তৈমুর খান
ঈদের প্রস্তুতি
রমজানের চাঁদ দেখে সিয়াম সাধনার প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় ঈদের প্রস্তুতি। ভোরবেলায় সেহরি খাওয়া এবং মাগরিবের আজানের পর ইফতার করার মধ্য দিয়েই আসে ঈদের উপলব্ধি। ভোরবেলায় হইচই এর মধ্য দিয়ে জেগে ওঠার আনন্দ এবং যেটুকু খাবার পাওয়া যায় তাই ভাগ করে খাওয়ার পর দাদীর জায়নামাজে গিয়ে নামাজের মহড়া চলতে থাকে। সারাদিন হয়তো সিয়াম পালন সম্ভব হয় না, কিন্তু মাগরিবের সময় ইফতারে টুপি মাথায় দিয়ে সকলের সঙ্গে বসার আনন্দ এবং ইফতারে অংশগ্রহণ করা কখনো বাদ যায় না। দুঃখের সংসারে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, সিয়াম সাধনার শিক্ষা খুব ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়। সহমর্মিতা, সহনশীলতা, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সকলকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই এই সিয়াম সাধনার প্রস্তুতি। একটাই লক্ষ্য—ঈদ আসবে। ঈদ আনন্দ নিয়ে আসবে। ঈদ নতুন পোশাক পরার আনন্দ, সকলকে সালাম করার আনন্দ, সকাল সকাল ময়দানে জমায়েত হওয়ার আনন্দ, পরস্পর পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাবার আনন্দ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিষ্টিমুখ করার আনন্দ নিয়ে আসবে। কারো সঙ্গে কারো তফাত থাকবে না। এক কাতারে দাঁড়িয়ে সবাই ঈদের নামাজ পড়বে। গোরস্থানের চারিপাশে গিয়ে দোয়া করবে তাদের আত্মীয়-স্বজনের জন্য। ধনীরা গরিবদের যাকাত দান করবে। সবাই সবাইয়ের দিকে হাসিমুখে ঈদ মোবারক বলবে। এইতো আমার দেখা গ্রাম বাংলার ঈদ। ছোটখাটো কৃষক পরিবার, সামান্য হাল-বলদের ক্ষুদ্র চাষি। যেটুকু ফসল ফলায় তাতেই সারাবছরের রসদ। কোনোরকম করে দিনপাত করার স্বপ্ন দেখে। এদের ঘরেই আসে ঈদ। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদ ওঠে ঈদের।
‘ঈদ’ শব্দটির অর্থ কী?
————————————
অর্থ যাই হোক, আমরা শুধু ঈদ অর্থে আনন্দকেই বুঝি। কেউ কেউ ঈদ অর্থে উৎসবকেই নির্দেশ করেন। কিন্তু উৎসবও পরোক্ষে আনন্দেরই ধারক। আবার কেউ কেউ ঈদের আক্ষরিক অর্থে ‘বারবার ফিরে আসা’-কেই বোঝান। সবগুলোর অর্থই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এ দিনটি বারবার ফিরে আসে বলে এরকম নামকরণ করা হয়েছে। একমাস রোজার অর্থাৎ সিয়াম সাধনার কষ্টের পর, ফিতরার দায়িত্ব পালনের পর আসে এই ঈদুল ফিতরের আনন্দ। পরবর্তী ঈদুল আযহা ত্যাগের আনন্দে পরিবর্তিত হয়। সেখানেও থাকে হজের কষ্ট। ঈদের তো এটাই শিক্ষা—কষ্টের পর আনন্দের আগমন।আল্লাহ কোরআনে বলেছেন কষ্টের পর সুখ দেবেন (সূরা তালাক ৬৫:৭ )। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।(সূরা ইনশিরাহ ৯৪:৫-৬)।
ঈদ শব্দের বানান
‘ঈদ’ একটি আরবি শব্দ। সুতরাং আগন্তুক শব্দ বলে দীর্ঘইকার (ঈ) ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু আরবি বানানের উচ্চারণে দীর্ঘ-টান ও ছোট-টানের প্রয়োগ দেখা যায়। এখানে ‘ঈদ’ বানানটিতেও উচ্চারণে দীর্ঘ-টানের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে এটিতে ব্যতিক্রম বানানরীতি হিসেবেই দীর্ঘইকার ব্যবহার করা হয়।হ্রস্বইকার ব্যবহার করলে ঈদকে ঠিকমতো উচ্চারণ করা যায় না।
ঈদের তাৎপর্য
ঈদ পালনের গভীর তাৎপর্য হলো এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাস রেখে মানুষে মানুষে দূরত্ব ঘুচিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন। ঈদের আনন্দ তখনই পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায়, যখন মানুষ তার প্রতিবেশীকে আপন করে নিতে পারে। যাকাত ও ফিতরা দানের মাধ্যমে তার সহানুভূতিশীল বিবেক জাগ্রত করতে পারে। পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় কাছে টেনে নিতে পারে। সব মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি। সবারই সমান অধিকার রয়েছে। কারো সঙ্গে কারো তফাত নেই। এই সাম্যনীতির তথা মানবনীতির মহানুভবতার প্রয়োগ ঈদ পালনের মধ্য দিয়েই ঘটে। ছোট থেকেই এই উপলব্ধি আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে আসছে। আটের দশক এবং নয়ের দশকের দিনগুলিতে গ্রামবাংলায় কৃষক পরিবারগুলিতে ঈদ পালনের তেমন জৌলুস ছিল না, কিন্তু আন্তরিকতা ছিল। পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসতে পারত। ঈদের দিন সমস্ত গ্রামকেই মনে হতো একটি পরিবার। অনেকেরই নতুন জামা-কাপড় কেনার সামর্থ্য থাকত না। যাকাত দেওয়ার মতো লোকেরও অভাব ছিল। জমিতে যেটুকুই ফসল হতো তা দিয়েই জীবন-জীবিকা এবং ঈদ পালনের আয়োজন হতো। সুতরাং মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের খুব একটা তফাত থাকত না। পাশাপাশি কোনো গ্রামে কোনো উচ্চবিত্ত ব্যক্তি বস্ত্র কিংবা অন্ন দান করলে সমাজের গরিব মানুষেরা সেই দান গ্রহণ করত। তার ফলে তাদের অভাবেও কিছুটা হালে পানি পড়ত। এভাবেই ঈদ যেমন একটা অর্থনৈতিক সাম্য এনে দিত, তেমনি সহানুভূতিশীল মানবিক শিক্ষাকেও সমাজে জাগ্রত করত। সম্পদশালী ব্যক্তি অনুভব করতে পারতেন, “আল্লাহ সম্পদ দিয়েও পরীক্ষা করেন, আবার না দিয়েও পরীক্ষা করেন। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। সাবধান হয়ে যাও।” এসবই ঈমানের এক একটি অঙ্গ। ইসলামে মানবিক শিক্ষাটিই সর্বদা বড় করে দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কবি কায়কোবাদ মহামিলনের উৎসব হিসেবেই ঈদকে দেখেছিলেন। ঈদের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য এবং আধ্যাত্মিক ও সামাজিক অবদানের কথা মাথায় রেখেই কবিতায় লিখেছিলেন—
“এই ঈদ বিধাতার কি যে শুভ উদ্দেশ্য মহান,
হয় সিদ্ধ, বুঝে না তা স্বার্থপর মানব সন্তান।
এ ত নহে শুধু ভবে আনন্দ উৎসব ধুলা খেলা।
এ শুধু জাতীয় পুণ্যমিলনের এক মহামেলা।”
ঈদের আনন্দের মধ্যে মানবিক ও ঐশ্বরিক উপলব্ধিই চূড়ান্তভাবে বিরাজ করে। সুতরাং ঈদ মানে আর পাঁচটা উৎসবের মতো নয়। অর্থ থাকলেই ভালো জামা-কাপড় পরে, ভালো-মন্দ নানা খাবারের আয়োজন করে নিজেদের আভিজাত্য ও দেমাক প্রকাশ করা নয়। প্রতিবেশী তথা সমাজ, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সুন্নাহ পালনের মধ্য দিয়েই এর চূড়ান্ত সিদ্ধি নির্ভর করে। এই কারণেই তো ঈদের জন্য মানুষ অপেক্ষায় থাকে। কে কতটা দান করতে পারেন, কে কতটা মানুষকে ভালোবাসতে পারেন, কে কতটা তার প্রতিবেশীদের (তারা অন্য ধর্মের হলেও) নিয়ে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারেন তারই একটি পরীক্ষা দিতে হয়। কবি গোলাম মোস্তফা এই কারণেই ঈদকে মানবতার বিরাট প্লাটফর্ম হিসেবেই দেখেছেন। সাম্য আর প্রেমের এরকম উৎসব আর কোথায় আছে? ‘ঈদ উৎসব’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—
“কণ্ঠে মিলনের ধ্বনিছে প্রেম-বাণী, বক্ষে ভরা তার শান্তি,
চক্ষে করুণার স্নিগ্ধ জ্যোতিভার,বিশ্ব-বিমোহন কান্তি
প্রীতি ও মিলনের মধুর দৃশ্যে
এসেছে নামিয়া যে নিখিল বিশ্বে
দরশে সবাকার মুছেছে হাহাকার বিয়োগ-বেদনার শ্রান্তি।”
যত বিদ্বেষ অন্তরায় অন্ধকার দূরে ঠেলে কাছাকাছি এনে দাঁড় করিয়েছে মানুষকে। ক্ষমা ও ভালোবাসায় মানুষ পবিত্র হবার সুযোগ পেয়েছে। শান্তি ও স্বর্গসুখ তো এখানেই।
পরিবর্তনের ধারায় ঈদ
কিন্তু আজ আমার ছোটবেলার দেখা ঈদের আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে এসেছি। গ্রামগুলিও আর নিছক গ্রাম নেই। মানুষের অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। আধা-শহুরে কালচারে গ্রামগুলি তার আসল চেহারা পরিবর্তন করেছে। ফলে মিশ্র-কালচারের এক কৃত্রিম জৌলুসে গ্রামগুলি ভ’রে উঠেছে। মানুষের আন্তরিকতা কমে গেছে। ঈমান ও সুন্নাহর প্রতি আর সেই একনিষ্ঠ আনুগত্যও চোখে পড়ছে না। তাই যাকাত-ফিতরা সমাজের কিছু অংশ মানুষই সচল রেখেছে। ঈদ সামাজিক উৎসবের বদলে একটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। যার যত অর্থকড়ি আছে, ঈদে তার তত আয়োজন। গরিব-দুঃখীরা বেশিরভাগই উপেক্ষিত হচ্ছে, তার বদলে বন্ধুবান্ধব ইয়ার-দোস্তরাই আমন্ত্রিত হচ্ছে। সিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও মানুষের মনে নানা কুযুক্তির উদয় ঘটেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা লোক-দেখানো পর্যায়ের ধর্ম পালনে পরিণত হয়েছে।
এই চিত্র এখনও গ্রাম বাংলায় দেখা যায়।
ঈদের দিনেও গরিব-দুঃখী ও অসহায়দের কষ্টের শেষ থাকে না। কবি শাহাদাত হোসেন এই অবস্থা দেখেই ‘বাংলার ঈদ’ কবিতায় লিখেছেন—
“বাংলার মুসলমান শুধু চেয়ে রয়—
মৌন ম্লান ক্লিষ্ট মুখ নির্বাক নিশ্চল।
ফিত্রার খুশী কোথা তার?
কি দান সে দিবে ক্ষুধিতেরে?
নিজেই কাঙাল রিক্ত—
ভিক্ষা মাগি ফিরে দ্বারে দ্বারে।”
শুধু বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও এই ছবি পরিলক্ষিত হবে। কবি সঠিক ফিতরা ও যাকাত আদায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তা ঠিকমতো পালন করলে এরকম দুরবস্থা থাকবে না। এদের ঘরেও ঈদের চাঁদ নেমে আসবে।
এতদ্ সত্ত্বেও ঈদ কিন্তু ঐতিহ্য হারায়নি। সিয়াম পালনকারী প্রতিটি মানুষ আজও ঈদের চাঁদ দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। রাত জেগে আল্লাহর কাছে তার পাপ-মোচনের জন্য ইবাদত করেন। আল্লাহকে ভয় করেই নিষ্ঠার সঙ্গে একমাস জীবনযাপন করেন নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত পানাহার বর্জন করেই। ভোরবেলায় প্রতি মসজিদে সুমধুর আজানের ধ্বনি শোনা যায়। শোনা যায় কোরআন তেলাওয়াতের সুললিত বাণীও। রমজানি ভোরে বাড়ির নানি-দাদীরা আজও ডালের বড়া ভাজতে ভাজতে গুনগুন শব্দে গেয়ে ওঠেন নবীর হুলিয়ানামা।সেই সুর আজও কানে বাজে:
“আল্লা আল্লা বলো বান্দা কলমা করো সার।
মোহাম্মদের দিন বিনা রাহা নাহি আর॥
মোহাম্মদের হুলিয়া কহি কান দিয়া শোনো।
দেলে একিন করে পড়ো তাহে ঈমান আনো॥”
বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়েরাও প্রথম আমপারা পড়তে শুরু করে। কোরআনের হরফ চিনতে চিনতে এক সময় তারা পুরো কোরআন শরীফই পাঠ করতে পারে। কোথাও মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান শুরু হয়। জন্ম নেয় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য। দান-খয়রাত করার ইচ্ছাটিও এই সময় জেগে ওঠে যা ঈদের খুশিতে পরিণত হয়। নজরুল তাই লিখেছিলেন:
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাকিদ।”
নিজেকে বিলিয়ে দেবার আসমানী তাগিদ যা রমজানেই শুরু হয়েছিল, ঈদে তাকেই পূর্ণতা দিয়েছে। আল্লাহর প্রতি ভরসা এবং ঈমানকে সঙ্গে নিয়েই জীবন সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জুগিয়েছে। সেই কথা-ই নজরুল ‘ঈদ মোবারকে’ বলেছেন—
“শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো,
কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,
বরষের পরে আনিলে ঈদ! ”
এখানেই ঈদের ব্যাপ্তি ও শক্তিকে উপলব্ধি করা যায়। বাংলার জনজীবন এমনিতেই বিপর্যস্ত থাকে। বর্তমানে রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ যত মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে, সমস্যা ও সংকট ততই সৃষ্টি হচ্ছে। মুসলিমরা আগামী দিনে ঈদ পালন করতে পারবে কিনা এ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্বজুড়েই মুসলমানদের উপর নেমে এসেছে ধ্বংসযজ্ঞ। ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে মায়ানমার, ফ্রান্স থেকে চীন সর্বত্রই চলছে অস্তিত্ব সংকটের লড়াই। ভারতেও তার প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। তাই নজরুলের কবিতা আজও সত্য হয়ে আছে।
নজরুল দেখেছেন অসংখ্য মরুভূমি,বালুচর আর অনাবিল আঁখিজল।সবই যে জীবনযুদ্ধের কথা তা বলাই বাহুল্য। তাই মানবতার জয়গান সেদিন যেমন সত্য ছিল, আজও তেমনি সত্য। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সুখ-দুঃখের সমভাগী হয়ে বেঁচে থাকার এবং আনন্দ ভাগ করে নেবার প্রয়োজন।এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ঈদের মাহাত্ম্য। হাজার কষ্ট, শত অন্তরায় সবকিছু গ্রাস করলেও ঈদকে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত হিসেবেই ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা মনে করে। ঈদের মধ্যে দিয়েই আজও তারা শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানায়:
“পথে পথে আজ হাঁকিব, বন্ধু,
ঈদ-মোবারক! আসসালাম!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল-কালাম!
বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ।
আমার দানের অনুরাগে-রাঙা ঈদগা’ রে!
সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে—
দেহ নয়, দিল হবে শহীদ॥”
নিজেকে উৎসর্গ করা আল্লাহর নামে, মানুষকে ভালোবাসা হৃদয় উজাড় করে—ঈদ ছাড়া কে শেখাবে? রসুলের পথ, রসুলের আদর্শ বিশ্ব মানবকে এক বাঁধনে বাঁধতে শিখিয়েছে। সুতরাং ঈদ শুধু একটি উৎসবের নাম নয়, একটি আনন্দের নাম নয়, একটি বিশ্ববিধানের স্বর্গ ও শান্তি স্থাপনের মাধ্যমও বলা যেতে পারে।
ঈদ সংখ্যা সাহিত্য পত্রিকা
——————————————-
ঈদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ তথা এই বাংলাও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে থাকে। কেননা ঈদ বাঙালি সংস্কৃতিরই একটি অঙ্গ। বিভিন্ন সময়ে ঈদ সংখ্যাগুলি যেমন উৎকৃষ্ট সাহিত্যেরও জন্ম দিয়েছে, তেমনি আয়োজনেও খামতি রাখেনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং সাহিত্যসভাও যা ‘ঈদ মিলনী উৎসব’ নামে অনুষ্ঠিত হয়। শুধু মুসলিমরাই নয়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষও ঈদ সংখ্যাগুলিতে তাদের শিল্পীসত্তাকে বিকশিত করার সুযোগ পান এবং অনুষ্ঠানগুলিতে যোগদান করেন।
ইতিহাসের দিকে তাকালে যতটুকু দেখতে পাই তাতে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই ঈদ নিয়ে লেখালেখির সূচনা। ১৯০৩ সালে সৈয়দ এমদাদ আলীর(১৮৭৫-১৯৫৬) সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘নবনূর’ পত্রিকায় তাঁরই লেখা কবিতা ‘ঈদ’ ঈদ নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম কবিতা বলেই মনে হয়। কবিতাটির কিছুটা অংশ:
“ধর্ম ও কর্মরে জীবনের মাঝে
প্রতিষ্ঠিত করি আজ
জীবনের আবহে হও অগ্রসর,
নাহি তাতে কোন লাজ।
যে চেতনা থাকে একদিন জাগি,
দীর্ঘ নিদ্রা তার পরে,
সে তো আনে শুধু ঘন অবসাদ
জীবনে ঢালে অনন্ত বিষাদ
দেও তারে দূর করে।”
এখানে কবির কাছে ঈদ এক আত্মজাগরণের উৎসব হিসেবেই উপলব্ধ হয়েছে। বিষাদ ও আলস্য দূর করে কর্মতৎপরতায় নিজেকে বিকশিত করার প্রেরণা হিসেবেই ঈদের আগমন। তাই ঈদকে সর্বান্তকরণে বরণ করেই নিজেকে পরিশুদ্ধ করে অগ্রসর হওয়া। যুগে যুগে বাংলা সাহিত্য এই ধারাতেই ঈদকে ধারণ করেছে। নজরুলও ঈদকে এভাবেই দেখেছেন। পরাধীন দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা ও ক্লান্তিকে দূরে সরিয়ে বাঁচার নতুন তাগিদে ঈদকে তুলে ধরেছেন। তাই কবিতায় লিখেছেন:
“জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পাঁজরের হাড়?”
ঈদের চাঁদ যখন শিশুর পাঁজরের হাড় হয়ে উদয় হয়, তখন বোঝা যায় জীবন কত যন্ত্রণার, কত অসহায়তার, কত নিদারুণ দুঃখের। তবু তো সেই ঈদ—যে ঈদে মানুষ জীবনকে অনুভব করতে পারে, ভালোবাসাকে অনুভব করতে পারে। তাই মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদও লিখেছেন ‘ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই’:
“আজকে এল খুশীর দিন
দেখ না চেয়ে খুশীর চিন
দেখ না চেয়ে আজ রঙিন
খুশীর ঝলক ঈদগাহে।
জামাত ছেড়ে থাকবে যে
ঘরের কোণে রইবে সে
রইবে হয়ে একপেশে
একলা থাকায় দুঃখ তাই।
সবাই মিলে একদলে এক আশাতে
যাই চলে এক আশাতে
যাই বলে ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই।”
দুনিয়াটা ঈদগাহ হলে সাম্য ফিরে আসবে, ভেদাভেদ ঘুচে যাবে, মানুষের মধ্যে জেগে উঠবে মূল্যবোধ। পরস্পর পরস্পরের আপনজন হয়ে উঠবে।
কবি বেগম সুফিয়া কামাল তাঁর ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতায় লিখেছেন—
“ওই উদিল গগনে সুন্দর শিশু চাঁদ
আমিন। আমিন। রাব্বুল আলামিন করে সবে মোনাজাত।”
এই মোনাজাত শুধু সাহিত্যে নয়, বাস্তব জীবনেও লক্ষ করা যায়। গ্রাম বাংলার মানুষ তথাকথিত নাস্তিক সভ্যতায় এখনো নিজেদের সমর্পণ করেনি। এখনো ঈমান ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে আল্লাহর ভরসায় জীবন পার করে। যখন কোনো অবলম্বনই তার জীবনে নেই, যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে উৎখাত করারও প্রয়াস চলে, যখন একের পর এক আঘাত ও মৃত্যু তার জীবনে নেমে আসে—তখন সে একান্তভাবেই আল্লাহর কাছে তার আবেদন জানায়। মনের কথা বলে। এই মোনাজাত রমজান এবং ঈদের মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়।
কবি সিকান্দার আবু জাফর ঈদ উপলক্ষেই দোয়া চেয়ে পিতার কাছে চিঠি লেখেন। চিঠির প্রতিটি শব্দে কত আন্তরিকতা, কত আশা ও কত বিশ্বাস ঝরে পড়ছে তা বোঝা যায়। সেই ‘ঈদের চিঠি’-তে কবি লিখেছেন—
“ঈদের সালাম নিও, দোয়া করো
আগামী বছর কাটিয়ে উঠতে পারি যেন
এই তিক্ত বছরের সমস্ত ব্যর্থতা। অন্ততঃ
ঈদের দিন সাদাসিধে লুঙ্গি একখানি, একটি পাঞ্জাবী আর
সাদা গোলটুপি তোমাকে পাঠাতে যেন পারি; আর
দিতে পারি পাঁচটি নগদ টাকা।”
ঈদ কতখানি মূল্যবোধ জাগাতে পারে, কতখানি দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে আমাদের নিয়ে যেতে পারে, কতখানি স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে তা এই এক টুকরো চিঠির ভাষায় ফুটে উঠেছে। এ কথা আমাদের প্রাণের কথা, আমাদের বেঁচে থাকার কথা, আমাদের ভালোবাসার কথাও। বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি আল মাহমুদও ‘ঈদের খুশি’ নামক ছড়ায় লিখেছেন ঈদের দিনের খাওয়া-দাওয়ার কথা। এটাও একটা স্বপ্ন থাকে মানুষের। ঈদ এলেই কিছুটা আলাদা কিছু রান্নাবান্না হয়। আত্মীয়-স্বজন কুটুম্বরা পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানায়। দূরের মানুষেরা ঘরে ফিরে আসে। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া, আনন্দ ফুর্তি গল্প-গুজবে সময় কাটানো একি কম কথা! তাই সারা বছর ধরে ঈদের পথ চেয়ে থাকতে হয়। কবি লিখেছেন—
“সব খুশিরই গন্ধ আছে-ঈদের খুশিরও
ঈদের খুশির গন্ধটা ভাই ঘিয়ে ডোবানো
আদর সোহাগ সবকিছুতে রান্নাঘরের ঘ্রাণ
কোরমা পোলাও ছাড়া কি ভাই ভরবে কারো প্রাণ?”
বাড়ির ছেলেমেয়েরা সেই খাবারের জন্যই সারা বছর ধরে আয়োজন করে। আর সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সেই আনন্দ ভাগ করে নেয়। সুতরাং ঈদ যেমন সংস্কৃতির একটি পরিচয়, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের একটা সম্পর্ক স্থাপনের পথও। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, মানবিকতা, ঐশ্বরিক চেতনা সবকিছুর মধ্য দিয়েই এই ঈদের প্রকাশ। সেখানে সেরা-খাওয়া দাওয়াও উপেক্ষিত হবে কেন? তাই ছড়াটি শেষ হয়েছে এইভাবে—
“সবকিছুতে স্বপ্ন আছে খাওয়ার স্বপ্ন সেরা
স্বপ্নে স্বপ্নে যাক মিলিয়ে ধনী-গরিবেরা।”
এই স্বপ্ন থেকে যাবে যতদিন বাঙালি থাকবে এবং বাঙালির ঈদ থাকবে।