spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়ে'ভোরের হাওয়া'য় গান গেয়েছেন কবি

লিখেছেন : তাজ ইসলাম

‘ভোরের হাওয়া’য় গান গেয়েছেন কবি

তাজ ইসলাম 

“ভোরের হাওয়া” কবিতার বই। নিন্দা দিয়ে তার শুরু। তারপর নীরবতার গুমোট পরিবেশ অতিক্রম করে আসে “সকালের রোদ”। এরপর ” সেমেটিক নারী “

মরুদ্যানের ফুল খুঁজে ” কৃষ্ণপক্ষ রাত ” অতিক্রম করে পৌছে যান ” ভোরের বাগান “-এ। 

তখনও সন্ধান হয়নি ভোরের হাওয়ার। মূলতঃ এটি একটি কবিতা কিতাব। যে কিতাবে এই নামে কোন কবিতা নাই। ভোরের হাওয়া কবিতা কিতাবে ‘ভোরের হাওয়া’ নামক কবিতা ছাড়াই আছে এক শত কবিতা। বইটি কবি কাজী জহিরুল ইসলাম’র। কাজী জহিরুল ইসলাম বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে পরিচিত নাম। কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও আছে তার সরব উপস্থিতি। তবে কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। অনেক উজ্জ্বল নামের মাঝে তার নাম সুনামের আলো ছড়ায়।

বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন তিনি। এই বইটি তার পরিকল্পিত পুস্তকের একটি। কততম পুস্তক তা বলতে পারছি না বলে দুঃখিত। তবে এতটুকু বলা যায় তিনি ৯০ টি গ্রন্থের প্রণেতা। কবি জাতিসংঘে কর্মরত। তিনি জাতিসংঘ সদর দফতরের আয়কর বিভাগের প্রধান। কবিতা নিয়ে নিরীক্ষা– প্রাজ্ঞ কবিদের অনেকেই করেন। “ভোরের হাওয়া ” সরাসরি নিরীক্ষাধর্মী না বলে পরিকল্পিত বলাই শ্রেয়। একই ছন্দের কবিতা দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই। ইতিপূর্বে আরও অনেকে এমন কাজ করলেও ছন্দ নিয়ে এটি একটি অন্যরকম আয়োজন। একই ছন্দের বিভিন্ন আঙ্গিকে কবিতার একটি পরিপূর্ণ বই লিখতে তিনি ব্যয় করেছেন তার সময়, শ্রম। মেধা ও চেষ্টার সমন্বয় এই পুস্তক। পুস্তকে আছে একশত কবিতা।

একই  ছন্দের কবিতা দিয়ে  সাজিয়েছেন তার বই। বইয়ের কবিতার আগে লিপিবদ্ধ আছে তার একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধে বলা আছে মাত্রাবৃত্তের আদিঅন্ত। আরও বলা আছে ছন্দ,তাল,লয়,মাত্রা পর্বের কথা, কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন কোন কবিতা কোন চালে রচিত। কয় মাত্রায় রচিত কয়টি কবিতা।

এবং তিনি এও উল্লেখ করেছেন কোন কোন কবিতা একই মাত্রার। ছন্দ নিয়ে যিনি কাজ করেন অতঃপর বিশ্লেষণ করে বলে দেন তার কবিতা কোনটা কত মাত্রার,তার কবিতায় ছন্দের নানা বাঁক, বিচিত্র ঢেউ থাকবে এটি অনায়াসে আশা করা যায়।

এ রকম বই নবীনতর কবির জন্য ছন্দের সহায়ক পুস্তক হিসেবেই বিবেচ্য।

কবি মনের খেয়ালে লেখেন। ছন্দ জেনেই লেখেন। ছন্দের অনুগত হয়ে লেখেন না। কবির কবিতার অনুগত হয়ে যায় ছন্দ। ছন্দ তখন বাতাসে ঢেউয়ের তালে তালে নাচে।কবি যখন লেখেন

“চোখ দুটো সেলফোনে ধ্যানী এক বগা/

আঙুলেরা লকলকে কচি লাউ ডগা/”

তখন উপমা,উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্পের আবহে গীতল হয়ে দোলা দেয় ছন্দ।

প্রযুক্তির সাথে প্রকৃতির সন্তান বগার সমন্বয়,আবার আঙুলকে কচি লাউয়ের তুলনার দক্ষতা একজন কবির মেধা,প্রজ্ঞা আর কাব্য প্রতিভার অসাধারণ উপস্থিতি। একই কবি যখন ছন্দের প্রতি মনোযোগী হন,মাত্রা পর্বের বিন্যাসের প্রতি অধিক খেয়াল রাখেন তখন তার কলম থেকে বেরিয়ে আসে :

“পাখি খায় পাকা পেঁপে/ গাছ কেন ওঠে কেঁপে?  /”।

পাঠক উপলব্ধি করে কবির মনোজগত। তারা ভাবে ছন্দ,মাত্রা,পর্বের প্রতি দায়বদ্ধ কবি। কবির হয়তো তাড়না ছিল এই চালের একটি কবিতা দাঁড় করাতে হবে। সেই জন্যই একই কবির হাত দিয়ে উৎকৃষ্ট একটি কাব্য পঙক্তি বের হওয়ার পর একই কবির কলমের ডগায় ঝরে পড়ে রসকষহীন পঙক্তি  “পাখি খায় পাকা পেঁপে/ গাছ কেন ওঠে কেঁপে?  /”। অবশ্য প্রত্যেক কবিতায়ই শেষ পর্যন্ত একখান বক্তব্য উপস্থিত হয়। এ কবিতার সারমর্মেও একটি মেসেজ যে নাই সে কথা বলছি না। আমরা মূলত একজন কবির দুই কবিতার দুইটি পঙক্তি পাশাপাশি রেখে ভিন্নভাবে কবিতার মেজাজ অনুভব করলাম।

বয়স হলে মানুষের মনে জাগে মৃত্যু ভয়। পৃথিবীকে বিদায় জানাতে হবেই।বয়স ছাড়াও মৃত্যু ভয় হৃদয়ে রাখে সচেতনজন। সে জানে এই পৃথিবী থেকে তার প্রস্থান হতে পারে এখনই, কিংবা একটু পর। তবু মানুষ আশাবাদী। কবিও আশাবাদী। তার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কবিতায়:

“যদি বেঁচে থাকি এই শীতে/আগুন জ্বালাবো সঙ্গীতে/ সে- আগুন শুষে নেবে শীত/ গ্লানিময় পুরনো অতীত।(যদি বাঁচি)।”

এই যে সংশয়, তারপর আশা, কেনইবা সংশয়, কেনইবা আশা! জীবন নিয়ে কেন এমন প্রশ্নের উদ্রেক! কারণ তিনি বয়সে,বিজ্ঞতায়,ভ্রমণে,পঠনে অভিজ্ঞতায় নিজেকে আবিস্কার করেন প্রাজ্ঞজনদের কাতারে। তখন বলেন ” শোনো হে মানুষ,অভিজ্ঞতায় গেছি আমরা  আজ পেকে।/ দেখেছি অনেক পথের ভিখিরি…. /মাঝে মাঝে দেখি একা এক নারী দামি গাড়ি হেঁকে আসে,/ দুই চোখে তার টলোমলো দুই পদ্মা- যমুনা ভাসে।/ এতো কিছু দেখে শিখেছি অনেক ঋদ্ধ হয়েছে বোধ/ ( বটগাছ)। এই ঋদ্ধ বোধই তাকে পরিনত করেছে জীবনবোধের দ্রষ্টায়।

কবি কাজী জহিরুল ইসলাম প্রকৃতির সন্তান। কিংবা বলা যায় প্রকৃতির শিল্পী। প্রকৃতি যাপনে ঋতু পরিক্রমায় হেমন্ত তার কবিতার প্রিয় শব্দঋতু। তিনি লিখেন, ” দেখো যদি হেমন্তে আমি/ হইনি তখনো দূরগামী/(যদি বাঁচি)।” দূরগামী হননি এবং আছেন হেমন্ত নৈকট্যেই।তাই সরলভাবেই বলে যান, ” হৈমন্তী সকালে আজ/ নীরব পুরো পাড়া।( হেমন্তের ভোর)। ভোরও তার প্রিয় মুহুর্ত। হেমন্ত ভোরের পরেই তিনি অবগত হন ” মেঘলা ভোরে”  ” মেঘ এঁকেছে ভেলভেটের পর্দা কিছু ভারী/…

মেঘলা ভোরে ছায়ার খেলা,অগ্নি ঝিলমিলও।( মেঘলা ভোর)। ভেলভেটের পর্দা ছিঁড়ে কবি মন ভেসে যান হাওয়ায় হাওয়ায়। হারিয়ে যাওয়ার আগে হেমন্তকে নেমন্তন বা বিনয় নির্দেশ করে যান ” হিলসাইডে দাঁড়িয়ে থেকো হৈমন্তী হাওয়া।/… আসছি আমি/ পথের পাশে দাঁড়িয়ে থেকো হৈমন্তীর হাওয়া।( হৈমন্তীর হাওয়া)। ভোর, হাওয়া,হেমন্তের পৌনঃপুনিকতাকে আমরা মুদ্রাদোষ হিসেবে বিবেচনা করছি না। আমরা বরং ভাবছি এটি স্বদেশ ছেড়ে বিদেশ যাপন করা এক প্রাজ্ঞ কবির স্মৃতিকাতরতা। দীর্ঘ প্রবাস যাপন করা কবির স্বদেশের স্নিগ্ধ হাওয়া,শান্ত ঋতুর প্রেমাচ্ছন্নতা। নিজের দেশ,আবহাওয়া, ঋতু পরিক্রমার প্রতি মুগ্ধতা। মুগ্ধতা থেকেই তিনি উচ্চারণ করেন :

“কানে কানে বলে কেউ ঝড়কে পেও না ভয়,/ জ্ঞানের উঠোনে রাখো উদ্যমী দুপা/

দুপুরের বৃষ্টিতে কাদা হও ভিজে।/ ( কত কী যে শিখি)”।

দুপা লেখতে অনেকে উর্ধ্ব কমা ব্যবহার করেন। তিনি করেননি।

কবি কাজী জহিরুল ইসলাম ভোর,বিহঙ্গ, পাখি,প্রকৃতি থেকে আহরণ করেন কবিতার পঙক্তি। তার কবিতা চরণ যেন প্রকৃতি প্রেমিকের স্বগতোক্তি। তিনি লিখেন, ” ঘুম থেকে উঠে গিয়েছি বাগানে/ পেড়ে আনি কিছু পঙক্তি / আবীর মাখানো যদিও রয়েছে/ রুদ্রে ছিল না কমতি/( ভোরের বাগান)”।

দেহ,দেহতরী তার কবিতার নাম। ভাববাদ বা দেহতত্ত্বের কবিতাও বলা যায়। একজন কবি যেমন অবলোকন করেন তার কালকে। কালের ভিতরই ধ্যানস্থ হন  ভাবনায়। কবিতো দার্শনিকও বটে।তিনি আধুনিক বিজ্ঞান মনষ্ক দার্শনিক।তার ভাষ্যে ”  কস্মোপলিটন ইটের নগরীতে একাকী বসে আমি/ দূরের দাঁড় টানি।( বৃষ্টি সন্ধায়)।

কাজী জহিরুল ইসলাম বৈশ্বিক নাগরিক। কর্মসূত্রে ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর অনেক দেশ। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন সেসব দেশে। প্রবাস জীবনে চলতি পথে চলেছেন চোখ কান খোলা রেখে। যাপিত জীবনের চিত্র এঁকেছেন শব্দে শব্দে।

এই বইয়ে গ্রন্থিত কবিতা “ভূ- মধ্যসসগরের মেয়ে” “দূর পরভূমে”, “হেঁটে যাও নিরাপদে “, “ম্যানহাটন ১ও২” দেবী আফ্রিকা সহ বেশকিছু কবিতায় আছে ভিন্ন ভিন্ন দেশে বসবাসের অভিজ্ঞতার ছাপ। ব্যস্ততা তাকে গ্রাস করতে পারেনি। সময়কে কাজে লাগিয়ে চলেছেন প্রতি মুহুর্তে। এফ ট্রেন( জ্যামাইকা টু ম্যানহাটন যাত্রাপথে গেঁথেছেন শব্দমালা। হলিসউড, নিউ ইয়র্কে বসে লিখেছেন ” পাতাল রেলগাড়ি” র গান। সে গানের চিত্রকল্পে দেখতে পাওয়া যায়,” স্ট্রিটগুলো জলে ভাসা কুমিরের দাঁত/ এভিনিউগুলো এক ভয়াল করাত/(ম্যানহাটন)”। বিশ্বের এইসব শহরে যারা বসবাস করে তারা ” কেউ শাদা কেউ কালো শ্যামলাও আছে/… (তাদের) কারো নাক বোঁচা কারো খুব খাড়া/… ( কেউ) সংসারী,কর্মঠ,কেউ গৃহহারা।…(তারা) “নানা জাত ধর্ম ও কৃষ্টির বাস/শান্তি ও বিভেদের কত ইতিহাস,তা জানা যায় জহিরুল ইসলামের কবিতা নদে ডুব দিলে।

কাজী জহিরুল ইসলাম সহজ শব্দে সরল বাক্যে চিত্রকল্পময় পঙক্তি নির্মাণে পারঙ্গম।

” টাইয়ের নটে বেঁধেছি যে শনিবার” কোন দুর্বোধ্যতা ছাড়াই উপমা,চিত্রকল্পের এক চমৎকার নমুনা।” মেয়েটির মুখ কচি ম্যাপলের পাতা,/ তিরতির কাঁপে/ ” এমন বহুত বহুত পঙক্তি হাজির করা যায় কবিতা থেকে। 

কাজী জহিরুল ইসলাম কবিতা নির্মাণের আগে নব সাজে তৈরী করেন শব্দ।এই শব্দ প্রচলিত শব্দই। তিনি তাতে যোগ করেন মুন্সিয়ানা। অগ্নি আর ফুল খুবই সহজ সরল ও পরিচিত শব্দ।শব্দদ্বয়কে সংযুক্ত করেন কবি।তৈরী হয় অগ্নিফুল।  

ব্যবহৃত কাপড় সূঁইয়ের ফোঁড়নে হয়ে উঠে নকশি কাঁথা। মননশীলতার এফোঁড় ওফোঁড়ে নকশীকাঁথার নকশার মতো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় আলোেপুস্প,শব্দবীজের মতো যুগল শব্দ।পুরাতন হয়েও তখন পাঠকের বোধে ধরা দেয় নতুন স্বাদ,অর্থ ও দ্যোতনা নিয়ে।

জলধি নামক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছে কাজী জহিরুল ইসলাম’র কবিতার বই ” ভোরের হাওয়া”। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের একশত কবিতার বই ভোরের হাওয়া।তার আগে প্রকাশ হয়েছিল স্বরবৃত্ত ছন্দের শত কবিতার বই।বইয়ের মূল্য ৪০০ টাকা। পৃষ্ঠা ১৫০। কাগজ,ছাপা,প্রচ্ছদ,সবমিলিয়ে চমৎকার একটি বই।হাতে হাতে রাখার মতো বই।বই হাতে রাখে যারা তারাতো পড়েই। পড়ুন ভালো লাগবে।প্রতিটা কবিতার ভাষা সরল,বক্তব্য সাবলীল,চিন্তা বোধগম্য। বইটির বহুল প্রচার হোক তা অবশ্যই কামনা করি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ