪২ ওর শরীরটা ক্রমেই যেন শীর্ণ হইয়া যাইতেছে। বড় ভাবনার বিষয়। কি যে কষ্ট হয় কিছুতেই কিছু হইতেছে না। চিরজীবনের বন্ধু, সুহৃদ, একমাত্র পরামর্শদাতা, জীবন গঠনের নিয়ন্তা… তবে কি দিন ফুরাইয়া আসিতেছে? কিছুতেই তো বিশ্বাস হয় না।’

২১ নভেম্বর ১৯৪২ দিনলিপিতে লিখেছেন:

‘সজ্ঞানে কথা বলিতে বলিতে চলিয়া গেলেন।

ভালমন্দের মধ্যে মন্দটুকু বুঝিলাম না।

এই কি চিরবিদায়।’

১৯৪২-এ সত্যানন্দ দাসের মৃত্যুর পর কুসুমকুমারী বাস করতেন কলকাতায়। কিন্তু তাঁর মন পড়ে থেকেছে বরিশালে। সাতচল্লিশের পর দেশভাগ স্বাধীনতা এবং বয়সের ভার এসব কারণে আর কোনোদিন বরিশাল ফেরা হয়নি। ১৯৪৭ এর ৬ই জানুয়ারি ৭২ বছরের জন্মদিনে কুসুমকুমারী দিনলিপি লিখেছেন:

‘আজ ২১ পৌষ সোমবার জীবনের ৭২ বৎসর উত্তীর্ণ করিলাম। … এবার একাকী এই জীবনযাত্রা উদযাপন করিব। কাহাকেও কিছু বলিলাম না। যে ছেলেমেয়ে নিজ হইতে উৎসাহ আনন্দ করিতে চাহে সে স্বতন্ত্র— আমার বলিবার কিছু নাই। নিভৃতে নির্জনে চিন্তা করিয়া আনন্দ পাই। ঘটনা পরম্পরা কোথা হইতে কোথায় লইয়া চলিয়াছে আমাকে। জীবনে অনেক কিছু দেখিলাম, শুনিলাম, জানিলাম, বুঝিলাম। যিনি প্রকৃত শিক্ষক হইয়া আমাকে শিক্ষা দিয়াছিলেন আজ আর তিনি ইহজগতে নাই। কিন্তু তাঁর সেই প্রাণপণ শিক্ষা ব্যর্থ হয় নাই মনে করি। আজও বরিশালের গৃহঅঙ্গন, প্রাঙ্গণ, প্রান্তর লতা প্রকৃতি আমাকে আকর্ষণ করে। জানি না সেই শেফালি গাছ আজও জীবিত আছে কিনা —

এই দিনলিপি একজন সংবেদনশীল ভাবুকের দিনলিপি। শুধুমাত্র গার্হস্থ্য জীবন সম্পৃক্ত একজন সাধারণ সেকেলে মহিলার নয়, একজন জীবন দার্শনিকের আত্ম জিজ্ঞাসায় আর্ত এইসব দিনলিপিকা। আরও একটি দিনের কথা। ১৯৪৭-এর ২০ জুন। দেশভাগের দুঃখময় আত্মভগ্নতায় তাঁর আবার মনে পড়ল বরিশালের কথা:

‘২০ জুন। ১৯৪৭ — আজ ৫৮-২১ ভোটে বঙ্গবিভাগ হইল। … এতদিনের যুক্ত বাংলা ছিন্ন হইল। বরিশালের কথা ভাবিতেও কষ্ট হয়। আমাদের কতদিনের, কত আশা-ভরসার বরিশাল, কত স্মৃতিজড়িত বরিশাল, সেই নাগকেশর ফুল সেই সেই নদীর পারের ঝাউবীথি সেই স্বপ্নময় নদীতীর সবই আজ মনে পড়িতেছে। —বরিশাল তুমি সগর্বে বাঁচিয়া থাক। তোমার কীর্তি, তোমার যশ, তোমার স্বাতন্ত্র্য, তোমার মহত্ব যেন লুপ্ত না হয়। আজ পূর্ববঙ্গ ভারত ছাড়া ভাবিতেও কত কষ্ট বোধ হয়। ভগবান তোমারই ইচ্ছা পূর্ণ হৌক।’

এরপর তাঁর স্বপ্নের-স্মৃতির বরিশালে আর কোনোদিন ফেরা হয়নি। যেমন ফেরা হয়নি তার পুত্র জীবনানন্দ দাশেরও। ১৯৪৮ এর ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় ১৭২/৩ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ এর বাড়িতে তিয়াত্তর বছর বয়সে কুসুমকুমারী দাসের মৃত্যু হয়। 

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা