তৈমুর খান
এক স্বাধীন কবিসত্তা নিয়ে জন্মেছিলেন দেবারতি মিত্র। মানবজীবনের বহু পথ, বহু সংস্কার, প্রাচীন আবেগ প্রবৃত্তির অমোঘ বাতাবরণ তিনি বুঝেছিলেন একরত্তি বয়স থেকেই। তাই নিঃশ্বাসে ফুসফুসে কবিতার চলাচল টের পেয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন “বহুকালের সুখ, ক্রন্দন, হাহাকার, উৎসব, ইন্দ্রিয়ানুরাগ, অদম্য আবেগ, আরও নাম না জানা অসংখ্য সংস্কার ও প্রবৃত্তি আমার চেতনার মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকে। হঠাৎ একদিন অঙ্কুর, ডালপালা ফুলফলসহ কবিতা হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। কখনো কখনো অজান্তে কবিতা পিছন থেকে চোখ টিপে ধরে, তার রূপ গুণ বেদনা বৈভব আদ্যোপান্ত ঘাড় ধরে লিখিয়ে নেয়।” (‘শিলাদিত্য’ জুলাই সংখ্যা ২০১৪)। কবিতার শেকড় যে তাঁর জীবনের মাঝেই লুকানো আছে একথা বলাই বাহুল্য। ১৯৬৭ সাল থেকে এই ২০১৪ পর্যন্ত নানা বাঁকের ভেতর দিয়ে তিনি পথ হেঁটেছেন। প্রকাশিত হয়েছে বহু কাব্যগ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হল: অন্ধ স্কুলে ঘন্টা বাজে, আমার পুতুল, যুবকের স্নান, ভূতেরা ও খুকি, জঙ্গলে কাটুল, খোঁপা ভরে আছে তারার ধুলোয়, জীবনের অন্যান্য ও কবিতা, তুন্নুর কম্পিউটার, মুজবৎ পাহাড়ে হাওয়া দিয়েছে ইত্যাদি। সব কাব্যগুলির মধ্যেই আছে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের এক গতি নির্দেশক চলন। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় সে কথা বলেছেন “এ হল একজন অসফল,মর্মপীড়িত, ভ্রান্ত, নারীর দু’হাতের অঞ্জলিতে সময়স্রোত ধরবার একটা অস্থির চেষ্টা।” আর এই কারণেই প্রথম দিকের কবিতায় আছে চঞ্চল অথবা ছটফটে পৃথিবীতে আত্মসম্মোহনের বাতাবরণ। ঝরঝরে নদীর সমুদ্র যাত্রা। দিকচক্ররেখার প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন নিজের শরীরে কেঁপে ওঠা। অঝোর পাগল বৃষ্টিপাত। পুঞ্জপুঞ্জ অজস্র চুম্বন। কবি লিখেছেন:
“এখন সমস্ত দিন ছুটোছুটি ভারি ভালো লাগে
জারুল গাছের শাখা জ্বলজ্বলে হলুদ বিহ্বল
একটি ঘুড়ির কথা মৃদু জড়াজড়ি যেরকম
উচ্ছল বিকেলবেলা প্রত্যেকটি অনুভব আমি
গাঢ় লাল চিহ্ন দিয়ে আলাদা দেখিয়ে দিতে পারি
আমি এঁকে দিতে পারি নাম
উড়ন্ত অক্ষর খুঁজে কার ঠোট কাঁচা কালোজাম।”
(তরুণী পিয়ানো আর কিশোর)
ঝরনা-নদী-পাহাড় থেকে আকাশ-নিসর্গ-ঘুড়ি
উড়ন্ত অক্ষরের প্রাদুর্ভাব কবিকে আদিগন্ত এক মুক্তি প্রয়াসের প্রজ্ঞায় পৌঁছে দিয়েছে। যদিও তা এক ‘পাগলামি’ মনে হতে পারে , তবুও তা জীবনের গতিময় সদর্থক ক্রিয়ায় অভিসিঞ্চিত।যে কষ্টের জীবন, দমবন্ধ রুদ্ধশ্বাসের এক প্রায়ান্ধকার বিরাজ করেছে যা কখনো ‘পিঁপড়ের কষ্টের মতো’, অথবা ‘কেঁচোর স্বপ্নের মতো’ মনে হয়েছে কবির। সেই জীবনেরই তো মুক্তি আকাঙ্ক্ষা। স্বাভাবিকভাবেই কবি মেঘ-রোদ্দুর-হাওয়া বাতাসে মিশে যেতে চেয়েছেন:
“মানুষের প্রতিবিন্দু শোণিতের অমৃতত্ত্ব জানে,
একাকী সামলে চলে দুঃখহীন দুঃখের বিদ্রোহ।
একমাত্র মোহ যার ঝরে গেছে মৃত্যুর আড়ালে
প্রত্যহ সূর্যাস্ত থেকে রক্ত নিয়ে সূর্যোদয় জ্বালে।”
(সুকান্ত ও সূর্যোদয়)
সুতরাং প্রতিবিন্দু রক্তের মধ্যেই জীবনের আনন্দনাচ যেমন আছে, তেমনি প্রতিটি দুঃখের মধ্যেই দুঃখবিহীন বিদ্রোহ জেগে ওঠে। যে সময় কবি কষ্টের সীমানায় অন্ধপাতালের ভেতর নিজেকে খোঁজ করেন, অন্ধস্কুলের ছায়াঢাকা পাণ্ডুর দেয়ালে অপূর্ণ-সমাধি দেখেন—তখন সেই সময়ই বিধুর বিথার স্তব্ধালোকেও ঈশ্বরের মুখ মনে আসে। অন্ধস্কুল বদলে যায় বুদ্ধমন্দিরের খুব দীর্ঘ, দীর্ঘতর ঘন্টার বিরতিতে।
‘আমার পুতুল’ কাব্যে সমূহ অন্ধতার মধ্যেই এক বিস্মরণ খেলা পেতে বসে। এক ঘোরলাগা পাখি নেমে আসে দৃশ্যের ভেতর। অনৈশ্বরিক বেদনায় শরীর জেগে ওঠে। দৃশ্যান্তরের পর্যটনে চলতে চলতে কবির চুম্বন ঘননীল প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে বিস্তৃত হয়। “সারাটা বসন্তকাল ধরে গুনেও শেষ করা যায় না ঢেউ” এই বোধ থেকেই অস্তিত্বের প্রগলভতা প্রেমের সৌকর্যে মুগ্ধ আবিলতা সঞ্চার করে। খোলা ইস্পাতের মতো ঝকঝকে ঠোঁট, বাঁ গালের উচ্ছল তারা ঐ তিল, ছটফটে ধারালো শরীর। নতুন লালঝুরি ফুল ভরা গাছ বসন্তের এই গোলার্ধ সবই সচল হয়ে উঠেছে। বিদেশি জাহাজ নিটোল নীলাভ, অচেনা গাড়ির হর্ন, সারি সারি ছুটন্ত ঘোড়সওয়ার সবই শূন্যে, প্রান্তলোকের মহাসীমানায় ভাসছে। অনন্তের ভালোবাসায় চুম্বনের রাত নিবিড় গর্ভকোষে শেষপর্যন্ত হারিয়ে যাচ্ছে। এইসব প্রেম কবির অনুভূতির দৃশ্যে বারবার উঠে আসে। আর সচল প্রয়াসী দিগন্তের আরশিতে কবি দেখতে পান:
“এইসব দৃশ্য
একের পর এক, একের পর এক
হাসছে, খেলছে, নাচছে
ভিতরে ডাকার ভঙ্গি করে
পৃথিবী মাতাল করে দিয়ে
গাইছে চেনা গানের কলি—
সে রাস্তা পার হচ্ছে
সে রাস্তা পার হচ্ছে
এখনও সে রাস্তা পার হয়।” (সে রাস্তা পার হচ্ছে)
এই রাস্তা জীবনের অমোঘ ও অনন্তের ভেতর যৌবনের নিরলস প্রবাহ।সৃষ্টির চেতনায় তা সর্বদা ভালোবাসার ডাক শুনতে পায়, আর সম্পর্কের ভেতর গড়িয়ে যেতে থাকে। দেবারতি মিত্র এই রাস্তাতেই জীবনের সমাগমকে লক্ষ করেছেন। কখনো বোধের তীব্রতা অবচেতনেও পৌঁছে গেছে। তখন গাছ-পাহাড়-রোদেরও প্রবৃত্তিক্রিয়া সংযুক্ত হয়েছে অন্তর্নিহিত কবিচেতনায়। কবি উপলব্ধি করেছেন:
“গাছগুলো টুপি খুলে ক্রমাগত সেলাম ঠুকছে
ঝমঝম ঝমঝম বলগাহীন বৃষ্টির গাড়ি
ছুটেছে মৃত্যুর দিকে মৃত্যু আর রাজছত্রধারী।”
(প্রিয় রাজছাত্রধারী)
কবির অদ্বৈতসত্তায় পদার্থেও প্রাণসঞ্চার ঘটেছে, ব্রহ্মপ্রত্যয় থেকেই সর্বব্যাপী এই বোধের জাগরণ ঘটে থাকে। এখানেও তা-ই হয়েছে। ‘মৃত্যু’ ব্যক্তিবাচকের বৈশিষ্ট্য পেয়েছে বলেই রাজছত্রধারীর সহগমনে সমূহ পরিণতির গতিনির্ধারকে তার উত্থান ঘটেছে।
স্বয়ংক্রিয় শব্দযাপনের ভেতর এক গতিময় পরাজগতের ঠিকানা দিয়েছেন দেবারতি মিত্র। এই জগতের বাস্তবতা ও অবাস্তবতা একই সঙ্গে বিরাজ করেছে। ছবি তৈরি হয়েছে, গতি অনুভূতির আলো পেয়েছে, জীবনও প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তবু ব্যক্তি ‘আমি’টির ঘোর বিষাদ আর অবস্থিতি বোধের তীব্রতায় ধরা দিয়েছে। কবি সচকিত কল্পনা ও আবেগের নির্মীয়মান অক্ষাংশে প্রকৃতিরও পারিপার্শ্বিকে অবগাহন করেছেন। আকাশ-সমুদ্রে বাতাসে ব্যাপ্তির সেই ঘোর উপলব্ধি:
“শনশন ছুটে আসে তারা
নীল কেশপাশ জড়িয়ে ফেলছে
ঘুম আলো জোয়ার জোয়ার
তারুণ্যের মধ্যিখানে রুক্ষ উৎকণ্ঠ চুল,কড়া ঘাম,
সৌরভ, পৌরুষ, স্নেহ,রক্ত, সিগারেট
মাতাল করছে বিষণ্ণতা,
আমার গলার হার হাওয়াতে ঝটকা লেগে
আটকে রয়েছে সাদা নিথর বোতামে,
রক্ত নামে হুহু করে মাথা থেকে পায়ে
পা যেন চলেছে ছুটে জুতোর বাইরে
গতি চেপে ধরে আকর্ষণ
উগ্র বন ভেসে ওঠে বাল্টিক সাগরে।”
(নিবু নিবু অন্ধ আলো)
আলো-আঁধারের এই ঘোর বিস্তৃত হয়ে চলে সীমাহীন জগৎব্যাপী। সেখানে অসম্ভব কিছু নেই।ভাবনার এমন প্রবাহ যে নিজেকে যেমন ইচ্ছা মুক্ত করা যায়। শোক-দুঃখের অবস্থিতি কখনো ক্লান্ত করতে চাইলে বা কবিকে বন্দি করতে চাইলে এই স্বয়ংক্রিয় আত্মসম্মোহনে নিজেকে ছেড়ে দেন। ‘যুবকের স্নান’ কাব্যে এই বোধের চলাচল আরও গতিময় হয়ে ওঠে। এখানেই কবি উপলব্ধি করেন ‘পৃথিবীর চেনা কোনো ছোট ঘর নয়’—কবি সর্বদা নিজেকে বাইরে, আকাশে, বাতাসে, এক ভিন্নতর পৃথিবীর দিকে নিয়ে যান; যেখানে নিজেকেও কোনো কোনো সময় অচেনা মনে হয়। কখনো পৌরাণিক আচ্ছন্নতায় গাছের রূপকে, কখনো প্রাচীন নারীর রূপে রূপকথার আলোয় সর্বদা নিজেকে জাহির করতে থাকেন। ভেতরে নয়, বাইরেই তাঁর গতি ও স্বাচ্ছন্দ্যের অবকাশ, আত্মা ও বোধের মুক্তি, ঈশ্বর ও মানবজন্মের অনন্ত প্রশ্রয়:
“ডুবন্ত আকাশ নীল অরেখ জানালা
স্বপ্নের চেয়েও স্বর্গহীন
কেন তুমি ভয় পাও পড়ে যাবে ভেবে
ফিসফিস করা ঠোঁট চেপে ধর
জিভে ও অধরে।” (কুসুম কুসুম মধু)
এই নিসর্গপুরের ছায়া তাঁর কবিতায় ভেসে ওঠে। সময়ের প্রবল ধারায় যেখানে বাল্টিক সাগর থেকে মিশরের পিরামিড, ক্লিওপেট্রা থেকে সক্রেটিস সর্বত্রই সঞ্চারিত হয় বোধ। হৃদয়কে স্তব্ধতা দিতে চেয়েও জাগরণের বাসনাকে স্থিমিত করতে পারেন না। কাব্য ও বিজ্ঞানের মহাকাশ তত্ত্ব, সূর্য ও সূর্যমুখীর সংলাপে কবি জীবনেরই কোনো অন্বয় উদ্ধার করতে চান। দরোজা-জানালা খুলে ডাকেন সব আবিষ্কার ও অনাবিষ্কৃত বিজ্ঞান ও ভাবনাদের। মনের ভেতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে তাদের। কবি প্রশ্ন তোলেন—
“সত্যিই কি
মধ্যযুগীয় খ্রিস্টানদের মতো সব মেনে নিতে হবে আমাকে,
সান্নিধ্য পাব না আমি?”
অন্বেষণ এমনই বৃহৎ জগতের, ভিন্ন গ্রহের দিকে কবিকে নিয়ে যায়, কবি সেখানে সবকিছু দেখতে চান, দেখা দিতে চান না। ঘুম, নক্ষত্র, মহাদেশ, সমুদ্র চেতনা, বাতাস, মাটি, পাহাড়, নিসর্গ সব মিলিয়ে যে বিশ্বানুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে চলেন কবি তাতে তাঁকে মনে হয়, তিনি দেশপ্রেমিককে বিশ্বনাগরিকের মধ্যে বিলীন করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে T. Medwin-এর কথাটি সত্য হয়ে ওঠে:
‘You have merget the patriot in the cosmopoliate.’ .এই cosmic feelingই মুখ্য হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। কবিও বলেছেন “সারা পৃথিবী যেন ঝাঁপিয়ে আমার উপর চলে আসে— আমি আমার নিজের মর্মে তার সমস্ত কাঁপন,তার সব রং, ঐশ্বর্য, বেদনা,অন্ধকার, বঞ্চনা, চরিতার্থতা যেন অনুভব করি ।” এভাবেই মুক্তি ব্রহ্মের ভেতর স্থান-কালের ভেতরে রেখা ঘুচিয়ে চিরন্তন আত্মার ব্যাপ্তি রচনা করেছেন।
আত্মসংলাপ কখনো কখনো কবির অন্তর্জীবনের নিবিড় সংশয়কে দোলায়িত করেছে। ‘আমি আর জন্মাতে চাই না’ কেন কবি জন্মাতে চান না? ‘যদি না সে আসে’— এখানে ‘সে’ সংশয়ার্তির ভেতর চলমান প্রেমিকসত্তার প্রতীক্ষা, যাকে কবি আকাশময় ব্যাপ্তির ব্যঞ্জনায় উপনীত করেছেন। একদিকে ‘আকাশ’ , অন্যদিকে ‘সমুদ্র’ কবির উপলব্ধির মহিমাকে ধারণ করেছে। তেমনি সূর্যাস্ত, সূর্যও রশ্মিময় প্রাণিত বোধের স্বয়ংক্রিয় অভিক্ষেপ। সূর্য কবির আত্মকারক গ্রহ। সূর্য সূর্যের কন্যা। বিশ্বপরিক্রমায় তার সান্নিধ্য সতত কবিকে আকৃষ্ট করেছে। ‘ব্ল্যাকহোল তত্ত্ব’ যেমন জীবনের অন্ধকারপূর্ণ ক্ষত, সূর্যাস্তও তেমনি আলোকময় বেদভাষার পবিত্র আধার। জীবনের সেতু গড়ে নিয়ে কবি একে একে সব পরিক্রমায় অভিবাসন চেয়েছেন। ‘ভূতেরা ও খুকি’ কাব্যটি সেই ব্যক্তিজীবনেরই নিবিড় সংশ্লেষ বলতে হবে। বাস্তব-পারবাস্তব এখানেও কবির দরোজা খুলে দিয়েছে। আত্মসংলাপগুলি জটিল এক অন্ধকারে তাদের গ্রন্থিমোচন করতে চেয়েছে। বিস্ময়ের ঘোরে আবর্তিত বোধকে কবি নিয়ে গেছেন রহস্যের মোচড়েই:
“লন্ঠন ডুবিয়ে চলে গেল ঢালু জলে।
গলাটেপা মাঝরাত,
আরো ব্যর্থ আরো চ্ছন্ন চোখহীন পদ্মের শিকড়,
ওপরে কোথায় শূন্য?
দমবন্ধ আকাশ জলের নিচে সে এখন মেঘ,
একাকিনী।” (শ্মশান কালী)
‘আরো অন্ধ’ জীবনের ব্যত্যয় থেকেই নিস্ফলা মাতৃত্বের স্বাদ যেমন কবির ব্যক্তিজীবনকে খণ্ডিত করেছে, তেমনি অসফলতা, অপূর্ণতাও ব্যক্তিজীবনে সর্বদা ধাক্কা মেরেছে। স্বাভাবিকভাবেই কবি নিজস্ব জগতের বিশৃঙ্খলা আবেগকে মুক্তি দিতে ভূতেদের সৌজন্য উপেক্ষা করেননি। বলা ভালো, সেইসব বোধের দ্বারা তাড়িত হয়েছেন।সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যোতিষ গণনাও এখানে ছায়া ফেলেছে। আসলে কবির বেদনার প্রকাশ, শূন্যতার প্রকাশ, জীবনকে গভীরভাবে আশ্রয় দেবার অনন্য প্রয়াসও বটে।
‘জঙ্গলে কাটুল’ কাব্যটি মৃত্যুচেতনায় সংকেতবহ আরও এক জীবনের পর্যটন। প্রিয়জন (মা) অথবা আত্মজনদের মৃত্যু যে শূন্যতা ও শোকবিহ্বলতার সৃষ্টি করেছিল—সেসবেরই এক দার্শনিক উদাসীনতা কবিকে গ্রাস করেছিল। ‘ঘাসফড়িঙের আয়ু’ কবিতায় লিখেছিলেন:
“মাথা ছাতা ধরেছে শোক—
ভিক্ষের ঝুলি হাতে দিয়ে
সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে চলেছে শোক।”
এই শোক যে ঘাসফড়িঙের মৃত্যুএবং মায়ের মৃত্যুকে একই বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছে কবি তা বুঝেছিলেন। মৃত্যু এমনই অমোঘ ও বিষণ্ণ করে তুলেছিল যে ,কবি জলের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন:
“জলে দুলবে শাপলা নয়,
সন্তানের শব।” (লাল কালো মেঘ)
‘মা’ শব্দটি আকাশ-বাতাসময় বেজে উঠেছিল। কবি চেতন-অবচেতনে শুনতে পাচ্ছিলেন সে ডাক— “মা, মা, মা।” জীবনের পরিধি অন্বেষণ করতে গিয়ে কবির জিজ্ঞাসা বারবার উত্থিত হয়েছে:
আকাশ কি শুধুই আলোর জীবনী, শুধুই আঁধার?
কি নেই ,কে নেই সেখানে। সমুদ্র তো আকাশেই!”
‘মুজবৎ পাহাড়ে হাওয়া দিয়েছে’ কাব্যে এসেও এই আকাশ-সমুদ্রেই জীবনের প্রচ্ছায়াকে আরও প্রগাঢ় করে তুলেছেন। দেহ নয়, আত্মা ; সর্বব্যাপী এক মহাআত্মার ব্রহ্ম অবস্থিতিকেই টের পেয়েছেন। তাই সর্বভূতেষুর বিশ্ববন্দিত বোধে কবির উত্তরণ ঘটেছে। মানবচরিত্রের বাঁকগুলি চিনে নিয়েও কবি অনন্তের ডাক শুনেছেন মানবের মধ্যেই। সেই কারণেই শেষ কাব্য ‘মজবুৎ পাহাড়ে হাওয়া গিয়েছে’-তে এসেও একই কথা বললেন:
“আগে ছিলাম দেয়াল,ছাদ,দরজা,
জানালা চৌবাচ্চার—
এখন আমি হাইওয়ে ধারে মেঘ, রোদ্দুর, পাকুড় গাছের,
অটোরিকশা, বাস, ট্যাক্সি,ভাঁটবন, আসশ্যাওড়ার জঙ্গলের।”
শেষে লিখলেন:
‘আমি এখন কুকুর বেড়ালের,হাওয়া বাতাসের।’
কবি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে মুক্তি দিলেন। বোধের বিস্তৃতি সর্বত্রই ছড়িয়ে গেল। প্রাণীতে বস্তুতে মিশে গেলেন কবি। কোথাও কোনো ভেদ রইল না। এক শূন্যতার ভিতর কবির কল্পনার দৌড় এমনই ব্যাপ্তি রচনা করে যে পারম্পর্য ভেঙে সব উপাদান-ই এক মানবীয় সত্তার বলয় হয়ে যায়। তাই বাতাস, জল, আগুন, আকাশকে ডাকলে দেবারতির-ই সাড়া পাওয়া যায়। এরকম সর্বব্যাপী উত্থান বাংলা কবিতায় প্রথম। দেবারতি মিত্র কোথাও এক প্রসন্ন বিবর্তনের সদর্থক আত্মধ্বনিরই সন্ধান করেন। যা তাঁর কবিতাকে বিশ্বলোকের প্রজ্ঞায় বৈশ্বিক অন্বয় দান করেছে। মহাকাশ-জ্যোতিষ্ক সূর্য-নক্ষত্র সবই আবর্তিত হয় তাঁর অস্তিত্ব নিরীক্ষায়। আবার দৈনন্দিনের আনন্দযাপন, দুঃখ-বেদনাও বাজতে থাকে। খিদে পাওয়ার প্রবৃত্তির মতো তাঁর কাছে কল্পনা পাওয়াও একটা বিষয় হয়ে যায়। জৈব প্রবৃত্তির সঙ্গে অবকাশযাপনের সম্পর্কটিও ক্রিয়াসঞ্জাত হয়ে ওঠে। জীবনের দ্রাঘিমায় দাঁড়িয়ে তিনি যে বলয় রচনা করেছেন তা বাস্তব-অবাস্তবের অনুষঙ্গে ভাস্বর হয়ে ওঠে। মা ও মেয়ের সম্পর্ক, সন্তান ও জননীর সম্পর্ক, চর্যাপদ থেকে এজরা পাউন্ড সমস্তই তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে যায়। তেমনি বাস্তবতা থেকে জাদুবাস্তবতাও অনায়াসে ছুঁতে পারেন। জীবনের পরতে পরতে যে রহস্য, যে ভাবনা, যে আশ্রয় প্রার্থনা, যে অসহায়তা—সবকিছুকেই মুকুলিত করে তুলেছেন কবি।বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই তাঁর হেশেলঘর হয়ে উঠেছে। শব্দেই তিনি মালমশাল্লা মাখিয়ে দিয়েছেন। বোধের আগুনেই তা উষ্ণ হয়ে উঠেছে।