তাজ ইসলাম
ফরহাদ মজহার, কবি। জ্ঞান, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে তার আরও একাধিক পরিচয় আছে। কবি ছাড়াও তিনি চিন্তক, দার্শিনক, রাজনীতিবিদ। ফরহাদ মজহার তার নিজের জন্য কবিতাকে রেখেছেন দর্শনের পরের তালিকায়। তবু তিনি কবি হিসেবেই অধিক উজ্জ্বল। ধর্মীয় বিষয়ে তার চিন্তা আর দর্শনের প্রকাশে তিনি বিতর্কিত। ধর্মের সাথে লালন চৈতন্যবাদের সমন্বয় পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে তাকে বিতর্কিত জনই সাব্যস্ত করে মুসলমান সমাজ। হাল সময়ে ফরহাদ মজহার কবিতার চেয়ে দর্শন চর্চাতেই সময় বেশি দেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার এক্টিভিটি চোখে পড়ার মতো। এক্ষেত্রেও তিনি যুগের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম। তার সমসাময়িক বা আরও পরের যারা তারা সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে। যন্ত্র বা বিজ্ঞানের জয়জয়কার এই সময়ের প্রচার মাধ্যমের শক্ত অনুসঙ্গ সোশ্যাল মিডিয়া। প্রবীণ কবি হয়ে এই মাধ্যমকে কাজে লাগানো এবং নেতৃত্ব পর্যায়ে বিচরণও তার সক্ষমতারই পরিচায়ক। সম্প্রতি একটি কবিতা লিখে সাড়া ফেলেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সংক্ষেপে যাকে ‘ভাইরাল’ বলা যায়।
কবিতার শিরোনাম : ‘ আ ল হা ম দু লি ল্লা হ ‘।
এই কবিতায় উদ্বেলিত হয়েছে প্রথমত দুই পক্ষ :
এক– ধার্মিক
দুই–বিপ্লবী
‘আলহামদুলিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করায় আবেগে উদ্বেলিত হয়েছে সরল মুসলমান। আবার তাদের এই সরলতার মাঝে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে যান সতর্ক মুসলমানেরা। তারা স্মরণ করিয়ে দেন কবির লালন,চৈতন্য,আর রাজনীতির মার্কসবাদের সূত্রতার কথা। ইসলাম শুধু আবেগ সর্বস্ব বিষয় নয়, ইসলামের মূল অবলম্বন বিশ্বাস।
বিশ্বাসহীন কিংবা বিশ্বাসে গড়বড় ব্যক্তির আবেগী কথা,বক্তব্য আদর্শ বা গ্রহণীয় অনুকরণীয় না, সতর্কতার থিম এটাই।
ইসলামী আদর্শ বিচ্যুত কবির কোন উত্তম কথার প্রশংসাতে সমস্যা নাই। প্রশংসা করা উদারতা। তবে তার আদর্শ গ্রহণ করা যাবে না। চিন্তায় প্রভাবিত হওয়ার ক্ষেত্রে থাকতে হবে সদা সতর্ক।
কবি ফরহাদ মজহার কবিতায় প্রয়োগ করেছেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ শব্দ। তার এই প্রায়োগিক কৌশল ইসলামের প্রচার কিংবা প্রশংসার জন্য নয়।
এই প্রয়োগ একটি ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও ঘটনা সমূহের যোগসূত্র বুঝাতে সহায়ক।
আমরা মনে করি এটাই তার প্রায়োগিক উদ্দেশ্য ।
কবিতার সবিস্তার পাঠ নির্যাস হল; এদেশে ইসলাম ছিল স্বমহিমায় সংঘাতহীন, দ্বন্দ্বহীন অবস্থায়। এদেশে একটি বিশেষ মহল নানা কায়দায় ইসলামকে বহুকিছুর মুখোমুখি দাঁড় করায়। এ কবিতায় রয়েছে সেসব কথার জবাবের উপযুক্ত উপকরণ।
“আম্মা বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, তাঁর কন্ঠ সদা সর্বদা কৃতজ্ঞতায় ভেজা থাকত”
‘আম্মা ‘ মাতৃভূমির অলঙ্ঘনীয় প্রতীক। আম্মা আমাদের অস্তিত্বের শিকড়। আলহামদুলিল্লাহ তার বিশ্বাস। আমরা বিশ্বাসী ছিলাম। আমরা এদেশের সন্তান। আমরা বিশ্বাসী হলে এদেশ বিশ্বাসীদের মাতৃভূমি। ধর্ম এদেশের জনরক্তের প্রবাহমান স্রোত। এইখানে ছোট একটি প্রশ্ন থাকে। আলহামদুলিল্লাহ তো মুসলমান ও ইসলামের অস্তিত্বকে স্বীকার করে। তাহলে অন্য ধর্মকে অস্বীকার করা হয় না? মোটেই না। ফরহাদ মজহার জন্মসূত্রে মুসলমান। কাজেই তিনি প্রয়োগ করেছেন ইসলামী শব্দ। তিনি মূলত প্রতিনিধিত্ব করেছেন ধর্মের। মহিমা প্রচার করেছেন ধর্মের। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন ভূমি ও ধর্মের সহাবস্থানের। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন ধর্ম,ভূমি,জনতার মেলবন্ধনের। এদেশের মানুষ ধার্মিক। এই দেশে বিরাজমান ছিল ধর্মীয় শান্ত পরিবেশ। ইসলাম যেমন ছিল, মুসলমান যেমন ছিল, ইসলাম ধর্মের মতো ছিল অন্যসব ধর্ম ও ধার্মিকেরাও।
অন্য ধর্মের অনুসারীদের মা তাদের নিজ নিজ ধর্মের প্রশংসাবাচক শব্দই উচ্চারণ করতেন। তাদের মাঝে ছিল না কোন ভেদাভেদ। অন্তত কবিতায় এমন কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
বিভেদ, সংঘাত ও আগ্রাসনের কারণটি ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছে কবিতার পরবর্তী পর্বে পর্বে, ছত্রে ছত্রে।
কবি বললেন,
“আম্মা বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, তাঁর কন্ঠ সদা সর্বদা কৃতজ্ঞতায় ভেজা থাকত”
এরপরই এই বক্তব্যের সাথে একটি ‘ কিন্তু ‘ যুক্ত করেছেন। এই কিন্তুর পরই খোলাসা করেছেন সবিস্তারে। বাংলা ভাষায় কিন্তু একটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। কিন্তু নানা অর্থ প্রকাশ করে। কিন্তু একটি বহুরূপী শব্দ। আমরা সেদিকে আজ যাব না। আমরা থাকছি কবিতাতেই। মা আলহামদুলিল্লাহ বলতেন। মা কৃতজ্ঞতায় আলহামদুলিল্লাহ বলতেন। আলহামদুলিল্লাহতে সমর্পিত হতেন। আলহামদুলিল্লায় মুগ্ধ থাকতেন। কিন্তু আমরা তার সন্তান হেঁটে গেলাম ভিন্ন পথে। অন্য চিন্তায়। অন্যতর চেতনায়। সে কথা বুঝাতেই তিনি বললেন, আম্মা আলহামদুলিল্লাহ বলতেন….
“কিন্তু বিজয়ীর বেশে অস্ত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে বজ্রনির্ঘোষে আমরা বললাম ‘জয়বাংলা’
আমাদের এই বলার মাঝে মায়ের প্রতি ছিল না কোন দরদ কিংবা সম্মান। আমরা বললাম রূঢ়ভাবে,বেপরোয়াভাবে
” জয়বাংলা”।
এবারও মা, মাতৃভূমি নিজের আস্থা ও বিশ্বাসে,কৃতজ্ঞতায় বিনয়ী রইলেন। এবং,
“মা সন্তান ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ !
এরপর কবির কথায় উপলব্ধির মানসে পাঠ হোক কবিতা।
“নয় মাস মায়ের চোখে পানি ছিল না, ফলে আরবি অক্ষর গুলো নদীর স্রোত হোল
অতঃপর চলল মেঘনায়, বাংলার সব জল বঙ্গোপসাগরেই ফিরে যায়।
তারপর চোখের জল মেঘ হয়, হিমালয় ভ্রমণ শেষে বর্ষা হয়ে ঝরতে থাকে।”
তারপরই চিত্রিত হয় মায়ের সন্তানদের চরিত্রের ভয়ংকর চিত্র। উন্মোচিত হয় অহংকারের দৃশ্য।
“অথচ আমাদের অহংকারগুলোকে আমরা কালো কোট বানিয়েছিলাম
আমাদের লোভ আর লালসাকে বানিয়েছিলাম মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট”
কবির মতে তারা অহংকারী হয়ে গেলেন। কথায় বলে অহংকার পতনের মূল। পতনের সূত্রপাত কি ও কীভাবে আগের বক্তব্যে খুঁজতে হবে। তখনও আম্মা কেমন ছিলেন?
“যেসব সন্তান যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফেরে নি, আম্মা গোপনে প্রতিদিন সন্ধ্যায়
আরবিতে তাদের নাম ধরে ডাকতেন, সব নক্ষত্র তাঁর মুখস্থ, “
অহংকারী হলে একজন কেমন হয়? হয় অবাধ্য,স্বার্থপর,অসভ্য। তবু আম্মা তার সন্তানদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আম্মার এমন দরদে কবি নিজেই এবার বলেন
” আলহামদুলিল্লাহ। “
কবিতার পরের পর্বটাই মূলত কবি ও কবিতার টার্নিং পয়েন্ট।
কবির বক্তব্য বিবৃত হয়েছে উত্তম পুরুষে। সে বক্তব্য স্পট এবং সাহসী। বক্তা হিসেবে তিনি এ কবিতায় প্রাজ্ঞ, বক্তব্য প্রাঞ্জল। তাফসির করলে লিখতে হবে বহুকথা। ভীরু,কাপুরুষ ও মেরুদণ্ডহীন সময়ে ফরহাদ মজহার উচ্চকিত, বলিষ্ঠ কণ্ঠ। এই পর্ব বিশ্লেষণের মতো সুঁচালো তীর কিংবা বীরবাহু হস্তে ধারণ করা তীর্যক কলমের প্রয়োজন। এমন ভয়ার্ত সময়ে সুন্দরবনের বাঘের সামনে হরিণ হাঁটতে সাহস করলেও অসুর বধের হিম্মত নাই কারও।
ফরহাদ মজহার ক্ষীণ দেহে পর্বত প্রাণ নিয়েই বয়ান করেন নিজের বক্তব্য। কাব্য রসমিশ্রিত সে শব্দ পাঠক তন্ময় হয়ে পাঠ করেন। তার কবিতা পাঠ করতে করতে উচ্চারণ করেন,
“আমরা আমাদের সব দেয়ালগুলিতে ‘জয়বাংলা’ লিখে দিয়েছি
আমাদের সব টাওয়ার গুলোতে পত পত পত পত উড়ছে ‘জয়বাংলা’
আমাদের জাতীয় সংসদ ‘জয়বাংলা’, ক্যান্টনমেন্টের নাম ‘জয়বাংলা’,
কিন্ডারগার্ডেনের নাম ‘জয়বাংলা’, এমনকি মাদ্রাসার নামও ‘জয়বাংলা’।
এরপর শুধু খাঁজকাটা,খাঁজকাটা।
“এই পরিস্থিতিতে মাকেও ‘জয়বাংলা জননী ‘ডাকা সঠিক, আমরা মুক্তিযোদ্ধা
বজ্রনির্ঘোষে যা খুশি জননীকে ডাকতেই পারি, ‘আলহামদুলিল্লাহ’!
পাঠকদের মধ্যে যারা নিরীহ,নিরামিষ, নির্জীব,নিস্ক্রিয় এবং কামনা করেন কায়মনোবাক্যে নিশ্চিত নিরাপত্তা তাদের জন্য কাব্যিক প্রার্থনা,
“সকল প্রশংসা তাঁর যিনি যুগপৎ ফ্যাসিস্ট ও মোমিন পয়দা করেন
এবং তাদেরও, যাদের মুখ সেলাই করে দিলেও শুধু তাঁরই প্রশংসা করে
আমাকে ধৈর্যহারা হিতাহিতশূন্য কোর না, আমি তো তোমারই দাস
যেন ফাঁসির দড়ি পরাবার সময়ও বলতে পারি ‘আলহামদুলিল্লাহ!”
আলহামদুলিল্লাহ বলে সবাই ঘুমাতে যান।