spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধদ্বিতীয় দশকের কবিতা দ্বন্দ্বময় আত্মস্ফুরণের পরিবৃত্তি

লিখেছেন তৈমুর খান

দ্বিতীয় দশকের কবিতা দ্বন্দ্বময় আত্মস্ফুরণের পরিবৃত্তি

*(‘অখণ্ড বাংলার দ্বিতীয় দশকের কবিতা’ বইটিতে সংকলিত হয়েছেন বাংলাদেশ, ‍পশ্চিমবঙ্গ,আসাম, ত্রিপুরা ও প্রবাসী বাংলাভাষী ‍একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক কালখণ্ডের ২২১ জন কবির নির্বাচিত কবিতা।বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা প্রকাশনী (৬১ নং দোকান, কনকর্ড ‍এম্পোরিয়াম, কাঁটাবন, ঢাকা-১২০৫)।২০১০ এর আগে এবং ২০২০ সময়কাল পর্যন্ত যেসব তরুণ প্রজন্মের কবিরা কবিতা লিখতে এসেছেন মূলত তাঁদের কবিতাই সংকলিত হয়েছে বইটিতে। শূন‍্য দশক বলতে আমরা যা বুঝি তার সঠিক দিকনির্দেশনার পরিচয় পাওয়া যাবে এইসব কবিতা থেকে। আলোচ্য প্রবন্ধটি মূলত এই গ্রন্থটির কাছেই সর্বতোভাবে ঋণী।) 

তৈমুর খান

 কবিতায় দশক বিভাজন কবিতাকে চিহ্নিত করার কারণেই বলে আমার মনে হয়েছে। কবিতাকে দশক ভেদে ভাগ করা ঠিক নয়। কারণ কবিতা একটি প্রবহমান সৃষ্টিধারা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শক্তিশালী কবির হাতে তা অনন্যতা পেয়েছে। সভ্যতার ক্রমশ অগ্রসরতা মানুষের চাহিদা ও রুচির পরিবর্তন ঘটিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মৌলিক বা আদিচেতনার কোনো পরিবর্তন হয়নি, বলেই আজও কবিতা লেখা হচ্ছে, আগামিতেও হবে। বস্তুপৃথিবীর অন্তরালে যে ব্যক্তিজীবনের শূন্যতা তা তো কখনোই পূরণ হবার নয়। সেই শূন্যতার হাহাকার, অবিরাম ঘর্ষণ, অসামঞ্জস্য, রাষ্ট্রব্যবস্থা, যুদ্ধ সব নিয়েই কবিতা লেখা হবে। কবিতা একটি অসম্পূর্ণ ও অসমাপ্ত শিল্প যা ভাবনার প্রচ্ছায়াকে অনবরত ধরার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু কখনোই তাতে সিদ্ধি আনা সম্ভব নয়। মানবজীবন যেমন সমস্যাসংকুল, কবিতাও সেইসব সমস্যা ও অন্তরায়ের পরিভাষা। ব্যক্তিজীবনের মর্মরিত কিছু নিরুচ্চার, কিছু সংকেত এবং অবশ্যই ভাষাকল্প কবিতায় রূপ পেতে চায়। সুতরাং ব্যক্তি, সময় ও সমাজ নিয়েই কবিতার অভিযাত্রা। আর এসবের মধ্যেই ধর্ম বা ধর্মদ্রোহিতা, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঈশ্বর বা ঈশ্বরদ্রোহিতা সবকিছুই এসে যায়। আবার এসব না এসেও শুধু শূন্যতার অভিমান বেজে উঠতে পারে—যা নাথিংনেস্ বা এম্পটিনেস্ হয়েই ফিরে আসে। সবকিছুই একটা abstract ধারণায় বাহিত আত্মঘোরের সামীপ্য, যাকে আমেরিকার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, বিজ্ঞান রহস্যের লেখিকা উরসুলা ক্রো এবের লী গুইন(Ursula Kroeber Le Guin) বলেছেন: “I know who I was, I can tell you who I may have been, but I am now, only in this line of words I write.” লেখার মধ্যে যে কবির অদৃশ্য অস্তিত্ব বিরাজমান তাঁর এই কথার মধ্যে আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। সুতরাং টি এস এলিয়টের কথায় ‘All time is eternally present’ ভাবা যেমন সত্য, তেমনি সব কবিকেই সব যুগে আধুনিক বা সাম্প্রতিক ভাবা যুক্তিযুক্ত।

   দ্বিতীয় দশকের কবিতার অভিমুখ কোন্ দিকে, বা কবিচেতনার পর্যায়গুলি নির্ণয় বা অনুসন্ধান করতে গেলে একই ধারণার তৈরি হবে; যে ধারণা আমরা পূর্বের দশকগুলিতে পেয়েছি। অর্থাৎ সময় ও জীবনের ভাঙন, অস্থিরতা, নাগরিক জীবনের নিঃসঙ্গতা, আশ্রয় ও প্রেমের অন্বেষণ এসবই উঠে আসবে। তবু পঞ্চাশ বা ষাটদশকের কবিতায় মানবচৈতন্যের গভীর ব্যাপ্তি স্পর্শ করে আমাদের। ভাঙনের মধ্যেও বাঙালিত্বকে, জাতীয়তাবোধকে আমরা বিসর্জন দিতে পারিনি। নিজেকে সমাজের বৃহত্তর আয়নায় দেখেছি। সত্তর,আশি ও নব্বই দশকে এসে আমাদের দেখার ক্ষেত্রটা ছোট হয়ে গেছে অনেকটাই। আত্মজৈবনিক ক্রিয়ার ভেতর সৃষ্টিসঙ্গমের মাধুর্য প্রতিফলিত হতে চেয়েছে। পারস্পরিক সংযোগের রাস্তা খুঁজেছি। প্রথম দশকে আমাদের ব্যক্তিবিচ্ছিন্নতার নৈঃশাব্দ্যিক ফাঁক বা শূন্যতা মারাত্মক হয়ে উঠেছে। শিল্প নান্দনিক ঐশ্বর্য থেকে সরে এসেছে। নিজেরাই নিজেদের চিনতে পারিনি। এই বিচ্ছিন্নতার উপলভূমিতেই জন্ম নিয়েছে দ্বিতীয় দশক।২০১০ এর কিছু আগে এবং পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে যাঁরা কবিতা চর্চা করতে এসেছেন, তাঁদের কণ্ঠস্বর আলাদা করে আমাদের চেনার প্রয়োজন হয়নি। কেননা যুগের রিরংসা থেকে, ধ্বংস ও কদর্য উল্লাস থেকে তাঁরা নিজ উত্থানকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। একই রাস্তায় সকলেই যেন Street-man হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম আমরা জানতে পারি অরবিন্দ চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘অখণ্ড বাংলার দ্বিতীয় দশকের কবিতা’ নামক সুবৃহৎ গ্রন্থটি থেকে। কবিরা হলেন: অজিত দাশ, অনন্যা মণ্ডল, অনুপম মণ্ডল, অপু মেহেদী, অব্যয় অনিন্দ্য, অমিত আশরাফ, অরবিন্দ চক্রবর্তী, অসীম নন্দন, আজিম হিয়া, আব্দুল্লাহ আল মুকতাদির, আরিফ শামসুল, আল ইমরান সিদ্দিকী, আশিকুর রহমান, আসমা অধরা, আসাদ সনি, আহমাদ শামীম, ইলা লিপি, ইফতেখার ঈশপ, ইমেল নাঈম, উপল বড়ুয়া, উবায়দুল্লাহ  রাফী, ওজিয়াস মানিক, কবির কল্লোল, কাউসার সাকী, কামরুল কমল, কালপুরুষ, কায়েস সৈয়দ, কিশোর মাহমুদ, কুশল ইশতিয়াক, গিরিশ গৈরিক, চাঁদনী মাহারুবা, জয়ন্ত জিল্লু, জিয়াবুল ইবন, জুয়েইরিয়াহ মৌ, জেবাউল নকিব, ডাল্টন সৌভাতহীরা, তনজিম আতিক, তান্ত্রিক রঙন, তানভির পিয়াল, তাসনুভা অরিন, দন্ত্যন ইসলাম, দেওয়ান তাহমিদ, দেবজ্যোতি ভক্ত, দেবাশিষ মণ্ডল, দ্বিত্ব শুভ্রা, দুখাই রাজ, নাজিয়া ছায়া, নাহিদ ধ্রুব, নিখিল নওশাদ, নিজাম বিশ্বাস, নুসরাত নুসিন, পয়মন্ত শিকদার, পাঠান জামিল আশরাফ, পার্থ অগাস্টিন, পাভেল আল ইমরান, প্রত্নপ্রতিম মেহেদী, বসন্ত বোস, বাদল ধারা, বিধান সাহা, মহিম সন্ন্যাসী, মাইবাম সাধন, মারুফ আদনান, মাহমুদুর রহমান, মিছিল খন্দকার, মেহরাব ইফতি, মোহাম্মদ জসিম, রক্তিম রাজিব, রনক জামান, রবিউল আলম নবী, রাজীব দত্ত, রাতুল রাহা, রাসেল রায়হান,রহুল ঘোষ, রিকি দাশ, রিমঝিম আহমেদ, রিলকে রশীদ, রুবেল সরকার, লেবিসন স্কু, শঙ্খচূড় ইমাম, শাফিনুর শাফিন, শামশাম তাজিল, শামীম আরেফিন, শামীম আহমেদ জিতু, শারমিন সামি, শাহ মাইদুল ইসলাম, শ্রাবণ রহমান, শিমন রায়হান, শিমুল জাবালি, শিশির রাজন, শুভ্রনীল সাগর, শেখর দেব, শ্বেতা শতাব্দী এষ, সফি কামাল রিয়াদ, সমীক অধিপতি, সঞ্জয় ঘোষ, সরকার মুহম্মদ জারিফ, স্বরলিপি, সাকলাইন সজীব, সাজ্জাদ সাঈফ, সাদী মোহাম্মদ সাফিলা আক্তার, সাম্যরাইয়ান, সারাজাত সৌম, সালেহীন বিপ্লব, সালেহীন শিপ্রা, সিপাহী রেজা, সিলভিয়া নাজনীন, সুদেব চক্রবর্তী, সুবর্ণা গোস্বামী, সুমন ইউসুফ, সুলতান সালাহউদ্দিন, সুলতান স্যান্নাল, সূর্য্যমুখী, সৌম্য সালেক, হাসনাইন হীরা, হাসনাত শোয়েব, হাসান মসফিক, হাসানুজ্জামান, হাসিবুল আলম, হিজল জোবায়ের প্রমুখ।

     বাংলা কাব্যজগতে এতজন কবির উদয় বেশ আশাব্যঞ্জক মনে হতে পারে, কিন্তু কবিতায় সেই দৃষ্টান্তমূলক স্বাতন্ত্র্য তেমনভাবে আকৃষ্ট করে না। চিরাচরিত পথে সময়ের নগ্নতা, দাহ, উল্লম্ফন, নস্টালজিক ভাবনা এবং সমাজ ও রাষ্ট্র সমালোচনার পথগুলিই কবিরা বেছে নিয়েছেন। ভাষা,শব্দ ও চিত্রকল্প সৃষ্টিতে কিছুটা ভিন্নতা কোথাও চোখে পড়ে বটে, কিন্তু সর্বব্যাপী আত্মচারিতার প্রখর উত্তাপ কোথাও পাই না। বরং এই শতকে কবিরা ক্ষণিকতা, প্রাসঙ্গিকতা এবং অন্তর্মুখহীনতাকেই অবলম্বন করেছেন। প্রভাব বিস্তারকারী অমোঘ ও দিশারী হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁদের হাতে বাংলা কবিতা কিছুটা স্তব্ধতা পেয়েছে, নিঃসঙ্গতার পাঠশালায় পাঠ নিয়েছে, মেটাফোরিক উচ্ছ্বাসে ভাবনাকে জারিত করেছে, আবার ছন্দ ও ছন্দোহীনতায় গদ্যচালকে অবলম্বন করেছে। সব মিলিয়ে এক অস্থির ও দিশাহীন গতানুগতিকতারই নামান্তর বলা যায়। আত্মবিনির্মাণে তাড়িত হয়ে পথ অন্বেষণ করেছে। কাব্য রচনায় ও ভাবনায় যে স্থিতি ও দার্শনিকতার প্রয়োজন সেটা তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি। বলেই স্ববিরোধী আত্মলোকের অসংযমী নির্যাস হয়ে উঠেছে তাঁদের কবিতা। তাতে যেমন শিল্প নেই, তেমনি শ্রমও নেই। শুধু বার্তা আর ক্যারিকেচারে ভর্তি দৈন্যের অবিমিশ্র প্রলাপ। কবিরা কী চান নিজেই ঠিক নির্ণয় করতে পারেন না, অথচ সময়ের উঠোনে নিজের ছায়াকেই অনুসরণ করেন। ঐতিহ্যকে অনুসরণ করার এবং অস্বীকার করার মধ্যেও যে নতুনত্ব নেই এবং নিজেকে চেনানোর আলাদা কোনো চাবিও তাঁরা খুঁজে পাননি তা বলাই বাহুল্য। তথাকথিত ধর্মকে মান্যতা, অথবা ধর্ম ও ধর্মগুরুদের আক্রমণে, সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সবই যেন গতানুগতিকতায় চালিত। আত্মসত্তার সূক্ষ্ম অবলীন চেতনায় বিস্তৃত হওয়াটাই জরুরি ছিল কবিদের কাছে; কিন্তু সেটা কম ক্ষেত্রেই হয়েছে। বাহ্যিক আহ্বানে তাঁরা যতটা আজ্ঞাবহ, অন্তর্লোকের উঁকিতে তা এহবাহ্য হয়ে ওঠেনি। ফলে কবিতা নাম নিয়ে যা ফলাবতী হতে চেয়েছে তা অনেক জায়গাতেই দুস্ফল।

     কবিরা সেই সময়েরই ঝাঁকের কই যাঁরা সমষ্টিগতভাবে বোধের জলাশয়ে সাঁতার দিয়েছেন যা নতুন নয়, কিছুটা চমকপ্রদ মনে হতে পারে। বক্তব্য আর লক্ষ্য, আত্মসম্মোহনের পর্যায়টি এভাবেই পরিস্ফুট হতে চেয়েছে:

 মোহাম্মদ জসিম:

“আমি এখনো এক চামচ জলের যাদুবাস্তবতায় বিশ্বাসী—

ইতিহাসে একটি গোলাপ রেখে যেতে ইচ্ছুক…”

 প্রেম আর সৃষ্টির যুগলে গোলাপ চিহ্ন আবহমান প্রেমিকেরই স্বপ্ন যা যাদুবাস্তবের মধ্যে দিয়ে জেগে উঠেছে। মৃত্যু, ক্ষত, মিছিল, স্লোগান এহবাহ্য যখন কবির অন্তরের তাগিদ থেকে প্রেমের নিরাপত্তা ও নির্ভরতাই কাম্য হয়ে ওঠে। তাই এই দশকেও শুনতে পাই:

“আমি রাষ্ট্র নেব না প্রিয়; নেব তোমার অঙ্গুরীয়।” (রুবেল সরকার)

 উল্লেখ্য ‘অঙ্গুরীয়’ শব্দটা আবহমানকাল থেকেই প্রেমিক-প্রেমিকার দ্বারা বাহিত হয়ে আসছে, এখানেও তার অন্যথা হয়নি।

     সময়ের ক্ষতকে অস্বীকার করা যায় না বলেই কবি লিখতে পারেন:

 “আমার মৃত্যুভয় ভাষা নেড়ে দেখুক—কী আছে আড়ালের আয়োজন।” (শঙ্খচূড় ইমাম)

 আড়ালে সেই অসামর্থ্য তাড়িত বিহ্বল দুঃখ-ঝরনাই বিরাজমান। সেই ‘ঈর্ষাপুরে’রই দহন সাম্রাজ্য।

   সময়কে সঙ্গী করেই এই বোহেমিয়ান ভ্রমণ কবিদের। কবিরা জানেন নিজেদের। শিল্পী Luhraw এর ভাষায় বলা যায়: “Thanks to my art, I now know who I am.” তাই কবিতাতে ফিরে ফিরে আসে এই আত্মচারী বিন্যাস:

“ধীরে ধীরে হাওয়া হয়ে যাচ্ছি

লু হাওয়ার মতো। ঘুরছি, ফিরছি, ভাসছি।

তছনছ করছি শহর-গ্রাম-জনপদ।

এলোচুলে হেঁটে যাওয়া তন্বী-তরুণীর

জিভের আগায় অস্বস্তির কারণ হচ্ছি।”

                       (শামীম আহমেদ)

‘দগ্ধ যৌবন’ হয়ে বেড়ানো জীবনের দায় থেকেই কবিতার উত্থানে নতুন ভোর খুঁজলেও জীবন বারবার হোঁচট খেয়েছে। কবির ‘একমুঠো’ বিশ্রামের প্রয়োজন হয়েছে। যুগের ক্লান্তি ও অস্থিরতাই এর মূল কারণ। স্বাভাবিকভাবেই এক যৌথশূন্যতার ভেতর দিয়েই তাঁরা সময়ের অভিযাত্রী হয়েছেন। হৃদয় দগ্ধ হওয়ার কথকতায় সড়গড় হয়েছেন। তাঁদের জন্মক্ষণটির উল্লেখ করেই লিখেছেন:

 “শূন্যে যে জন্মায়

 শূন্যে মরণ হয়”

 (দুলছিল নৌকা বস্তুত নিশ্চল: হিজল জেবায়ের)

 “গর্ভ থেকেই বাক্যহীন, মূক।” এই সময়ের কবিতায় এই দর্শনই মরমরিত।

   বিখ্যাত সাহিত্যিক আলবার্ট কামু ‘The myth of sisy-phus and other eassys’ গ্রন্থে লিখেছেন:

  “What is called a reason for living is also an excellent reason for dying.” বেঁচে থাকার কারণ যে মৃত্যুর মধ্যেই নিহিত আর সেই কারণেই যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় কবিরা তা জানেন বলেই এই শতকেও বারবার তাঁদের লেখায় তা ফিরে এসেছে।

 কবি হাসানুজ্জামান লিখেছেন:

“অবসাদ ক্লান্তিরা খেয়ে ফেলেছে নৈতিক ভোকাল কর্ড, মজ্জা ও মনন।

ঈশ্বর নিহত হয়ে শুয়ে আছেন মর্গের স্ট্রেচারে।”

 অথবা

“অনন্ত পতনের অনুভূতি ছাড়া কিছু নেই মিনোটরের গোলকধাঁধাময় পৃথিবীতে।”

          (ঈশ্বর পানকৌড়ি ও চাপাতি বিষয়ক)

 পৃথিবীর সৌন্দর্য, বাস্তবতার কোনো মূল্য নেই। ঈশ্বরও নিহত। নৈরাজ্যবাদী চেতনা তো আজকের নয়। এই অবসাদের বয়স দীর্ঘ। জীবনানন্দ দাশ তাকে এড়াতে পারেননি ‘আমি তারে পারি না এড়াতে/ সে আমার হাত রাখে হাতে;’ সেই বোধ থেকেই জারিত হয়ে চলেছে পরবর্তী প্রজন্ম। সৌন্দর্যের মধ্যেই ধ্বংস ও অবক্ষয়টি সত্য হয়ে উঠেছে। ইংরেজ ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও সমালোচক জর্জ অরওয়েল (George orwell-1984) বলেছেন: “It’s a beautiful thing, the destruction of words.” ‘অনন্তপতনের অনুভূতি’ যেন এর মধ্যেই নিহিত।

     আমেরিকান নাট্যকার, কমেডিয়ান, লেখক ও সঙ্গীতজ্ঞ উডি এ্যালেন(Woody Allen) রসিকতা করে বলেছেন: “It’s a match made in heaven…. by a retarded angel.” এই কথার মধ্যেই আমরা নিহত ঈশ্বরের শুয়ে থাকা উপলব্ধি করতে পারি। যুগসংকটের তীব্রতা আত্মঅন্বেষার পথকেও ঢেকে ফেলেছে। তাই কবি বলেছেন: ‘মিনোটনের গোলকধাঁধাময় পৃথিবী’। ধর্ম এখানে ধর্মহীন, ঈশ্বরও ঈশ্বরহীন। নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। সব destruction-এ পর্যদস্ত। ইলা লিপি এই কারণেই লিখেছেন:

“কন্ঠনালী ছুঁয়ে নামে ঝরনা জর্জরিত শিল্পকলা।

বোধ ও বিভ্রমের মৌনতায় লুট হতে থাকে শব্দের গ্রাম

প্রতিবেশীরা আশ্চর্যের নীতিতে গড়ে ধর্ম মন্দির।” (বৃত্ত)

 এই ‘ঝরনা জর্জরিত শিল্পকলাই’ আজকের সাহিত্য। বোধের তীব্র দহনে যা নিঃসঙ্গতার অভিশাপ হয়ে বয়ে চলেছে ‘the destruction of words.’

    নিজেদের ছায়ায় দাঁড়িয়ে এক নিঃসঙ্গতার ভাষায় কবিরা কথা বলেছেন। সেখানে রংচটা প্রেমবীজ, নষ্টক্ষেত, শস্যবিহীন মাঠ আর বিশ্বাস হন্তারক সন্ন্যাসী আর প্রহরীর দেখা পেয়েছেন। সময়ের ভাঙা আয়নায় যে মুখগুলি ভেসে উঠেছে তা যে সভ্যতারই কদর্য প্রতিচ্ছবি তা না বললেও চলে। সুতরাং কবিতাগুলি কোনো বিকশিত আত্মবোধে উদ্বোধিত করে না। অসহায় ক্লান্ত যুগলিপি হয়েই উড়ে বেড়ায়।

   আসাদ সনি লিখেছেন:

“আমাদের বীর্যে থাকে বিগত জীবনের ব্যর্থতা

আমাদের জরায়ুতে থাকে বিগত জীবনের ক্ষত

আমরা সেই ব্যর্থতা ঢেলে দেই জরায়ুতে

আমরা সেই ক্ষত পূর্ণ করি বীর্য ধারণ করে,

আমাদের সন্তান সত্যিকার অর্থে আমাদের ব্যর্থতার টিউমার।”

                      (আমাদের টিউমার)

 কবিতাটিতে যুগসঞ্চিত ব্যর্থতারই, অক্ষমতারই, সৃষ্টিহীনতারই এক নিঃস্ব আবর্তন ক্লান্তির অন্ধকার ঢেলে দিয়েছে। জীবনানন্দ দাশ যুগের এই ক্লান্তিকে সেই কুঁজ, গলগণ্ড, নষ্টশশা চালকুমড়োর ছাঁচে ফলে উঠতে দেখেছেন। এই দশকে এসেও তার বিবর্তন ঘটেনি, ‘ব্যর্থতার টিউমার’ হয়ে দুষ্টক্ষত হয়ে ক্যান্সারের দিকে ধাবিত হয়েছে। একটা বিমর্ষতার উত্তরাধিকারী হিসেবে কবিরা আরও অক্ষম এবং ক্লান্তির ধারক হয়ে উঠেছেন।

    নিঃসঙ্গতা কত মারাত্মক ও অমোঘ হয়ে উঠেছে তা যেন কেহই এড়াতে পারেননি। অবশ্য ৮০-৯০ দশকের সমষ্টিগত নিঃসঙ্গতা থেকে এই নিঃসঙ্গতা একান্ত আত্মগত। এই নিঃসঙ্গতা কিন্তু স্তব্ধতা নয়, এক শূন্যতার অসহায় আর্তনাদ। অপু মেহেদী লিখেছেন:

“পাশে বসে থাকাও একধরনের নিঃসঙ্গতা।

তোমার আমার যৌথ ডানার আকাশ। উড়তে

উড়তে মেখে নিলাম উল্কার ঘাম, ফড়িং ডানার আর্তনাদ। ঋতুবতী মেঘেদের শরীরে তখন আলিঙ্গনের তীব্র নিনাদ।”

                       (নিঃসঙ্গতার জটিলপাঠ)

 এই আর্তনাদের মধ্যে আমরা রোমান্টিকতাকেও অনুভব করতে পারছি। বিশ্বাসের অভাব থেকেই আসে অসহায়তা। তাই পাশে বসে থাকার মধ্যেও ‘দুঁহুঁ কোরে দুঁহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’। অবশ্য ঋতুবতী মেঘ যে মেঘরমণী হয়ে কিছুটা রোমান্স প্রসব করে তা বোঝাই যায়। আলিঙ্গনের হাতছানি দেয়। আত্মস্ফুরণের আর একটি ক্ষেত্র পেয়ে যায়। এই মেঘ আকাশ, নৈসর্গিক চিত্রকল্পগুলি নীরবতার মানচিত্র নির্মাণ বিদ্যার মতো। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আমেরিকান বিখ্যাত কবি অ্যাড্রিনে রিচ (Adrienne Rich)তাঁর ‘Cartographies  of Silence’-এ লিখেছেন:

 “A conversation begins

 with a lie

 and each

Speaker of the so-called common language feels

the ice-floe split, the drift apart

 as if powerless, as if up against

a force of nature

 a poem can being

 with lie

And be torn up.”

 এই নীরবতার মানচিত্রেই ধারণ করে মনুষ্যপ্রবৃত্তি, কল্পনা ও মিথ্যা সংলাপ, যা খুব common language হয়েও অনুভূতিগুলি নির্মাণ করতে পারে এবং প্রাকৃতিক উপমায় শক্তি সঞ্চার করতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে:

১) অরিন্দম চক্রবর্তী:

“পদকর্তা হাসি চিবান, সভানেতা চুলকিয়ে চুলকিয়ে মেঘ করেন।

অন্দরমহলে রোদ উঠলে খাঁচার মুনিয়া

খুব একা ঠোঁটে রুমাল চেপে রসময় খুলে দেন।”

                              (লিপস্টিক)

২) আল ইমরান সিদ্দিকী:

“খয়েরি-সাদা; সুফিনৃত্যের ভঙ্গিতে হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে ঝরে পড়া ফুলের মতো করে

প্রশান্তি নামছে তোমার অন্তরে। নির্জন বেলাভূমিতে পাতার আসন পাতা—

তুমি বসে আছো—মুখে দূর অস্তাচলের আলো, মুখে লেগে আছে হাসি।”

                       (প্রাণায়াম রিপ্রাইজ)

৩) আসমা অধরা:

“অনুভূতির পিঠে বধির আশ্চর্যের

ন্যায়, দিনের কন্ঠজুড়ে তিনলহর

সীতাহার পরায় সূর্য; চমকে চমকে

ওঠে প্রভাত—দ্বিপ্রহর—আর সান্ধ্যসিঁথির রকমফেরী আলোর সিঁদুর।”

                     (যে পৃথিবী উপেক্ষিত)

 প্রতিটি চিত্রকল্পেই এক সচল অবিমিশ্র প্রাণের অভিঘাত প্রতিফলিত। ব্যঞ্জনা বা সংকেতের ভেতর কবিরা যেতে চাননি, শুধু শব্দ ব্যবহারের এক অনন্য যাদু নিক্ষেপ করেছেন। ফলে হাসি চিবানো, চুলকিয়ে চুলকিয়ে মেঘ করা, ঠোঁটে রুমাল চেপে রসময় খুলে দেওয়া, সুফিনৃত্যের ভঙ্গি, অস্তাচলের আলো, অনুভূতির পিঠ, সান্ধ্যসিঁথি, আলোর সিঁদুর প্রভৃতি প্রাণের আলোয় প্রতিমার রূপ পেয়েছে। এই দশকে শব্দ ব্যবহারের এই ক্ষমতাটুকুই কিছুটা হলেও আশাব্যঞ্জক।

       দ্বিতীয় দশকের বেশিরভাগ কবিতাতেই ক্লান্তির, বিষণ্নতার, আত্মভুক জড়তার, অনবরত ঝরে পড়া সত্তার জাগরণ টের পাই। পরমার্থ বিস্ময়ের কৌতূহলে গভীরতা দান করে না; যৌনতার সুগন্ধী প্রজাপতি খুঁজতে ব্যস্ত কবিরা। রাষ্ট্র, সন্ত্রাস, অমানবিকতা, ধ্বংস, বিদ্বেষ তাঁরা সকলেই দেখে চলেছেন, কিন্তু মানবজাগরণের ব্যাপ্তি তাঁদের সৃষ্টিতে নেই। টুকরো টুকরো অবদমনের নিরলস শূন্য কলসির আওয়াজই নিরন্তর পেয়ে যাচ্ছি। তবু কবিরা মাঝে মাঝে আত্মআবিষ্কারের পর্যায়টিতে গভীর অভিনিবেশ দান করেছেন। যেখানে প্রেম ও স্বপ্নজন্মের অনুজ্ঞাটি রূপান্তরিত হয়েছে সৃষ্টিপ্রজ্ঞার বিভিন্ন পর্যায়ে। অনন্ত ইচ্ছার মতো তা বেজেও উঠেছে। কবি তানভীর পিয়াল ‘পারলৌকিক বন্দরে’র দিকে আমাদের নিয়ে গেছেন তাঁর সংরাগ উন্মোচনে:

“নিদ্রাকুসুমের দিকে ঝুঁকে আছে রঙময়ূরের ভ্রূণ।”

 এই নিদ্রাকুসুম একদিন রঙময়ূরকে জাগাবে। কবি দেওয়ান তাহমিদ ‘বিস্ময়চিহ্নের মতো’ জীবনের আশ্চর্য পর্বে নিজেকে উদ্বোধিত করে তোলেন:

“সতেজ ঘামের ঘ্রাণে, পাউরুটি চুবিয়ে টঙের

চা-ভর্তি ময়লা গ্লাসে, গিলে ফেলি একটি বিকেল।

মেঘের স্তনে তখন গোলাপি লজ্জা, তোমাকে কি পেছনে ফেরায়?”

 এই গোলাপি লজ্জাও ভালোবাসার ইস্তাহার রচনা করে। কবি পাঠান জমিল আসরাফ ‘ক্যানভাস’ এভাবে লেখেন:

“বোতাম খুলতেই বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে কয়েকটি হরিণ;

শিং তাক করা দৃষ্টি নিবন্ধ রাখে আমাদের দিকে।”

 ক্যানভাসে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের ইঙ্গিত ফুটে ওঠে। কবি মিছিল খন্দকার ‘পাঁজরের ইঁদুরে কাটা প্রত্যকের নিজস্ব হৃদয়ের’ পরিচয় এই শতকে দিলেও মূলত বিমূঢ় বিভ্রান্ত কবিরা এখনো দিকচিহ্ন নির্ণয়ের সঠিক কাঁটাকম্পাস খুঁজে চলেছেন। absurd চেতনায় কখনো কখনো নিজেদের মুক্তি দিতে চান। নিজেরাও সঠিক লক্ষ্য অনুধাবন করতে পারেন না। আলবার্ট কামুর মতো তাঁরাও:

“Seeking what is true is not

 Seeking what is desirable”

 ‘দি মিথ্ অফ সিসিফাস’ এর এই কথাটি এই সময়েও চূড়ান্তভাবে সত্য হয়ে উঠেছে। এই দ্বন্দ্বময় পরিবৃত্তি থেকেই কবিরা তাঁদের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাবেন।

       দ্বিতীয় দশক দোদুল্যমান আত্মস্ফুরণের ভেতর দিয়েই আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাক। তাঁরা যেমন পোস্টমডার্নকে আঁকড়ে ধরে নেই, তেমনি আধুনিকতার সনাতন সংজ্ঞায়ও ঘুরপাক খায়নি। সকলেই একটা নিজস্বতা অর্জন করতে চেয়েছে। বহুমুখী আত্মবাচক ক্রিয়ায় এবং সর্বনামে বিস্তৃতি ও প্রজ্ঞাকে ধারণ করার সাহস দেখাতে শুরু করেছে। এখনো হয়তো সিদ্ধি আসেনি। আবহমান পাঠক অসীম ধৈর্য নিয়েই অপেক্ষা করে আছে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ