spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকপ্রচ্ছদ বিতর্ক : মজিদ মাহমুদ

লিখেছেন : মজিদ মাহমুদ

প্রচ্ছদ বিতর্ক : মজিদ মাহমুদ

অনেকে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন- এবারের দেশ পত্রিকায় নজরুল-জীবনানন্দ দাশের ছবি-সম্বলিত প্রচ্ছদ নিয়ে। সম্ভবত জানতে চাওয়ার কারণ, যেহেতু নজরুল নিয়ে আমি অল্প-বিস্তর কাজ করি, আবার জীবনানন্দ দাশও আমার কাজে অনুপস্থিত নন। এবারের দেশের প্রচ্ছদে এমন কি আছে, যার জন্য  নজরুল-ভক্তদের মনে আশঙ্কার জন্ম হয়েছে যে, এই প্রচ্ছদকর্মের মাধ্যমে নজরুলকে ইচ্ছেকৃত কিছুটা খাটো করা হয়েছে; কিংবা কবির পদ-মর্যাদা অনুপাতে তাঁকে জীবনানন্দ দাশের নিচে টেনে আনা হয়েছে। ভক্তের অনুরাগ ও শ্রেণিপাত নিয়ে কথা না বলাই ভালো। ভক্তের অবস্থান কখনো একদিনে তৈরি হয় না, একদিনে তিরোহিত হয় না; আবার সর্বক্ষেত্রে এটি অনড়ও নয়। জীবনানন্দ দাশ বয়স বিবেচনায় নজরুলের চেয়ে কয়েক মাসের বড় হলেও কবিতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন বিদ্রোহী কবির প্রায় দেড় দশক পরে- ১৯৩৬ সালে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরে। তার আগে তিনি নজরুল ঘারানার কবি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। নজরুল-জীবনানন্দ দাশ দুজনই কবিগুরুর প্রায় চল্লিশ বছর পরে বাংলা কবিতার ভাগ্যাকাশে উদিত হলেও খুব অল্পদিনের মধ্যে নজরুল প্রায় বিশ্বকবির পাশে আসন করে নেন। রবীন্দ্রনাথও তাতে কুণ্ঠিত ছিলেন না; বরং বাংলা কবিতায় লাঞ্ছিত-বঞ্চিতদের কণ্ঠস্বর হিসাবে নজরুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন; যেখানে উচ্চকোটির মানুষ হিসাবে সঙ্গত কারণে তাঁর পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। এই মহান দুই কবির  প্রয়োজনীয়তা ঔপনিবেশিককালে বেড়াজালের ভেতর সরলবৃত্ত তৈরি করতে পেরেছিল; কিন্তু ব্রিটিশ পরবর্তীকালের মানুষের জটিল জীবনের নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব হাহাকার যন্ত্রণা তার অনেকখানি অধরা ছিল; আর সেটিই হয়তো পুরণ করলেন জীবনানন্দ দাশ। আধুনিক মানুষের সহানুভূতিহীন টুটুরো টুকরো ব্যথা-বেদনা- যা ব্যক্তির একান্ত নিজেস্ব, আর সেখানে জীবনানন্দ দাশ অনন্য এবং একা। হয়তো আজ নিঃসঙ্গ মানুষের একান্ত নিভৃত কবিতাযাপনে জীবনানন্দ দাশ কিছুটা বেশি জেগে থাকেন। সেখানে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এর প্রাসঙ্গিকতা- ঠিক তাঁর মতো করে ধরা দেয় না; কিন্তু মানব সামাজর সামষ্টিক সংকট-উত্তরণে জীবনান্দ দাশের ভূমিকা তাদের মতো সরব নয়। কিন্তু কবিতা পাঠকের কাছে তার মূল্য কেবল সামাজিক প্রয়োজনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় না, প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করেও কবিতা পাঠক গ্রহণ এবং বর্জন করে থাকেন। 

তবে দেশ পত্রিকার বর্তমান প্রচ্ছদ নিয়ে কিছু বলার আগে এটি উল্লেখ করতে হয়, আমি অনেক নজরুল-ভক্ত ও গবেষককে দেখেছি- যারা নজরুলের চেয়ে জসীমউদ্দীন ফররুখ আহমদকেও কিছুটা এগিয়ে রাখেন! আসলে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তবে আমার কাছে মনে হয়, এসব ভক্তদের অবস্থান যত না কাব্য পাঠের দ্বারা তাড়িত তারচেয়ে বেশি রাষ্ট্র ও সংঘের চেতনা দ্বারা জারিত। অথচ নজরুলের ক্ষেত্রে এ দুটো কোনোটাই হওয়ার কথা নয়। কারণ নজরুল এসব সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ দ্বারা তাড়িত ছিলেন না। তিনি ছিলেন মূলত লাঞ্ছিত-বঞ্চিতদের কবি, স্বাধীনতা সংগ্রামের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের কবি; আর চিরন্তর সঙ্গীতের স্রষ্টা। এর আগেও লিখেছি, রবীনন্দ্রনাথের সঙ্গে অনেকে এখন নজরুলের নাম যুগল বাদ দিয়ে জীবনানন্দ দাশের নাম আনছেন। আসলে যুগল হিসাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের বিষয় ও চেতনাগত যতটা মিল জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে ততটা অমিল। কিন্তু দেশ পত্রিকার বর্তমান প্রচ্ছদের ছবি আমার কাছে খারাপ লাগেনি। মনে হয়েছে এর মধ্যে অর্থের গভীর দ্যোতনা আছে। প্রথমে একটু হোঁচট খেলেও পরে গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি- শিল্পী এখানে গভীর মুন্সিয়ানার পিরচয় দিয়েছেন। কারণ এই দুই মহান কবির মাঝখানে রয়েছে অভঙ্গ বাংলার মানচিত্র, যার দুই পাশে দুজন কবির ছবি জ্বলজ্বল করছে। একজন রাঢ়বঙ্গ থেকে এসে সুজলা বঙ্গে স্থায়ী আবাস গেড়েছেন, আর অন্যজন সুজলা বাংলা থেকে গিয়ে অপর বাংলায় জেঁকে বসেছেন। এই চিন্তার মধ্য ইচ্ছেকৃত ছোট কিংবা বড়র ধারণা কাজ করেছে বলে মনে হয় না। মানচিত্রের অবস্থানগত দিক সে কথাই বলে। তাছাড়া এই ছবির দ্বারা এটিও ব্যাখা করা সম্ভব, নজরুল-বলয়ের আলোছায়া থেকে আরেকজন কবি কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছেন। তবে পরিতাপের বিষয়, এই প্রচ্ছদটির উদ্দেশ্য যাই হোক, নজরুল-জীবনানন্দ ভক্তদের কাছে আলাদা কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেনি। বরং খুব শঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করেছি, যারা নজরুলের অবনয়ন নিয়ে শঙ্কার প্রকাশ করেছে, তারা প্রতিপক্ষের কাছে সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে যারা জীবনানন্দের হয়ে কথা বলেছেন, তাদের শব্দ ও বাক্যবাণ  মোটেও জীবনানন্দ দাশের মতো সুমিত ও অর্থবহ ছিল না। কার ছবি কোথায় থাকল, সেটি আসলে কোনো অর্থবহন করে না। কেবল পেশি দিয়ে কবির আসন নির্ধারণ করা বাতুলতা। কোন কবি কতদিন কালের ভালে তার অক্ষয় জয়মাল্য পরিয়ে রাখবেন- তা নির্ভর করে তার কাব্যশক্তিরই গুণে; না হলে যতবড় কবিই হোক কালের গর্ভে তলিয়ে যাবেন; কিন্তু তাদের তলিয়ে যাওয়ার আগে যেন তার ভক্তরা তলিয়ে না যাই।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. মজিদ মাহমুদ সুকৌশলে প্রচ্ছদকে ডিফেন্ড করবার চেষ্টা করেছেন বলেই মনে হয় । তবে যারা নজরুলকে হেয় করার প্রয়াস চালাচ্ছেন বা নজরুল ভক্তদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন তাদের পক্ষ তিনি নেননি।
    তবে এটাও ঠিক যে এসব করে নজরুল কিংবা জীবনানন্দ কারও মর্যাদা বাড়ানো কিংবা কমানোর চেষ্টা ব্যর্থ হবে। শনিবারের চিঠি বা জীবনানন্দকে কবি মর্যাদা না দেয়ার যে কসরত। কলকাতার বুদ্ধিজীবী ও আনন্দবাজারিদের মজ্জাগত অভ্যাস তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
    জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পূর্বাপর যে অবহেলা, অবজ্ঞা তা বিবেচনায় রাখুন। তারা কতটুকুই বা তাঁকে কবি মর্যাদা দিয়েছিল, তাকে অবজ্ঞার মূল কারণ তিনি পূর্ব( প্রাচ্য!) বঙ্গীয় বলেই! সেই তাকে আবার নজরুল বধের হাতিয়ার করতে চাইছেন, সবই সেই পুরানো খেলা। আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য ও লেজুর মানস আমাদের বৃহৎ অংশকে নতজানু করে রেখেছে। ইনিয়ে বিনিয়ে বা সরাসরি তাদের পক্ষ নেয়ার লোকজন এই বঙ্গে নেহায়েত কম নয়!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ