ড. মাহবুব হাসান
কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ নিয়ে ভাবনার শেষ নেই। সাহিত্যের যে কোনো শাখারই মানুষ হোন না কেন, বিদ্রোহী কবিতার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমির কারণে তারা গুরুত্ব দেন। আর যারা কাজী নজরুলের কৃতিত্বকে নিজেদের গৌরব বলে বিবেচনা করেন, তারা হলেন কবি-সাহিত্যিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়।[সব মানুষই সাংস্কৃতিক মানুষ] কারণ, রাজনীতিকরা মনে করেন, তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার মন্ত্র যেন ওই কবিতা। আর সাংস্কৃতিক সম্প্রদায় ভাবেন তাদের জন্যই এ-কবিতা লিখেছেন নজরুল। আর সাংবাদিকরা যে সাহসের ওপর ভর করেন, সেই সাহস তারা লাভ করেছেন যেন নজরুলের বিদ্রোহীর আলোকেই।
সাংবাদিকতায় নজরুলই প্রথম ব্রিটিশ ঔপনিবে্শিক শাসকদের বিরুদ্ধে এমন বারুদময় মিথিক্যাল পরিপ্রেক্ষিতের বর্ণাঢ্য উপস্থাপনা করেছেন, যা অতীতে আর হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না আর। বলার অপেক্ষা রাখে না যে নজরুলের সাংবাদিকতার গদ্য মিথিক পরম্পরাসর্বস্ব। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর মত প্রকাশ করতে গিয়ে মিথের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি, যাতে সেই রচনার সাহিত্যমূল্য অটুট থাকে আর ব্রিটিশদের মনে তার হিট বা আঘাতটাও ঠিক মতো লাগে। সেটা কিন্তু ঠিকই কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিলো। তার রাজনৈতিক দৃষ্টিস্নাত গদ্য [প্রবন্ধ/নিবন্ধ এবং উপন্যাস] বইগুলোর বেশ কয়েকটিই ব্রিটিশের ভারতীয় সরকারের রোষানলে পড়ে নিষিদ্ধ হয়। যুগবানী নিষিদ্ধ হয় ১৯২২ সালে, বিষের বাঁশি নিষিদ্ধ হয় ১৯২৪ সালে। অগ্নিবীণা, ভাঙার গান,প্রলয়শিখা, চন্দ্রবিন্দু, যুগবাণী, এ-সব বই নিষিদ্ধ ও বায়েজাপ্ত হয়েছিলো ওই সব বইয়ের অগ্নিময় বাণীর কারণে। তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন তার কবিতা, প্রবন্ধ আর গানের বাণীর কারণেই। তিনি দেশকে দখলদার ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত করতেই কলম ধরেছিলেন। এই সত্য প্রকাশিত তার প্রতিটি লেখায় আমরা লক্ষ্য করি।
‘নজরুলের রচনায় তখনকার যুগমানসই প্রতিবিম্বিত। সশস্ত্র আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়ে এসেছে, শুরু হয়েছে গান্ধীজীর নেতৃত্ব অসহযোগ আন্দোলন— প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই রাজনৈতিক সামাজিক পটভূমিতে ঝড়ো হাওয়ার বেগে ছুটে এলেন নজরুল। বাংলা সাহিত্যে তিনি আনলেন চির বিদ্রোহের বাণী।
সৈনিক কবি নজরুলের হাতের লেখনী অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হয়ে দাঁড়াল ক্ষুরধার তরবারী।’ [নিষিদ্ধ নজরুল/শিশির কর/আনন্দ পাবলিশার্স/কলকাতা]
বিদ্রোহী কোন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ পেয়েছিলো তা নিয়েও বিতর্ক আছে। কেউ বলেন প্রথম মোসলেম ভারতে, ১৩২৮ বাংলা সনে ; কেউ বলেন বিজলী’তে। যে পত্রিকাতেই এই কবিতা ছাপা হোক না কেন, তা যে আগুনের গোলার মতো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তা বলার অপেক্ষা করে না। তরুণদের কণ্ঠে ওই কবিতার পঙক্তিগুলো লেগে রইলো যেন এ-তাদের সংগ্রামের বাণী। দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতোটাই অগ্নিধারণ করেছিলো যে, নজরুলের বিদ্রোহী সেখানে আগুনে ঘি ঢেলে দেবার মতো কাজ করলো। মোসলেম ভারত পত্রিকার মাধ্যমে নজরুলকে কবি হিসেবে জানলেও বিদ্রোহী তাকে বিশাল সমাজের কবি-প্রতিনিধি হিসেবে প্রমাণ করে।
মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি ষেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীরিতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারির খ্ড়গ কৃপাণ
ভীম রণভূমে রণিবে না—-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হবো শান্ত।’
যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামে লড়ছিলো, তাদের চেতনায় বিদ্রোহী জ্বালিয়ে দিলো মুক্তির আগুন। এতোকাল যে দ্রোহ নজরুল নিজের ভেতরে লালন করছিলেন, তারই প্রকাশ ঘটেছিলো তার বিদ্রোহীতে, এখন তা ছড়িয়ে পড়লো দেশের তরুন-প্রবীণ-বৃদ্ধদের অন্তরে। তারা ব্রিটিশদের শোষণ-নির্য়াতন থেকে মুক্ত হতে চাইছিলো বহুকাল ধরেই। কিন্তু দেশীয় ইরেজ-তোষণকারীদের কূটকৌশলের কারণে তা সব সময়ই ভন্ডুল হয়ে যায়। খেলাফত আন্দোলন, আর অসহযোগ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সৃষ্ট সম্মিলিত রাজনৈতিক অভিঘাতে আপামর জনতা জেগে উঠেছিলো মুক্তির জন্য, নজরুল তাকেই অগ্নি-গোলা করে ছুঁড়লেনে যেন তাঁর বিদ্রোহীকে।
বাঙালি চেতনায় দ্রোহ ছিলো, তবে তা ছিলো নিশ্চুপে, অন্তরের ভেতরে তা গুমরে মরছিলো, রাজনীতি তাকে উস্কে দিলেও আগুন জ্বালাতে পারেনি। কারণ সেই রাজনীতি জনমনে অগ্নিপ্রজ্জলনের উপাদান দিতে পারেনি। পারেনি উপনিবেশ থেকে মুক্তির কথা উচ্চারণ করতে। ফলে দ্বিধান্বিত জনতা যখন নজরুলের কবিতার ভেতরে তাদেরই প্রাণের কথা শুনতে পেলো, মুক্তির মন্ত্র দেখতে পেলো, স্বাধীনতার মর্ম পেলো, পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে কেমন করে বেরিয়ে আসতে হবে সেই মন্ত্রণার দিগন্ত চোখে ভেসে এলো, তখন তারা পেয়ে গেলো তাদের এতোকালের অন্বেষণের রাজপথ। মূলত দ্রোহ করে যে মুক্তি অর্জন করতে হবে এই কথাটাই রাজনীতিকরা ভুল গিয়েছিলেন ব্রিটিশদের তাবেদারি করতে গিয়ে। একমাত্র উর্দু কবি ও রাজনীতিক হযরত মোহানী স্বাধীনতার প্রস্তাব করে চিনিয়েছিলেন যে দ্রোহ ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব নয়। সেই অপরাধে তাকে ব্রিটিশের কারাগারে দুই বছর কাটাতে হয়েছিলো। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের যৌথ মিটিংয়ে হযরত মোহানীর প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন গান্ধী ও তার কংগ্রেসী নেতারা। বাংলায় প্রথম কোনো রাজনীতিক নন, মুক্তির পথ দেখে ছিলেন নজরুল। তাঁর অর্ধ-সাপ্তাহিক ধুমকেতু চায় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা। আর বিদ্রোহী কবিতায় সেই চাওয়ারই বাণীবৈভব আমরা দেখি। এভাবেই বাংলা কবিতায় দ্রোহের রাজনৈতিক চেতনা সাংস্কৃতিকভাবে অর্জিত হয়।
২.
বিদ্রোহী’র ছন্দবৈচিত্র্য, বাণীবৈচিত্র্য ও দ্রোহের প্রকৃতিবৈচিত্র্য পাঠককে কেবল মুগ্ধই করে না, তাকে ভাবতেও শেখায়। যে সব মিথিক কলা তিনি ব্যবহার করেছেন, তার উপরিকাঠামোর অর্থদ্যোতনা ও তার গহন-কাঠামোর [ডিপ স্ট্রাকচার]প্রতীকী ভাষ্যের যে যাত্রা আমরা উপলব্ধি করি, সাধারণ পাঠকও তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের ভাবনার সঙ্গে ভারতীয় মিথের লৌকিক ব্যবহার তাদের সাংস্কৃতিকভাবে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করেছে।ফলে কবিতার কথার মানে উপলব্ধি করতে কোনো সমস্যা হয়নি।
আমি চির দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
বিদ্রোহীর উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোর অর্থ বাঙালি পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য নয়। এ-কবিতার পঙক্তির পর পঙক্তির উদ্ধৃতি আমরা বহুবারই পড়েছি,দেখেছি এবং তাতে মুগ্ধতার কমতি পড়েনি।এর পেছনে সক্রিয় রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ। নজরুল যাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, যাদের রাজসিংহাসন ফূঁড়ে উঠতে চেয়েছিলেন, যাদের ‘অবসান’ করতে চেয়েছিলেন, সেই ইংরেজ এদেশ ছেড়ে গেলেও তাদের কালচারাল হেগেমনি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আর এখানেই নজরুলের বিদ্রোহীর প্রাসঙ্গিকতা আমরা লক্ষ্য করি। আমাদের সমাজ বাস্তবতা, আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক আচরণ, শোষণ ও বঞ্চনা, নিপীড়ন ও দলন-দমন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজশক্তির এদেশীয় শিক্ষিত এজেন্টদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এরা, মুখে বাংলা, বাঙালিয়ানা, বাঙালি সংস্কৃতির সজ্জাসৌরভ নিয়ে মুখর হলেও অন্তরে তারা লালন করে বৈশ্বিক সংস্কৃতির প্রবাহ। তাদের সাংস্কৃতিক আচার-আচরণও আন্তর্জাতিক সৌরভে স্নাত, কিন্তু পোশাকে-আশাকে বাঙালি। এর কারণ, আমরা যে সব ভাষায় প্রশিক্ষিত হই, আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে যে সাংস্কৃতিক ধারা বহমান, আন্তর্জাতিকতার নামে প্রবলভাবেই ইউরো কালচারাল ফাঁদের ভেতরে বাস করছি আমরা। এখানেও কাজী নজরুলের দ্রোহের যেন প্রয়োজন রয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের বিশিষ্টতা আমাদের বাঙালি হিসেবে যেমন চিনিয়েছে, তাকে সর্বাংশে লালন করতে হলে আরেকবার দ্রোহের প্রয়োজন।
তবে, নজরুলের ভঙ্গিতেই আমাদের এ-কথা বলতে হবে— ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর –হাতে রণ-তুর্য় ;
যুদ্ধ করার জন্য আমাদের মন-মানসিকতাকে ঠিক পথে চালিত করতে হবে। সেই রণ-তুর্য়’আমাদের মনের গহনে লালন করতে হবে, বহন করতে হবে এবং প্রয়োজনে তার ব্যবহার করতে হবে।
আমি মানি না কো কোনো আইন,
আমি ভরা তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি , আমি এলোকেশে ঝড় অকাল বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত, বিশ্ব বিধাতৃর!
……………………………………………………………
আমি আপনার তালে নেচে যাই আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
যে আইন মানুষের বিরুদ্ধে নিপীড়নের হাতিয়ার, সেই আইন কোনোদিনই একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য প্রণীত আইন হতে পারে না। ব্রিটিশদের হাতে তৈরি আইন পাকিস্তানি শাসনামলে প্রায় অবিকৃতভাবে প্রচল হয়। ব্রিটিশরা উপমহাদেশের মানুষদের শত্রু-জ্ঞান করতো এবং নেটিভরা তাদের চোখে সব সময়ই অন্যায়-অপরাধ করে থাকে। এই ধ্যান-ধারণার কোনো ইতরবিশেষ হয়নি বলেই আইনগুলো প্রায় অবিকৃতভাবে চালু করে পাকিস্তান সরকার। আবার সেই আইনই বাংলাদেশে যখন চালু হয়, রাজনৈতিক সামাজিক রাষ্ট্রনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি যতোই পাল্টে যাক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও ক্ষমতাসীন শাসকদের মনে-মননে ও মানসিকতায় আচরণে, দৃষ্টিকোণগত দিক থেকে ব্রিটিশদের চেতনাই পরিবহন করেছে। তারা আজ প্রভু, আর আমরা শাসিত জনগোষ্ঠী তাদের চোখে ‘নেটিভ’। এ-কারণেই দেশের শাসক গোষ্ঠীর আমলারা সাধারণ মানুষদের সঙ্গে অসাদচরণ করতে দ্বিধান্বিত হয় না। তারা যে প্রভু গোষ্ঠীর লোক, সেটা তাদের ক্ষমতার শান-সৌকতের ভেতর দিয়ে জানান দেয়। আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রয়োজন মহাভারতের ভীমকে। প্রয়োজন জলযুদ্ধের টর্পেডো, স্থল যুদ্ধের মাইন।
এ-সব কারণেই নজরুলের বিদ্রোহী আজো পুরোপুরিই আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের জন্য প্রয়োজন। মহাভারতের চরিত্র ধূর্জটিকেও আজ প্রয়োজন ভেবেছেন কবি তার অভিপ্সিত লক্ষ্যে পৌছার জন্য। কারণ শাসক ক্ষত্রিয়দের অপশাসন রুখে দিতে হলে ধূর্জটি যেমন কঠোর কোঠার হেনেছিলো, আজও তার ব্যবহার প্রয়োজন রয়েছে। অকাল বৈশাখের ঝড় যেমন এলোমেলোভাবে জনজীবনকে তছনছ করে দেয়, কবি নিজেকে সেই অকালবৈশাখের সাথে নিজেকে মিলিয়েছেন। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ঝড়কেও তিনি চাইছেন অসুর ম্রেণির দলনে।
একটি কবিতা, বিশেষ করে বিদ্রোহীর মতো কবিতা যে কাল থেকে কালান্তরে পৌছে যেতে পারে কেবল রাজনৈতিকভাবে ভুলের কারণে তা আজো প্রায় নির্ভুলভাবে প্রয়োজন হতে পারে সমাজের জন্য, বিদ্রোহী তাই প্রমাণ করে চলেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের রাজনৈতিক সমাজের কাছে সবচেয়ে উপযোগী, প্রয়োজনীয় কবি হিসেবেই বিবেচনা লাভ করেছিলেন তার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের নীতি-আদর্শ হিসেবে। চলমান সমাজকে ভেঙে গড়তে হবে যে নতুন সমাজ, সেখানেই তার উপযোগিতা আমরা আজো যেমন লক্ষ্য করে চলেছি, তেমনি স্বাধীনতাউত্তরকালেও আমাদের রাজনৈতিক শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের সেনানিরা তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। নজরুল সে-কারণেই দেশের ও জাতির জাতীয় কবি, জাতীয় সত্তার কবি অভিসিক্ত হন। সেই অভিষেক পুরোপুরিভাবেই যথার্থ। যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা ছিলেন গণমানুষের প্রতিনিধি, তাদের চেতনায় ছিলো মানুষের পক্ষে কাজ করার মতো মন ও মানসিকতা। তারা যে জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ, উন্নয়নের রাজপথে উঠেছিলেন, বিজয় অর্জনের ভেতর দিয়ে তা ঐতিহাসিকভাবে সত্যে পরিণত হয়। আমরা দেশমাতৃকার মুক্তিকে বাস্তব করে নিজেদের গৌরবের শিখরে তুলেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদ্রোহী কবিতাই কেবল নয়, নজরুলের দোশাত্মক সব রচনাই আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস ছিলো এবং আজও তা প্রাসঙ্গিক। নজরুল যে সাহস যুগিয়েছিলেন আমাদের যুদ্ধের ময়দানে, গান ও কবিতার অভ্রভেদী চেতনার রৌদ্রকরোজ্জ্বল আলোকমালায়, তাকে আমরা সবসময় বহন করিনি। নজরুলকে আমরা জাতির মাথার ওপরে তুলে রেখেছি, তার চিন্তা ও ভাবনার সব কিছু ব্যবহার করিনি। এবং আমরা বুঝতে পারিনি যে নজরুল ও বিদ্রোহী কবিতার সাংস্কৃতিক অভিঘাত আমাদেরই জাতি-চেতনার ভেতরে নতুন বাস্তবতা নিয়ে উপস্থিত। আজকে, সমাজে যে পরিমাণ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, যে পরিমাণ ব্যবসায়িক লুটেরা শ্রেণির উদ্ভব, যে পরিমাণ মিথ্যার রমরমা চলছে রাজনীতিতে ও সমাজের ভাঁজে ভাঁজে—- সেই সব অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধেই নজরুলের সাহসকে ব্যবহার ছাড়া অন্য কোনো নতুন পথ নেই।
বিশ্ববিধাতৃর যারা সুত মানে পুত্র, তারাই বিদ্রোহী, কেন না, তারা সমাজের অন্যায়, রাজনৈতিক সমাজের অন্যায়, প্রশাসনিক অন্যায়, লুটেরা শ্রেণির অন্যায়, শাসক শ্রেণির কর্তৃত্ববাদিতা— তাদের অন্যায়কে উপড়ে ফেলতে হলে চাই সেই সাহস, যা নজরুল বলেছেন নিজেকে ‘দ্রোহী’ ঘোষণা করে। শুধু তাই নয় তিনি নিজেকেও বিদ্রোহী-সুত বলেছেন। যে বিশ্ববিধাতৃর পুত্র তিনি, সেই মালিকও বিদ্রোহী। অতএব আমরা কেন দ্রোহের মধ্যে যে সাহস লুকিয়ে আছে তাকে জাগ্রত করবো না?
কাজী নজরুল ইসলামকে বুঝতে হলে তার চিন্তা-ভাবনা ও জীবনাচারের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। আমরা যদি লক্ষ্য করি, নজরুলের কাব্যিক উত্থান, বিদ্রোহী দিয়ে তার জনপ্রিয়তা এবং তার মনে রয়েছে যে সব সাহসী কথার উৎসার-উদ্ভাবনা, তাকে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। যে সাহসের ঘুড়ি তিনি আকাশে উড়িয়েছিলেন, তাকে আরো উড়াতে হবে। সেই মনোভাবের জন্যই কী জাতি আজ উন্মুখ নয়?