তৈমুর খান
বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের জন্মকে আমরা সকলেই স্যালুট জানিয়ে আসছি। সেই ইতিহাসেই বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার লোকের পরিচয়ও জেনে আসছি। আমরা বাঙালি বলে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিকেও আমাদের প্রাণের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পেরেছি। সুতরাং সেই গৌরবের মাহেন্দ্রক্ষণকে কিভাবে বরণ করা হয়েছিল কবির ভাবনায়—সেই সৃষ্টি ও শিল্পচেতনার নান্দনিক প্রজ্ঞাকেই অনুসন্ধান করেছেন তরুণ অধ্যাপক আশুতোষ বিশ্বাস তাঁর গবেষণালব্ধ ‘বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি ও অন্যান্য’(অমর একুশে বইমেলা ২০২৪)
গ্রন্থে। সত্তর দশকে মুক্তির সংগ্রাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে পূর্ণতা পেয়েছিল। স্বাধীন দেশের জনগণ তাঁদের সৃজনকর্মে এই দশকটির মাহাত্ম্যে কতখানি প্রভাবিত হয়েছিলেন তার একটা তাৎপর্যপূর্ণ তদন্ত লেখক করতে পেরেছেন।
যখন বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে এবং সত্তর দশকের কবিতা নিয়ে লেখকের পরিকল্পনা, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে একটা গভীর কৌতূহল থেকেই যায়। সত্তর দশক নানা দিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ। জাতিসত্তার মর্যাদা, সাহিত্য-শিল্পকলার নব জোয়ার, মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ এবং দেশপ্রেম ও মুক্তির স্বাদ উপলব্ধির আনন্দ। কিন্তু বাস্তবে তার কতখানি সদর্থক প্রয়োগ ও প্রকাশ ঘটেছে তারই একটি পরিচয় এই গ্রন্থে লেখক তুলে ধরতে পেরেছেন। বহু তথ্যের আয়োজনে এবং সমকালের লেখক-সমালোচকের বিবরণে গ্রন্থটি একটি মূল্যবান সংযোজন বলা যেতে পারে। মোট আটটি প্রবন্ধে সত্তর দশকসহ শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, সাম্য রাইয়ানও আলোচিত হয়েছেন। সুতরাং বাংলাদেশের কাব্যকাননের সিংহভাগ জুড়েই গ্রন্থটি তার অবস্থান চিহ্নিত করেছে।
১৯৭১ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে বিরাজমান কবিদের নিয়েই লেখক আলোচনার পরিসর নির্বাচন করেছেন। ১৯৫২-তে ভাষা আন্দোলন ও তার প্রভাব পরবর্তী সৃষ্টির ভাবনায়ও রেখাপাত করেছে। স্বদেশপ্রীতির সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনা মুক্তির পথেরই সোপাল রচনা করেছে। তারপর এসেছে স্বাধীনতা। উত্তাল এক অস্থিরতার মধ্যে কবির মনন জগতকেও আলোড়িত করেছে। শিল্পকে নিজের মতো আত্মপ্রকাশের ভাষা হিসেবেই কবিরা এক মুক্তি অনুভব করেছেন। লেখক উল্লেখ করেছেন “বেশিরভাগ কবিবর্গ দৃষ্টি রাখলেন মৃত্তিকা অভিমুখে। হৃদয় কর্ষণে তুলে আনতে চাইলেন শান্ত হৃদয়দিঘির টলটলে জল। বামপকেট ডানপকেট সামলাতে সামলাতে হাত রাখলেন হৃদয়ের কাছে। আর এই কারণেই সত্তরের কবিরা হয়েছেন মিতভাষী, রোমান্টিক স্বপ্নমেদুর, বিকেলের রঙিন মেঘের ঘোড়ায় চড়ে পাড়ি দিতে পেরেছেন মননের সপ্তসিন্ধু পারে।” কিন্তু একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠে এসেছে—সত্তর দশকে লিখতে আসা সব কবিই কি কবি? এর সমাধানও করেছেন লেখক। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতোই কবিদেরও খুঁজে পাওয়া দায় হয়েছে। মুষ্টিমেয় যে কয়জনকে পেয়েছেন তাঁরা সব বেশিরভাগই ষাটের কবি। কেননা তাঁদের কবিতা সময়কে অতিক্রম করে বৃহত্তর ও চিরন্তন জীবনক্ষেত্র অন্বেষণ করেছে। কিন্তু সত্তর দশকের বেশিরভাগ কবিতায় উদ্দীপ্ত আবেগ, একঘেয়েমিতা, সীমাবদ্ধতা এবং উত্তরণহীন শিল্পচর্চার পরিচয় থেকে গেছে। তবুও বেশ কয়েকজন কবি এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন, এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, ময়ূখ চৌধুরী, দাউদ হায়দার, আবিদ আনোয়ার, আসাদ মান্নান প্রমুখ। কবিরা পলাশের লাল রঙে কলম ডুবিয়ে কবিতা লিখে রাজনৈতিক ও সামাজিক দায় সামলেছেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রবেশ করেছেন নিজ ব্যক্তিচেতনার গহ্বরে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ যে আবেগের জন্ম দিয়েছিল তা অচিরেই মিইয়ে গেছিল সাহিত্যক্ষেত্রে। তাই সত্তর দশক একটা কালচিহ্নিত সময় মাত্র।
গ্রন্থটি একটা দলিল হিসেবেই বাংলা সাহিত্যের পাঠক ও গবেষকের কাছে গৃহীত হবে নানা কারণে। বাংলাদেশের সত্তর দশকসহ তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সাহিত্যচর্চার ইতিহাসকে সহজেই নিরীক্ষণ করা যাবে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, আলোচনা-সমালোচনা, কবিদের জীবনদর্শন, কাব্যকৃতি, সমকালীন পাঠক ও সমালোচকদের বক্তব্যের সঙ্গেও লেখক পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কাব্যচর্চার অভিমুখও নির্ণয় করেছেন। বিস্মৃত বহু কবিকে তুলেও ধরেছেন। যেমন কামাল চৌধুরী,মোহন রায়হান,শিহাব সরকার, নাসিমা সুলতানা, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, রবীন্দ্র গোপ প্রমুখ কবিদের নামই শুনিনি। এইসঙ্গে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’, শহীদ কাদরী, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ সাখাওয়াতের মতো কবিদের নিয়েও বিদগ্ধ আলোচনা একটা মূল্যবান প্রাপ্তি বলেই মনে করি। ব্যক্তিজীবন থেকে সাহিত্যশিল্পেও তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর কতখানি যুগাতীত ছিল তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তরতাজা তরুণ কবি সাম্য রাইয়ানকে নিয়েও লেখকের মূল্যবান পর্যালোচনা সাম্প্রতিক কালের তরুণ কবিদেরও প্রেরণা হয়ে উঠবে। শুধু লেখক এর সঙ্গে পরিচয় নয়, তাঁদের জীবন, পেশা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান, আত্মচেতনারও অন্বেষণ আছে। সব মিলিয়েই বইটি সব ধরনের পাঠকের কাছে প্রয়োজনীয় একটি বই।
বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি ও অন্যান্য: আশুতোষ বিশ্বাস, ঘাসফুল প্রকাশন, ১১/১, ইসলামী টাওয়ার, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০, মূল্য ৪০০ টাকা।