জন্মদিনে কবি
একজন কবির জন্মদিনে আরেকজন কবি শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন–
শুভেচ্ছা বার্তার সঙ্গে একটি ছবিও করছেন পোস্ট
ছবিতে থাকছেন একজন মন্ত্রী, একজন সংসদ সদস্য
একজন আমলা, একজন পরিচালক আর একজন নগর বাউল
ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না– কবি কোন জন!
কার জন্মদিনে তারা জানাচ্ছেন শুভেচ্ছা
এসব প্রাবল্যের ভিড়ে জন্মদিনের কবি যাচ্ছেন হারিয়ে
নাকি তাদের প্রতিটি জন্মদিনে ক্ষমতারও হচ্ছে জন্মদিন
নাকি ক্ষমতার জন্ম না হলে তাদের হতো না জন্ম
নাকি কবিকে একা ছাড়তে তাদের লাগে ভয়
তারা কখনো যায় পিরের দরগায়
কখনো মার্কেসের কারখানায়
তারা কেবল পারে না দাঁড়াতে নিজের পায়
নাকি তারা দিতে চান এমন কোনো বার্তা
নাকি বলতে চান- আমরাই রাষ্ট্রের অধিকর্তা
আমরাই কবিদের স্বীকৃতি করি দান
আমরাই দিয়ে থাকি কবিদের ইনাম
হয়তো কবিদের নিজস্ব দেশ হয়ে গেছে দখল
তাই প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে এসব কবিতার নকল
নাকি বিগত স্বেচ্ছাচারি কবির কঙ্কাল এসেছে ফিরে
নাকি দুই হাজার বছর আগে প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে
যে সব কবিকে করেছিলেন বিতাড়ন- এরা কি তারাই
যারা নগর প্রান্তে কবিতার মতো ঝাড়ে বুলি
আর দার্শনিকতার নামে বাজায় সিটি
আর সাবধান করে অনাগত কবিদের-
বলে, তফাৎ যাও মেহের আলী–
এখন ক্ষমতা ছাড়া কবিতা অচল
সমস্বরে বল আমরাই কবি, বাকিরা নকল
বল হরি বল, আমরাই কবি অন্যরা ছল!
…..
প্রভুর কাছে প্রার্থনা
প্রভু আমার মা-কে ক্ষমা করে দিও
বাবাকেও
বড় ভাই– তাকেও
আমার এক বোন ছিল জয়নব
সবার বড়– আমার জন্মের আগেই চলে গেছে সে
সে নিশ্চয় এখন তোমার বাগানে খেলা করে
যেহেতু সে মরেছিল সাপের কামড়ে
আর আমার সেজো বোন
সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে
ফেরেনি আর চেতনার জগতে
বোনটা খুব প্রিয় ছিল আমার- মায়ের পরে
গত বছর চলে গেল মেজ বোনটাও
তাকেও তুমি ক্ষমা করে দিও
আর আমাদের পাশে রব্বেল, রব্বেলের মা
তার বাপটাও মরে গেছে কয়েক বছর আগে
তার এক বোন ছিল
মরেছিল আগুনে
তারা তো আমাদেরই প্রতিবেশি
তুমি তাদেরও ক্ষমা করে দাও
তুমি কাউকে রেখো না আগুনে
এমনকি গরুগুলো, বকরির বাচ্চাগুলো
হাস ও মুরগিগুলো
ওরাও তো ছিল
যদিও তাদের আমরা রসনায় দিয়েছি
তবু ওরাও তো বেঁচে আছে তোমার জগতে
তোমার ভুবনে তো কেউ মরে না প্রভু
এক ঘর থেকে যায় আরেক ঘরে
এক দেশ থেকে আরেক দেশে করে ভ্রমণ
প্রভু আমাদের এই গ্রামটিও ছিল বেশ ভালো
এখানকার লোকজন মায়াময় খুব
পাক-মিলিটারি দিয়েছিল জ্বালিয়ে
কাঁচা রাস্তা বাঁশ ও খড়ের ঘর
বৃষ্টি হলে কাঁদা হয়ে যেতো
পাশের নদিতে করেছিল গোসল
এমন একটি গ্রামই না হয় দিও পুনরায়
শুনেছি তোমার উদ্যানে অনেক জমি
গাছ নদি ডালিম আঙুরকুঞ্জ
দুটি আম গাছও রাখিও সেখানে
খর্জুর কণ্টকের পাশে বড়ই বৃক্ষের কাঁটা
বেমানান হবে না নিশ্চয়
মন্ত্রী মহোদয়কেও করে দিও ক্ষমা
আমরা খেলা করবো
ফ্রকপরা মায়ের সাথে
হাফপ্যান্ট পরা পিতা
তাদের পিতারাও তো আসবে খেলতে
মায়েদেরই বা কি কাজ
তোমার দুনিয়ায় যেহেতু বার্ধক্য নেই
নেই মৃত্যু
যে সব বালক-বালিকা খেলে বেড়ায় তোমার উদ্যানে
তাদেরও তো মা-বাবা নেই- উদ্দাম অবুঝ
চাকরির অবসর শেষে
আমরাও কেউ থাকব না পিতা
কারো পুত্রের দায়িত্ব হবে না নিতে
কেউ আর তখন বোন নই, ভাই নই–
খেলা শেষে প্রত্যেকে একা চলে যাব–
যার যার বাড়ির পথে।
…..
বেহালা
আজ সন্ধ্যায় একটি বেহালা আমার হাত বেয়ে উঠে আসার আগে তুমি দেখে ফেললে বাইশ রাত জেগে থাকা নাইট কুইনের সঙ্গীরা। রানির বাচ্চা প্রসবের আগে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে শ্রমিক মৌমাছি। যারা গতরাতে সঙ্গমে মিলিত হয়েছিল– অবশেষে রানির হুলবিদ্ধ মৃত্যু- সেইসব পুরুষের লাশ নিয়ে অন্য এক উৎসব চলছে পাশের কামরায়। আমি তো বেহালাবাদক ছাড়া কিছু নই। রাস্তার ধুলোর মধ্যে যে সব বেওয়ারিশ গান মলিন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে ছিল বহুদিন– কবীর সুমনের গিটারে আশ্রয় না পেয়ে তারাই তো আমাকে বাজিয়ে চলেছে অবিরাম। রুগ্ন রাতের মধ্যে তুমি কি বেহালার স্পন্দন টের পাও? বুকের ব্যথার মধ্যে তুমি কি বেহালার ধুকপুকানি শুনতে পাও? বাগানের শীতের মধ্যে যে সব সাপ শিশু পরম নিশ্চিন্তে শুয়েছিল কাল তারাই তো আমাকে এনেছিল উদ্যানের পথে। যেখানে অনেক লম্বা গাছের সারি তাকিয়ায় ভর দিয়ে বেদনাকাতর রমণীরা মৃতদের পথ চেয়ে আছে। মরণ ছাড়া তাদের মিলিবার পথ খোলা নাই।
…..
অখণ্ড স্মৃতি
যখন আমি হাঁটতে পারতাম– দেখতে পারতাম আমার শরীর
যখন আমি কথা বলতে পারতাম– আমার আমির সঙ্গে
যখন আমার জন্ম হয়েছিল অখণ্ড গোলকের ভেতর
যখন আমরা খেলা করতাম অশ্বিনী কুমারদের সঙ্গে
যখন আমরা সরযূ নদীতে স্নান সেরে রোদ পোহাতাম অগস্ত্যয়
তখনো তোমাদের জন্ম হয় নাই
তখনো তোমরা শীতের কামড় থেকে বাঁচার জন্য
একটি আধপোড়া কন্দে কামড় দেয়ার জন্য
সহস্র মাইল সমুদ্র দিয়েছিলে পাড়ি
তোমাদের হাতে ছিল গন্ধকের গুলি
আমরা বাঁচার জন্য ছত্রখান হয়ে পড়লাম
গড়ে তুললাম বিভেদের প্রাচির
একদিন তোমরা যদিও পাত্তাড়ি গুটালে খণ্ডের ভেতর
আমাদের হৃদপিণ্ড ও যকৃতের মধ্যে করে দিলে ভাগ
আমরা এখন নিজেদের দেখতে পাই না
আমরা এখন আমাদের নামে বিভাজিত
কেউ গঙ্গার জল তুলে সন্ধ্যা অহ্নিক
কেউ পদ্মার পানি নিয়ে অদৃশ্য পশ্চিমে
এখন আর কেউ আমাদের যেতে দেয় না আমাদের কাছে
একটি খণ্ডিত হৃদপিণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে হয়
ভাই পানি তুমি কেমন আছে
তুমি কি দেখতে পাও আমাদের গড়িয়ে যাওয়া জল
আমাদের মায়েদের কান্নার নদী
যারা এখানে এসেছিল একদিন পিত্রালয় ছেড়ে
যারা তাদের শৈশব নিয়েছিল কেড়ে
তাদের বেদনার্ত স্মৃতি
তাদের ফিরে যাওয়া স্বাদ
এখনো ঘুরে বেড়ায় অখণ্ড ভূমির ভেতর
অশ্বের ক্ষুরের মতো অভিন্ন অবাধ।
…..
কবরে শুইয়ে দেয়ার পরে
এক সময় ভাবতাম মরে যাব বলে সব কিছু দ্রুত দেখে নিতে হবে
সময় ফুরিয়ে গেলে পারব না, ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হবে না
কী কষ্ট করেই না পাহাড়ে ওঠার কসরৎ করেছি
বোকার মতো হিমালয় শৃঙ্গেও উঠতে চেয়েছি
পোখরায় মহাদেবের কেভ, ডেভিস ফল
মেঘের মধ্য দিয়ে বিমানের লক্কর ঝক্কর উড়ে চলা
আর কিছুটা হলে তো পা হরকে জীবন কাবার
মানুষ সব সময় বড় কিছু দেখতে চায়
বড় পাহাড়, বড় সমুদ্র, এমনকি মরুভূমিও বড় হতে হবে
ক্ষুদ্র তো বড়কে ধারণ করতে পারে না–
সময় ফুরিয়ে যাবে বলে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া
ললনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার জন্য তড়িঘড়ি করা
আর কবিতা লিখতে না পারলে ভীষণ মন খারাপ হওয়া
এসব তড়িঘড়ির কারণ হয়তো মানুষ খুব কম দিন বাঁচে
কিন্তু আজ কবরে শুইয়ে দেয়ার পর সব নিরর্থ মনে হচ্ছে
কারণ এখানে শুইয়ে সব দেখতে পাচ্ছি
আগে যা দেখা হয়নি সেগুলোও
প্রথম কয়দিন অবশ্য নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে
হাড় থেকে মাংস খসানো, একই সঙ্গে কোষগুলো বিচ্ছিন্ন করা
এসব করার কারণ অনেকদিন মন খুলে হাসব বলে
হাড্ডির সঙ্গে মাংস না থাকায় সারা শরীর দিয়েই হাসতে পারছি
জীবিতরা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সামান্যই হাসতে পারে
প্রথমে অনেক দিন হেসেছি বেঁচে থাকার বোকামির জন্য
সবকিছু দেখার তড়িঘড়ির জন্য
এখন হাসছি সব দেখার কি অফুরন্ত সময়!
জীবিতদের যদিও বড় কিছু দেখার প্রতি সর্বাধিক আগ্রহ
তবু তারা জানে না মৃত্যুর চেয়ে বড় কি ছিল!