প্রচ্ছদগদ্যকোলাজ : সাজ্জাদ বিপ্লব

কোলাজ : সাজ্জাদ বিপ্লব

১. আমি একস্থানে স্থানু হয়ে থাকতে পারি না। সারা বছরই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও সফর করে বেড়াই। একবার বগুড়ায় গিয়ে এক তরুণ কবির সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আমার জানা ছিলো না যে তিনি নব্বই দশকের কবি। কিন্তু তার সম্পাদিত একটি পত্রিকা হাতে তুলে দিলে আমি চমকে যাই। দেখি এখানে সাহিত্যের এক কেন্দ্রচ্যুত প্রতিবাদের আগুন। দেখতে ছোটখাটো এই তরুণটি ঘুম ঘুম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে যখন বেশ দীপ্ত কণ্ঠে জানালো যে, শুধু ঢাকাতেই সাহিত্য হবে এটা তিনি মানেন না। সাহিত্যকে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যারা নিয়ে বিভিন্ন মফস্বল শহরে কাজ করছেন তিনি তাদের একজন। তখন পত্রিকাটি উল্টে প্রথমে তার কবিতা পড়তে চেষ্টা করলাম—

প্রতিদিন। প্রত্যুষে। মা’কে দেখি
ঘর পরিষ্কার করতে

মা আপনি কি ঝাড়ু দেন?

বিগত দুঃখ, যাবতীয় রোগ-শোক-ব্যর্থতা
অনাগত দুঃস্বপ্ন

[মন্তাজ-১, সাজ্জাদ বিপ্লব, ‘নব্বইয়ের কবিতা: অন্য আকাশ’ পৃ: ৭৩]

এতে আমার চৈতন্যে সহসাই যেন একটা কলিংবেলের শব্দ বেজে উঠলো। যে সহজতা উত্তর আধুনিক কবিকুলের গন্তব্য এ কবি যেন মায়ের পেট থেকেই তা আয়ত্ব করে এসেছে। এখানেও কেন মায়ের-ই চিত্রকল্প– তা আমি এখনো ভাবি!

[নব্বইয়ের কবিতা: গোধূলীসন্ধির নৃত্য, আল মাহমুদস্বল্পদৈর্ঘ্য: ফেব্রুয়ারি ২০০৩ বর্ষ ৭ সংখ্যা ১২, ঢাকা।]

২. সুবেদী ও সুস্থির চেতনার স্বল্পবাক কবি সাজ্জাদ বিপ্লব। স্বাদেশিক স্বাতন্ত্র এবং ইতিহাস- ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার অন্বেষায় সন্নিষ্ট তাঁর কাব্য দর্শন। আত্মগত মেহন-মননের রৌদ্রালোকে প্রকর্ষিত তাঁর শিল্প স্বর। সত্তা সন্ধানের বোধোৎসারিত প্রত্যয়, প্রতীজ্ঞা ও অভীপ্সা তাঁর কবিতার অন্তর্বেদ। জীবন ও সমাজ ঘনিষ্ঠ বিষয় আশয়গুলোর অবাধ বিচরণ তাঁর স্বকৃত স্বপ্নপাঠে। তাই গ্লানি মাখা ক্লেদাক্ত কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন–

মাহবুব আহ্ মাহবুব
রিয়াদের গালিচায় এলিয়ে পড়া
সে দিনের সেই দেহ
তোমার ছিল না
ছিল রোগাক্রান্ত এক বাংলাদেশের।

(এলিজি)

ঈঙ্গিতময়তা এই কবির অন্যতম এক কাব্য-চরিত্র। বিষয বস্তুর বিশদ বিবরণে অনাগ্রহী এই কবি– পাঠকের ভাবনাকে উস্কে দিতে চান অতি পরিমিত শব্দ সংকেতে। স্বল্প কথনের নিবির আবহে তিনি নির্মাণ করে যান বোধ গাম্ভীর্যের নীরব গীতি; যেমন–

পৃথিবী চলে যাক
পৃথিবী ছেড়ে
তোমাকে ছাড়ব না আমি
কেননা
আমার পৃথিবী তুমি

(পৃথিবী)

প্রোটনাকৃতির এই কবিতাটির অন্তর্বয়ন সুস্ফিত; এতে বিমূর্ত হয়েছে মানবাত্মার শাশ্বত স্বরূপ। অনুরূপ ঘনিভূত বোধের আরেক মিতবাক প্রকাশ ‘চার্বাক’ কবিতাটি—

স্বার্থের সিঁড়ি বেয়ে
তোমার নীড়ে
পৌঁছেছি যেই

দেখি তুমি নেই।

সহজাত ছান্দসিকতার সরল অলংকরণে সৌকর্ষিত তাঁর কাব্য শরীর। ভাষা, ভাব ও উপমা- উৎপ্রেক্ষার ক্ষেত্রে তিনি স্বতঃস্ফূর্ত। তাই গীতলতার মিহিময়তায় প্রবাহমান তাঁর পংক্তিমালা—

আল্লাহ রহিম
আল্লাহ করিম
আল্লাহ রহমান

আল্লাহ নামে
কুল্লে জীবন
সৃষ্টি বহমান

সাজ্জাদ বিপ্লবের অস্তিত্বে মিশে আছে কবিত্ব স্বভাব। তরে তাঁর অতিমাত্রিক মিতভাষিতা কবিতার প্রকাশ পথে এক অন্তরায় বটে। অতএব কাব্য কথনে তাঁকে উদার হতে হবে; বিস্তৃত করতে হবে তাঁর শব্দ সংসার।

[বাংলা কবিতায় বিংশ শতাব্দীর সমাপ্তি দশক, খৈয়াম কাদেরস্বল্পদৈর্ঘ্য, ২১ জুলাই ২০০০, বগুড়া।

৩. বিজ্ঞান বলে– ‘রঙে লাল সবুজ নীল এই তিন রঙের মিশ্রণকে সাদা রঙ বলে। আবার ধর্মীয়ভাবে– রঙের যে চিহ্নায়ন, সেখানে সাদাকে আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বাসের রঙ মনে করা হয়।’ আবার ভারতীয় শাস্ত্রে জলের রঙকে সাদা বলে। দেহতত্ত্বে মানবের ভিতর দু’টি সত্তা বিরাজমান। একটি পুরুষ সত্তা, অন্যটি নারী সত্তা। নব্বই দশকে বাংলাদেশে দেহবাদী কবিতা লিখেছেন এমন তরুণ কবির সংখ্যা নগন্য। বগুড়াতে সাজ্জাদ বিপ্লব [ জন্ম: বগুড়া ২৩.০৪.১৯৭১, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: পৃথিবী তোমার নয় (১৯৯৯), কবিতাং শরণং গচ্ছামি (২০০০)] এ ধারাতে কবিতা লিখছেন। দেহবাদী কবিতা অত্যন্ত সরল ভাষায় রচনা হয়। কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি ও হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায় দেহবাদী কবিতা। দেখতে সাদামাটা অথচ কবিতার ভিতর শরতের আকাশ, সাদা মেঘ আর ঐশ্বর্য্য হাতছানি দেয়। শরতের গাঢ় নীল আরও গাঢ়তর হয়:

মাঝখানে রয়েছে জল
একফোঁটা জল

দুই পাড়ে শুধু
তুমি আর আমি

সম্পর্কটাই দামি।

[প্রাকৃতিক]

[নব্বইয়ের বগুড়া: কবি ও কবিতা, তৌফিক জহুরস্বল্পদৈর্ঘ্য, ২১ জুলাই ২০০০, বগুড়া।]

৪. সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতায় শব্দের কৃত্রিমতা নেই। নেই বক্তব্যের রহস্যময় জটিল ধূসরতা। অত্যন্ত সহজবোধ্য হৃদয়ের ভাবাবেগ তাড়িত কবি সাজ্জাদ বিপ্লব। প্রেমে তারুণ্য, প্রতিবাদে দৃঢ়চেতা আর প্রবল আশাবাদী এই কবির কবিতা সাম্প্রতিক বিষয়াবলীকে যেমন ধারন করে তেমনি ইতিহাসের শুদ্ধ স্বর ও সংগ্রামী জীবনবাদী মানুষের কথা উচ্চারিত হয়। সংকলনে ‘এলিজি’ কবিতায় বোয়িং এর চাকায় পিষ্ট মাহবুব শুধু বাংলাদেশ নয় তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর শোষণ-নিষ্পেষিত জনতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে ধরা দেয়। ‘যেন রোগাক্রান্ত এক বাংলাদেশ’। সমাজ, রাজনীতি সচেতন, মানবিক বোধাক্রান্ত কবি সাজ্জাদ বিপ্লব কবিতার আঙ্গিক ও প্রকরণে স্বল্পবাক হলেও অর্থের বিন্যাসে সুদূর প্রসারী। তার কবিতায় বিষয়বস্তু ভাব প্রবণতার অতি সারল্য (তারল্য অর্থে নয়) কাব্যে রহস্য সন্ধানী অনেক পাঠক, কবিকে হতাশ করবে। বলতে দ্বিধা নেই তাদের সংখ্যা খুবই সীমিত।

[কবিতার অন্য আকাশ, টুটুল রহমানআঁতুড়ঘর, ২১ মে ২০০১, বগুড়া।।

৫. ‘কবিতাং শরণং গচ্ছামি’। প্রচ্ছদ করেছেন হোসেন দুদায়েভ। চমৎকার এবং ব্যতিক্রমধর্মী প্রচেষ্টার সুস্পষ্ট ছাপ পড়েছে বইটিতে। নাম শুনেই চমকে যেতে হয়। নামের সঙ্গে প্রচ্ছদও মানিয়েছে বেশ। নিচে লেখা আছে ‘সাজ্জাদ বিপ্লবিরচিত উত্তর আধুনিক কবিতা পুস্তিকা’। প্রাচীন বই এর মতো লেখা এই নির্দেশক লাইনটি কবি রম্য করে লিখলেও নাম এবং বাহ্যিক অবয়বের সাথে দারুন খাপ খেয়েছে। চমকপ্রদ এই আইডিয়ার জন্য কবিকে ধন্যবাদ। বইটি হাতে নিলেই পাঠক ভাববেন, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কোনো বই [পুস্তিকা!] পড়ছেন। কিন্তু এখানেই কবি সার্থক। মধ্যযুগীয় খোলস ব্যবহার করে, তার ভেতরে ঢেলে দিয়েছেন আধুনিক চিন্তাধারা। অধুনা-প্রাচীন মিশ্রণে বইটি পেয়েছে আরো সার্থকতা। একেবারে একুশ শতকের বিষয়বস্তু উঠে এসেছে তার লেখায়। বইটির : সভ্যতা, মিলেনিয়াম, সিডি রমে জীবনানন্দ, এপিটাফ, নার্সিসাস, ফোনালাপ-২, মনিটর, এলিজি– প্রভৃতি কবিতায় পাঠক অন্যরকম আনন্দ পাবেন। এ বইয়ের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্রেয় কবিতাকে অনুষঙ্গ করে কবি লিখেছেন বেশ কয়েকটি কবিতা। আর লিখবেন নাই বা কেন? কবিতার সঙ্গে যার দিবানিশি সহবাস, তিনি তো আর কবিতাকে ছাড় দিতে পারেন না। কবিতাং শরণং গচ্ছামি, গণতব্য-১, রূপান্তর, গণতব্য-২, সংজ্ঞা, স্বপ্ন–এ বইয়ের কবিতা বিষয়ক কবিতা। এছাড়াও বইটিতে সূচিবদ্ধ হয়েছে পৃথিবী, বড়দের স্বরবর্ণ অথবা কুম্ভকর্ণ, দূরত্ব, মৌলাধুনিক, ঈশ্বর, অঞ্জলি, ইভের জন্য, কাক ও কোকিল, বিকল্প পাঠশালা, বিষ্যুদবার– শিরোনামে চমকপ্রদ সব কবিতা। এসব কবিতায় স্থান পেয়েছে সামাজিক অসঙ্গতি, নাগরিক জীবন প্রবাহ, প্রেম, স্বপ্ন, প্রবল আস্তিকতা, দেশীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে বিশ্ব-রাজনীতি পর্যন্ত বৈচিত্রময় বিভিন্ন বিষয়। প্রথম কবিতা ‘কবিতাং শরণং গচ্ছামি’র নামেই বইটির নাম রাখা হয়েছে। দুঃখবাদী বুদ্ধকে কবি হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন কবি। ‘কবিতাং শরণং গচ্ছামি’ চরণটি বৌদ্ধধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক থেকে ধার করা হয়েছে। যে যাই বলুক না কেন, বাংলাকবিতায় মৌলিক ধারা ত্রিপিটক, গীতা, রামায়ণের কাছে অনেকটা ঋণী। এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে কবি আবার সেখানে ফিরে গেলেন। তবে ‘একি তবে অভিনয়’ এ চরণের মাধ্যমে কবিদের নৈতিক অস্থিরতা সম্বন্ধে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। ‘দূরত্ব’ কবিতাটি বইটির আরো একটি সার্থক কবিতা। আবহমান বাংলার চিরচেনা সংস্কৃতির বিশ্বাসগত পার্থক্য এঁকেছেন কবি এখানে। ওপার বাংলার খ্যাতিমান কবি সুভাস মুখার্জীর ‘পারাপার’ পাঠোত্তর এ কবিতা লেখা। এ কবিতায় কবি এঁকেছেন সুক্ষ্ম কিছু সাংস্কৃতিক পার্থক্য।

দিনের শেষ আপনি করেন শিঙ্গায় তুলে সুর
আমার শুরু কোরান পাঠে পুজা থেকে দূর
হোলির রঙে আপনি রাঙান আমার রাঙি নূর।

বইটির ‘বৃষ্টি’ কবিতায় বৃষ্টির ফোঁটার মতো অক্ষর-বিন্যাস করা হয়েছে। ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা বটে, তবে কম্পোজের ধরন ইতিহাস গ্রহণ করে না, ইতিহাস ‘লেখা’ গ্রহণ করে। ‘সংজ্ঞা’ কবিতায় মাত্র পাঁচটি শব্দে কবি প্রকাশ করেছেন কবিতার সংজ্ঞা। কবিতাটি পড়লেই বুঝা যাবে, প্রকাশের আগে এর নেপথ্যে প্রচুর পরিকল্পনা ও পরিশ্রম ছিলো। কবিতায় সামগ্রিক সংজ্ঞা ফুটে না উঠলেও কবিতাটি হয়ে উঠেছে চমৎকার।

কবিতা
স্বপ্নে পাওয়া ছবি তা।

বইটির অনেকগুলো চমকপ্রদ কবিতা থেকে তিনটি কবিতা অপেক্ষাতর ভালো লেগেছে। ‘মিলেনিয়াম’ কবিতাটি এ বইয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। প্রযুক্তি ও রোমান্টিক মানসের মিশ্রণ ঘটেছে এ কবিতায়—

ইন্টারনেট ধেয়ে আসে
তোমার ই-মেল
আমি অধম বুঝতে নারি
তুমি ফিমেল

‘এপিটাফ’– কবিতাটি এ বইয়ের আরেকটি প্রথম সারির লেখা। এ কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে তারুণ্যের জীবনধারা, শিল্পমনা একজন নাগরিকের বাসনা।

ভীষণ আমার ইচ্ছে করে
শেষ কটা কাল বেকার থাকি

থাকলে বেকার
তোমার কাছে দুঃখের ডালা খুলতে পারি
বেকারত্বের জ্বালা কি আর বুলতে পারি
….

থাকলে বেকার
নীলক্ষেত আর পল্টনে জ্ঞানের জমি ঘাটতে পারি
ক্ষুধার জ্বালায় সকল পথেই হাঁটতে পারি।

এই বইয়ের ‘’এলিজি” কবিতাকে আমরা বইয়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে অভিহিত করতে পারি। বোয়িং এর চাকায় পিষ্ট এক যুবকের করুণ পরিণতি তিনি তুলনা করেছেন বাংলাদেশের ক্রমানুপাতিক অবনতির সাথে। এ কবিতায় উঠে এসেছে প্রতিবাদ, দায়বদ্ধতা, বিশ্বাসঘাতকতা :

ক্ষয়ে যাওয়া তৃতীয় বিশ্বের
একতাল মাংসপিণ্ড মাহবুব।

মাহবুব কোন যুবক নয়
মাহবুব অর্থ কোন বন্ধুও নয়

মাহবুব হলো বাংলাদেশ

পাখায় ভর দিয়ে টারমাকে দাঁড়ানো এক দিগন্ত

…..
সে দিনের সেই দেহ
তোমার ছিল না

ছিল রোগাক্রান্ত এক বাংলাদেশের।

বইয়ের ‘’গণতব্য-১’ কবিতাটি স্রেফ কবিতা বিষয়ক একটি কবিতা –

কবিরা কথা কয়
কবিতা কাঁদে
কবিদের করা উক্তিগুলো
পা রাখে ফাঁদে।

এসব কবিতায় ক্ষুদ্র অবয়বের ভেতরে কবি গুঁজে দিয়েছেন বিস্তর উদ্দেশ্য।

‘ঈশ্বর’-কবিতায় তিনি বলেছেন–

আজো খুঁজি
সেই মুখ, সেই বুক সেই চুল

খোঁজাটা কি ভুল?

‘কাক ও কোকিল’–কবিতাটিও এমন:

লক্ষ টাকা পাওয়ার বেলায় লালায়িত লোভ
এক টাকা দেওয়ার বেলায় ধুমায়িত ক্ষোভ

বইয়ের শেষ কবিতা ‘স্বপ্ন’–কবিতায় বলা হয়েছে

কবিতার চাষ হয় কলাবতী গ্রামে
কবিদের বাস সেথা মহাপ্রভু নামে।

কবিতাকে কবি এখানে কলাবতী গ্রামের ফসল এবং কবিদের ‘মহাপ্রভু’ নামে অভিহিত করেছেন। কবির প্রত্যুজ্জ্বল সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটেছে এ কবিতায়। আরেকটি ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, বইটির নামের সাথে সঙ্গতি রেখে একদম পৌরাণিক [ত্রিপিটক-ধর্মী) কিছু কবিতা বইটিতে রাখা যেতো। গঠন পৌরাণিক হলেও এর বিষয় হতে পারতো এ সময়ের। যদিও বেশ ক’টি এ সময়কার কবিতা বইয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। টুকটাক কিছু অসামঞ্জস্য ছাড়া বইটি একটি চমৎকার প্রচেষ্টা।

[কৃষ্ণ গহ্বরে না ডুবা ন’টি গ্রহ, শুভ্র জাহিদপ্রভা, জুলাই ২০০৫ বরিশাল।]

৬. “কবিতাং শরণং গচ্ছামি” সাজ্জাদ বিপ্লবের কাব্যগ্রন্থের নাম। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ পটে ও ভেতরের প্রতি পৃষ্ঠায়ই “উত্তর আধুনিক কবিতাপুস্তিকা” বাক্যটি লেখা হয়েছে। এটা বেমানান মনে হয়েছে। এই গ্রন্থের “বড়দের স্বরবর্ণ অথবা কুম্ভকর্ণ, গণতব্য-১, চারবাক, মৌলাধুনিক, গণতব্য- ২, কাক ও কোকিল, সংজ্ঞা, স্বপ্ন” প্রভৃতি কবিতা শিল্পসার্থক নয় বলেই মনে করি । তার এসব কবিতা স্বল্পাবয়বে রচিত হয়েছে। ফলে চিত্রকল্প বা তার অবয়বে জীবননিষ্ঠতা পরিব্যাপ্ত হয়নি। এই গ্রন্থের “কবিতাং শরণং গচ্ছামি, পৃথিবী, সভ্যতা, বৃষ্টি, অঞ্জলি, নার্সিসাস, বিকল্প পাঠশালা, এলিজি, বিষ্যুদবার” শিল্পসফল কবিতা। গ্রন্থভুক্ত ‘এলিজি’ কবিতাটি প্রতীক কবিতার একটি শক্তিশালী উদাহরণ। এই কবিতায় ‘মাহবুব’ নামের এক যুবকের মধ্যদিয়ে তৃতীয়বিশ্ব ও বাংলাদেশের অস্থিরতা, ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ও বিপর্যয়ের চিত্রটি স্পষ্ট হয়েছে। একটু উদ্ধৃতি দিচ্ছি—

মাহবুব আহ মাহবুব
রিয়াদের গালিচায় এলিয়ে পড়া
সেদিনের সেই দেহ
তোমার ছিলো না
ছিলো রোগাক্রান্ত এক বাংলাদেশের। [এলিজি]

স্বল্পবাক ও সংক্ষিপ্ততা তার কবিতাকে কখনো কখনো শিল্পমানে পৌঁছতে বাধা দেয়। তবে গ্রন্থভুক্ত “পৃথিবী” বা “বিষ্যুদবার’ এ রকম কবিতা এই বাধা অতিক্রম করে সাফল্যের রশ্মি ছড়িয়েছে। “বিষ্যুদবার” দিয়েই উদ্ধতি দিচ্ছি—

বিষ্যুদবার এলেই
আমি নিঃস্ব হই তোমার মতো

খেলাপীদের কারণে
যেমন বি. সি. সি আই।

[নয়কবির কাব্যগ্রন্থ, রঘুনাথ পাদ্রী। প্রভা, জুলাই ২০০৫, বরিশাল।]

৭. “পৃথিবী তোমার নয়”- কাব্যগ্রন্থে সাজ্জাদ বিপ্লব উচ্চারণ করেছেন—

বন্ধুরা খোঁজে সুন্দরী মেয়ে
যে সংসার আগলাবে
আমি খুঁজি কবিতা-সুন্দরী
যে সংসারে আগুন জ্বালাবে

[কবিতা মানুষ হতে চাই]

–সাজ্জাদ, সংসারে আগুন জ্বালাবার কথা জোরেশোরে বললেও কবিতা-সুন্দরী যে আলোকিত সংসার গড়বে–তাতে সন্দেহ নেই। তবে, সাজ্জাদের এই সংসার ব্যাপক পরিসরের, পরিকল্পিত পরিবারের মতো নয়। তাঁর কাব্যসংসার গড়ে উঠেছে প্রেমে ও দ্রোহে। তৃতীয়বিশ্বের দারিদ্র্যের রূপটির বেদনাঘন ভাষারূপ দিয়েছেন তিনি। পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ছেন কবিতায়। ঐতিহ্যের রূপায়নে, ইসলামের নান্দনিক বয়নে, দেশপ্রেমের নির্ভরতায় তাঁর কবিতা– বহুমাত্রিক বিভা ধারন করেছে। মানবতার বিকল্প পাঠশালা নির্মাণ করতে চান তিনি। তাঁর ভাষ্য–

তুমি চেয়েছিলে
আমার গায়ের ঘাম
বুলডোজারে গুড়ানো সব দাঁত
আর রক্তে ঝড়া সংগ্রাম

মিলোসেভিচের নৃশংসতায় বার বার ফিরে আসে কসোভোর প্রতিধ্বনি–

ধ্বংস হোক
জাতিসংঘ মিথ্যার প্রাসাদ

রমরমা সুউচ্চ নগরীর গাঁথুনী
তৈরী হোক আজ বিশ্বাসের মেঠো পথে

সত্যের সিরামিকে।

[বিকল্প পাঠশালা]

সাজ্জাদ বিপ্লব এর একটি বিখ্যাত কবিতার নাম “এলিজি”। কবিতায় বিধৃত ‘মাহবুব’ চরিত্রের প্রতীকে রোগাক্রান্ত বাংলাদেশের ছবি ফুটে উঠেছে। অসাধারণ ব্যঞ্জনা পেয়েছে কবিতাটি। উদ্ধৃতি দেই–

মাহবুব আহ মাহবুব
রিয়াদের গালিচায় এলিয়ে পড়া সেদিনের সেই দেহ

তোমার ছিল না—
ছিল রোগাক্রান্ত এক বাংলাদেশের।

[এলিজি]

সাজ্জাদ তাঁর কবিতায় ইঙ্গিতধর্মীতা সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। সেজন্য, অনেক কবিতাকেই তিনি ছোট রাখতে চান। প্রতীক ও রূপকের স্বচ্ছন্দ নির্মাণে সেসব কবিতা রঙিন হয়ে ওঠে। কল্যাণব্রতে উচ্চার্য, মন্ত্রের মতো উচ্চারিত একটি কবিতা এরকম–

প্রতিদিন। প্রত্যুষে।
মা’কে দেখি ঘর পরিষ্কার করতে

মা আপনি কি ঝাড়ু দেন?

বিগত দুঃখ, যাবতীয় রোগ-শোক-ব্যর্থতা
অনাগত দুঃস্বপ্ন।

প্রেমের কবিতায়ও অভিনবত্ব সৃষ্টি করেন সাজ্জাদ বিপ্লব। এর উদাহরণ দেয়া যায় “বিষ্যুদবার” নামের কবিতাটি দিয়ে। একটি নতুন উপমা চোখে পড়ে সকলেরই। এ ধরনের চৌম্বকীয় কবিতা উত্তর আধুনিক কাব্যরীতিরও বৈশিষ্ট্য। কবিতাটি এই:

বিষ্যুদবার এলেই
আমি নিঃস্ব হই তোমার মতো

খেলাপীদের কারণে যেমন বি.সি.সি. আই। [বিষ্যুদবার]

নব্বইদশকের উজ্জ্বল প্রতিভা সাজ্জাদ বিপ্লব জীবনের সাবলীল ভাষ্য নির্মাণ করেছেন এভাবেই। একটি পরিচ্ছন্ন আবহ তাঁর শব্দচয়নে প্রযুক্ত হয়।

[নব্বইয়ের চারকবি: আলোময় কবিতা সংসার, নয়ন আহমেদপুন্ড্রনগর, ফেব্রুয়ারি ২০০৬, বগুড়া।

৮. সাজ্জাদ বিপ্লব নব্বই দশক-এর ছড়াকার হলেও ছড়ালেখিয়ে হিসেবে স্বল্প সময়ে তিনি বগুড়ার ছড়াঅঙ্গন ছাপিয়ে দেশের সব অঞ্চলে তিনি ছড়ালেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ছড়া ছাড়াও তিনি একাধিক পত্রিকা প্রকাশনার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত দেশের অন্যতম ছড়া ও ছড়া বিষয়ক কাগজ ‘লিমেরিক’ অল্প সময়ের মধ্যে ছড়া সাহিত্যে খ্যাতি লাভ করেছে।
তিনি ছড়া লেখেন নানান বিষয়-আশয় নিয়ে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, ব্যক্তি-বিশেষ, শহর-নগর, বহুধা বিষয় তার ছড়ার মূল উপাদান। ইতোমধ্যে তার তিনটি ছড়াগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ছড়ার অঙ্গনে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সাজ্জাদ বিপ্লবের ছড়াগ্রন্থ তিনটি:

ক. টুকটুকাটুক
খ. চলো সবে লড়ি
গ. সাম্প্রতিক ছড়া।
…..
ক. টুকটুকাটুক

মূলতঃ শিশু-কিশোরদের উপযোগী ছড়াগ্রন্থ। ছেলেবেলার স্মৃতি, কিশোর-কিশেরারীদের নানান ধরনের আনন্দ উৎসাহ, শহর ও গ্রামের বিচিত্র চিত্ররূপ, বিচিত্র ছন্দের দোলে ঢেউ দিয়ে যাওয়া চিত্রকল্প সাজ্জাদ বিপ্লবের ছড়ায় ছড়িয়ে রয়েছে। ছড়ায় রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনের আলোকপাত। ‘রাসূল হলেন” ছড়ায় তিনি বলছেন—

রাসূল হলেন বিশ্বজুড়ে মুসলমানের প্রাণ
রাসূল হলেন শান্তি সুখের অপার অফুরান।

গ্রাম আর শহর তার কাছে যেনো এক অপার বিস্ময়! তার অনুভূতির প্রকাশ–

ট্রেন চলে ঝিক ঝিক
ঝিক মিক
কোন দিক?
দেশ-গ্রামে ঠিক ঠিক।

অথবা–

ভালোবাসি শহর ও ভালোবাসি গাঁ
ভালোবাসি চারিদিকে ছড়ে আছে যা।

সাজ্জাদ বিপ্লবের ‘টুকটুকাটুক’ গ্রন্থের মূল ছড়া তার ‘মাকে নিয়ে’ ছড়া। কিশোর বয়সে সন্তানের অনেক জিজ্ঞাসা থাকে মায়ের প্রতি। মার কাছে শিশু-কিশোর-জীবনের গল্প স্বকৌতুকে তার সন্তান জানতে চান। কিন্তু কি ভাবে? দেখুন–

মাগো তোমার ছোট্ট বেলার
সঙ্গী সাথী কে ছিলো
চড়ুইভাতি আম বাগানে
লাল পুতুলের বে’ ছিলো

লাল পুতুলের বউটি বুঝি
পালকি চড়ে আসতো
বৌ কুটুমের সঙ্গীরা কি
আকাশ কেঁপে হাসতো

তুমি কি মা পড়তে বসে
অংক নিয়ে ভাবতে
ফাঁকি দিয়ে কখনো কি
হাঁটু জলে নাবতে

নামলে পরে হাঁটু জলে
আসতো যদি জ্বর
কেউ কি তখন বকা দিয়ে
ভাংতো গলার স্বর।

এর পর ছড়াকার তার নিজের ভেতরে যে শিশুকাল রয়েছে অবচেতন মনে সেই শিশুর কথা বেরিয়ে আসছে। বলছেন—

আমার যে মা পড়তে বসে
মন থাকে না ঘরে
মনটি আমার বাইরে যেতে
কেমন কেমন করে

ধর যদি পাখির সাথে
হারিয়ে আমি যাই
তুমি কি মা বলবে তখন
গল্প বলি আয়।

এভাবেই তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখে গেছেন– ভুতের বিয়ে, রাজারানী, মজার দেশ, সূয্যি মামা, হায় হায় পুশি, ঈদ এলে, টোকাই, ঘুমের ছড়া ইত্যাদি। এর মধ্যে দু’টি ছড়া একটু ভিন্ন স্বাদের। ছড়া দু’টির অর্থও ভিন্ন। দেখুন–

ভাষার ছড়া খাসার ছড়া
নয়তো ছড়া দুখের
ভাষার ছড়া আশার ছড়া
জীবন গড়া সুখের।

অথবা—-

স্বাধীনতা মানে নয়
মনে ব্যথা দেয়া
স্বাধীনতা মানে নয়
কেড়ে কিছু নেয়া

স্বাধীনতা মানে জানো
স্বাধীনতা মানে
খুশী মনে পথ চলা
সকলে তা জানে।

টুক টুকা টুক-এ খন্দকার মাজহারুল করিম নীরু’র প্রচ্ছদ এবং বাকী বিল্লাহ’র অলংকরণ ভালো। অবাচী প্রকাশন; ঢাকা থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৫ সালে।

খ. চলো সবে লড়ি

সাজ্জাদ বিপ্লব তার পূর্বের ছড়াগ্রন্থ ‘টুকটুকাটুক’ থেকে বর্তমান গ্রন্থে একটু সরে এসেছেন। টুকটুকাটুক-এ তিনি শিশু-কিশোরদের বিষয়-আশয় নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন ‘’চলো সবে লড়ি’ ছড়াগ্রন্থে তিনি উপস্থিত হয়েছেন এক লড়াকু মেজাজে। তার মেজাজ-মননে ঢুকে গেছে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ফটকা হাওয়ার বেলুন। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভারহীন আর সংগতিহীন আচরণ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের চারিত্রিক ধ্বস এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খণ্ড খণ্ড চিত্রাবলি। আছে বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদের ঘটনাপ্রবাহ। চলো সবে লড়ি–তে তার লড়াকু মেজাজের সুর শোনা যায়। তাই সব কিছুর ওপর তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান অমোঘ ও সত্য। তার ছড়া যেনো হয়ে ওঠে জীবনী শক্তি।
তিনি বলেন—-

ছড়া হোক মানুষের জীবনী শক্তি
ছড়া হোক সাহসীর নির্ভিক উক্তি
ছড়া হোক দেশটারে গড়বার যন্ত্র
ছড়া হোক শোষকেরে তাড়াবার মন্ত্র

ছড়া হোক যুগে যুগে শান্তির তুলনা
ছড়া দিয়ে পৃথিবীরে গড়তে ভুল না।

ছড়া দিয়েই শাসকদের কবল থেকে শোষণমুক্ত শান্তির স্বদেশ গড়ার মন্ত্রে নিজে যেমন উজ্জীবিত তেমনি অন্যদেরও লড়িয়ে যাবার মন্ত্র উচ্চারণে আবদ্ধ করছেন।
বলছেন—

মনে ত্রাস
বনে ত্রাস
ঘরে ত্রাস কি?
সব ত্রাস
সন্ত্রাস
উল্টিয়ে দি’।

সন্ত্রাস কবলিত এই দেশে তিনি সামাজিক অবক্ষয়ের ঘটনাগুলো তুলে ধরেন। যারা অবক্ষয় ব্যধিতে আক্রান্ত তাদের বক্তব্যগুলো শুনুন–

হ্যাপি হ্যাপি হ্যাপি
হ্যাপি নিউ ইয়ার
উদ্দাম নৃত্যে
চলে মাই ডিয়ার
দেশ যাক রসাতলে
করি না তো কেয়ার

অথবা—

দেশপ্রেম জনসেবা
কোন ধার ধারে না
খুন শুম হত্যা
নেই যা তা পারে না

নেতাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো কিভাবে এসেছে তার ছড়ায়—

নেতা বড়ো হিতৈষী
পরের দুঃখে কান্দে
টেস্ট রিলিফের মাল এলে
সবার আগে বান্ধে।

তারপর বলছেন–

ইচ্ছা হয় বলি–
গদি থেকে নামিয়ে তারে
পায়ের নীচে দলি।

এখানেই সাজ্জাদ বিপ্লব একজন কৌশলী ছড়াকার, নিজেকে উপস্থিত করেছেন উজ্জ্বল উপস্থাপক হিসাবে। তিনি ছড়াকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে দেখতেই অভ্যস্ত। সেই আন্দোলন খুনি আর অনিয়ম তাড়াবার আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূল অস্ত্র তার ছড়া।

লড়ার ছড়া
গড়ার ছড়া
নয়তো ছড়া ভাঙার

লড়ার ছড়া
ধরার ছড়া
চোর ও খুনি ডাঙার

লড়ার ছড়া
কড়ার ছড়া
নয়তো ছড়া নেতার

লড়ার ছড়া
মরার ছড়া
আন্দোলনে জেতার

এই আন্দোলনে লড়তে গিয়ে কোন বাধাই যেনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তিনি বাধাগুলো পেরোতে জেলে যেতেও রাজী। এতে কোন দ্বিধা নেই, সংশয় নেই।

পিছু টান ছাড়িয়ে
শত বাধা মাড়িয়ে
দেশটারে বাঁচাতে

হাতে হাত মিলিয়ে
মুনাফেক কিলিয়ে
চলো যাই খাঁচাতে।

‘চলো সবে লড়ি’ গ্রন্থের শিরোনাম ছড়ায় তিনি বলেন—

চলো সবে লড়ি–
হানাহানি ছেড়ে দিয়ে
উন্নতি করি।

তার আগে বলছেন—

আজ করে এই দল
কাল করে সেই
দেখে যেনো মনে হয়
কারো নীতি নেই

তাই দেখে বিদেশীরা
ছেড়ে দেয় বিনিয়োগ
উন্নতি না হলে
বাড়ে বলো কি নিয়োগ?

সাজ্জাদ বিপ্লব–একেক সময় একেক দোলের উপর দোলোনি দিয়ে ছড়া রচনা করছেন। তার ছড়ায় আছে– সালমান রুশদি, ইয়াসির আরাফাত, অংসান সু-কী, সার্বীয়া, চেচনিয়া, বাবরী মসজিদ, বিশ্বব্যাংক, সাপটা চুক্তির মতো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল। আছে জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, দেশের শীর্ষ নেতানেত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন, আমলাচরিত্র, সংস্কৃতির নানানমুখী স্খলনের দিক।
কবি আল মাহমুদ ও ছড়াকার শাহাবুদ্দীন নাগরীকে উৎসর্গীত ৩২ পৃষ্ঠার ‘চলো সবে লড়ি’র প্রকাশক অবাচী, ঢাকা। নিরু’র প্রচ্ছদ এবং বাকী বিল্লাহ’র অলংকরণ মানান সই। গ্রন্থটি ছড়া প্রেমিকদের ভালো লাগার।

গ. সাজ্জাদ বিপ্লবের সাম্প্রতিক ছড়া

‘চলো সবে লড়ি’র ২য় অংশ হিসাবে বিবেচনায় নেয়া যায় ‘সাজ্জাদ বিপ্লবের সম্প্রতিক ছড়া’ গ্রন্থটি। এ গ্রন্থটিতেও তিনি বাজেট, শেয়ার বাজার, স্বাধীনতা, সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক কালচার ইত্যাদি বিষয় উপস্থাপন করেছেন। ব্যতিক্রম ‘১৪০০ সালের ছড়া’। ১৪০০ সালের আগমন এবং বরণ আর প্রার্থনা এই ছড়ার উপজীব্য।
তিনি বলছেন—

চৌদ্দ শতক প্রাণের শতক নতুন শতক তাই
হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে এগিয়ে নিয়ে যাই

এই শতক হয়ে থাকে পৃথিবীতে সুখের
এই শতক কেটে দিক অমানিশা দুখের
এই শতক এনে দিক আমাদের শান্তি
দূর করে দিক সে আছে যতো ভ্রান্তি।

একইভাবে বাজেট নিয়ে পুণরায় জনগণের ভীতিকর এক অনুভূতির ধ্বনি তুলেছেন তিনি। বাজেট সম্পর্কিত ভীতিকর পরিবেশ থেকে তিনি কামনা করেন এক মঙ্গলময় বাজেট।
বলেন—

এ বাজেট একদিন শান্তি ফিরে আনুক
বাজেট মানে ভীতি নয় দেশবাসি তা জানুক।

সাজ্জাদ বিপ্লবের ছড়ায় যেমন দোল আছে, দোলের ভাংচুর আছে তেমনি কিছু কিছু ছড়ায় দোলের পতনও আছে। তিনি ছড়ার গ্রন্থ ঘিরে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার, সর্বস্তরের ঘুণে ধরা দিক গুলো নিপুণ চোখে খুটে তোলার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের সাম্প্রতিক ছড়ার প্রচ্ছদ টিপু ইসলাম কৃত, প্রকাশক পার্বণ, বগুড়া। বিপ্লব ছড়ায় নিবেদিত হোক, এমনই প্রত্যাশা পাঠকদের।

[প্রসঙ্গ: সাম্প্রতিক বগুড়ার ছড়াগ্রন্থ, ছড়াপত্রিকা ও ছড়ার ভাষা, মনজু রহমানঅন্তমিল, ডিসেম্বর ২০০৪, বগুড়া।]

চলো সবে লড়ি প্রসঙ্গে

৯. সাজ্জাদ বিপ্লবের কাছ থেকে ভবিষ্যতেও এরকম ছড়ার বই আমরা আশা করি। কারণ, বর্তমান বিশ্বের নির্যাতিত মানবতার স্বপক্ষে যিনি এমন জোরাল বক্তব্য রাখতে পারেন তাঁর কলম কখনোই যেন থেমে না যায়।

[কিশোর পত্রিকা, জুন-জুলাই ১৯৯৫)

১০. দেশের সমস্যা ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা ও বিষয় স্থান পেয়েছে বইটির বেশ কিছু ছড়ায়–যা ছড়াকারের মানবতাবাদী মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরে।

[কিশোর তারকালোক, অক্টোবর ১৯৯৫]

১১. সাজ্জাদ বিপ্লব সমাজকে দেখেছেন চূর্ণিতভাবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুনে ধরা যে অণু- পরামাণু রয়েছে তার বৈকল্যতা চোখ এড়াতে পারেনি। সকল দিকই উঠে এসেছে ছড়ার মাধ্যমে।

[সাপ্তাহিক বিক্রম, মার্চ ১৯৯৫]

টুকটুকাটুক প্রসঙ্গে

১২. বাংলা সাহিত্যে ছড়ার জগতে নব্বই দশকে যারা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাদের মধ্যে সাজ্জাদ বিপ্লব একজন।

[কিশোর নিউজ লেটার, সেপ্টেম্বর ১৯৯৫)

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা