আশরাফ আহমেদ
বিছানার পাশের টেবিলে অথবা বসার ঘরে সাধারণত আমার না পড়া বইগুলো রাখা থাকে। সেদিন শেষ না করা একটি খুঁজতে গিয়ে দুটো বই চোখে পড়লো। একটির নাম ‘আমাদের কাব্য’, অপরটি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা স্মারকগ্রন্থ চড়াখোলা’। বইদুটো উপহার দিয়েছিলেন কবি সুবীর কাশ্মীর পেরেরা। মাসখানেক আগের এক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকায় তিনি ক্ষণিকের তরে দেখা দিয়ে দুটি বই আমার হাতে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে বইগুলোর কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। চড়াখোলা হচ্ছে গাজীপুর জেলার একটি গ্রাম। বই দুটোর পাতা উল্টাতে একটি উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য চোখে পড়লো। তা হচ্ছে কোনোটিই ব্যক্তিবিশেষের একক রচনা নয়! বহুজনের লেখা সম্বলিত প্রথমটির প্রকাশক ‘বাংলাদেশ খৃষ্টান লেখক ফোরাম’, আর অপরটি ‘চড়াখোলা খৃষ্টান কোওপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড’ এর পক্ষে প্রকাশ করেছেন ফাদার বুলবুল আগস্টিন রিবেরু।
ওয়াশিংটন ডিসি এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশের খৃষ্টান সম্প্রদায় যে বিদেশে সঙ্ঘবদ্ধভাবে এবং গভীর মমতায় বাংলা সংস্কৃতি ধরে রেখেছে, তা বহুদিন ধরেই লক্ষ করে আসছি। বিদেশে যে কোনো অভিবাসী গোষ্ঠীই তা করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশেও যে তাঁরা ঈর্ষণীয়ভাবে এতো একতাবদ্ধ থাকে, তা জানা ছিল না। জেনেছি উল্লিখিত বই দুটি থেকে।
দ্বিতীয় বইটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চড়াখোলা গ্রামের প্রায় ৬০ জনের স্মৃতিচারণ রয়েছে। উল্লেখ্য, এদের প্রায় সবাই লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন অথবা নিজ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধার সংস্পর্শে এসেছিলেন। এর বাইরে যে ব্যাপারটির জন্য বইটিকে আমার শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে তা হচ্ছে যে বিনীত ও অনুপম ভাষায় ‘প্রারম্ভ নিবেদন’ নামে ভূমিকাটি লেখা হয়েছে তার জন্য। আর সেটি লিখেছেন কোনো ব্যক্তি নয়, লিখেছেন ‘স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনাসেবা পরিষদ’।
৫১ বছর ধরে বইটি লেখা বা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ না করার জন্য পুরো গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে ভূমিকার প্রথম বাক্যটি হচ্ছে ‘করজোড়ে ক্ষমাপ্রর্থী’! পাঁচ দশকের অধিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য হারিয়ে যাওয়ার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে ‘সর্বাপেক্ষা শুদ্ধতার সাথে (প্রকাশনা) কাজটি সম্পন্ন’ করার জন্য এই পরিষদ গ্রামের প্রতিটি পরিবারকেই সম্পৃক্ত করে ক্ষান্ত হন নাই। যদিও ‘এটি কোনো গবেষণাগ্রন্থ নয়’ বলা হয়েছে, ‘লেখক, তথ্য প্রদানকারী, তথ্যসংগ্রহকারী, সংযোগ স্থাপনকারী,ছবি উত্তোলনকারী, টাইপিংসেবা প্রদানকারী, পরিষদ সদস্য, সংবাদ বহনকারী, প্রচারণাসেবাপ্রদানকারী, পরামর্শ প্রদানকারীসহ আরো অনেকের’ সাহায্য’ নিয়ে লেখা বইটি গবেষণার কিছু আবশ্যিক উপাদানে সমৃদ্ধ। ফলে যে চারজন মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে বইটি গ্রন্থিত হয়েছে, তাদের বক্তব্যের মাঝে তথ্যের অসামঞ্জস্যতা আমার সীমিত পাঠে ধরা পড়েনি।
নির্ভরযোগ্যতার বিচারে বইটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। ভূমিকায় ‘এই গ্রন্থটির মালিক চরাখোলা গ্রামের প্রতিটি সন্তান’কে বইটি প্রকাশনায় সম্পৃক্ত হয়ে এবং প্রকাশিত বইটি পাঠ করে ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এখনও সম্ভব’ বলা হয়েছে, যাতে আমাদের জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের প্রতি পরম ও আন্তরিক আনুগত্যের ছোঁয়া স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
২০২৩ সালে ঢাকার ‘প্রতিবেশী প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত ৩৮৪ পৃষ্ঠার এই পেপারব্যাক বইটির মূল্য মাত্র ৩০০ টাকা ধরা হয়েছে।
অপর ‘আমাদের কাব্য’ খৃষ্টধর্মাবলম্বী চল্লিশজন কবির একটি কবিতার বইটি ২০২৩ সালে প্রকাশিত। পড়ার আগে বইয়ের পাতা উল্টালেই মনটি প্রসন্ন হয়ে যায়। প্রত্যেকের ছবি ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সহ তিন পৃষ্ঠা জুড়ে দৃষ্টিনন্দন স্কেচসহ সেই কবির পরপর তিনটি কবিতা। কবিতার লোক নই বলে মন্তব্য করতে পারবো না, তবে যে কয়টি পড়েছি সেসবের মর্মার্থ বোঝার জন্য কবিকে জিজ্ঞেস করা বা ডিক্সেনারির সাহায্য নিতে হয়নি, এবং কয়টিই ভালো লেগেছে। বইয়ের প্রকাশক বাংলাদেশ খৃষ্টান লেখক ফোরাম, যাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘লেখক সৃষ্টি করা, লেখকদের পরিচর্যা করা, ও লেখকদের জন্য প্লাটফর্ম তৈরি করা’। ‘আমাদের কাব্য ফোরামের চতুর্থ গ্রন্থ। এই বইয়ের কবিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করলেও আদিতে সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। কবিতার বিষয়ে বৈচিত্র্য থাকলেও কবিগণ একই সমাজভুক্ত বিধায় সেই সমাজের বিভিন্ন চিত্র পাওয়া যাবে বলে ভূমিকায় মন্তব্য করা হয়েছে। মুষ্টিমেয় দুয়েকজন ছাড়া সবাই এক বা একাধিক বই প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত, একজন তো বিখ্যাত ‘কালি ও কলম’ সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রবাদ আছে বাংলাদেশের দুজন লোক একত্র হলে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে অন্তর্কলহে লিপ্ত হন। ওয়াশিংটন ডিসি এবং যুক্তরাষ্ট্রের অপরাপর শহরে অগণিত সংগঠনই এর প্রমাণ দেয়। কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে আমাদের ডিসি এলাকার বাঙালি খৃস্টান কমিউনিটি। তাঁদের অনুকরণীয় এই একতার কারণটি নিয়ে মাঝে মাঝেই ভেবেছি। এবার বইদুটি দেখে ও পড়ে কারণটি পরিষ্কার হয়ে গেল। তাঁদের নেতা হওয়া ও এবং আত্ম উন্নতির পরিবর্তে গোষ্ঠী স্বার্থ ও গোষ্ঠীর উন্নতিই মূখ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বইতে যেমন দেখেছি, ‘আমাদের কাব্য’ সংকলনে সাত সদস্যের একটি সম্পাদনা পরিষদ থাকলেও নেই কোনো প্রধান সম্পাদক। নিজেকে প্রাধান্য না দিয়ে গোষ্ঠী উন্নতির শিক্ষাটি যদি খৃষ্টধর্মের শিক্ষা হয়ে থাকে, তবে সেই শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করা উচিৎ।
১৪ই জুন, ২০২৪
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সম্মানিত লেখককে বই দুটি সম্পর্কে চমৎকারভাবে পর্যালোচনা করার জন্য।