spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধমজিদ মাহমুদের কবিতা : সৃষ্টিচারণায় সর্বব্যাপী প্রেমের আবেগ

লিখেছেন : তৈমুর খান

মজিদ মাহমুদের কবিতা : সৃষ্টিচারণায় সর্বব্যাপী প্রেমের আবেগ

তৈমুর খান 

মজিদ মাহমুদ(১৯৬৬) ‘কবিতা শতক'(২০২২) সংকলনটিতে তাঁর প্রখর প্রতিভার বৃত্ত পূর্ণ করেছেন। আশির দশকের এই শক্তিশালী কবি তাঁর মানবীয় আবেগকে ঐশ্বরিক, পার্থিব, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক আবেগে পরিপূর্ণ করে তুলেছেন। সৃষ্টি রহস্যের ভেতর দিয়ে নিজেও চালিত হয়েছেন। আবার স্রষ্টার মধ্যেও নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন। প্রজ্ঞাকে তিনি আবেগে চালিত করেছেন। কিংবদন্তিময় রহস্যকে তিনি আত্মজীবনের সম্মোহনের অনুজ্ঞায় পরিণত করেছেন। সারাবিশ্বে যত সম্প্রদায় আছে, যত ধর্মমত,বিশ্বাস,আধ্যাত্মিক বোধের জন্ম হয়েছে— সবকিছুর মধ্যেই তিনি অবস্থান করেছেন। নাস্তিক্য থেকে আস্তিক্যবাদেও তিনি চলাচল করেছেন। বিজয় ও বিজিতের মধ্যেও তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। আদিম মানুষের মধ্যে,আবার সভ্যতার চূড়ান্ত আলোক প্রাপ্ত মানুষের মধ্যেও নিজের বোধকে চালিত করেছেন। দেবদূত-তপস্বীদের, কবি ও মহাকবিদের, সভ্য ও অসভ্যদের, যুদ্ধবাজ খুনি থেকে নিরীহ ত্যাগীদের ভাবনাতেও নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। সভ্যতার যত কাহিনি,যত স্বপ্ন,যত ক্রম ও ব্যতিক্রম, যত আলো ও অন্ধকার, যত বলা ও না-বলা,যত মৃত্যু ও বাঁচা, যত বিচার ও অবিচার,যত সৃষ্টি ও ধ্বংস,যত কাব্য ও মহাকাব্য,যত প্রেম ও বিচ্ছেদ,যত সুখ ও অসুখ,যত প্রাণী ও বস্তু,প্রকৃতি ও শূন্যতা,লেখা ও না-লেখা সবকিছু থেকেই কবির এই কাব্য জন্মের পটভূমি। সংস্কৃতির এই সর্বব্যাপী সংযোগ থেকেই নিজ উত্থানের কাহিনি শুনিয়েছেন কবি। নিজ জন্মের পূর্ব মুহূর্তটি উপলব্ধি করে ভূমিকায় লিখেছেন: “এই কবিতাগুলো লেখা হচ্ছিল মাতৃগর্ভ থেকে,পিতার ঔরস থেকে,যখন একজন পুরুষ ও নারী ভাগাভাগি করে আমাকে বহন করছিল। এই কবিতাগুলো লেখা হচ্ছিল পিতার পিতাদের জন্মের আগে,মাইটোসিস মেয়োসিস বিভাজনের আগে,মুরগি ও ডিম আলাদা হওয়ার আগে,ভাষা নির্মাণের আগে,এমনকি সমুদ্রের শ্যাওলা ও পানি নির্মাণের আগে। এই কবিতাগুলো লেখা হচ্ছিল—যখন সমগ্র সৌরজগৎ সূর্যের চুল্লিতে হচ্ছিল,যখন সকল ছায়াপথ ও গ্যালাক্সিমণ্ডলী, ব্ল্যাকহোল ও নক্ষত্রনিচয় ঈশ্বরকণার সঙ্গে যুক্ত ছিল।” 

 মানুষের মধ্যে যে বোধের জন্ম হয়েছে তা কবির জন্মেরও বহু আগে। স্রষ্টা যখন ভূমণ্ডল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন তখন থেকেই। এই বোধই জন্ম পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে আসছে। এর অন্যথা নেই। ব্যতিক্রম নেই। এই বোধকেই কবি লিখেছেন।সুতরাং কাব্যের ভূমিকায় সেই সর্বব্যাপী প্রজ্ঞারই ভাষ্যরূপ কবিতা হয়ে ফিরে এসেছে।সব বোধেরই একটা মানবীয় অবস্থান আছে। একটা প্রকৃতি আছে। সীমানাও আছে। কবি সেসবকেই অনুধাবন করেছেন। যা ছিল, যা আছে, তা-ই থেকে যাবে। এই কৌতূহলী দর্শন ও দ্বন্দ্ব নিয়েই আদিম চেতনাকে লালন করা মানুষেরই কাজ। আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান এই কারণেই বলেছেন:

“Note, to-day, an instructive, curious spectacle and conflict. Science, (twin, in its fields, of Democracy in its)—Science, testing absolutely all thoughts, all works, has already burst well upon the world—a sun, mounting, most illuminating, most glorious—surely never again to set. But against it, deeply entrench’d, holding possession, yet remains, (not only through the churches and schools, but by imaginative literature, and unregenerate poetry,) the fossil theology of the mythic-materialistic, superstitious, untaught and credulous, fable-loving, primitive ages of humanity.”

(Walt Whitman, Complete Prose Works)

অর্থাৎ দ্রষ্টব্য, আজকের দিনে, একটি শিক্ষণীয়, কৌতূহলী দর্শন এবং দ্বন্দ্ব। বিজ্ঞান, (যমজ, তার ক্ষেত্রগুলিতে, তার মধ্যে গণতন্ত্রের)—বিজ্ঞান, একেবারে সমস্ত চিন্তাভাবনা, সমস্ত কাজ পরীক্ষা করে, ইতিমধ্যেই পৃথিবীতে ভালোভাবে বিস্ফোরিত হয়েছে —একটি সূর্য, আরোহণকারী, সবচেয়ে আলোকিত, সবচেয়ে মহিমান্বিত— নিশ্চিতভাবে আর কখনও অস্তমিত হবে না। কিন্তু এর বিপরীতে, গভীরভাবে প্রবেশ করা, দখল করা, এখনও রয়ে গেছে, (শুধু গীর্জা এবং বিদ্যালয়ের মাধ্যমে নয়, কল্পনাপ্রসূত সাহিত্য এবং অপুনরুৎপাদিত কবিতার মাধ্যমে) পৌরাণিক-বস্তুবাদী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত এবং বিশ্বাসযোগ্য, কল্পকাহিনির জীবাশ্ম, ধর্মতত্ত্ব-প্রেমময়, মানবতার আদিম যুগ।

কবির এই আদিম চেতনার সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে সৃষ্টিচারণায় সর্বব্যাপী প্রেমের আবেগ। স্রষ্টা যখন মাটি দিয়ে আদমকে সৃষ্টি করলেন, অসংখ্য ফেরেশতারা তখন তাঁকে সেজদা করলেন।আদমের শরীরে প্রাণ সঞ্চার হল।শিরায় শিরায় প্রবাহিত হল রক্ত। এক একটি হরমোনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। প্রথমেই যার প্রয়োজন হল সে হল এক নারী।তখন আদমের সব তৃষ্ণা মেটাবার জন্য সৃষ্টি হলেন হবা। আদম তাঁকে দেখামাত্র প্রলুব্ধ হলেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই শুরু হল এবাদতের প্রথম ধাপ। ‘কুরশিনামা’ কবিতায় সে কথাই লিখলেন কবি:

“ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়

আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে

সেই নারী এসে আমার হৃদয়-মন তোলপাড় করে য়ায়

তখন আমার রুকু

আমার সেজদা

জায়নামাজ চেনে না

সাষ্টাঙ্গে আভূমি লুণ্ঠিত হই

এ মাটিতে উদ্‌গম আমার শরীর

এভাবে প্রতিটি শরীর বিরহজনিত প্রার্থনায়

তার স্রষ্টার কাছে অবনত হয়

তার নারীর কাছে অবনত হয়”

কবির কাছে ‘হবা’ পরিণত হলেন ‘মাহফুজা’য়। এই আদি আবেগ,আদমের আবেগ কবি ও বহন করে চলেছেন। তাবৎ সৃষ্টিকুলই বহন করে চলেছে। রাধার কাহিনির মধ্যেও সেই আবেগ দেখেছেন। নারী পৃথিবীর কেউ নয়, সে তো ঐশ্বরিক সম্পদ হয়েই রয়েছে। মধ্যবিত্ত ক্লেদাক্ত জীবনে আজও সে অধরা। কবির প্রভু তাই নারীময়।তসবির দানা ছুঁয়ে নারীর অঙ্গকেই স্পর্শ করা যায়।তারই ধ্যান প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টারই ধ্যান। কবি মাহফুজা নামেই তাকে জানেন। ‘এবাদত’ কবিতায় উল্লেখ করলেন:

“মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা

আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়

তুমি ছাড়া আর কোনো প্রার্থনায়

আমার শরীর এমন একাগ্রতায় হয় না নত

তোমার আগুনে আমি নিঃশেষ হই

যাতে তুমি হও সুখী”

মনে রাখা দরকার,আদম এই নারী সম্পর্ককেই বিস্তৃত করেছেন পৃথিবীময়। কবিও তা উপলব্ধি করে লিখেছেন: “তোমার সান্নিধ্যে এলে জেগে ওঠে প্রবল ঈশ্বর”। সব গুনাহের ‘আজাব’ও কমে যায়। ‘তাসদিদজজম’ কোথায় পড়েছে তাও কবি জানেন। কবির তেলাওয়াত, কোরবানি সবই তাঁর কাছে উৎসর্গিত হয়। সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে নারী-শরীরের সামর্থ্য ও শক্তিতে কবিও বিস্মিত হন। তাই মাহফুজাকে দেবী হিসেবেই দেখেন। ভাস্করের মূর্তি গড়া হলে পূজারীর অর্ঘ্য নিবেদন করেন। সৃষ্টির প্রথম ‘মাহফুজা’ সব নারীই হয়ে ওঠে। ভূমিকম্প, বন্যা, একাত্তরের মৃত্যুময় দিনগুলিতে এই মাহফুজাকে এক মুহূর্তও ভোলা যায়নি। মাহফুজাই আরশের নিচে,কুরশির নিচে বিরাজ করছে। সেখানেই কবিও ঠাঁই পেতে চান। কখনো জন্মভূমিও মাহফুজা, কখনো বিশ্বাসও মাহাফুজা,কখনো আবার হৃদয়ের শক্তিও। নদী সমুদ্র পর্বত জলপ্রপাত জুড়ে তার অবস্থান। প্রকৃতি, মাতৃত্ব, প্রেয়সী সব রূপেই তাকে দেখেছেন। কালে কালে, যুগে যুগে, মানুষে মানুষে তার অবস্থান। লোকপুরাণ, ইতিহাস, লোককাহিনিতেও তার বিস্তার ঘটেছে। মাহফুজার মধ্যদিয়েই বৈশ্বিক চেতনার উত্থানকে চিরন্তন রূপ দিয়েছেন। 

    এই কবিজন্ম ধারণ করে কবি অতীতের বহু জন্মান্তরকে স্মরণ করেছেন। তার মধ্যে দিয়েও আদিম যোগসূত্রের বন্ধনটিও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। কবি তাঁর জন্মের একটি হিসেব দিয়েছেন এরকম:

তেত্রিশ বছর কবির মানবজন্মের প্রাক্কাল,

তেত্রিশ হাজার বছর আগে পশুজন্মের প্রাক্কাল,

তেত্রিশ লক্ষ বছর আগে বৃক্ষজন্মের প্রাক্কাল,

তেত্রিশ কোটি বছর আগে জলজন্মের প্রাক্কাল,

তেত্রিশ সহস্র কোটি বছর আলোকবর্ষ পথ পরিক্রমার শেষে নতুন জন্মের কষ্ট অনুভব করেছেন।

‘তেত্রিশ সহস্রাব্দ কোটিতম জন্মদিন’ কবিতায় এই আদিম চেতনারই চক্র ফিরে এসেছে। কবি লিখেছেন:

“চেতনার মহান স্তম্ভ ভেদ করে মানবজন্মের এইসব

ইতর কাহিনির বিস্ময় থেকে আমাকে নির্বাপিত করো

জন্ম মানে তো গর্ভমূল থেকে উম্মূল হওয়া

জন্ম মানে তো পৃথিবীর মাটির উদর থেকে উগলে দেওয়া

তাই অবশেষে তেত্রিশ সহস্রাব্দ শেষের জন্মবর্ষে

কোনো এক মাকে গহ্বরে রেখে

কোনো এক নববধূর জরায়ুতে দ্রুত ঢুকে পড়ছি আমি

আর বারংবার বুদ্ধকে শরণ জেনে বলেছি:

প্রভু কিভাবে হবে আমার এই মায়া-মোহ আর লোভের সংবরণ…”

এই জন্মের কোনো শেষ নেই।পৃথিবী সৃষ্টির কাল থেকেই এই জন্ম প্রবাহমান।তাই কবির অনুধাবন ‘আমার জন্মদিন হয়ে গেছে জন্মের আগে’।সময়ের বিচারে এই জন্মের কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই।কবি বারবার অনুভব করেছেন ‘শরীরে লেগেছিল বহু জন্মের আদর।’এভাবেই প্রত্নপথের সন্ধান করে চলেছেন।প্রকৃতিই ঈশ্বরী হয়ে কবির জন্ম দিয়েছে।জন্মের রূপান্তর ঘটেছে।অযুত সহস্র বছর ধরে শ্যাওলার বীজ হয়ে থাকা আর পানির যোনির ভেতর ভেসে এসে পাথরের গায়ে জেগে ওঠাও এই প্রক্রিয়ার ভেতরেই পড়ে।আবার জন্মান্তর রক্তমাংসের জন্মেও ফিরিয়ে আনে।আসহাবে কায়াফের ধাতব মুদ্রা পকেটে যিশু জন্মের কয়েক সহস্রাব্দ আগের সূর্যোদয়কেও স্মরণ করেন ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৯-এ। পিকাসোর মতো হয়ে ওঠেন একসময় ছবি আঁকতে আঁকতেও। সমুদ্র জন্মের ভেতরও জীবনের বিস্তারকে অনুসরণ করেন। ‘সমুদ্র দেখার পর’ কবিতায় লেখেন:

“আমি আবারও যাব তোমার জলের যোনিতে মিশে

লক্ষ কোটি বছর ধরে এই জলাবর্ত শেষে

আমাকে মানব মাতৃগর্ভে দিও

মানুষের মার জন্য আমার মায়া পড়ে আছে খুব।”

সব জন্মের ভেতর দিয়ে জীবনের এই চক্র প্রবাহিত হলেও মানব জন্মেরই শ্রেষ্ঠত্ব বারবার উপলব্ধি করেছেন। মানব শরীরের সৌন্দর্যের মধ্যেই ঈশ্বরের অবস্থান উপলব্ধি করেছেন।কতকগুলি নিয়ম আর আইন শেখা-ই জীবন নয়।জীবনেরে নিজস্ব নিয়ম আছে। গাছ-জীবনের মধ্যেও প্রাণস্পন্দনের মাত্রা অনুভব করা যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি টানও সেই আদিম ঈশ্বর প্রদত্ত ‘নেয়ামত’। স্বর্গভ্রষ্ট হওয়ার গল্পও এখানে লুকিয়ে আছে। মদ-মাংস-আপেলের কাহিনি এই কারণেই ফিরে আসে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ‘স্ফীত জরায়ু’ হয়ে ফুঁসে ওঠে। ‘বায়ুনামা’ কবিতায় অগণিত প্রাণ প্রবাহের উত্থান ফিরে এসেছে। বায়ু প্রাণের ‘সমীরণ’ হয়ে উঠেছে। সংগীত ও সুরে অপরিমেয় উচ্ছ্বাসে নির্মাণ করেছে সংসার। তাই কবি বলেছেন ‘জীবন তো সময়েরই নাম।’

মানুষ কখনোই আদিমতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। তার সৃষ্টির উৎসকে নানা রূপে বহন করে নিয়ে চলে। এই মৌলিক চেতনা থেকেই উৎসারিত হয়েছে সৃষ্টির বহুমুখী পরিচয়। সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি যতই অগ্রসর হোক চিরন্তন আদিমতার কাছেই সবাই দায়বদ্ধ থাকি। এই বোধ স্বীকার করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিককালের এক শিল্পী ও লেখিকা জেনিফার ওট বলেছেন:

“Man has been slipping backward for ages. The more advanced we became the more primitive we grew.”

(Jennifer Ott, Serendipidus) 

অর্থাৎ মানুষ যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে। আমরা যত বেশি অগ্রসর হলাম ততই আদিম হয়ে উঠলাম।

কবি মজিদ মাহমুদও এই আদিমতার জগতে আত্মসন্ধান করেছেন, নিজের স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।সেখানে মানুষ-প্রাণী-উদ্ভিদে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। সৃষ্টি ও বিলয়ের মধ্যে থেকে নব উত্থানে গড্ডলিকা প্রবাহই সর্বদা বহমান। স্বর্গ থেকে প্রথম যে ভেড়ার পাল পৃথিবীতে এসেছিল, সেই ভেড়ার পালের মধ্যেও আত্মস্বরূপ প্রকট হয়েছে। কবিতার নামও দিয়েছেন ‘গড্ডলিকা’। সেখানেই উল্লেখ করেছেন:

“নামহীন ভেড়িদের দুগ্ধ পান রতিক্রিয়া শেষে

ফিরে যাই তাদের জগতে

জানতে ইচ্ছে করে আমি তবে কে

কে তবে এনেছে আমাকে

এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জানি নেই প্রয়োজন

নেই দর্শন তত্ত্বের জটিলতা

শুধু জানি,এইসব ভেড়ার পাল,ভেড়িদের সাথে

রয়েছে গাঁথা আমার জন্মের মানে।”

এই ‘জন্মের মানে’ বৃহত্তর ব্যাপক অর্থে সমূহ সৃষ্টির মধ্যেই প্রতীয়মান হয়ে আছে। কবি শুধু ব্যক্তি নন,সময়ের খণ্ডিত সীমানায় শুধু মজিদ মাহমুদ নন,আবহমান সৃষ্টির মধ্যেই তাঁর বহুমুখ,বহুরূপ,বহু পরিচয় এই অনন্তে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে।

    মজিদ মাহমুদ পরিবার-পরিজন, জন্মভূমি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা, ইতিহাস এবং কাব্য-কবিতা রচনাকেও তাঁর জীবন ও ভাবনার অপরিহার্য অভিজ্ঞান করে তুলেছেন। আর সবকিছুর মূলেই আবিষ্কার করেছেন এক অফুরন্ত প্রেমের উৎসকে। এই প্রেমের কাছেই কবি দায়বদ্ধ এবং তা জীবনের একমাত্র পথ ও আশ্রয় তা উল্লেখ করতে ভোলেননি। সেই প্রেমই ভালোবাসার ঈশ্বর হয়ে সৃষ্টির সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। ‘ভালোবাসা তোমার প্রভু’ কবিতায় লিখেছেন:

“ভালোবাসা এক সাহসী প্রভু

চলো ভালোবাসার কাছে যাই

ভালোবাসাকে সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করি

অব্যর্থ ডানায় ভর করে ভালোবাসা

মধ্যাহ্নের ছায়াপথে চলতে থাকে

ভালোবাসা যদিও অব্যক্ত অভিপ্রায়, তবু

ভালোবাসাই ঈশ্বর

ভালোবাসা তার নিজের এবং

গ্যালাক্সিমণ্ডলের বহির্গমনের পথ সম্বন্ধে জ্ঞাত”

ভালোবাসার কোনো ব্যাখ্যা নেই,সীমানা নেই,পরিবর্তন নেই,প্রথম সৃষ্টি থেকে তা একই নিয়মে চলে আসছে। ভালোবাসার পুরস্কার ভালোবাসাতেই প্রতিদান দেয়। ত্যাগে, অভিমানে, অহংকারে, লজ্জায় ভালোবাসারই উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সৌন্দর্যে, ঐশ্বরিক বোধে, বাঁচার তাগিদে এই ভালোবাসারই চিরন্তন রূপ কবি দেখেছেন। সমগ্র কাব্যেই এই ভালোবাসার নানারূপ ধরা পড়েছে। ভাবনার মূল বিভাবে ভালবাসাকেই রেখেছেন। তাই বলেছেন:

“যদিও ভালোবাসাকে তুমি তোমার নিজের মতো

করেই ভালোবাসো,তবু ভালোবাসাই তোমার নিয়ন্তা

ভালোবাসাই তোমার প্রভু

সকল অনুজ্জ্বলতার মাঝে ভালোবাসা

সকল জীবন্ত বস্তুর সৌন্দর্য চুরি করে

ভালোবাসার দেবতা হয়ে ওঠে

ঈশ্বর এবং ভালোবাসা উভয়কেই তুমি এক নামে ডাকতে পারো।”

এই ভালবাসার মধ্যেই জগৎ-সংসারের বাঁধন অটুট হয়ে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্বেতশ্মশ্রু কান্তিমান বৃদ্ধ পিতাকেও আলোময় পুরুষ হিসেবে দেখতে পান এই ভালোবাসার কারণেই। দেশকে ভালোবেসে তিনি তাঁর ঈশ্বরকে ভালোবাসার পরিচয় দেন। একদিকে পিতৃত্বের অসম্ভব টান,অন্যদিকে অসম্ভব ত্যাগী হতে পারার মধ্যেও অপত্য ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দেন। মহাপ্রলয়কালে সকলকে উদ্ধার করার জন্য নূহু নবী যে নৌকা তৈরি করেছিলেন তাতে একমাত্র পুত্র ‘কেনান’ নৌকায় উঠেনি।তার ফলে পর্বত চূড়াও তাকে বাঁচাতে পারেনি।নূহু নবীর নবুয়াত প্রাপ্তিই সেদিন বড় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পিতৃত্ব থেকে কি নবুয়াত বড় হতে পারে? কবি যদি নূহুর মতো হতেন তাহলে কী করতেন? নিজেই উত্তর দিয়েছেন ‘পুত্র ডুবে যাচ্ছে’ কবিতায়:

“পুত্র ডুবে যাবে আর পিতা থাকবে প্রমোদতরীতে!

সেই ভিতুদের নবী আজ গতায়ু প্রভু

আমিও জলে যাব আমার পুত্রের সাথে

আমিও থৈ থৈ আগুন পানির মধ্যে হাবুডুবু খাব

জীবন মৃত্যুর স্বাদ মেখে নেব শরীরে”

পুত্রের সঙ্গে পিতাও জলে ডুবে মরে যেতেন,তবু ভালো, তবুও নবুয়াতকে কখনো বড় হতে দিতেন না। যে প্রভুর নৌকা,যে প্রভুর এই সংসার,সামলাবার ভার তাঁর উপরেই থাকত। তাই কবিতার শেষ লাইনটি কবিকে লিখতে হয়েছিল:

“তোমার কিশতি প্রভু তুমিই সামলাও…”

পিতৃত্বের পরিচয় যেমন দিয়েছেন, তেমনি পুত্রের মাতৃভক্তির পরিচয়ও দিয়েছেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দামোদর নদ সাঁতরে পার হওয়ার মধ্যে। মৃত্যুর মুখে নিজেকে ঠেলে দিতে পিছ-পা হননি বিদ্যাসাগর। মায়ের ডাকে শুধু নদী পার হওয়া নয়, সব অসাধ্য সাধনেও যোগ্যতার সঙ্গে তার উত্তরণ ঘটানোতেও। ‘বিদ্যাসাগরের মা’ কবিতায় তা উল্লেখ করলেন:

“আমার রক্তের মধ্যে দামোদর

আমার রক্তের মধ্যে মহিষ

মাগো তুই মহিষাসুর বধের মন্ত্র শেখা

আমি তোর কাছে যাব

আমার অর্ধেকটা শরীর জলের কাছে রেখে

বাকি অর্ধেক তোকে দেবো; তোর

পুঁইয়ের মাচা লাল শাক

আর আমার দামোদর নদী

নদীর মধ্যে মহিষ

মহিষের শিং ধরে ভেসে যাচ্ছে

             আদিম মেয়োসিস।”

এক মা বহু মায়ের প্রতীক হয়ে চিরন্তন অসুরনাশিনী মায়ের রূপ ধারণ করে। শুধুমাত্র মাতৃভক্তির অর্ঘ্য থাকলেই সব অন্তরায় লঙ্ঘন করা সম্ভব এ কথাই কবি বোঝাতে চেয়েছেন। 

  কবিতায় পৌরাণিক প্রসঙ্গগুলির নানা উপকাহিনি স্বাভাবিকভাবেই এসে উপস্থিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের বস্ত্রহরণ, তুর পাহাড়ে মুসা নবীর আল্লাহকে দর্শন করতে গিয়ে পাহাড়ের অগ্নিদগ্ধ কাহিনিও যেমন স্বাভাবিক, তেমনি বরফের ঘরে এস্কিমোদের আগুন জ্বালানোও

স্বাভাবিক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনি গ্রিক কিংবদন্তির নানা জন্ম বৃত্তান্তগুলিও একে একে উন্মোচিত হয়েছে। বোধিদ্রুম বৃক্ষের কথাও ভাবতে গিয়ে এসেছে সুজাতার পায়েস দান প্রসঙ্গ। কিন্তু সেখানেও শুষ্ক বৃক্ষের ডালে কবি আগুন দেখেছেন, যে আগুন ঈশ্বরের। তাই কবিতায় বলেছেন: ‘আগুন মানে ঈশ্বর, জীবনের অক্ষবিন্দু, হা ঈশ্বর!’ পাখি, গাছ, মানুষ এই ত্রিভুজ কষ্টের মধ্যে আনন্দ কোথায়? অর্থাৎ প্রতিটি জন্মেই আছে কষ্টের গভীর পরীক্ষা। আপেলের দু’ভাগ হওয়াও ‘ক্ষতাক্ত’ জীবনের মিলন ও বিরহ গান যা অন্ধকারে কালো বিন্দুর দিকে ধাবিত হয়েছে। সাপ-জীবনেও মস্তিষ্কে কষ্টের বিষকণা নিয়ে বাঁচতে হয়। ইলিশ ধরা ফাঁদ পেতে ‘মৎস্যভুক মানব সন্তান’ মাছ ধরলেও নিজেরাও কখনো শিকারির ফাঁদে মাছ হয়ে ধরা পড়ে। সময়ের শরে তাদেরও ‘ক্ষতাক্ত’ হতে হয়। খরগোশ জীবনের কাহিনিতেও আছে বেঁচে থাকার দৌড়। গাছ-জীবনে কাঠুরিয়ার করাতকল নিবিড় যন্ত্রণার ভেতর ঠেলে দিয়েছে। মা-পাখিদের বাসাহারা হওয়ার চেতনাও কবিকে উদ্বিগ্ন করেছে। গাছের ভাষা, পাখির ভাষা, স্বপ্ন নিজেই ধারণ করেছেন। 

 কবিতা কেমন হবে, কী বিষয়ে কবি কবিতা লিখবেন তাও অকপটে  আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। ‘কবিতা’ নামক একটি কবিতাতেই তিনি বলেছেন:

“কবিতাকে যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যেতে চাই

ঘরের লক্ষ্মীরা ঘরে থাক

যারা বেরিয়ে আসতে পারবে রাস্তায়

মাঠে-ঘাটে মিছিল সংগ্রামে

যারা লিঙ্গহীন বন্ধুর মতো চারপাশে

যারা মিলনে পারঙ্গম শয্যায়

যারা সহমরণে অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠবে

তারাই আমার কবিতা

তাদের জাতপাত ধর্মাধর্ম বর্ণগোত্র

দেশকাল আমার বিবেচ্য নয়।”

কবিতা যে বিউটি পার্লারে গিয়ে সেজেগুজে আসা বিয়ের পাত্রী নয় কবি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।ছন্দ-অলঙ্কারে পরিপাটি করে সাজানো পংক্তিও নয়। কবিতা প্রতিবাদী এক কন্ঠস্বর।খালি পায়ে ফুটপাতে হাঁটা জীবন সংগ্রামে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ানো। কবিতা ছলনাহীন জীবনের উষ্ণতায় প্রগাঢ় হয়ে ওঠা শব্দ।শুধু বাইরের দৃশ্য নয়,ফুল পাখি আকাশ চাঁদ নয়।যৌনতাও নয়। কবিতা অস্তিত্বের অন্বেষণ।কবিতা আত্মার স্বরূপ সন্ধান। জন্মান্তর অতিক্রম করা জীবনধর্মের প্রতিটি পদক্ষেপে তার স্বর সন্ধান। তাই জাত-ধর্ম, বংশ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে সকলকে মেলানোর সাধনা কবিরও।কবি হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে সে কথার উল্লেখ করলেন ‘অণুবিশ্বের কবিতা মালা’য়:

“আমি মন্দিরে গিয়ে রাম নাম করি

মসজিদে গিয়ে রহিম

গির্জায় গিয়ে মা মেরি যিশু

সিনাগগে যেয়ে মোসেজ

তোমার সকল রূপে মুগ্ধ আমি

সব পেতে চাওয়া শিশু।”

এই মানব পরিচয়ই কবির কাছে বড় হয়ে উঠেছে।দ্বৈত-অদ্বৈতবাদেও কবির কোনো আগ্রহ নেই। তাজমহলে প্রেমের বাঁশি শুনে দুঃখ জাগানিয়া সুরে মন ভেজান। ইতিহাস সরিয়ে নিছক হৃদয়ের কাছেই দাঁড়ান। হৃদয় না থাকলে প্রেমও থাকে না। হৃদয় না থাকলে মানুষও থাকে না। হৃদয় না থাকলে কবিতাও লেখা যায় না। এই হৃদয়ের কাছেই সমস্ত কাব্যের ভার কবি নামিয়ে রাখেন। সব অহংকার চূর্ণ করে, সব অভিমান আর চোখের জলকে কবিতার কাছে রেখে দেন শুধু হৃদয়ের কারণেই। মজিদ মাহমুদ সেই হৃদয়েরই কবি, যে হৃদয় চিরদিন ধরেই মানব সভ্যতাকে প্রেমের বাঁধনে বেঁধে রেখেছে। যে হৃদয় শুধু ভালোবাসার কাছেই দায়বদ্ধ।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ