প্রচ্ছদকবিতানির্বাচিত ৪০ কবিতা : শাকিল রিয়াজ

নির্বাচিত ৪০ কবিতা : শাকিল রিয়াজ

গুম

মৃত্যু এসে কানে কানে ফিসফিস করে।

চেঁচিয়ে ধমক দেই তাকে,
কী বলবে বলো, জোরেশোরে বলো বন্ধুবর
অন্তর্ধানের এমন ডাক হোক উৎসবমুখর।
জীবন তো গোপনীয় কিছু নয়
জীবন তো কেটে গেল সশব্দ বিলাপে হাহাকারে হাহাকারে
যে জীবন সকলেই চেনে তার কাছে কেন নিচুস্বরে প্রাণভিক্ষা চাও যাদুধন?
কী বলবে বলো। মুখোমুখি বলো। উচ্চস্বরে বলো
খাবার টেবিলে ট্রেনে-বাসে ভ্রমণের ভিড়ে তুমুল আড্ডায়
বলো মৃত্যু, প্রিয়জন, কী তবে চাওয়া
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠকে ধার নিয়ে বলো তবে
পূজোর মাইকে বলো গীর্জার ঘণ্টায় বলো
বলো সমাবেশে আঙিনা-বৈঠকে ক্লাসরুমে
ফুটবল মাঠে পূর্ণিমায় বিয়ের আসরে।

উচ্চরবে আমি মারা যেতে চাই সোনা
নিরিবিলি অন্ধকারে গুম হতে চাইনা কখনো।


বৃত্ত

বেলুনে বেলেছো মন, অনিশ্চিত রুটি হই দিন দিন।
আয়ু বাড়ে গোল হয়ে, শীর্ণকায় হতে থাকে অভিলাষ।
দক্ষ সদালাপী হাতে গুণগুণ করে রুটি নয়, বেলেছো আমাকে হায় অবিরাম, মথেছো আমাকে।
এ এক অদ্ভুত বৃত্ত হয়ে বাড়ে আমার জীবন।
এমন উন্মুক্ত রান্নাঘরে,
এই ধোঁয়াময় সেঁতসেঁতে স্বাদে
আমাকে যে সেঁকা হয় অবশেষে গরম তাওয়ায়।

একবার খুব বৃষ্টি হলো এই রান্নাঘরে
ফোটানো ছাতার মত টানটান হয়ে খুলে গেল তোমার শরীর। ফুলে গেল শেমিজের নকশাকাটা নজর।

চোখ নেমে যায় বারবার ভুলের উনুনে
কতক অভিসম্পাত হয়েছিল সেঁকা তাতে আর
ফেঁপে উঠেছিল সাংসারিক তাপে আর দ্বিখণ্ডনে!

ছোট্ট জানালার কাঁচে হৈচৈ করে কিছু বৃষ্টি নামে
ভেতরে তখন খুলে থাকা ছাতার মতন
টানটান করা তোমাদের দেহে
টোকা দিয়ে বাজাই আক্রোশ।
জ্বলে ওঠা আগুনের মত রাগান্বিত ক্ষোভ
রুটির ধরনে ঘোরে। ঘুরে ঘুরে ক্রমাগত সূর্য
যখন উত্তর গোলার্ধের দিনগুলো বড় করে দেয়
তোমরা তখন কাঁদো শুয়ে শুয়ে আঁধারের কাছে।

তার পাশে পড়ে থাকি রুটি উত্তপ্ততা নিয়ে।
বৃত্তহীন হতে গিয়ে এই আমি শুধু বৃত্তে পুড়ে যাই।


আপনি তো
………………

আপনি তো ওই ঘরে নিরিবিলি কাপড় পাল্টান
অথচ কেন মনে হয় গাইছেন গান!
আপনি তো চুলগুলো নেড়েচেড়ে খোঁপাতে রাখেন
অথচ কান কেনো শোনে বেহালার তান?

আপনি তো ওই ঘরে নির্ভেজাল আয়না দেখেন
অথচ চোখে হাহা স্বরে পারদেরা হাসে
আপনি তো ওই ঘরে দরোজার খিল এঁটে দেন
অথচ কেন মনে হলো, বসেছেন পাশে!

আপনি তো ওই ঘরে ঘেমেছেন ঠোঁটের উপর
অথচ জিভে লবনের স্বাদ জমে নাই
আপনি তো বিচলিত, খোঁপা ভেঙে বিনুনি গাঁথেন
অথচ রাগে অনুরাগ ভাঙে সহসাই।

অপেক্ষা মিশেছে গানে, চিরদিন শুনি এই গান
আমাকে বসিয়ে রেখে পরনের শাড়ি বদলান!


ঘুমের ভেতর

ঘুমের ভেতর আবছা করে তুমি
আবার এলে ঘুম ভাঙাতে ফের
আবার তুমি হাত দিয়েছো গায়ে
তাপ খুঁজেছো জ্বরের মানুষটায়।

এই যে দেখো কতো বছর পর
জাগলে তুমি ঘুমের শহরটিতে
জানলা খোলা, উড়ছে পাতা কাঁচে
নক করেছে আমার ছোটকাল।

তুমি তখন খুব অসুখি ছিলে
বাড়ির দিকের রাস্তা ছিল ভারী
তোমার পায়ে মদ্যদোলন ছিল
তোমার পায়ে ছিল পদস্খলন।

বেঁচে আছো? কোথায় কেমন আছো?
কোন শাড়ীতে প্যাঁচাও দেহের লাজ
আমি এখন বরফঢাকা বাঁশি
শিস দিয়েছি ঘুমের দিকে ফিরে।

হঠাৎ তোমার কান্না শুনি ঘোরে
কাঁদো তুমি আগের মতই মৃদু?
কেমন আছো হু হু হৃদয় তুমি
কেমন আছে কলেজ ফেরা পথ?

জুলাই মাসের আকাশ জ্বলা রোদে
আজো হাঁকে বিষ্যুদবারের ছায়া?
তোমার নামটি ওই বিকেলের কোলে
রেখে এসে হাত ধরেছি মায়ার।

ঘটা করে প্রেম দিয়েছো গালে
শুষ্ক চোখে চোখ মেরেছো কতো
ভালবাসার দাগগুলো সব রেখে
কেমন আমি দীর্ঘ অভিবাসী!

বেঁচে আছো? কেমন বেঁচে আছো?
কোন সড়কের কোন তালাতে ঘর?
ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে আজো
তোমার হাসির চিহ্ন পাওয়া যাবে?

তিরিশ বছর আগের ধূলিগুলো
ফুঁ দিয়েছো হঠাৎ ঘুমে এসে
হঠাৎ তোমার হাত রেখেছো জ্বরে
গাল রেখেছো এমন অন্ধকারে!

নামটি তোমার ভুলেই গেছি মেয়ে
ছদ্মনামে ডায়রি ছিল ভরা
ডায়রিগুলো কোথায় আছে আহা
নামগুলো ঠিক কোথায় মানানসই!

মাসুদ রানার মাঝ পাতাতে ভরে
ছোট্ট করে চিঠি দিতে খুব
ছোট্ট ছোট্ট জীবন আঁকা স্বর
তুলে রাখতাম নিঃসঙ্গ গিটারে।

কোথায় আছো? কোথায় এখন থাকা?
চায়ের চুমুক ঠাণ্ডা করেই দাও?
বুকের ব্যথা পুষেই রাখো বুকে?
ভীষণ মায়ায় হাত রাখেনা কেউ?

ঘুমের ভেতর আসলে তুমি মেয়ে
পাঁজরজুড়ে ব্যথার অভিমান
ঘুমের ভেতর আসলে ব্যথা নিয়ে
পাঁজর তোমার রাখলে আমার গায়ে।

তোমার পাঁজর খুলছি যেন খাতা
একটি করে লাইন লিখেছি তাতে
ঠিক যেখানে তীব্র ব্যথার সুর
ঠিক সেখানে টান দিয়েছি দাঁড়ি।

কাঁদছি আমি কাঁদছি আমি দেখো
তোমার মতই কাঁদতে আমি পারি
তোমার কবি কাঁদছে অবিরাম
এই জীবনে আর পাবে না খোঁজ।

ভালবাসার ছন্নছাড়া পা
যেমন হেঁটে আসে তেমন যায়
দু’টি হৃদয় দু‘দিক ঠেলে দিয়ে
ছন্নছাড়া হাওয়ায় মিশে যায়
হাওয়ায় মিশে যায়
হাওয়ায় মিশে যায়।


মৃত্যু

এখন একটুতেই মাটিতে পড়ে যাই
হু হু বাতাসের টানে হুমড়ি খেয়ে পড়ি
পাথরে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ি
ভারসাম্যহীন দেহে বিকেলের শেষ রোদ এসে পড়েছে
আমি বারবার নৈসর্গের বিপদে পড়ি।

এখন একটুতেই ভেঙে পড়ি
স্বদেশের জন্য কান্নায় লুটিয়ে পড়ি
সন্তানের আদরে বিগলিত হয়ে পড়ি
মৃত পিতার জান্নাত কামনায় অথবা
জননীর দীর্ঘায়ু চেয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ি।

আরও কিছু পড়ে যাওয়া অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায় খুব
তোমার নীলবর্ণ চোখে খুব সহজেই পড়ে যাই
তোমার নিস্পৃহতার গভীরে পড়ে যাই
অস্পষ্ট হাতছানির প্রেমে পড়ে যাই
কিছু অদ্ভুত ঘোরের ফাঁদে পড়ে যাই
মুগ্ধ শৈশবের স্মৃতিতে পড়ে যাই
অতীতের কিছু বিক্ষত রমণীর মনে
দগদগে ঘায়ের মতো পড়ে থাকি
তোমাদের মনে পড়ে যাই ক্রমাগত।

সিঁড়িতে নামতে গিয়ে পড়ে যাই
বাসে উঠতে গিয়ে কিংবা
রিকশা থেকে পিছলে পড়ে যাই
পড়ে যাই নিজেরই দুঃসহ বেদনার ভারে
ভারসাম্যহীন জীবনের অসীম পথের ধাক্কায়
চূর্ণময় ভেঙে পড়ি সড়কগুলোতে।

দু’ফোঁটা আদরের মোহে পড়ি
এক পঙক্তি আলিঙ্গনের মোহে পড়ি
ব্যর্থতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ি
আমি ঘুমিয়ে পড়ি আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

এখন একটুতেই আমি পড়ে যাই।

এই পতনের আর কি মানে আছে দয়াল?

মাটি ডাকছে।


দুটি মুঠ
………………

মৃত্যুর সামনে এসে জীবনটা বেঁকে বসে আছে।
কীভাবে ফেরাবে তাকে?
অটামে এমন হয়, পাতা ঝরে রাতের গভীরে
কমলা রঙের পাতা, শয্যাশায়ী, সেখানে করুণ জ্যোছনা
কিছু সুর রেখে যায়।
এমন মেলোডি আমি তুলে রাখি গিটারের তারে।

গিটারে তোমার চোখ, মৃত্যুকামী তুমি
ডাগর অনুসরণ।
স্ক্রুর মত ঘুরে ঘুরে তোমার অবাধ্য চোখ আলগা হয়ে গেলো
মৃত্যু পষ্ট হয় এই অন্ধতায়।

মৃত্যুর সামনে এসে জীবনটা বেঁকে বসে আছে।
দোয়ার ভঙ্গিতে আমি তাই
দুহাতে এনেছি বয়ে দশটি আঙ্গুল
তুমি ধার নেবে দুটি মুঠ এই ভরসায়।
দুটি মুঠ! তুমি ধার নেবে এই ক্ষুধা?

অনাহারী এক প্লেটে পড়ে আছি সামান্য খাবার
কীভাবে ঠেকাবে?


শুধু মনে আছে
…………………

তুমি রাত জেগে গান শোনাতে
আমি রাত জেগে কবিতা শোনাতাম।
সেইসব গান আর কবিতা
ভুলে গেছি কবে!
শুধু মনে আছে
রাত জেগেছিলাম।

তুমি ভয়ে ভয়ে হাত ধরেছিলে
আমি ভয়ে ভয়ে চুমু খেয়েছিলাম।
সেইসব চুমু আর হাত ধরাধরি
ভুলে গেছি কবে!
শুধু মনে আছে
ভয় পেয়েছিলাম।

তুমি শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে
আমি শুয়ে শুয়ে তারা গুণতাম।
সেইসব আকাশ আর তারা
ভুলে গেছি কবে!
শুধু মনে আছে

শুয়েছিলাম।


নিষিদ্ধ

কোথায় যাবো আজ?
ভালোবাসার হাত ধরেছে
পথের কারুকাজ।

রাতের আছে ক্রোধ
অন্ধকারের কাছে আমি
খুঁজছি প্রতিশোধ।

ছুঁইতে নাকি বারণ
নিষিদ্ধতার কাছেই আমি
খুঁজছি প্রেমের কারণ।

ভুত এসেছে ভুত
তোমার সাধের উঠোন জুড়ে
খেলবো যে কুতকুত।

ভোর হবে না আর
আমার সজল চোখেই ডোবে
তোমার রবিবার।

হঠাৎ কেন জ্বর?
টেলিফোনের অন্য পাশে
ফুঁসছে তোমার বর?


তুমি আমি

তুমি আমার জীবন যদি
আমি তোমার মৃত
তোমার প্রোজ্জ্বলনে আমি
অগ্নিকান্ত ঘৃত।

তুমি আমার রৌদ্রগুলো
আমি তোমার মেঘ
তোমার জন্মদিনে আমি
ছুরির নিচে কেক।

তুমি আমার মুগ্ধ সাঁতার
আমি তোমার ডুব
তোমার মধুর সন্তরণে
শ্বাস ফেলেছি খুব।

তুমি আমার পরী যদি
আমি তোমার ভূত
রাতবিরাতে খুঁজে বেড়াই
তোমায় ধরার ছুত।

তুমি আমার মিহি বাতাস
আমি তোমার ঝড়
তোমার ফুঁতে গা জুড়োবে
আমার ভাঙা ঘর।

তুমি আমার পথিক যদি
আমি তোমার পথ
তোমার পদচিহ্নে খুঁজি
না ভাঙা শপথ।

তুমি আমার ভীষণ রানী
আমি তোমার ফেউ
তোমার দেহের বৈঠা নিয়ে
ঢেউ খেলেছি ঢেউ।


কম

ভালবাসা কিছু কম হোক প্রিয়া
বিশ্বাস হোক বেশি
চুলগুলো কম পরিপাটি হোক
চাহিদাটা এলোকেশী।

ফুলগুলো সব ফেলে দিয়ে আজ
হাতদুটো শুধু দাও
শাড়ির আঁচলে যে গ্রাম লিখেছো
সে পথেই শুধু যাও।

কম করে বলো প্রেমের গল্প
মিথ্যা কিছুটা কম
চায়ের টেবিলে দুটি কাপে হোক
যথারীতি সঙ্গম।

স্বপ্ন কিছুটা অগোছালো হোক
বালিশেরা হোক নীল
কপোলে চুমুর দাগ মুছে গিয়ে
উঁকি দিক দু’টি তিল।

জড়িয়ে ধরেছো, এতো জোরে কেনো?
একটু তো রাখো ফাঁক
দু’জনের ছোট মাঝামাঝিটায়
ভালবাসা দম পাক।

রাগ করে শেষে অভিমান নিয়ে
ঘুরে তুমি বসলেই
পুরুষেরা শুধু জানে গোলাপের
সামন পেছন নেই।


একাকিত্ব

চেয়েছিলে প্রেম সে বেলায় তুমি
প্রেম দিলে প্রেম জিততো
এ বেলায় তুমি ফিরে এলে শুধু
দিতে পারি একাকিত্ব।

কথার দমকে দিন উড়ে যেতো
ছিল না ভাবনা-বোধ
এখন ভাবনা ওড়াওড়ি করে
কণ্ঠে নেমেছে রোধ।

চাইবে কী বলো দেখা হলে ফের
প্রেম নাই প্রেম নাই
নিতে পারো এই শুকনো চোখের
ব্যথাতুর কান্নাই।

তোমার চিঠিটি ফিকে হয়ে গেছে
হলুদ হয়েছে আরো
খুব করে তাকে শাসিয়ে বলেছি
হাত ছাড়ো হাত ছাড়ো।

তোমার কোলেতে ভেঙে পড়বার
দিনগুলো ওঠে তেতে
অটামে পাতারা ঝরবার আগে
রঙে রঙে ওঠে মেতে।

ঝরা পাতা ঠেলে ফিরতে চেয়েছি
অথচ যাচ্ছি সরে
কতদূর গেলে ভুগতে হবে না
একাকিত্বের জ্বরে?


ওহী — ১

আমরা মূলত মৃত
জীবনের জামা গায়ে হাঁটি কিছুদিন!
আমরা মূলত ক্রীত
হাত পাতি সে জামায়, বলি, কিছু দিন।

ওহী — ২

তোমার ছোঁয়ায় ভাল আছি প্রিয়া
তোমার আদরে তৃপ্ত
তবু কেন চোখে জিজ্ঞাসা রাখো দৃপ্ত?

জানতে চেয়ো না অন্তর্গতে
কেমন কাটছে দিন
সত্যটা আমি বলবো না কোনদিন।

ওহী — ৩

বোতামে জড়ানো এ কার দীর্ঘ চুল?

তিনটি রমণী চুমু খেয়েছিল আজ।
ভুলে গেছি তুমি তুই কি আপনি
কে বেশি বন্য ছিল
কে যেন হঠাৎ মুখ ঘষেছিল বুকে?

তুই বা তোমার নাকি আপনার
কার চুল বেখেয়ালি?

ওহী — ৪

মাপ করে দে খোদা আমায়
‘নাই’ ভেবেছি তোরে,
মাপ করেছি আমিও তোকে
‘নাই’ ভেবেছিস মোরে।


জার্নালিজমের মেয়ে

তোমাকে দেখেছি ভোরে একুশের বর্ণ কোলাহলে
জার্নালিজমের মেয়ে, প্রথম বর্ষের সেই রেখা
কী সুন্দর নাম আহা! লাজনম্র, উঠেছিলে হলে
মনে পড়ে? সেই থেকে তো আমার রমণীত্ব শেখা।
তারপর দেখা নেই ছ’বছর। প্রবল ফাল্গুনে
তোমাকে দেখেছি আজ প্রথাহীন উগ্রতার ভিড়ে
মিশুই বলেছে আগে, মেয়েদের মধ্যে হাতে গুণে
একমাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ মাখেনি শরীরে
কম্যুনিকেশন থিয়োরির মর্ম। আন্তঃযোগাযোগে
তুমিও অভ্যস্ত হলে? বুঝেছিল মাসুদ চৌধুরী।
আর আমি? ছিটেফোঁটা জানতাম, ওই দেহ ভোগে
কী দারুণ জ্বরে! ঠোঁটে নেচে ওঠে কত সুরসুরি।

মেধার বালাই নেই, তবু শুনি তোমার সুগোল
স্তনের প্রতিভা নিয়ে তুমি আজ বিখ্যাত হয়েছো
শোকে ও উল্লাসে কাঁপে কতিপয় চিহ্নিত ভূগোল
কাঁদিনি বিক্ষত আমি, তবুও তো শরীরে রয়েছো!


পাশের বালিশ

ঘুম থেকে সময় বাঁচিয়ে চোখের ঢুলুঢুলু পাতায় রেখেছো আজ ভোরে।

তোমার এলার্ম ঘড়ি তাই আগেভাগে ডেকে তুললো। পাশের রুমে বাচ্চাদের এলার্ম বাজবে আরো পনেরো মিনিট পর।

বুঝলাম, তুমি জেগে থেকে কিছুটা শুতে চেয়েছিলে। কিছুক্ষণ লেপ্টে থাকতে চেয়েছিলে এই দিকে।

ঘুমের চোখে ধুলো দিয়ে আনা এই পনেরো মিনিটের নাম দিলাম —

প্রেম।


একটি শাদা প্রেম

অন্ধকারে বসে আছি
তুষারপাত থেকে কিছু আলো ছিনিয়ে নিয়ে
কে ছুঁড়ে মারলো জানালায়?

কেউ নেই। কিছু পদচিহ্ন পড়ে আছে পথে।
আঁকাবাঁকা ছন্দহীন পদরেখা, টলোমলো অক্ষর যেন।
এই ঘন তুষারপাতে কে এমন কবিতা লিখে গেলো পথে?
আমি তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ আন্দাজ করে ফেলি। আমি তার প্রেমে পড়ি।

আমি দেখি, তুমি বাসায় ফিরেছো। একটি একাকী বাসায়।
শীত সেলাই করছে তোমার দাঁতগুলো। দেখি,
একটি চিরুনি তোমার চুল ছুঁতে কীভাবে থুতনি ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে তোমার অতৃপ্ত নতমুখে
আমি ওই হতভাগ্য চিরুনি হয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে
তোমার পিঠ বেয়ে নামাবো অন্ধকার।

অন্ধকারে মাথা রেখে ঘুমাই।
তুষারপাত থেকে কিছু আলো ছিনিয়ে নিয়ে
কে ছুঁড়ে মারলো ঘুমে?

কেউ নেই। কিছু স্বপ্ন পড়ে আছে কাঁধে।
রঙহীন, অবয়বহীন, মৃতের মত শাদা।
তুমি বললে, শাদা তো মিছরির রঙ! ভারী মিষ্টি।
তুমি বললে, তাই স্বপ্নকে জিহ্বায় টেনে এনে স্বাদ চেখে দেখি।
কিছু না, তোমার ঠোঁটের চারধারে হাসি সামলানো
টোলগুলো জিহ্বায় টের পাই।

এই নবেম্বর রাতে, এই তুষারপাতে
এই ঘনঘোর শাদা অরণ্যে
তোমার জুতোয় জমে থাকা স্নো
কত নিরিবিলি গলে গিয়েছিল ফ্লোরে
আর গড়িয়ে গড়িয়ে এসে নিঃশব্দে ভিজিয়ে দিয়েছিল আমার পা।

এই জুতো ঘরে ফেরে, পদচিহ্ন পড়ে থাকে পথে
কাল খুব ভোরে উঠে এই চিহ্নগুলো পোস্ট করবো তোমাকে।

তোমার ঠিকানা কি গ্রীষ্মকাল?


কবি আল মাহমুদের মৃত্যুতে

সুউচ্চ পাহাড়ের ওপাশ থেকে
নক্ষত্রের পেছন থেকে
যাবতীয় ফুল ও গানের আড়াল থেকে
আলো ও অন্ধকারের কিনার থেকে
নিসর্গের খা খা শূন্যতা থেকে
মিছিল ও কোলাহলের প্রতিধ্বনি ছোঁয়া প্রাচীর থেকে
বুনো গ্রাম, উচ্ছল নদী ও হারিয়ে যাওয়া নোলক ফিরে পাবার আকুলতা থেকে
ব্যথা ও রুগ্নতার শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকা
ভারাক্রান্ত শাদা বাতাস থেকে
ফিসফিস করে কেউ আপনার কানে কানে বলেছিল, এসো কবি, এসো আমাদের কাছে,
পৃথিবীর আয়তনে খুব ঠাসাঠাসি হয়ে আছো আহা!

আমাদের কবি অবশেষে চলে গেলেন
মখমলের মতো তাঁর পেলব ডানহাত নেড়ে।

আমি ঘরের আলো নিভিয়ে জানালা খুলে দিলাম
এই শীতার্ত অস্পষ্ট দৃষ্টিহীন মধ্যরাতে
আমি হাত নেড়ে যাচ্ছি অসীমের দিকে আর
আমার দাঁত কামড়ে ধরেছে জানালার গ্রিল।


কাল তুমি অফিসে ফিরবে

পৃথিবীরা মরে যায় যার যার গৃহে
আমার অভিবাসে আমি একা বেঁচে থাকি
একাই বেঁচে থাকি এই মায়াহীন অনাত্মীয় সন্ধ্যায়
দিকভ্রষ্ট ট্রেনে মন খারাপ করে কোথাও
চলে যাবার মতো বেঁচে থাকি।
একটি প্রাণোচ্ছল অপেক্ষাকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে রেখেছি
জন্মান্তরের আশায়। জীবন সহজ হোক নতুন অধ্যায়ে।

কাল তোমার ছুটি শেষ হবে নবোঢ়া
কাল তুমি অফিসে ফিরবে
কাল তুমি আমার ছায়াচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে
অনিদ্রার সাগর থেকে তুলতে চাইবে দু‘ফোটা তেষ্টা
তোমার ভ্রমণতপ্ত চিবুকের দিকে
একবারও তাকাবো না কাল।

আমি বারবারই একা বেঁচে থাকি
তোমাদের সুখসন্তপ্ত মৃত্যুবিলাসের শহরে
অহেতুক কিছু ব্যথা নিয়ে দুঃসহ বেঁচে থাকি।

কেন তুমি বেড়াতে যাও দূরে? ভূমধ্যসাগরে?
সান্তোরিনির শাদা পাথরে রোদ হয়ে পড়ে থাকা গ্রীষ্মকাল
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালে
তুমি কি জলপাই বনে গিয়ে কাপড় পাল্টিয়েছিলে?
তোমার শরীরে জলপাইয়ের গন্ধ লেগে আছে।
জলপাই তোমাকে কী করেছে?
বলো, কী করেছে?

কাল আমার চোখের দিকে তাকিয়ে
ভূমধ্যসাগরে তোমার স্নানের গল্প বলবে
আর জলপাইয়ের কথা বলতে গিয়ে
মুখ ভরে যাবে মনে পড়ার লালায়…

আরো দুই পঙক্তি হলে শেষ হতে পারতো এই কবিতা
অথচ আমার চোখ থমকে গেল
ভূমধ্যসাগরের মিহি গভীরতায়
আমার শ্বাস রুদ্ধ হলো জলপাইয়ের নিলাজ গন্ধে।


বাদামী
……………

তোমার নৈঃশব্দ্য নিয়ে বসে আছো যেখানে
সেখানে হুলুস্থূল করে কিছু ভাবনা জড়ো হয়
তোমার এই নৈঃশব্দ্য ভাবনায় আমি একদম অচেনা
কিন্তু তোমার এই নৈঃশব্দ্য ভাবনা আমার অচেনা নয়।
তুমি তাকিয়ে আছো যেদিকে সেই শূন্যতায় আমি অচেনা
কিন্তু সেই শূন্যতা আমার অচেনা নয়।
তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত চোখ থেকে
এক ফোঁটা পানি হাওয়ায় মিশে গেলো
ওই দুঃখ ভারাক্রান্ত চোখের কাছে আমি অচেনা
কিন্তু ওই দুঃখ ভারাক্রান্ত চোখ আমার অচেনা নয়।
স্তিমিত জানালায় চাঁদের আগুন এসে লাগে
এ চাঁদ গলে গেল যে উৎকণ্ঠার তীব্র শ্বাসে
আমি তাকেও চিনি
তোমার উৎকণ্ঠায় আমি বহিরাগত
কিন্তু তোমার উৎকণ্ঠা আমার কাছে বহিরাগত নয়।
আমাদের এই সান্ধ্য বন্ধুসভায় তুমি আজ অনন্যা নও
তোমার রুদ্ধ হয়ে আসা শ্বাসে কিছু ভাঙা প্রেমের টুকরো গেঁথে আছে
তোমার ব্যথাতুর রুদ্ধশ্বাসে আমি অচেনা
কিন্তু ওই রুদ্ধশ্বাস আমার চেনা।

তুমি যখন গ্রীবা উঁচু করে শূন্যে তাকাও
তোমার কানের নিচের কালো ট্যাটু
আরেকটু স্পষ্ট হয়।
প্যাঁচানো হরফে তুমি লিখে রেখেছো তোমার শহরের নাম—
স্টকহোম।
এই প্রেমহীন অবসন্ন শীতল শহর
তোমার কানের নিচে গরম হয়ে ওঠে।
এই প্রেমহীন অবসন্ন শীতল শহরে
আমি নিতান্তই বহিরাগত
কিন্তু এই প্রেমহীন অবসন্ন শীতল শহর
আমার কাছে বহিরাগত নয়।

তুমি কার জন্য কাঁদো?
কার জন্য হূ হূ করে তোমার বাদামী চোখ?
এই ফর্সা লোকালয়ে এই শাদা মানুষের ভিড়ে
আমি তোমার চোখের মতো বাদামী
কিন্তু আমার কাছে তোমরা বাদামী নও।


কাঁদিনি, শুধু চোখ মুছলাম

কাঁদিনি, শুধু চোখ মুছলাম।
ভীষণ ব্যথা নিয়ে এসেছি আজ
সম্পর্কের কর্কশ দড়িতে বাঁধা শরীর থেকে
খুলছে যখন একটি একটি প্যাঁচ একেক গিঁট
তখন কিছু নীল দাগ জেগে ওঠে শরীরে
তুমি হাত দিয়ো না এই উপভোগ্য যন্ত্রণায়
শুধু দড়ির এই প্রান্ত ধরে রাখো স্নেহে
আমিই ঘুরে ঘুরে আলগা হয়ে সরে যাবো বহুদূরে।

কাঁদিনি, তবু চোখে ভিড়েছে জলপ্রপাত
জল পতনের তোড়ে জেগে ওঠা কুয়াশার চারপাশে রংধনুর মতো কিছু মানুষ আমোদে মেতেছে
আবছা কিছু মানুষ কিছু হিংসুটে ছায়া কিছু হাসি।

কাঁদিনি।
তবু টলটলে চোখের ভেতর উঁকি দিয়ে
দেখে ফেললে হৃদয়ের গনগনে বিলাপ ও দাহন
কাঁদিনি। কান্নাকে ভালোবেসে শুধু রেখেছি লুকিয়ে।

কাঁদিনি, শুধু চোখ মুছলাম।
শুধু হাতের উল্টো পিঠে
স্ফটিকের মতো জমা হয় লবণের নিবিড় জ্বালা
সেখানে চুমু দিতে গিয়ে
তোমার জিহ্বায় লেগে যায়
কাঁদতে না পারা পুরুষের রুদ্ধশ্বাস বেদনার স্বাদ।

তোমার জিহ্বার কসম! আমি কাঁদিনি।
এতো নোনা জল ডিঙিয়ে
কোনোদিন আমি
ভিড়তে পারিনি কান্নার শানবাঁধা ঘাটে।


বঙ্গবন্ধু এভিন্যু

বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে পড়ে থাকা
কিছু ক্ষত রাতদিন কাঁদে।
তাদের পদপৃষ্ঠ করে
মিছিলে নামে সুচতুর রাজনীতি।
এই ক্ষত দেবে যায় কংক্রিটের নীচে।

এই সড়কের কিছু মুখর মানুষ
শরীরে স্প্রিন্টারের দুঃসহ জ্বালা নিয়ে
রাজনীতির কাছে বিস্মিত কণ্ঠে
কিছু জানতে চায়।
তাদের বোবা করে রাখে কেউ।

দুপাশের শ্লোগান আঁকা দেয়ালে,
সাইনবোর্ডে, ফুটপাথে
গ্রেনেডের দাগগুলো দিনদিন পষ্ট হচ্ছে
আমাদের অভ্যন্তরীণ দানব পষ্ট হচ্ছে দিনদিন।

এইসব ক্ষত, দীর্ঘশ্বাস আর দাগ
সারানো হয়না কেন?

আমরা দীর্ঘশ্বাস থেকে কিছুই শিখিনা
ক্ষত ও দাগ থেকে কিছুই শিখিনা
আমরা ইতিহাস থেকে কখনো শিখিনা কিছু

তবু
আমাদের মনে পড়ার জন্য
এই দাগগুলো দাগ হয়ে থাকুক
ক্ষতগুলো ক্ষত।

পিতা ও ছায়াপথ
………………

বারো বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে
আমাদের মতই আরেকটি ছায়াপথের
দেখা পাওয়া গেছে।
এক সেকেন্ড মানে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল
পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি মাপের আমি
এই দূরত্ব মাপতে মাপতে মরে যাচ্ছি

এতো বড় জগত কেমনে বানাইলা আল্লা!

আমার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে
দেড় হাজার বর্গফুটের পিতা হতে গিয়ে
মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেল

অথচ

এই পঞ্চাশের ঘরে এসেই একটা মানুষ
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের পিতা হয়েছেন

মাত্র দুইজনের পিতার মাপের আমি
একটি দেশের পিতার বড়ত্ব
মাপতে মাপতে মরে যাচ্ছি
এতো বিশাল মানুষ কেমনে বানাইলা আল্লা!


আমার কন্যা ঘুমের মধ্যে হাসে

আমার কন্যা ঘুমের মধ্যে হাসে
খুব বেশি না, মুচকি হাসি। মাঝেমধ্যে
ঠোঁট বাঁকিয়ে কায়দা করে হাসতে গিয়ে
ঘুমে ঢাকা চোখদুটো ওর তিরতিরিয়ে কাঁপে।
আমার কন্যা ঘুমের মধ্যে হাসে।

মেঘের ফাঁকে হরিৎ বরণ চাঁদ
পথের পাশে শাদা ফুলের গায়ে
নরম করে আঘাত করার মতো
ঘুমের মধ্যে হেসে ওঠে মেয়ে।
শাদা মেঘের কুসুম কুসুম আঁশে
রোদের তরল হাত রয়েছে ঝুলে
একটি বহুরঙা ঘুড়ি হঠাৎ
মেঘকে বলে এবার তুমি নামো!
মেঘ নেমেছে জানলা দিয়ে ঘরে
আমার মেয়ের গালের ফোলা ভাগে
এক ফোঁটা জল ঢেলেই বলে, চলি
এই এতোটুক বিরক্তকে ক্ষমা করে দিয়ে
ঘুমের ঘোরে আমার কন্যা হাসে।

স্বপ্নে এখন দৌড়ে কোথাও যাস?
বেগনি রঙের প্রজাপতির ডানায়
ছোট্ট করে ফুঁ দিয়ে তুই উড়াবি কি হাওয়ায়?
স্বপ্নে এখন গ্রিসের পথে মেয়ে
কিংবা আলানিয়ার বীচে স্নান
মিশর গিয়ে দেখে আসা নেফারতিতির মালা
নিজের গলায় পরে হঠাৎ হাসি পেলো খুব?

আমার মেয়ে আড়াল করে আয়না দেখে হাসে
ঘুমের মধ্যে এখন কি সে আয়না নিয়ে আছে?
হাসছে যে খুব? কী লাগবে ওর?
নাকের নোলক? কানের ঝুমকা? মেকাপ বাক্স?
ছোট্ট একটি অগোছালো নিজের মতো রুম?

পরীর গল্প শুনে শুনে হাসতো আমার মেয়ে
স্বপ্নে এখন পরী দেখছে সে
পরীর সঙ্গে কথা বলে হাসি পাচ্ছে খুব
আমি জানি হাসি পাচ্ছে খুব।

আমার মেয়ে ঘুমের মধ্যে হাসে
ঘুমের মধ্যে চোখদুটো ওর কাঁপে
একলা আমি বসে থাকি
ঘুমের দিকে চেয়ে
আমার মেয়ের ঘুমসিক্ত হাসির দিকে চেয়ে।

স্বপ্নতে তোর কী কী ছিল চাওয়া?
কোন অধরা ধরতে গিয়েও ধরতে পারিসনি?
কোথায় যাবি? তারা ধরতে? নদী ধরতে?
ঘুমের ভেতর ভাইটি কি তোর সঙ্গে থাকে?
স্বপ্নেও ওর কাণ্ড দেখে হাসি পেলো?
খেলার ঘরে তুলে রাখা হলুদ রঙের ডানাদুটো
ঝেড়ে মুছে পরতে গিয়ে হাসি পেলো খুব?
আমার মেয়ে স্বপ্ন দেখে হাসে।

হাসি দেখে স্বপ্ন পড়া যায়?
কোন হাসিটার পেছনে যে লুকিয়েছে কোন চাওয়াটা!
কোন আশাটা ভাবতে ভাবতে উবে গেল —
বুঝার জন্য কেউ আমাকে ধার কি দিবেন
ম্যাজিক খোয়াবনামা?

রাত্রি জেগে বসে আছি
এই জগতের সকল কিছু হাতের কাছে নিয়ে

আমার মেয়ে উঠলে জেগে সবকিছু সে পাবে।


আব্বা

মেঘের উপর গ্রাম বসেছে গ্রাম
গাছপালা আর ঘরবাড়ি সব শাদা
মেঘের উপর বৃষ্টি পড়ে না আর
মেঘের উপর নেই মাটি আর কাদা।

মেঘের উপর আকাশ অনেক নীল
ওই ওখানে আব্বা মৃদু হাসেন
‘কীরে বাছুর এখনো তুই লিখিস?’
আব্বা আমায় আজো ভালোবাসেন!

ছায়াপথের তীব্র নেবুলা কি
তার কপালের নামাজ পড়ার দাগ?
ভীষণরকম পথ হারানো পথে
দাগ চিনিয়ে দিচ্ছে সবুজবাগ।

আব্বা অপরাহ্নে জ্বলেন দূরে
মেঘ-তারাতে বাবার গঠন আঁকি
এই নিচুতে তারই গঠন নিয়ে
কেমন বেঁচে আছি জানেন নাকি!

বাঁচার নামে প্রতিক্ষণেই মরি
তারচে‘ বরং হাতটি বাড়াও, ধরি।


পিথাগোরাস

রাত স্তন্যপায়ী। হে চাঁদ, চাঁদের কঠোর প্রচ্ছায়া
তোমার গহ্বর ছিঁড়ে লাফ দেয় খয়েরি ইঁদুর
রাতের ইশারা পেয়ে গল্প শেষ করে ঘড়ির প্রলাপ
তবুও কখনো বিড়ালের কান্না কাঁধে নিয়ে
পাপবিদ্ধ এক ফেরিওলা হেঁকে যায়
মধ্যরাতের সড়কে
তার রুগ্ন চিৎকারে জাহান্নামের প্ররোচনা
কখনো প্রশ্রয় পায়
কখনো শরীরে আগুনের লকলকে ছাট এসে
পুড়ে দেয় উর্বর জরদ, উন্মুক্ত পিথাগোরাস।

যৌন অনুভুতি ঘিরে কেন এত ক্রুদ্ধ উন্মোচন
কেনো এক বলিষ্ঠ কটিদেশের সন্ধান-প্রাণিত
দৈর্ঘ্য প্রস্থ ঘনিষ্ঠ বিন্যাস কেঁদে ওঠে অন্ধকারে?
সেই অন্ধকার, যেন কারো দীর্ঘ চুলের কপাট খুলে
চুয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা অন্ধ রেণু!

সেদিনই জেনেছিলাম
অন্ধকার হয়ে যেতে পারে কখনো নিস্তব্ধ হুলুস্থূল
এত প্রজ্ঞা তার
এতই নিঃশব্দ আর্তনাদ
শ্বাসকষ্টের এতই ক্লেদজ তরঙ্গ ছায়া হয় অন্ধকারে

একজন এসে বলেছিল রাতে আর্দ্র আলিঙ্গনে।


সংসার

সংসার নিয়ে ভাংচুর যত খেলতে খেলতে
দুটি কান্নায় তিনটি হাসিতে লুটিয়ে পড়তো
ছেড়া আর এক ছেড়িতে
সংসার মানে ভাংচুর তারা বুঝেছিল ঢের দেরিতে।
কিভাবে বুঝলো ছেড়া আর ছেড়ি, ছেলেটি মেয়েটি?
শয্যার পাশে ছিল কি ছিল না
চোখে তো ছিলই অভিলাষ
আজ গুণে দেখে সব মৃতবৎ
মেয়েতে কান্না ছেলেটিতে উল্লাস।
অথবা ছেলেটি ভ্রূণ দিতে গেলে
মেয়েটিতে থাকে খুন
অথবা দুজন বাইরে দাহ্য ভেতরে ভেতরে হিম
অথবা বাইরে হিম হয়ে থাকা ছেড়া আর ছেড়ি
ভেতরে প্রবল দাহের প্রতাপে পুড়ে পুড়ে খাক

তাহাদের প্রিয় কামগুলো পুড়ে যাক

ভালবাসা ওরা গড়েছিল ঠিক
ঠিকঠাক মতো সঙ্গম আর সংসার ছিল খুব
তবুও যেখানে পাখোয়াজ বাজে সেখানেই নিশ্চুপ।


যে ভঙ্গিটার নাম ভালবাসা

আত্মহত্যার রাবার দিয়ে মুছে ফেলি আয়ু
জীবনকে মনে করি পাপ, হাতের পাতায় যতটুকু শ্বাস লেখা
যেটুকু আয়ুর ভাগ্য, তা থেকে ঝরাতে চাই কোনো কিছু
কে কুড়ায় এই ঝরা? কালো বক এসে জানায় আদাব।

করতল শয্যা হয় যদি, সে শয্যায় বিবাহ-রেখার পাশে
আরেকটি ক্ষীণ রেখা হয়ে শুয়ে থাকি চুপচাপ
কে আমাকে ডাকে? ডেকে বলে, কতটা শুয়েছ মাঝি?
কতটুকু ভান? একটা প্রাণের মাঝে কতটুকু প্রাণ?

তবুও তো প্রাণ। প্রাণে হাত থাকে। হাতে করতল।
করতলে কররেখা। সে রেখায় ওঁত পেতে থাকা ভাগ্য
আজ উপড়াব আত্মহত্যার শাবলে।
তাহলে? তাহলে কেন অন্তর্গত জ্যোতিষী বলেন,
‘শেষতক সুখ আসিবেক, বিবাহ হইবেক’?

একটি দেহের নিচে আরও এক শরীর কাঁপছে মৃদু।
এই আসনের নাম ভালবাসা। এই ভঙ্গিটাকে
ছোট রেখে এসেছি বটতলায়, গোরাচাঁদ রোডে;
আজ ইস্কাটনে, দিলুরোডে কত বড় হয়ে ফিরে এল!


এই ঘরে মারা গিয়েছিলো রেহনুমা

এই ঘরে মারা গিয়েছিলো রেহনুমা।
স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। আত্মহত্যা।
তাকে আমি চাইনি, এটাই অভিমানের কারণ।
তাকে আমি চাইনি, কেননা খুব কালো ছিলো ওর শরীরের রং
চাইনি কেননা, ও তো প্রেম শব্দটা গুছিয়ে বলতে পারেনি
তাছাড়া ও কথা বলতো দূষিত বাংলায়,
স্বাস্থ্যবতী ছিল আর বসতে গেলে পা ছড়িয়ে বসতো।
একে ভালবাসা যায়!
আমি তাই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
রেহনুমা হাসিমুখে বলেছিলো তার বেঁচে থাকা অর্থহীন।
সে আমাকে দায়ী করে কোন চিরকূট রাখেনি শিয়রে
কেননা এ ব্যাপারে সে আমাকে দায়ী মনে করেনি।
দায়ী করেছে তার ভাগ্য আর শরীরকে।
রেহনুমা হাসিমুখে বলতে পেরেছিল তার বেঁচে থাকা অর্থহীন
এই হাসির নামই ছিল মৃত্যু, এবং ভালবাসা।
এবং পৃথিবীর সবকিছুকে অর্থহীন বলতে পেরেছিল
নিজের প্রেমকে অর্থময় মনে করার লোভে।

এই ঘরে মারা গিয়েছিল রেহনুমা।
বহুদিন পর এই জঙ্গলময় গ্রাম্য ভিটেটিতে এসে
একজন আত্মহত্যার বেদনাময় কক্ষের কাঠের জানালায়
আমার নামের পাশে যোগ চিহ্ন দিয়ে তার নামের কংকাল
হেসে উঠতে দেখে আমি কেঁদে ফেললাম।


কবরের নিস্তব্ধতা

সূর্য অস্ত গেছে কবে!
চলো মারা যাই। মরে গিয়ে
কবরের নিস্তব্ধতা উপভোগ করি
আর তো আনন্দ নেই
তোমার সহাস্য স্তন থেকে জ্যোছনা পান করা শেষ

আরো সাধ ছিল কতিপয়, আমাদের উষ্ণ ঘুমে
ভিজে যাবে নক্ষত্রের মত কঠিন আগুন
সবুজ লতায় ঢাকা তোমার ব্যথিত নেমপ্লেট
ধুলো ঝেড়ে আবার হাসবে চোখ ঠেরে
গলায় বেগুনি মাফলার, ঠাণ্ডা লেগে যাবে গোপন চুম্বনে
ধ্বনিতে রুগ্নতা এনে অতঃপর
অভিযোগ ঠেলে দেবে যেভাবে চায়ের কাপ
টেবিলের ডানদিকে ঠেলে দাও প্রতিটি সন্ধ্যায়

জ্যোছনায় কি ধুয়ে যায় এতসব সাধ?
কিছুটা আর্দ্রতা কিছু তবে ক্রন্দন আকাঙ্ক্ষা হবে মৃত্যুর গুঞ্জনে

চলো, এসেছে কর্কশ ছায়া আমাদের নিতে
কবরের নিস্তব্ধতা উপভোগ করে আসি, চলো।


চিঠি

নামের চেয়ে বেশি প্রিয় তোমার ছিল যে চিরকাল ছদ্মনাম
ঝড়ের ঠিকানায় চিঠি পাঠাই সে-ভাষা কখনই পদ্য না
নিজেকে লিখে লিখে অন্তরাতে কোন সে অসুখের ভাসাই ভেলা
সঞ্চারীতে এসে অন্ধকারে, নিজেই খাম হই ইনভেলাপ।

তোমার পিছে পিছে ইনভেলাপে নগ্ন নারীদের সর্বনাশ
ডেকেছে যারা, আজ তারাই বীর। তারা কি মিছিলের গর্ব না?
এ গেল শ্লেষ শুধু; মূল কথা যা, বাসনাবিহ্বল যৌনতা
গভীরতম পথে আকাশচারী বিষণ্ণবিধুর মৌনতায়।

তবে কি বুননের মুদ্রা, ঢঙ, শস্যক্ষেত সব অশ্লীল?
প্রেমের উছিলায় তাম্র, লোহা, প্রস্তরযুগটা চষলোকটা প্রেমিক ছিল কাল সারারাত

এই ঝড়ে ভাঙাচোরা অন্ধকারে অভিভূত শয্যা
পেতে কাল রাতে আমি একা একা প্রেমিক ছিলাম
দরোজা জানালা ভেঙে হিস হিস প্রেমের নিলাম
ছুটে এসে খুলে দেয় সমূহবসন, লাজলজ্জা।

কাল রাতে বস্ত্রহীন জানালায় কোনো ম্লান দৃষ্টি
কাকে খুঁজেছিল? ঝড়ের গভীরে এক বেদনার
নগ্ন উচ্চারণ তবু চিনে নেয় চোখের কিনার
একজন শয্যামুগ্ধ যুবকের চোখে কালো বৃষ্টি।

এখানে কি ভেজে কেউ? শাড়ীর আঁচলে
লি?
মাটির গভীরতা কে জানে কত, কতটা ভেজা জমি উর্বর
কতটা পিড়ামিড, কেমন মমি, রোগের কতদূর খুঁড়বো?
কতটা তল তার কয়টি ক্ষত, একা একাই জল সিঞ্চি
বুকের বাম দিক ক্লান্ত, হত, জটিলতার ব্যথা চিনচিন।

তোমাকে মনে পড়ে বর্ষামেঘে শাড়ির ভিজেছিল অঞ্চল
তোমাকে ভুলে যাই রৌদ্র দেখে রোদেরা হননের সঞ্চয়।
চিঠি তো খটমটে ভাষায়, তাই তোমার নাম রাখি উহ্য
ছদ্মনাম খুঁজে পাইনি আজো ভেঙেছি তালাশের উদ্যোগ।

লিখেছি এতকিছু অথচ জানি একাকীত্বের এ আর্তনাদ
ছাড়া তো নিয়মের শিল্পগুণে কবিতা নিজে হতে পারতো না।


বীজতন্ত্র

কার শরীরের কোন গোপনে রেখেছিলাম বীজ
গোপনতার মধ্যে বিষাদ করছিল গিজগিজ
বিষাদ কেন? বিষাদ কেন? উর্বরা হিম-নারী
শীতবস্ত্রের নিচে তখন সূর্যটা বাহারি।

জ্যোছনাপাতা সঙ্গমে যেই হাত ছোঁয়ালাম আমি
ইতিহাসের ফুলকি এসে পোড়ালো আগামী।

ছাদে মেলা নীল শাড়িতে অতীত মুছে তাই
বর্তমানের গালে ভাসাই কামরাঙ্গা রোশনাই
তোমরা যারা ভবিষ্যতের আনন্দ-নর্তকী
তারাই বলো শেষ রাতে ফের জ্যোছনা ঝরতো কি?

জ্যোছনা ঝরার আগেই নাকি রাতের সমাপন
ছোঁয়ার আগে শরীরজুড়ে যেভাবে কাঁপন
উঠত তোমার, ঠিক তেমনি রাতের আগে দিন
আগেভাগেই শোধ হয়ে যায় ভবিষ্যতের ঋণ।

সেই যে কবে বিদায় হলাম বীজের খবর কী?
বললে ফোনে, কাল শোনাবে, আজকে না আর ছিঃ!
আজকে তবে কীসের আদর কীসের ধারাপাত?
চলে যাবার ঠিক পেছনে নেড়েছিলে হাত।


তোমার বিরক্তে

অফিসের রুমে কেউ ভুল করে ঢুকে পড়েছিল
কিছুটা আনত মুখ অগোছালো অসীম বিব্রত
এই রুক্ষ দরোজাও মাঝেমধ্যে
এভাবে ঢুকিয়ে দেয় কিছু কিছু রোদ, কোমলতা, অটামের ঝরাপাতা।

এই শুষ্ক দরোজায় কোনদিন পড়েনা তো টোকা
শুধু ভুল করে কেউ ঢুকে যায় ক্রন্দন লুকাতে
বহুদিন পর পর যেন কেউ আড়াল খুঁজতে
ভুল করে উঁকি দিয়ে হয়ে যায় অযথা বিব্রত।

ঘরের ভেতর কেউ ভুল করে ঢুকে পড়েছিল
ভুলের ভেতর থেকে বলেছিল কেউ কাঁপা স্বরে,

— বিরক্ত হলেন?

বিরক্ত হয়েছি খুব। এই দেখো ঘুমুতে পারিনা
এই দেখো নাওয়া খাওয়া বাদ
এই দেখো আমার অস্তিত্ব কেড়ে নিয়ে গেলো কেউ।
দহন লেগেছে প্রাণে, এই ঘরে ভুল ভাঙাভাঙি
কখনো হয়েছে বলে মনে নেই। কারো মনে আছে?

জীবনের কাছে এসে ভুরুগুলো কুঁচকে রয়েছে
তোমার বিরক্তে সোনা।
তুমি এসে ভুরুগুলো টানটান করে দিয়ে যাও!


নির্ঘুম রাতের জার্নাল

দীর্ঘ একটি রাতের নেশায় আমরা ছিলাম দুই
ছোট্ট তোমার নিঃশ্বাস ঘিরে হাবিজাবি করে শুই
কেন ডেকে নিয়ে হাত ধরেছিলে কেন মৃদু চুম্বন
ভলগার স্রোতে মিশে গিয়েছিল পদ্মার দুঃখী মন।
খুব সাবধানে ঢেউ দিয়েছিলে তবু জেগেছিল ঝড়
ঝঞ্ঝার কোলে মাথা রেখেছিল ভাঙ্গা একটি ঘর।
চাঁদ নুয়েছিল জানলার পাশে পর্দা টেনেছি লাজে
এমন দুর্বিপাকের মিলনে উঁকি দেয়াটা কি সাজে?
কাম থেমে যায় প্রেম রুখে যায় বখে যায় মিহি ছোঁয়া
আমরা তখন সিগারেট থেকে নামাই শুভ্র ধোঁয়া
তুমি গেয়েছিলে ভিক্টর সোই, আমি নূসরাত ফতে
এভাবে ঢেলেছি সঙ্গীত কিছু পরস্পরের ক্ষতে।
দুটি ঘর থেকে দুটি ব্যথা নিয়ে জোছনায় বসে রই
চারটি আঙুল সিগারেটে জাগে চার চোখে হইচই।
জানি আজ তুমি গুগলে বসবে, ট্রানসেলেটরে দেবে
খুব সোজা করে লিখলাম তাই তোমার কথাটি ভেবে।


ভিলনিউস

ভিলনিউসে সন্ধ্যাগুলো মরা
তার উপরে মেঘ করেছে খুব
একটু পরে বৃষ্টি যদি নামে
একটু পরে রাস্তাটা নিশ্চুপ।

ইট বিছানো গলির মোহনায়
লাইট ফেলেছে মধ্যরাতের বার
ভুতের ভয়ে চমকে ওঠার মতো
রাতের হাতে নাচছে শনিবার।

চারদিকে খুব সটান নিরিবিলি
মুখোমুখি পরীটা উদ্দাম
নিঃসংকোচে বৃষ্টিরা তার হাতে
আমার আগেই দিচ্ছিল নীল খাম।

রাগ করে কেউ ফিরেছে রাত্রিতে
গৃহগুলো স্বপ্নভাঙা আজ
মেয়ের চোখে একটু কাঙালপনা
টেনে টেনে আঁকছিল সেই সাজ।

ডিস্কোথেকের একঘেয়েমি নাচ
ভেংচিয়ে মুখ বাইরে ঝুঁকেছিল
নাকের নথে জ্বলছে অসভ্যতা
সভ্যতাকে খানিক ঝলসে দিলো।

পুরান দেয়াল গ্রাফিত্তিতে মোড়া
চক দিয়ে নীল কবুতরটা এঁকে
কানে কানে বলে দিলাম, পাখি
পালিয়েছি ঘৃণার শহর থেকে।

ভিলনিউসে সন্ধ্যাতারাগুলো
একে একে ঝাপসা হয়ে গেলে
ইট বাঁধানো পুরান সড়কটিতে
খুব ভীরু হয় একটি দুঃখী ছেলে।

তোমার কাছে কথা লুকাই ভ্রমে
তোমার কথাই ভীষণ মনে পরে
এই শহরে থার্মোমিটার পাবো?
ভিলনিউসের গা পোড়ে যে জ্বরে।


জর্জের শ্বাস

আমার বাঁ পকেট এখনো ফুলে আছে
আন্ধারমানিক নদের এক ফুঁ অপূর্ব বাতাসে
কবে একদিন এই তীক্ষ্ণ মিহি বাতাস
ঢুকে পড়েছিল পকেটে! তারপর
পকেটেরই পোষা হয়ে গেছে পুরোটা জীবন।

এইটুকু অতিরিক্ত বাতাস আমি জমিয়ে রেখেছিলাম জর্জ
শান দেয়া তীব্র শিসের মতো প্রস্তরভেদী
এক মুঠো বাতাস তোর শ্বাসে ফেলবো বলে
আমি জমিয়ে রেখেছিলাম এই কালো বুক পকেটে।
তোর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল জেনে
আন্ধারমানিকেও থেমে গেছে ঢেউ।

জর্জ, তোর কণ্ঠ থেকে উপচে পরা আয়ু
যদি আবার ফুঁ দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে পারতাম
তোর নিচু জীবনের দমে,
ঘটা করে দীর্ঘশ্বাস পালা দরিদ্র ফুসফুসে!
যদি পারতাম, মাটি থেকে তুলে আনতাম ব্রিথ।

তোর বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতার বাইরে
পৃথিবীটা ধীরে ধীরে শাদা হয়ে যায়,
তোর বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতার ভেতরে
এক অদৃশ্য জীবন আছড়ে পড়ে কালো হয়ে যায়
শাদা-কালোর এই ছানিপড়া ঘোলাটে পৃথিবীতে
তোর মৃত্যুটাই শুধু রঙিন হয়ে গেল।

এখন একজোড়া বোজা চোখ
আমাদের আত্মার দিকে ভীষণ তাকিয়ে আছে
এখন হৃদয়ের সর্বশেষ পালস থেকে
জন্ম নেয়া একটি রূপকথার ভাণ্ড
উপুড় হয়ে পড়েছে পিচঢালা কালো সড়কগুলোতে।

এই প্রবাহমান বাতাস সাক্ষী
স্বাক্ষী এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিন
মিহি বিকেলে হাত উঁচু করা স্ট্যাচু অব লিবার্টি স্বাক্ষী—
এখানে একজনের শ্বাস-ভিক্ষা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

এভাবেই নিতে না-পারা একটি শ্বাস
পুলিশের হাঁটু থেকে মোচড় খেয়ে খেয়ে
আমার দুহাতে এসে প্রাণভরে শ্বাস নিতে চায়।

আমি মোনাজাতের মত হাত তুলে
তোকে আগলে রাখবো জর্জ।


ইসরাইল

হামাস ভেঙেছে নিজেকে দেখার আয়না
ইসরাইল, মাফ করে দেয়া যায় না?
রাফার বালক ঘরে ফিরে মাকে পায় না
ইসরাইল, মাফ করে দেয়া যায় না?
গাজার শিশুরা তিনদিন কিছু খায় না
ইসরাইল, মাফ করে দেয়া যায় না?
ক্ষীণ স্বরে রাখি যুদ্ধ রদের বায়না
ইসরাইল, মাফ করে দেয়া যায় না?


আমেরিকা

আমেরিকা!
তোমার যুদ্ধের নিচে
আমি এ্যাটম কুড়াবো,
শান্তি শান্তি বলে
জীবন ফুরাবো।


সতেরই অক্টোবর

জানালার কাঁচে তিনটি গোলাপ এঁকে
বৃষ্টির ছাট ফিরে গেছে ঘরের চালে
বৃষ্টির হয়ে নিজেকে বললাম, শুভকামনা

কেউ জানেনি।

দু‘টি ম্যাপল আর তিনটি ওকের পাতা
লালচে হলুদ গ্রিটিং কার্ডের ধরণে
দরোজার নিচ দিয়ে অর্ধেক ঢুকে পড়েছে

কেউ বোঝেনি।

একদল শুকনো পাতা হাওয়ার ঘুর্ণিতে চড়ে
যে পল্লব থেকে খসে পড়েছিল ভোরে
তারও অনেক উপরে গিয়ে নাচলো কিছুক্ষণ

কেউ দেখেনি।

ডাইনিং টেবিলে আধা-খেলা দাবার কোর্টে
একটি রাজা চেক হয়ে থাকার রুদ্ধশ্বাস থেকে
চোখ ফিরিয়ে এনে
একটি পরাজয়কে
অহেতুক ড্র করে রাখি

কেউ হারেনি।

ভালবাসা কথাটা খুব জ্বালায় বলে
বারান্দায় রেখে এসেছিলাম কাল
রাতের তুষারপাতে ভিজে ফুলে গেছে আজ

কেউ নেয়নি।

সেকেন্ড হ্যান্ড দোকান থেকে শুভেচ্ছা কিনে
মাপে মেলেনি বলে আবার ফেরত দিয়ে এলাম
আজ খোঁজ নিয়ে দেখলাম

কেউ কিনেনি।

ব্লুবেরি জেলি কেক, মাফিন, চিপস,
আইসক্রিম, ক্যান্ডেল আর একটি ফুঁ
ফেলে দিয়ে এলাম মোড়ের ডাস্টবিনে

কেউ আসেনি।


সানডে

তোরই জন্য জান দিয়েছি, জান দে
দেখা মোদের হবেই হবে সানডে
মন বসে না কারান্টিনে, কান্দে
তোর দরোজায় টোকা দেবো সানডে।

সুর্য যখন ফেলবে আলো চান্দে
তোর চিবুকে জ্যোছনা হবে সানডে
একলা হুঁকা সাজিয়ে বলি, টান দে
সুখটানটা দেবো দুজন সানডে।

বলবো কাবাব সঙ্গে আছে, নান দে
গ্রিল জ্বালিয়ে ডিনার হবে সানডে
গলায় কিছু ঢালবি গরম ঠাণ্ডে?
রাগ করেছে বিকেলবেলার সানডে।

আটকে আছি কোভিড মামার ফান্দে
ক্লোজ হয়েছে মানডে এবং সানডে
একটুখানি প্রেম ঢেলে দিস ভান্ডে
আমার হঠাৎ সবগুলো দিন সানডে।

তোর বেহুদা গভীর কথার খান্দে
পিছলে পড়ি যতবারই সানডে
কিছু কথা তুলে রাখিস ফান্ডে
কিছু কথা শুনবে শুধু সানডে।

প্রভূর মতো দাঁড়িয়ে আছি, বান্দে
আজকে কি তোর গির্জে যাবার সানডে?
যীশুর থেকে কিছু দোয়া আন, দে
মানুষগুলো ফূর্তি করুক সানডে।

বেলুন উড়ুক গাছের শাখে, কান্ডে
তোর আদরে লজ্জা পাবে সানডে
বা হাত যদি সরিয়ে নিলি, ডান দে
স্যানিটাইজার থাকবে সাথে সানডে।

কোন বাহানা করবি রে তুই পাণ্ডে?
দেখা মোদের হবেই হবে সানডে
দোকান থেকে কিনবো রুটি, আন্ডে
লকডাউনের কাছেই থাকে সানডে।

চুন খসেছে? ঠিক আছে ভাই, পান দে
রাগগুলো সব মিটিয়ে দেবো সানডে
ভোঁতা হয়ে বসে আছিস! শান দে
ক্ষত হবো তোর আঁচড়ে সানডে।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. শাকিল রিয়াজের কবিতা আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে। তাঁর কবিতার শক্তি নিঃশেষ হবে না। বাংলা ভাষার এক অনিবার্য কবিশক্তি তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা