তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ নব্বই দশকের কবি। নব্বই দশক তার উত্থানকাল, এ দশকেই ছড়িয়ে পড়েছিল তার সুখ্যাতি। এযাবৎ অব্যাহত আছে তার সে ধারা। দু’হাতে লিখছেন নিয়মিত। দেশের জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতা, বিভিন্ন সাহিত্য ম্যাগাজিন ও বই প্রকাশের ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত ছড়িয়ে যাচ্ছেন নামের সুনাম। কবিতা প্রেমিকদের কাছে নয়ন আহমেদ এখন পরিচিত নাম। তার কবিখ্যাতির গুণমুগ্ধ প্রচারপত্র হয়ে পাঠকের দহলিজে এসেছে “মুক্তবুলি : উত্তরাধুনিক সাধক কবি নয়ন আহমেদ সংখ্যা”।
মুক্তবুলি : একটি ম্যাগাজিন। বরিশাল থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত। প্রায় অর্ধযুগ যাবৎ শিল্প সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ের সমন্বয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তারা তাদের প্রকাশনা ও প্রচারণা। ষষ্ঠ বর্ষের ২৮ তম সংখ্যার জুলাই আগস্ট ২০২৩-এ তারা নয়ন আহমেদকে নিবেদন করে বাজারে ছাড়ে তাদের সংখ্যাটি।
একজন কবিকে সহজে জানার জন্য এটি একটি সমম্বিত আয়োজন। তাদের এই আয়োজনে অংশ নিয়েছেন কবির সতীর্থ কবি-সাহিত্যিকগণ। আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় লেখকদের একটি অংশ। তারা আলোচনা করেছেন নয়ন আহমেদ ব্যক্তি, ব্যক্তিত্ব, কবি ও কবিতা নিয়ে। এক মলাটে কবি নয়ন আহমেদকে জানার সুবর্ণ সুযোগ। নয়ন আহমেদের সাড়ে তিন দশকের কাব্য বিচরণের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের সারসংক্ষেপ পত্রস্থ হয়েছে এই সংখ্যায়। আছে নয়ন আহমেদের নির্বাচিত কবিতা :
ভূকম্পন
……
এই নাতিশীতোষ্ণ পাঠ্যক্রম; গার্হস্থ ভূগোলে–
একটা নীতিশাস্ত্র– পড়ুয়া পৃথিবীর শয্যাগৃহে
তুমি পরিবেশন করছো আবহাওয়া — সংবাদ।
সবুজ ওড়নার মতো বৃষ্টি হবে।
এই বার্তা শুনে হেসে উঠলো আসবাব ;
কলরব করে উঠলো পৃথিবী।
কয়েকটা নাশপাতি কেটে প্লেটে সাজাতে সাজাতে বললে–দ্যাখো, প্রেম ও শুভকামনার বর্ণমালা।
তোমার নাকটা একটু ছুঁয়ে দিতেই নড়ে উঠলো পৃথিবী। রিখটার স্কেলে তার কাঁটা ঘুরে দাঁড়ালো ৩.৫।
একটা মৃদু ভূকম্পন হলো।
একজন শাদা হাঁস
…….
– কে যাচ্ছে? কে বহন করছে আর্তনাদ?
:আমি তোমাদের দুঃসহ আকাঙ্ক্ষা।
যাই অন্ধের মতো একটু একটু করে।
আর দীর্ঘ করি ব্যক্তিগত ঢেউ,উজ্জ্বল করি।
পৃথিবীকে প্রতিবেশী করি।
— আর মানুষ?
: মূলত একজন শাদা হাঁস।
বিষাদ না পেরোলে আমি তাকে চক্ষুষ্মান করবো না।
– তোমাকে দেখতে দাও। আমি অধীর হয়ে আছি।
: একবার রোদকে চুম্বম করতে শেখো। পাবে।
নিজেকে একবার টান দিয়ে বাইরে আনো।
তারপর পালক ছড়িয়ে কেবল সাঁতরে যাও।
তোমাকে একটি সহনীয় আয়তকার উচ্ছ্বাস দেবো।
ইমান
……
একটা দীর্ঘদুপুর টানিয়ে দিয়েছি হ্যাঙ্গারে।
ওর ওমে বড় হচ্ছে জংধরা শীর্ণকাশ আবেগ।
দেখতে দেখতে হবে প্রশান্ত মহাসাগর।
সম্পূর্ণতা পাবে।
তোমার ছিলো দশহাজার গোধূলি–
হারিয়েছো কেন?
ছিলো পাঁচটি বঙ্গোপসাগর।
লুকিয়েছো কেমন আড়ালে?
জানি,জীবন একটা সামান্য
মটোরদানার মতো আনন্দে পরিদৃষ্ট হয়ে ওঠে।
এই ভেবে, তোমাকে ছুঁয়েছে দুপুর–
তার পূর্ণ রঙ ; তার দীপ্যমান বোধি।
তোমাকে ফরশা করছে দ্যাখো আমার কবিতা।
আমি যাবো দুপুরের তীব্রতায়–
গভীরে,জীবনে।
যাবে,তুমি যাবে?
এবার ইমান আনো রোদলাগা জীবনের প্রতি।
একটা দীর্ঘ দুপুর টানিয়ে দিয়েছি হ্যাঙ্গারে।
“নয়ন আহমেদ নব্বই দশকের মেধাবী বাউল কবি।” আশির দশকের খ্যাতিমান কবি হাসান আলীম তার সাহিত্য সমালোচনা গ্রন্থ ” কুসুমে বসবাস” এ ২০০৩ সালে নয়ন আহমেদকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধে এভাবেই চিহ্নিত করেন। মুক্তবুলি’তে তিনি নয়ন আহমেদকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধে সে কথা স্বীকার করেই শুরু করেছেন তার প্রবন্ধ। তিনি বলেন, ( নয়ন আহমেদ) প্রধানত একজন উত্তর – আধুনিক তুখোড় মারেফতি কবি।… আমার কাছে তিনি একজন অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রকল্প ও আধ্যাত্মবাদের দরবেশি কবি।”
আল হাফিজ কবি নয়ন আহমেদের সমকালীন কাব্য সহযোদ্ধা। আল হাফিজ নয়ন আহমেদকে নিয়ে লেখেন, ” তিনি তাঁর কবিতায় যাপিত জীবনের বৈচিত্রপূর্ণ ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে মা- মাটি আর মানুষ। “
মুক্তবুলি : নয়ন আহমেদ সংখ্যায় বোদ্ধা লেখকগণ নয়ন আহমেদের কবিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বহুমাত্রিক বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। ফিরোজ মাহমুদের মতে ” আধ্যাত্মিক প্রেমের কবি নয়ন আহমেদ”। ” নয়ন আহমেদ: কুরআনিক মূল্যবোধের কবি ” হিসেবে চিহ্নিত কবি পথিক মোস্তফার প্রবন্ধে। পথিক মোস্তফা বলেন, ” বেশির ভাগ কবি- সাহিত্যিককেইতো আজকাল দেখি, ধর্ম নিয়ে বিশেষ করে ইসলাম নিয়ে গাত্রদাহ হতে কিংবা কুরুচিকর শব্দের ইঙ্গিতময় পোজ দিয়ে কবিতার বা গদ্যের ক্যানভাস সাজাতে,তাই এ কথা বলা। কিন্তু নিজের কাব্যগাঁথুনিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে মোটেও শঙ্কিত নন কবি নয়ন আহমেদ।” কবির কাব্যভাষার সুতীক্ষ্মতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। ” নয়ন আহমেদের কবিতা: নয়া কাব্যভাষার সিম্ফনি” শিরোনামে বিস্তর আলোচনা করেছেন ড. ফজলুল হক তুহিন। কাওছার আহমেদ,আযাদ আলাউদ্দীন, সাজ্জাদ শাহরিয়ার প্রমুখের লেখায় পাঠক জানতে পারবেন কবি নয়ন আহমেদের কবি ও কবিতার বর্ণিল চিত্রময়তার কথা। আযাদ আলাউদ্দীন মূলত করেছেন বুক রিভিউ। কবির “আমার বিবাহিত শব্দরা” নামক কাব্যগ্রন্থের আলোচনা করেছেন এ সংখ্যায়। বুক রিভিউ না করে তিনি কবির কবি ও কবিতা,ব্যক্তি ও কবিতা নিয়ে কথা বললে পাঠক আরও কিছু জানতে পারতো। লেখককে নিয়ে কোন ম্যাগাজিন করার বহুমাত্রিক গুরুত্ব থাকে। অন্যতম হল সমসাময়িক লেখকের দৃষ্টিতে আলোচ্য লেখক সম্বন্ধে সহজে জানা যায়। লেখক পাঠক ও ভক্তদের জন্য এটি আনন্দ সংবাদ। মুক্তবুলি’র এই সংখ্যায় চোখ রাখলে উন্মোচিত হবে কবি নয়ন আহমেদ ও তার কবিতার ভেতর বাহির। মুক্তবুলি, নব্বইয়ের আলোচিত,জনপ্রিয় একজন কবিকে নিয়ে সংখ্যা করে পালন করেছেন গুরুদায়িত্ব। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সংখ্যাটি বোদ্ধা পাঠকদের নজরে থাকবে। সাহিত্যের ইতিহাসে মুক্তবুলি গৌরবময় অংশিদার হয়ে থাকবে।
………
মুক্তবুলি : উত্তরাধুনিক সাধক কবি নয়ন আহমেদ সংখ্যা
জুলাই আগস্ট ২০২৩
প্রকাশক ও সম্পাদক: আযাদ আলাউদ্দীন
মূল্য:৫০ টাকা। বরিশাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত