প্রচ্ছদকবিতাগুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন

গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন

স্মৃতি

স্মৃতিতে সে ফিরে ফিরে আসে না ফেরার দেশ থেকে আজও
যাবার কি খুব তাড়া ছিল তবু সে চলে গেছে কোনো পূর্বাভাষ ছাড়াই
একবারও ভাবল না কী কী সে রেখে গেছে কার জন্যই বা রেখে গেছে
এলোমেলো জানালা জলের অভাবে শুকনো মাটির টব সাদাকালো দুপুরবেলা
নতুন বালিশে তোমার আর মাথা রাখা হলো কই চিলেকোঠার মেহগনি খাটে

পাড়ায় আজ মঞ্চ সাজিয়ে পালাকীর্তনের ধুম চলেছে সন্ধ্যের শুরু থেকেই
নদীয়ার প্রখ্যাত কীর্তনীয়া সতুমহারাজ পুরো দল নিয়ে নেমে পড়েছে ধরাতলে
সারারাত গান ভোরবেলায় হয়তো দূরের ছেলেরা হাজির হবে সঙ্গে মেয়েরাও
ভালো থাকতে হলে ভালো কিছু কাজ করতে হয় তুমি ছিলে ভালো কাজের মানুষ
যারা দেশটা উচ্ছন্নে গেল বলে শুধু হাহুতাশ করে মরে তারা কেউ ছিল না পালাকীর্তনে

শ্যাম বড় না কুল বড় আমরা কেউ কিন্তু ভাগাভাগির মধ্যে নেই এই মধ্য সন্ধ্যায়
শুনেছি তোমার নাকি ছিল সুরেলা গলা যদিও তোমার গান শোনার সুযোগ ঘটেনি কখনও
নিভৃতে কান্নার মতো তোমার সেই গানে আচ্ছন্ন হতো আকাশ বিধুর হতো বাতাস
তোমার শরৎকাল তোমার হেমন্তকাল হয়তো তুমি ভুলে গেছ কিন্তু তারা কেউ ভোলেনি তোমায়
কীভাবেই বা ভোলা যায় যখন অগ্রহায়ণে আজও শিশিরকণার মতো ছড়িয়ে থাকে তোমার দিন ও রাত

হারিয়ে গেছি

আমি ঘুমের মধ্যে একদিন হারিয়ে গেছিলাম এক নদীর ধারায়
নদীর নাম আমার জানা ছিল না নদীর বাবার নামও নয়
অথচ আশ্চর্য নদী আমাকে সম্বোধন করেছিল আমার ডাকনামে
বলেছিল এতদিনে সময় হলো আমার কাছে আসার
আমি তো অপেক্ষায় আছি সেই অন্ধকার ফুটে ভোর হবার প্রতীক্ষায়
চলো তোমাকে নিয়ে যাই আমার তলদেশের বৈঠকখানায়
ভেজা নরম মাটির গন্ধে তোমাকে সেখানে সম্ভাষণ আজ আমার

কোনো কোনোদিন আমার হারিয়ে যাবার কোনো ঠিকানা থাকে না
গ্রাম ছাড়িয়ে গ্রাম গ্রাম পেরিয়ে বিস্তৃত জলাভূমি বেবাক টাঁড়
দেখা হয়েছিল এক গ্রাম্য উদ্ভিন্ন বালিকার সঙ্গে তার কুটিরের দোরগোড়ায়
বিস্মিত স্বরে বলেছিল তার জানা ছিল না আমার এই অযাচিত আগমনের বার্তা
প্রস্তুতি নেই তাই অতিথি সৎকারেরও নেই কোনো সম্বর্ধনাসভা আয়োজন
ঘুমের রাত্রি নামে চারিদিক নিঃস্পন্দ নির্বাক বালিকার চোখেও নেমে আসে ঘুম
আমার জানা ছিল না আমি আজ হারিয়ে গেছি কোন নির্বাসনে কোন অজানায়

পর্যটন

সারাটা দিন শুধু হাঁটা বোসপাড়া থেকে ঘোষপাড়া
কখনও বা একটু ছোট্ট করে ছুটে যাওয়া সেনপাড়ায়
আমরা যারা মিত্তির পাড়ায় থাকি আজন্ম থাকি
কতবার যে ভেবেছি এই পাড়াতেই আমাদের নাকি সব চাষবাস

আর গাঙ্গুলিদের গোয়ালঘরের বাঁপাশে গোঁত্তা মেরে
ঢুকে যাওয়া যে মোরামের পথ
কতবার যে ভেবেছি এখানেই পাতব আমাদের রাজ্যপাট
মাথার ওপরে থাকবে লালনীল চাঁদোয়া আকাশ
আর থাকবে আদ্যিকালের একটা সিংহাসন কিছু খোলা তলোয়ার

সন্ধ্যেবেলায় সবাই নামগান গায় কার নামগান কারাই বা গায়
সোনাঝুরি বন থেকে উড়ে উড়ে আসে সোনালি কত যে গাছ
আমাদের কোনো কাজ নেই আমরা বান্ধবীরা খেলি গুটিসুটি খেলা
ছায়া ছায়া ছায়ালোকে কখন যে ভেসে ওঠে রাতের রাজারানী নক্ষত্ররা

গাছ কি কখনও মরে যায় মরে নাকি কখনও কোনো গাছ
আমরা জানি সব গাছ জেগে থাকে সারাটা দিনরাত
গ্রীষ্মকাল থেকে বসন্তকাল একটানা বেজে যায় মৃদঙ্গ পাখোয়াজ
অথচ আমাদের আজও যাওয়া হয়ে ওঠেনি আরও কত এপাড়ায় সেপাড়ায়
শুধু ভাবি ভালোই তো আছি বেশ কুয়াশামাখা এই প্রাচীন পরগণায়

রেলওয়ে জংশন স্টেশন

একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই রেলওয়ে জংশন স্টেশনে বসেছিলাম
যেখান থেকে আমি ইচ্ছেমতো চলে যেতে পারি দিশা থেকে বিদিশায়
চোদ্দটি প্ল্যাটফর্মে চোদ্দটি ট্রেন ছিল দাঁড়িয়ে গন্তব্য আলাদা আলাদা
আমি অনিশ্চয়তায় ভুগছিলাম কোন ট্রেনের যাত্রী হয়ে যাব কোথায়
সব ট্রেনই হুইশেল বাজিয়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল
দোনামনা করতে করতে আমি উঠে বসেছিলাম এমন এক ট্রেনে
যে ট্রেন আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল আমার বাবার ভিটেবাড়িতে
কিন্তু বাবা তো নেই আমার কবেই বাবা চলে গেছে কোথায় যেন কোন পরপারে
পরিত্যক্ত ঘর দালান উঠোন তুলসীতলা ধূসর আসবাব তৈজসপত্র
তাহলে কি আমার গন্তব্যে ছিল কিছু ভুল ভুলোমন ফিরে এসেছিল জংশনে

এবার হয়তো যাব আমি মায়ের সন্ধানে যদিও জানা নেই যাব কোন ট্রেনে
মায়ের স্মৃতি মনে পড়ে ধেয়ে আসে মায়ের শরীরের গন্ধ আবেগী আদর
মা আমাকে বলেছিল ভুলে যাসনি কখনও আমায় তুই ছাড়া আমার কে আছে বল
অথচ আমাকে না জানিয়েই মা একদিন চলে গেছিল কোন অজানায়
আমি জানি আমাকে আরও একদিন যেতে হবে সেই রেলওয়ে জংশন স্টেশনে
শুধু জেনে নিতে হবে কত নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে কোন ট্রেন যাবে মায়ের বর্তমান ঠিকানায়

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. পড়লাম। ভালো লেখা। কাজল সেন আমাদের প্রিয় কবি ও প্রিয় মানুষ। লেখা গুলোর ভেতরে একটা ছায়া ছায়া ভালোলাগা আছে, যা পাঠ শেষের অনেক ক্ষণ পর্যন্ত একটা ভাবনার ঘোরে আবিষ্ট করে রাখে। পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পারে অনায়াসে। কাজল সেন এর কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে সারল্য। সহজ কথাকে জটিল করে না তুলে সহজ করে পরিবেশন করা। করতে পারা। এটা একজন কবির পক্ষে একটি বিশেষ দক্ষতা। সবাই পারে না এই কারুকাজ। সারল্যই তো কবিতার সব চেয়ে দামি অলংকার। কাঠিন্যের জটিলতা থেকে কবিতাকে মুক্ত করার দায়িত্ব তো কবিরই। নইলে কবিতার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ জন্মাবে কী করে? এমনিতেই কবিতার কাছে দাঁড়ানোর মানুষ কম। শিল্পকে হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে পাঠক তো আরও দূরে সরে যাবে। এদিক থেকে দেখতে গেলে কবি ও পাঠকের মধ্যেকার সেতুটিতে বেশ স্বচ্ছন্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে কবি কাজল সেন এর কবিতা। এটাই তাঁর বিশেষত্ব। এটাই তাঁর দক্ষতা।
    ভালো থাকবেন কাজলদা। শ্রদ্ধা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা