spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাগুচ্ছ কবিতা : কামাল আহসান

গুচ্ছ কবিতা : কামাল আহসান


গাজা শিশুর ঘুমেরা
………….

কাগজ একটি অচ্ছুত পদার্থ, কলম চলবে
বৈঠার মতোন লাগানো যাবে না হাত।
কলমের ঠোঁট থেকে এখন কাগজ
যাচ্ছে সরে, অফসেট প্রিন্টারের ঘরে ঘরে।

ওড়নার পাড়ের মতোন বিপ্লবেও হেডিং
হবে খুনেরাই, হবে স্বচিত্রের খবর ধারাবাহিক।
আজ রাতে হবে গাজায়
শহিদ শতশিশু, চাই লিখতে কাগজ!

প্রথম নাতির মতো ভাগ্যবান তুমি ওহে ২০১৪ সন।
এতো শিশুশহিদ একত্রে ঘুমাইতে
এই এলো প্রথম তোমার কোলে।
হাসতে হাসতে কেঁদে দিচ্ছে আজকের পৃথিবীর ঘাস,
স্বামী-সন্তান হারানো এক রাফেজার মতো।
গাজার শিশুর সমান উচ্চতা পৃথিবীর কোনো পাহাড়ের নেই।

…………….
আজ আমি খুনি হবো
…………….

আজই একটি কুকুর মারবো!
ইসরাইলীদের উপর প্রতিশোধের প্রতিক হবে এটা।

কুকুর আধা-নিরীহ প্রাণী, ঠিক হবে না এ খুন।
তবে যদি পাগলা কুকুর মেলে, ওদের সমান রাখে মান।
খুন চেপেছে মানবতায় ধরতে নিজের দান ।

আমি জেগে থাকি ধনুকের তীর।
আপনারা কি আরব বাদশার মতো,
ফিলিস্থিনি শিশুর রক্তের ঘ্রাণে সুখ নিদ্রা যান?

………….
পাখিরূপ
…………..

আমিও যখন পাখি হই, ডানা দু’টো মাঝে মাঝে
মা পাখির মতো ক্লান্ত হয়, বনের উপর যেতে যেতে।

বাজ পাখির সুতীক্ষ্ম দৃষ্টির মতন পৃথিবীকে দেখি!
তার সব সুন্দর ভূমিতে হাঁটছে মানুষ।
উড়তে উড়তে দেখি আমি, আফগান, ফিলিস্তিন,
ইরাক, সিরিয়া; আমার বদলে যায় পাখিরূপ।

ভাবছি সরল দোলকেই উড়ো পাখির ভাবনা;
নারী ও শিশু হন্তারক ওরাও কি মানুষ না?
অমন বিভৎসের খোলে, রূপ বদলে
মানুষ হতে তাই পরাণে ভীষণ ভয় দোলে।
আমি চুপ, সুতীব্র রকম চুপ;
আমারও ভালো লেগে ওঠে পাখিরূপ!

………….
বগুড়ার আসমান
………….

চারদিকে সাদা সাদা হাঁস উড়ছিল সেদিনের বগুড়ার আসমানে!
স্মৃতির শরীরে ঘুণপোঁকা ধরেছে;
অবলীলায় পড়ে গেছে চর, শুনে আপনার সমাপ্তি!
চারদিকের সাদা হাঁসেরা মুহূর্তে হলো আফ্রিকান কালো।

নাজ কমপ্লেক্সে সাপ্তাহিক আড্ডার হাজিরা চিকন সিঁড়ির দোতলায়,
সেই শুক্রবার বগুড়ার আসমানে উড়ছিল সাদা সাদা হাঁস!
এখনই আরম্ভ হোক কবিতার জোয়ার!
বললেন তিনি শরমে ভরানো দুই চোখ চকচক করে হাসছিল।

তখনও সাদা সাদা হাঁস উড়ছিলো আসমানে;
জানালার ফাক দিয়ে দেখা গেল বগুড়ার আসমান।
আজো কয় কথা, শাহ সুলতান, শীলাদেবী, মহাস্থানগড়।
আর বেহুলার বাসর ঘর করছে চিৎকার,
আমি উপাখ্যান আর এই ঘরে ঘুরছে কবিতা।

লক্ষীন্দরও লিখছে গীতিকা, বগুড়ার আসমান দেখে দেখে;
যে বাতাসে শাদা শাদা হাঁসেরা উড়ছে।
শূণ্য, আজ শূণ্য, আজ সব শূণ্য।
বগুড়ার আসমান দিয়ে আজ কালো কালো হাঁসেরা উড়ছে;
ভয়াবহ এক একটি ব্যথায়, ব্যথার থেকেও শেষবার মৃত্যুরাও নিয়েছে বিদায়।

…………….
গণতন্ত্রের মানচিত্র
……………..

পৃথিবী দেখতে ভালো!
কত সুন্দর প্রকৃতি ধরেছে শরীরে।
নারীর সোহাগে ভালোবাসে না তোমাকে,
এমন কেহই নেই, পাওয়া যায়নি খুঁজে।

সবাই তাহলে ভলোবাসে তোমাকে পৃথিবী!
নক্ষত্রের যত বুক খোলা হোক,
দেখা যাবে পৃথিবী তোমার মুখ।
আমৃত্যু তাকিয়ে থাকবো মানচিত্রের দিকে পৃথিবীর।

পুঁজিবাদী গনতন্ত্রের তামাশা দেখায়,
এতোই মত্ত হই আমি।
কয়েক হাজার রাত ঘুমহীন, শুধু
আমেরিকার মানচিত্রের দিকেই তাকিয়ে থাকা যায়।

পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের চেহারা যেন,
পৃথিবীকে বার্তা দিতে দিতে যাচ্ছে।
দাজ্জাল আসছে, দাজ্জাল আসছে!

……………
মোনাফিক থাকে ঘরেই, বাইরে নয়
……………

অনেক সাহস করে একখন্ড তুলা
নিক্ষেপ করেছিলাম সবুজ আকাশে।
ইমাম হোসাইনের রক্তের মতন রঙ নিয়ে ফিরে এলো,
চৌদ্দশত বছর সাঁতরে ইতিহাসের শরীর।

দয়া করে শিয়া-সুন্নী দন্ধটা থামাও ইরাকিরা!
আর সিরিয়ার বাদশা থামাও ক্রোধ!
চানক্যের শাস্ত্র চেপে ধরেছে মাথাটা তোমাদের,
নবরূপ, মুনাফিক রপ্তানি করছে আমেরিকা, ইউরোপ!

………………
কবিরাজ্যের পর্যটক

………………

মেঘের সকাল ফাঁকি দিয়ে ঠোঁটে পেয়েছিস রাগ,
ঘরের আলোয় গড়া রাতে দেখিসতো অনুরাগ!
হাঁটার সড়ক কাঁধে ওঠে ঘাটের দিকেই আসে,
আমার জমায় বিঘ্ন হলে শুনতাম ভালোবাসে।

হাতের গড়ন ধরে ঋতু আমার সম্মুখে,
আমি তোমার বসন্ত শীত আগুনের মুখে।
রোদের ঝলক লাগে ঠোঁটে নামেনি বিকেল,
তোমার হাতের বালা জোড়া কবিরাজ্যে জেল।

বারুদ বিহীন অস্ত্র জমা রাতের নজরে,
পাহারাহীন কবিরাজার থাকবি অন্তরে।
কবিরাজ্যে ঘুমায় না কেউ কারো আগে পরে,
দেশ গহনার ধরণ গড়ন চিত্র আঁকে ঘরে।
রাজার আসন নয় সিংহাসন স্বর্ণে গড়া টুল,
কাগজ কলম সব প্রহসন, কবিতাই আসল।

…………….
রিমান্ডে বখতিয়ার খিলজী
……………..

তোমার কি মনে পড়ছে তানিজা?
আমার মুখস্থ ছিলো লক্ষণ সেনের একটি দীর্ঘ কবিতা।
ঘোড়ার খুরের শব্দে ভুলে গেছি।

বখতিয়ারের বিরুদ্ধে এটা কবিতা আপার মতো,
আমার একটি গতিময় অভিযোগ।
যার দাখিলেই আজ হতো মঞ্জুর দীর্ঘ রিমান্ড।
সেন বাবু না পালালে তবে, আমি আর ইতিহাস মিলে;
কবিতা আপার কোর্টে মামলাটা লড়তাম।

কবি কখনো পরাজয়ের সাথে পরিচিত হয় না তানিজা!
রিমান্ডের কালি দিয়ে কবিতাই লেখে আপা,
খুরের শব্দের থেকে রাজা পালানোর অন্ধকার,
বেশি ভুলিয়ে দেয় মুখস্থ কবিতা।

…………….
লক্ষ্য আমার স্বদেশ
……………..

কিছুটা সুন্দর আঘাত করতে পারো বন্ধুরা আমার!
যতোটা করছো তার চেয়ে ঢের বেশি।
দ্রæতগামী সেই যন্ত্রণা পৌঁছাবে খুব তারাতারি,
হৃদয়ের কোলাহল ভেঙ্গে চুরমার করে।

কাজী নজরুলের বুলবুলির বসবাস এখানেই,
এখানেই বিশাল নার্গিসবন।
জসিম উদ্দীনের আসমানী জন্মেছে এখানে, বহুযুগ
আগে রচিত হয়েছে কবর তাঁরও আমার স্বদেশে।

………..
সভ্যতা
………..

সভ্যতারা সর্বদাই আমার পেছনে পেছনে থাকে,
প্রগতিরা থাকে সামান্য মানব ছায়ার আড়ালে।
কলাপাতার মতন আমি দোল খাই সভ্যতায়।

প্রগতিশীল বাতাসের অনেক উপর দিয়ে
বয়েই চলেছি সত্যনিষ্ঠার সংসারহীন হয়ে।
সভ্যতার শরীরে কারা কালোরঙ পোশাক পরাও?
পশুর বদলে কলাপাতা পুড়ে দাও মানুষের মুখে?

…………….
কামাল আহসান

(০২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ — ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১)

কবি কামাল আহসান একজন আধুনিক বাংলাদেশি কবি ও সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে ৯০ দশকে যে কয়েকজন মেধাবী কবির আবির্ভাব ঘটে তার মধ্যে কবি কামাল আহসান অন্যতম। জীবন বিশ্বাস যার স্রষ্টার প্রতি। কবিতার ছন্দে ছন্দে সেই বিশ্বাসের স্ফুরণ পাখনা মেলে। এছাড়া সত্য, সুন্দর, একেশ্বরবাদ, পরকাল, নবী-রাসুল, দেশপ্রেম ও প্রেম-ভালবাসার মত ইতিবাচক বিষয় আসয়ই ছিল তার লেখার মূল অনুষঙ্গ। জীবন ও স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী এই কবির প্রথম গল্পগ্রন্থ (প্রণয়দষ্টিতা ১৯৯৬) প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য অঙ্গনে তার যাত্রা শুরু হয়।

জন্ম ও ব্যক্তিগত জীবন
………..

কামাল আহসানের জন্ম ১৯৭৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারী পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার উত্তর কেশবপুর গ্রামে। তার পিতার নাম মোহাম্মদ চান মিয়া, মাতা সুফিয়া বেগম। তারা ছিলেন দুই বোন ও এক ভাই। পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ( মুসফিকা মল্লিক তুলি) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির এক মেয়ে (কাইফা কামাল সাওদা) রয়েছে। পারিবারিক ভাবে কামাল আহসান সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনো ছোঁয়া পাননি। সাহিত্য অঙ্গনের কিছু বড়ভাই ও বন্ধুদের হাত ধরে সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ তার। এরপর থেকেই তিনি সাহিত্য অঙ্গনে মনোনিবেশ করেন।

শিক্ষা ও কর্মজীবন
……….

শিক্ষা জীবনে কামাল আহসান ১৯৮৯ সালে কেশবপুর এন এস মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাশ করেন। এরপর তিনে চলে আসেন বরিশালে। সেখান থেকে ১৯৯২ সালে অমৃত লাল দে কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেন। এরপর বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে এম এস এস পাশ করার মধ্য দিয়ে তিনি তার শিক্ষা জীবন শেষ করেন। এরপর কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করনে। এছাড়া তিনি শেকড় সাহিত্য পত্রিকা ও বেশ কয়েকটি অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেন।

রচনাবলি
………..

কাব্যগ্রন্থ
১. আহসান জেনে গেছে বরফের ছল (২০০০)
২. মানুষ মানুষ বলে সুনাম ছাড়াবো (২০১৮)
৩. বিমুগ্ধ সন্ধ্যার গান (২০২১)
৪. রঙের রাধিকা (২০২৪)

গল্পগ্রন্থ
১. প্রনয়দষ্টিতা (১৯৯৬)

কবি কামাল আহসান ফাউন্ডেশন

কবি কামাল আহসানের সৃষ্টি সংরক্ষণ, প্রকাশ ও প্রচারের জন্য ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখ গঠিত হয় কবি কামাল আহসান ফাউন্ডেশন। কবি নয়ন আহমেদ চেয়ারম্যান, কবি আল হাফিজ কো-চেয়ারম্যান ও কবি পথিক মোস্তফাকে সদস্য সচিব করে এই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আছেন কবি সালমান রাইয়ান, সজীব তাওহিদ, ইয়াসিন হিরা, ফিরোজ মাহমুদ, হারুন আল রাশিদ, মিতা মোস্তফা, রিয়াজ আহমেদ, সাফিন রিয়াজ, শামিম রসুল, মৃন্ময় হাসান প্রমুখ। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন, কবি পত্নী মুশফিকা মল্লিক তুলি, ভাগ্নে হাফিজুর রহমান হিমেল, হাসান আল বান্না প্রমুখ।
কবি কামাল আহসানের গ্রন্থ প্রকাশের স্বত্ব এই ফাউন্ডেশন সংরক্ষণ করে।

মৃত্যু
…….

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় কামাল আহসান মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ