spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যপারস্যে রবীন্দ্রনাথ

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

পারস্যে রবীন্দ্রনাথ

কাজী জহিরুল ইসলাম 

ত্রিশোত্তর বাঙালি কবি কিংবা তাদের কবিতা নিয়ে লিখতে বললে আমি কোনো কিছু না ভেবেই চট করে লিখতে বসে যাই। কিন্তু যখন কোনো কাগজের সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা চান তখন আমি এক অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকি। একটি চৌবাচ্চায় কত লিটার জল আছে তার অনুমান নির্ভুল না হলেও কাছাকাছি হয়। পুকুর বা দীঘি কতটা গভীর তাও আন্দাজ করে কাছাকাছি যাওয়া যায় কিন্তু সমুদ্র কতখানি গভীর তা আন্দাজ করতে গেলে বিশেষজ্ঞ হতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল সমুদ্র। সেই সমুদ্রের গভীরতা মাপার জন্য আমি যথেষ্ঠ দক্ষ নই। বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক পাঠ আমাকে এই সিদ্ধান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে, আজকের বাঙালিরা (দুই বাংলায়ই) যে ভাষায় কথা বলেন, সেই আধুনিক প্রমিত বাংলাটি তিনিই নির্মাণ করেছেন। গদ্যে, পদ্যে এবং গীত রচনায়, এই ত্রিধারায় ভাষাটি তিনি তৈরি  করেছেন এবং এটিকে গণমানুষের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন এর কৌলিন্য একটুও ম্লান না করে।

আমরা খুব কমই রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ রচনা নিয়ে কথা বলি। ছোট গল্পের মতো বাংলা সাহিত্যের ভ্রমণ রচনাও বলা যায় তারই সৃষ্টি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়ো ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পালামৌ’ বাংলা ভাষার প্রথম ভ্রমণকাহিনী যদিও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ৭টি ভ্রমণগ্রন্থই মূলত বাঙালি লেখকদের ভ্রমণ রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। 

গত কয়েক মাস ধরে বাঙালি-আমেরিকান সিনিয়র সিটিজেনদের একটি সাহিত্যের আসর/ক্লাস পরিচালনা করি আমি। গত ক্লাসে এক সদস্য প্রশ্ন করেছিলেন, ভালো ভ্রমণরচনা কি করে লেখা যায়। আমি তাকে এই পরামর্শ দিয়েছিলাম, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো এক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিক না হতে, ভ্রমণকালীন সময়ের স্থান, সময় উল্লেখ করতে এবং যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় তাদের নাম, ধাম, পরিচয় উল্লেখ করতে, গদ্যে যেন গতি থাকে তাও নিশ্চিত করতে বলেছি। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণগুলো যখন পড়ি তখন এই বৈশিষ্ট্যগুলোর উপস্থিতি লক্ষ্য করি এবং বাড়তি যা পাই তা হচ্ছে ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং প্রতিটি স্থান ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার নিজস্ব একটি দর্শন। ফলে তার রচিত ভ্রমণ শুধু আনন্দদায়কই না একই সঙ্গে শিক্ষামূলক। এই রচনায় আমি তার “পারস্য যাত্রী” গ্রন্থ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করবো।

১৯৩২ সালের ১১ এপ্রিল, ৭১ বছর বয়সে, তিনি পারস্যরাজ রেজা শাহ পাহলভির আমন্ত্রণে বেরিয়ে পড়েন। দেশ থেকে আর বেরুবেন না এই সিদ্ধান্তে তিনি শেষ পর্যন্ত অটল থাকতে পারেননি। হাফিজ, শেখ সাদীর দেশ দেখার আগ্রহের কাছে তার বার্ধক্যের জরা হার মানে। একজন কবির কাছে রাজার আমন্ত্রণের গুরুত্ব আছে বটে কিন্তু তার চেয়েও তীব্র অন্য কবির টান। হাফিজ, শেখ সাদীর সিরাজ শহর দেখার একটা তীব্র টান তিনি ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিলেন। যদিও তিনি মুখে বলেছেন, ‘পারস্যরাজের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ এল। মনে হল এ নিমন্ত্রণ অস্বীকার করা অকর্তব্য হবে।’ সফর সঙ্গী হলেন, তার সেবা-শুশ্রূষার জন্য পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবী এবং কর্মসহায়ক হিসেবে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কবি অমিয় চক্রবর্তী। বাল্যবিধবা প্রতিমাকে রবীন্দ্রনাথই উদ্যোগী হয়ে নিজের পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেন। সেটিই ছিল ঠাকুর বাড়ির প্রথম বিধবা বিবাহ। রথীন্দ্রনাথ যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন প্রতিমাকে পেয়ে কিন্তু জীবনের এক পর্যায়ে বন্ধু নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা দেবীর প্রণয়-সঙ্গ তাকে প্রতিমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধু প্রতিমা বাবামশাইয়ের সেবা করতেন পরম যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে। স্ত্রী, কন্যা হারানোর পরে তিনি নিজের যত্নের ভার পুরোপুরি প্রতিমার ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। 

ছোট্ট এক হাওয়াই জাহাজে চড়ে ইরান যাত্রার অনুপুঙ্খ বর্ণনা তুলে ধরেছেন পারস্য যাত্রী গ্রন্থে। তিনি এ-হাওয়াই জাহাজের নাম দেন কখনো  ‘ব্যোমতরী’ মানে আকাশের নৌকা, কখনো ‘খেচররথ’, ‘যন্ত্রপাখি’ আবার কখনো ‘বায়ুযান’। এলাহাবাদে এসে যখন খেচররথ জ্বালানি নেবার জন্য মাটিতে নেমে এলো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ডাইনের জানালা দিয়ে দেখি নিচে কিছুই নেই, শুধু অতল নীলিমা, বাঁ দিকে আড় হয়ে উপরে উঠে আসছে ভূমিতলটা। খেচররথ মাটিতে ঠেকল এসে; এখানে সে চলে লাফাতে লাফাতে, ধাক্কা খেতে খেতে; অপ্রসন্ন পৃথিবীর সম্মতি সে পায় না।…কোম্পানির একজন ভারতীয় ও একজন ইংরেজ কর্মচারী আমার ফোটো তুলে নিলেন। তার পর খাতায় দুচার লাইন স্বাক্ষরের দাবী করল যখন, আমার হাসি পেল।…উর্ধ্ব থেকে এই কিছুক্ষণ আগেই চোখে পড়েছে নির্জীব ধূলিপটের উপর অদৃশ্য জীবলোকের গোটাকতক স্বাক্ষরের আঁচড়। যেন ভারী যুগাবসানের প্রতিবিম্ব পিছন ফিরে বর্তমানের উপর এসে পড়েছে। যে ছবিটা দেখলেম সে এক বিপুল রিক্ততা; কালের সমস্ত দলিল অবলুপ্ত; স্বয়ং ইতিবৃত্তবিৎ চিরকালের ছুটিতে অনুপস্থিত; রিসার্চবিভাগের ভিৎটাসুদ্ধ তলিয়ে গেছে মাটির নীচে।’

এভাবে পথে পথে যেখানেই নেমেছেন, থেমেছেন, সেই জায়গার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, রাজনীতি অতি সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। এলাহাবাদের পর যোধপুর, করাচীতে যাত্রাবিরতি সেরে খেচররথ ঢুকে পড়ল পারস্যে। পারস্যে ঢুকে প্রথম যাত্রাবিরতি নিলেন জাস্কে। তার ভাষায় জাস্ক  সমুদ্রতীরবর্তী মরুভূমিতে গড়ে ওঠা একখানি গ্রামবিশেষ। কাদায় তৈরি কতগুলো চ্যাপ্টা ছাদের চৌকো ছোটো ছোটো বাড়ি, যেন মাটির সিন্দুক একেকটা।

যারা ইংরেজি জানেন তেমন ক’জনের সঙ্গে কথা বলে তার মনে হলো, ‘অতীতের আবর্জনা-মুক্ত সমাজ, সংস্কারমুক্ত চিত্ত, বাঁধামুক্ত মানবসম্বন্ধের ব্যাপ্তি, বাস্তব জগতের প্রতি মোহমুক্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি, এই তাদের সাধনার প্রধান লক্ষ্য। তারা জানে হয় বর্তমানকালের শিক্ষা নয় তার সাংঘাতিক আঘাত আমাদের গ্রহণ করতে হবে। অতীতকালের সঙ্গে যাদের দুশ্ছেদ্য গ্রন্থিবন্ধনের জটিলতা, মৃত যুগের সঙ্গে আজ তাদের সহমরণের আয়োজন।’

১৩ এপ্রিল সকাল আটটায় বুশেয়ারায় পৌঁছে আকাশে ওড়ার বিষয়ে তার মনে নানান ভাব খেলা করতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, মাটির মানুষ যখন ধাতব ডানায় ভর দিয়ে আকাশে ওড়ে সেই ওড়ায় রূপসৌন্দর্য্য নেই। তিনি বলেন, ‘এতদিন পরে মানুষ পৃথিবী থেকে ভারটাকে নিয়ে গেল আকাশে। তাই তার ওড়ার যে চেহারা বেরোল সে জোরের চেহারা। তার চলা বাতাসের সঙ্গে মিল করে নয়, বাতাসকে পীড়িত ক’রে; এই পীড়া ভূলোক থেকে আজ গেল দ্যুলোকে। এই পীড়ায় পাখির গান নেই, জন্তুর গর্জন আছে। ভূমিতল আকাশকে জয় করে আজ চীৎকার করছে।…বিমানের কথা শাস্ত্রে লেখে – সে ছিল ইন্দ্রলোকের, মর্তের দুষ্যন্তেরা মাঝে মাঝে নিমন্ত্রিত হয়ে অন্তরীক্ষে পাড়ি দিতেন – আমারও সেই দশা।’

পারস্যে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে তিনি তার নিজের দেশেই এসেছেন। নিজের আর্য-পরিচয়ও বারবার মনের আকাশে উঁকি দিয়েছে। ইউরোপে গিয়েও তিনি সম্মান পেয়েছেন তবে প্রাচ্যের দেশগুলোতে গিয়ে তিনি যে সম্মান পেয়েছেন তা অন্যরকম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এখানে আমার সম্মান মানে তাদেরও সম্মান। প্রসঙ্গত তিনি তার মিশর-ভ্রমণ উল্লেখ করেছেন। সেখানে যাবার পর মিশরের রাষ্ট্রনেতারা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আসেন, সেজন্য পার্লামেন্টের সভা কিছুক্ষণের জন্য মুলতবি রাখতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘প্রাচ্যজাতীয়ের মধ্যেই এটা সম্ভব’। তিনি বলেন, ‘পারসিকদের কাছে আমার পরিচয়ের আরো একটু বিশিষ্টতা আছে। আমি ইণ্ডো-এরিয়ান। প্রাচীন ঐতিহাসিক কাল থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত পারস্যে নিজেদের আর্য-অভিমানবোধ বরাবর চলে এসেছে, সম্প্রতি সেটা যেন আরও বেশি করে জেগে উঠবার লক্ষণ দেখা গেল। এদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্মন্ধ। তারপরে এখানে একটা জনশ্রুতি রটেছে যে, পারসিক মরমিয়া কবিদের রচনার সঙ্গে আমার লেখার আছে সাজাত্য।’

স্থল-মরুপথে ১৬ এপ্রিল শিরাজ অভিমুখে যাত্রা করেন। বিস্তীর্ণ মেঠো রাস্তা। মাঠের পরে মাঠ, জনমানবশূন্য, কোথাও ঘর-বাড়ি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। উচ্চ মালভূমি, পাহাড়ে বেষ্টিত, মাঝে মাঝে গিড়িশ্রেণি। এই মালভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫/৬ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। মাঝখানটা নেমে গেছে বিশাল এক মরুভূমিতে। দূরে কোথাও হঠাৎ খেজুর অথবা বাবলা গাছ ছাড়া আর কোনো বৃক্ষরাজি নেই। দুপাশে বস্তা ঝুলিয়ে গাধা অথবা খচ্চরের হাঁটাচলা চোখে পড়ছে কদাচিৎ। কাঁটাঝোপের মধ্যে  উট, ভেড়া এবং মেষ চড়াতে দেখা যাচ্ছে দুয়েকজন রাখালকে। এরই মধ্যে পথের ওপর তোরণওয়ালা ছোটো ছোটো মাটির কেল্লা। সেখানে মোটর থামিয়ে কবিকে অভ্যর্থনা জানান নিরাপত্তা কর্মীরা।

শিরাজের পথ দীর্ঘ। তাই পথিমধ্যে খাজরুনে যাত্রাবিরতি এবং গভর্নরের আতিথ্যে রাত্রিযাপন। খাজরুনের বর্ণনা দিচ্ছেন কবি এভাবে, ‘পথের মধ্যে খাজরুনের গবর্নর ঘোড়সওয়ার পাঠিয়েছেন আমাদের আগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। বোঝা গেল তারা অনেকক্ষণ ধরে প্রতীক্ষা করছেন। প্রাসাদে পৌঁছলুম। বড়ো বড়ো কমলালেবু গাছের ঘনসংহত বীথিকা; স্নিগ্ধচ্ছায়ায় চোখ জুড়িয়ে দিলে। সেকালের মনোরম বাগান, নাম বাগ-ই-নজর। নিঃস্ব রিক্ততার মাঝখানে হঠাৎ এইরকম সবুজ ঐশ্বর্যের দানসত্র, এইটেই পারস্যের বিশেষত্ব।…অতিথির সম্মানে আজ এখানে ছুটি। সেই সুযোগে অনেকক্ষণ থেকে লোক জমায়েত হয়েছিল। সকলের মুখে তাদের রাজার কথা। বললেন, তিনি অসামান্য প্রতিভার জোরে দশ বছরের মধ্যে পারস্যের চেহারা বদলিয়ে দিয়েছেন।’

চলতে চলতে শূন্য মাঠের পরে যখন শিরাজ দৃষ্টিতে এলো, চোখে পড়ল পপলার, কমলালেবু, চেস্টনাট, এলম গাছের মাথা। গভর্নর নিজে এসে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন বড়ো এক বাড়ির সভাকক্ষে। সেখানে  শিরাজের নাগরিকদের হয়ে একজন অভিবাদন পাঠ করলেন: শিরাজ শহর দুজন চিরজীবী মানুষের গৌরবে গৌরবান্বিত। তাদের চিত্তের পরিমণ্ডল তোমার চিত্তের কাছাকাছি। যে উৎস থেকে তোমার বাণী উৎসারিত সেই উৎসধারাতেই এখানকার দুই কবিজীবনের পুষ্পকানন অভিষিক্ত। যে সাদীর দেহ এখানকার একটি পবিত্র ভূ-খণ্ডতলে বহু শতাব্দীকাল চিরবিশ্রামে শয়ান তাঁর আত্মা আজ এই মুহূর্তে এই কাননের আকাশে ঊর্ধ্বে উত্থিত, এবং এখানে কবি হাফেজের পরিতৃপ্ত হাস্য তাঁর স্বদেশবাসীর আনন্দের মধ্যে পরিব্যাপ্ত। 

পরদিন সাদীর কবর-প্রাঙ্গনে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ভাই ফেরুঘি, যিনি একজন দার্শনিক, কবির পারস্যে আসা সার্থক হবে উল্লেখ করেন, তাকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আপনাদের পূর্বতন সূফীসাধক কবি ও রূপকার যাঁরা আমি তাদেরই আপন, এসেছি আধুনিক কালের ভাষা নিয়ে; তাই আমাকে স্বীকার করা আপনাদের পক্ষে কঠিন হবে না। কিন্তু নূতন কালের যা দান তাকেও আমি অবজ্ঞা করি নে। এ যুগে য়ুরোপ যে সত্যের বাহন-রূপে এসেছে তাকে যদি গ্রহণ করতে না পারি তা হলে তার আঘাতকেই গ্রহণ করতে হবে। তাই বলে নিজের আন্তরিক ঐশ্বর্যকে হারিয়ে বাহিরের সম্পদকে গ্রহণ করা যায় না। যে দিতে পারে সেই নিতে পারে, ভিক্ষুক তা পারে না।’

এমনি করে প্রতিটি ভ্রমণের ক্ষণে ক্ষণেই তিনি শুনিয়েছেন কাল-মহাকাল নিয়ে তার নিজস্ব চিন্তার ব্যঞ্জনা। এই গ্রন্থে উল্লেখিত আর একটি মজার গল্প বলেই লেখাটি শেষ করছি। 

তিনি হাফেজের সমাধি দেখতে বের হলেন। সেখানে যাওয়ার পর তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে বসানো হল। তখন সমাধি-রক্ষক একটি বড়ো চৌকোনো গ্রন্থ এনে টেবিলের ওপর রাখলেন। এটি কবি হাফেজের কবিতার বই। সমাধি-রক্ষক রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি যে কোনো একটি প্রত্যাশার কথা ভেবে বইটি খুলুন। যে পাতাটি বের হবে সেই পাতাতেই আপনার প্রত্যাশার পরিণতি লেখা আছে। বিষয়টি পারস্যের লোকেরা বিশ্বাস করে, এটি একটি লোকজ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ মনে মনে ভাবলেন, ধর্মনামধারী অন্ধতার প্রাণান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায়। এরপর তিনি বইটা খুললেন। যে পাতাটি বেরুল সেই কবিতাটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। উপস্থিত ইরানি কয়েকজন মিলে যে অনুবাদ করে শোনালেন তার অর্থ দাঁড়ায়, প্রথম অংশ: মুকুটধারী রাজারা তোমার মনোমোহন চক্ষুর দাস, তোমার কন্ঠ থেকে যে সুধা নিঃসৃত হয় জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমানেরা তার দ্বারা অভিভূত। 

দ্বিতীয় অংশ: স্বর্গদ্বার যাবে খুলে, আর সেই সঙ্গে খুলবে আমাদের সকল জটিল ব্যাপারের গ্রন্থি, এও কি হবে সম্ভব? অহংকৃত ধার্মিক নামধারীদের জন্যে যদি তা বন্ধই থাকে তবে ভরসা রেখো মনে ঈশ্বরের নিমিত্তে তা যাবে খুলে।

কবির প্রশ্ন কিংবা প্রত্যশার সঙ্গে উত্তরের এই সঙ্গতি দেখে সফরসঙ্গী ও অন্য বন্ধুরা বিস্মিত হলেন। হাফেজের কবরের পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন, ‘এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল, এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজন একই পান্থশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভর্তি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি।  তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারেনি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল, আজ কত-শত বৎসর পরে জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৪ মে ২০২২।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ