spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যমোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ ও নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলা

লিখেছেন : আহমাদ মাযহার

মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ ও নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলা

আহমাদ মাযহার 

‘নিউ ইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা’য় প্রতি বছর আমন্ত্রিত হয়ে লেখকদের অনেকেই আসেন। এবারও আসবেন তেমন অনেকে। বইমেলার ফ্লায়ারে কারো কারো নাম উল্লেখ থাকে, কারো কারো থাকে না। বিশ্বজিত সাহার কাছ থেকে জানলাম লিটল ম্যাগাজিন ‘ঊষালোকে’র সম্পাদক ও কবি মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহও আসবেন। বইমেলার পক্ষ থেকে তাঁকে আগেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ভিসা না পাওয়ায় তাঁর আসা হয়নি। আমার মতে বইমেলার ব্যতিক্রমি অতিথিদের একজন তিনি। ‘ঊষালোকে’র নবপর্যায়ে প্রকাশের সময় অধিকাংশ সংখ্যায়ই লেখক হিসেব আমি উপস্থিত থেকেছি। শাকেরউল্লাহ-র আন্তরিক তাগিদে আমি হুমায়ুন কবিরের ‘নদী ও নারী’, এবং ‘বাংলার কাব্য’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলী বাকের উপকথা, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশ বনের কন্যা’, আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, ‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘পদ্মরাগ’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রসঙ্গে লিখেছি। সত্যি বলতে কি তাঁর ‘ঊষালোকে’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে লিখতে এবং পত্রিকার প্রকাশনায় তাঁর সনিষ্ঠতা দেখতে দেখতে আমি নিজেও ‘বইয়ের জগৎ’ সম্পাদনায় উৎসাহী হয়ে উঠেছিলাম!

মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ পত্রিকার একেকেটি সংখ্যা প্রকাশের জন্য পরিকল্পনা পর্যায়ে যে গবেষণা ও অনুসন্ধান এবং যে গভীর নিমগ্নতা ও নিভৃত সাধনার পরিচয় দিয়েছেন তার সঙ্গী হয়ে কখনো কখনো আমি সাক্ষী থেকেছি। লিটল ম্যাগাজিন যেমন সৃষ্টিশীলতার উন্মোচনে ভূমিকা রাখতে পারে তেমনি পারে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্মকে অনুধাবন ও উপলব্ধিতে ভূমিকা রাখতে। মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহর ‘ঊষালোকে’ তেমনি একটি কাজ! তিনি কেবল পত্রিকা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেননি, পত্রিকাগুলোকে বইরূপ দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে সীমিত না করে সময়োত্তীর্ণ করে তোলার চেষ্টা করেছেন। 

মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ ‘নিউ ইয়র্ক’ আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা’য় আমন্ত্রিত হয়ে আসছেন। তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বইমেলা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। কিন্তু বইমেলায় তাঁর অংশগ্রহণের ধরনটি অস্পষ্ট। কারণ মেলার অনুষ্ঠানসূচির কোথাও বক্তা হিসেবে তাঁর নাম দেখা গেল না! বোঝা গেল মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহকে তাঁদের বারোয়ারি আয়োজনের কোথায় স্থান দেয়া হবে তা বুঝে উঠতে পারছেন না আয়োজকেরা। অথবা তাঁর নিমগ্ন চর্চার কথা শুনবার তাৎপর্য বইমেলা কর্তৃপক্ষ অনুভব করতে পারছেন না! ‘ঊষালোকে’র জন্য স্টল বরাদ্দ হয়ে থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাস্থ্যগত করাণে তাঁর পক্ষে স্টলে থাকাও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না! সুতরাং তাঁর বই অন্য কারো সহযোগিতা নিয়ে রাখতে হবে। 

সুইডেন ভিত্তিক উত্তরাপথ পুরস্কার ১৯৯০, পশ্চিমবঙ্গের ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি পুরস্কার’ ২০০৫  ও ‘লোক লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার’ ২০১০ ‘ঊষালোকে’কে সম্মানিত করেছিল। লোক পুরস্কার প্রাপ্তির সময় ‘ঊষালোকে’ সম্পর্কে ২০১০ সালে একটি ছোট্ট রচনা লিখেছিলাম। তাঁর নিউ ইয়র্ক আগমন উপলক্ষে সে রচনাটি এখানে উপস্থাপন করা হলো। আশা করি নিউ ইয়র্কের বন্ধুরা তাঁর সম্পর্কে এ থেকে কিছুটা ভালোভাবে জানতে পারবেন!

২.

ঊষালোকে‘ : একটি যথার্থ লিটল ম্যাগাজিন

আশির দশকের আগে থেকেই মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ কবিতা লিখতেন। কিন্তু আমি তাঁকে প্রথমে চিনেছিলাম ‘ঊষালোকে’-র সম্পাদক হিসাবেই। সেই আশির দশকের গোড়ার দিকেই ‘ঊষালোকে’কে চোখে পড়েছিল আমার। আশির দশকের যে সময়ে ‘ঊষালোকে’ প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল সে-সময় বাংলাদেশে সাহিত্য পত্রিকার আকাল চলছিল। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সম্পন্ন সাহিত্য পত্রিকা সমকাল-এর প্রকাশনা তখন বন্ধ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের খ্যতিমান ‘কণ্ঠস্বর’ও ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নতুন সময়ের সাহিত্যকে নতুনদের হাতেই বেড়ে উঠতে হবে এই বিবেচনায়। পাকিস্তানি আমলে কয়েকটি সরকারি সাহিত্য পত্রিকা ছিল, স্বাধীনতা-উত্তর কালে সেগুলোও আর প্রকাশিত হচ্ছিল না। ষাটের দশকের লিটল ম্যাগাজিন মিছিলের যে রেশটুকু ছিল তারও প্রায় অবসান ঘটেছে তখন। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যতিক্রমী যে দু-একটা তৎপরতা অব্যাহত ছিল ক্ষীণ হয়ে এসেছিল তারও কণ্ঠস্বর। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত সবেধন নীলমনি ‘উত্তরাধিকা’র বের হচ্ছিল ক্ষীণকায়া নিয়ে, এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে একুশের সংকলন প্রকাশের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তাও স্তিমিত হয়ে এসেছিল সে-সময়। একের পর এক নতুন বিনোদন পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছিল শুধু। এমনকি পাকিস্তানি আমলে পশ্চিমবঙ্গের ¬প্রসাদ-উল্টোরথ পত্রিকার আদলে যে দু-একটা বিনোদন পত্রিকা ছিল সেই ঐতিহ্যেরও অবসান ঘটে গিয়েছিল তখন। নতুন জাতের বিনোদন পত্রিকায় সাহিত্যের স্থান প্রায় ছিল না বললেও চলে। থাকলেও তা খানিকটা করুণাপ্রার্থীর মতো। প্রবীণ কবি আহসান হাবীব তখনও সক্রিয় ছিলেন বলে সরকারি প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীর পৃষ্ঠায় তরুণ লেখক-সাহিত্যিকদের আগ্রহী জমায়েত খানিকটা সরবভাবে চলছিল। কেউ কেউ হয়তো দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর নাম বলবেন দৈনিক বাংলার সহযাত্রী হিসাবে। কিন্তু এই দুয়ে মিলে আর কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে। তা ছাড়া সকলেই স্বীকার করবেন যে দৈনিক পত্রিকা সাহিত্যের নতুন কোনো ভাবধারা বা সৃষ্টিশীলতার নতুন চেতনার উদ্ভাস ঘটাতে পারে না। তা-ছাড়া ক্রমশ বাংলাদেশে তখন যেভাবে একের পর এক বিনোদন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ চলছিল তাতে সাহিত্যের স্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছিল। ঊষালোকে সাহিত্যের নিরঙ্কুশতাকে কাঁধে নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল। ঊষালোকের প্রকাশনা শুরুর কালে বাংলাদেশে মুদ্রণ ব্যবস্থার এত উন্নতি ঘটে নি, বরং বলা চলে লেটারপ্রেসের সংকটযুগের শুরুর কাল ছিল সেটা। লাইনো বা মনোটাইপে ছাপার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তার সুবিধা নেয়া একদিকে যেমন কঠিন হয়ে পড়েছিল অন্যদিকে লেটারপ্রেসে ছাপার গুণগত মান ধরে রাখা যাচ্ছিল না সীসার টাইপের ম্যাট্রিক্স খারাপ হয়ে যাওয়ার পর ব্যয়সাশ্রয়ী না হওয়ায় তার নবায়ন সম্ভব হচ্ছিল না বলে। ফলে ‘ঊষালোকে’ মুদ্রণ সৌকর্যে তার যুগের শ্রেষ্ঠ রূপকে ধারণ করতে পারে নি। তা-সত্ত্বেও ঊষালোকে আভিজাত্য দেখিয়েছে তার লেখা নির্বাচনে বিষয়বৈচিত্র্য ও বিশুদ্ধ সাহিত্যপ্রীতির পরিচয় রেখে। সেই লেটার প্রেসের যুগেও ঊষালোকে বিশেষ বিশেষ সাহিত্যিক তাৎপর্যকে সামনে তুলে ধরেছে। বিশেষ সংখ্যা করেছে কবি ফররুখ আহমদের ওপর, বিশেষ সংখ্যা করেছে সে-সময় বিস্মৃতপ্রায় হয়ে পড়া মনীষী কবি-রাজনীতিক-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবিরকে নিয়ে। হুমায়ুন কবিরের কোনও প্রাথমিক গ্রন্থপঞ্জিও ছিল না তখন পর্যন্ত। সদ্যপ্রয়াত আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘ঊষালোকে’-এর সম্পাদকের আহ্বানে এর পৃষ্ঠাতেই প্রথম একটি গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়ন করেছিলেন। ভাষাপরিস্থিতি, সমাজ ও নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে ঊষালোকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছিল তার প্রথম পর্বে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে যে কেবল প্রথম পর্ব ঊষালোকে-র কর্মকৃতির তাৎপর্য বিচার করলে মূল্যায়নে এর উৎকর্ষের মাত্রাকে যে স্থান দেয়া হতো তা কতটা উচ্চে হতো তা নিয়ে আমার সংশয় আছে।

কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে ঊষালোকে উৎকর্ষের যে পর্যায়কে স্পর্শ করেছে তাকে মূল্য না দিয়ে পারা যাবে না। সম্পাদকীয় বৈশিষ্ট্যে ‘ঊষালোকে’ রীতিমতো অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রথম পর্বে যে হুমায়ুন কবির-চর্চা ছিল খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের দ্বিতীয় পর্বে তা পৌঁছেছে এক সম্পন্ন স্তরে। অনেক পরিশ্রমে সম্পাদক নিজে যেমন হুমায়ুন কবিরের এক সম্পন্ন গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়ন করেছেন তেমনি তাঁর সম্পর্কে লিখিয়ে নিয়েছেন সমসাময়িক কালের প্রবীণ ও তরুণ লেখকদের দিয়ে। হুমায়ুন কবিরের বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাস নদী ও নারী  নিয়ে এবং তাঁর অসাধারণ কাব্যবীক্ষার নিদর্শন বাঙলার কাব্য বইটি নিয়ে দুটি সংখ্যা তো প্রকাশিত হয়েছেই এ-ছাড়াও সম্পূরক কাজ হিসাবে কয়েক সংখ্যাব্যাপী তাঁর সম্পর্কিত দুষ্প্রাপ্য রচনা উদ্ধার করে হুমায়ুর কবির চর্চাকে একটা পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে ‘ঊষালোকে’ পত্রিকা। 

শামসুদ্দীন আবুল কালাম তাঁর ‘কাশবনের কন্যা’ উপন্যাসটির জন্য একসময় বেশ খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বাঙালির স্বভাবসুলভ বিস্মৃতিপরায়ণতার কারণে এই উপন্যাসটিও প্রাপ্য মূল্য পায় নি। আধুনিকতার প্রতাপে বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গীয় নদীস্পৃষ্ট মনস্তত্ত্ব নির্ভর উপন্যাসটি আধুনিক সমালোচকদের মনোযোগ হারায়। অথচ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে নদীতীরবর্তী জনজীবনে যে অধ্যাত্মচেতনা ও অনিকেত মানসিকতার দেখা মেলে তা যে স্বাভাবিক এবং আধুনিকতানিরপেক্ষ এবং তা ব্যক্তির সংকটেরও কারণ তা অনুধাবন করলে ‘কাশবনের কন্যা’ উপন্যাসটির বিশেষত্ব উপলব্ধি করা যাবে। ‘ঊষালোকে’-এর কাশবনের কন্যা বিষয়ক বিশেষ সংখ্যাটিও সামনে নিয়ে এসেছে এই উন্মোচনকে। ‘ঊষালোকে’র এই সংখ্যাটি কেবল কাশবনের কন্যা উপন্যাসটিকেই সামনে নিয়ে আসে নি বরং শামসুদ্দীন আবুল কালামকেও বিস্মৃতির কবল থেকে রক্ষা করেছে। 

‘ঊষালোকে’-এর পরের সংখ্যাটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাসুলীবাঁকের উপকথা’ নিয়ে। নানাকারণে উপন্যাসটি আধুনিকতাকে ধারণ করতে পেরেছিল ভিন্ন একটি অবস্থান থেকে। বাংলাসাহিত্যে বৃহদায়তনের মধ্যে সমাজমানসকে এবং ব্যক্তিসত্তার টানাপড়েনকে তারাশঙ্কর যেভাবে ধারণ করেছিলেন তার তুলনা বিরল। তারাশঙ্করের শতবর্ষে তাঁর বিশিষ্ট উপন্যাস ‘হাসুলীবাঁকের উপকথা’ নিয়ে নানামুখী মূল্যায়নে সংখ্যাটি সমৃদ্ধ। এ-কথা ঠিক যে তারাশঙ্কর বাংলাভাষার একজন চিরায়ত সাহিত্যিক। কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্যিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর উপন্যাস নিয়ে যথোপযুক্ত আলোচনা কমই হয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যরসিকদের মধ্যে এই অসামান্য উপন্যাসটির পুনরালোচনার ব্যবস্থা করে ধন্যবাদের ভাজন হয়েছেন।

আবু ইসহাক তাঁর ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ভিন্ন উপন্যাস ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ও অসাধারণ। তা সত্তে¡ও আমাদের সমালোচনা সাহিত্যের দৈন্যের কারণে এ সম্পর্কে তেমন আলোচনা হয় নি। এই দীনতাকে মেনে না নিয়ে ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ সম্পর্কে একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘ঊষালোকে’। ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের খ্যাতির প্রতাপও এই উপন্যাসকে খানিকটা আড়ালে ফেলে দিয়েছে। তা-ছাড়া তিনি নিভৃতচারী ছিলেন বলে তাঁর সম্পর্কে সাহিত্যমহল জানতোও খুবই কম। নিঃসন্দেহে ঊষালোকে এই আড়ালকে অপসারণ করেছে। নতুন প্রজন্মের সামনে আবু ইসহাককে তুলে এনেছে উজ্জ্বলভাবে।

এতক্ষণ আমি ‘ঊষালোকে’ পত্রিকার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বললাম। এর সম্পাদনা সম্পর্কে কিছু না-বললে এর অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন হবে না। সার্বিকভাবে বিচার করলে দেখব যে আমাদের সাহিত্য সংশ্লিষ্ট প্রকাশনার মান খুবই অপেশাদার ও অনান্তরিক। এর কারণ হয়তো বা এই যে এধরনের কাজের পেশাদারিত্বের বিনিময়ে আর্থিক প্রাপ্তি কম বলে যথার্থ পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠে নি। ‘ঊষালোকে’-এর সম্পাদক এইখানে কঠিনভাবে নিরাপোষ। মুদ্রণপ্রমাদ দূর করবার জন্য যে আন্তরিক প্রয়াস তিনি নেন তার চিহ্ন পত্রিকাটির পাতা ওল্টালে যে কেউই অনুভব করবেন। শুধু মুদ্রণপ্রমাদ দূরীকরণের প্রয়াসের যে উল্লেখ করা হল এর মধ্য থেকে তাঁর সম্পাদকীয় নিষ্ঠার পরিচয় পুরোপুরি পাওয়া যাবে না। আরও কিছু প্রয়াসের কথা উল্লেখ প্রয়োজন। যেমন এক-একটি সংখ্যার জন্য তিনি সুচিন্তিত পরিকল্পনা করেন; অনুসন্ধান করেন যোগ্য লেখকের। একেকটি রচনাকে কাঙ্ক্ষিত মানের করে তুলবার জন্য সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন লেখকদের। যে কোনো রচনার জন্য লেখকর অবদানের সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদকের শ্রম এবং ভাবনাও যুক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ এমন একটি পত্রিকার সম্পাদনায় যে পেশাদারিত্ব প্রয়োজন মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ তার যথাসাধ্য করেন নিবেদিতপ্রাণ হয়ে। এরপরও যে সীমাবদ্ধতাটুকু থাকে তার কারণ বাংলাদেশের সাহিত্যিক সংস্কৃতির সার্বিক সীমাবদ্ধতা। আমাদের বিদ্যায়তনিক প্রকাশনাও এই সীমাদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে সামান্যই। সে হিসাবে এই ব্যক্তি উদ্যোগের পেশাদারিত্বকে উচ্চ মূল্য দিতেই হবে। 

লিটল ম্যাগাজিনে মুদ্রণসৌকর্য খুব বেশি প্রত্যাশিত নয়, কিন্তু একটা সাধারণ রুচির ছাপ তারা রাখতে চেষ্টা করেন। লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে ঊষালোকে এ-ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম, কারণ এর সার্বিক প্রকাশনা মান সাহিত্য বিষয়ক প্রকাশনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সাধারণ যে উন্নত মান তার চেয়েও উচ্চ। পৃষ্ঠাসজ্জার পরিচ্ছন্নতা, কাগজ নির্বাচনের রুচিশীলতা ও বাঁধাইয়ের নিখুঁততার ছাপ এর অবয়বে পরিস্ফুট থাকে, রচনাগুলো উপস্থাপনে থাকে মার্জিতরুচির পরিচয়। পত্রিকাটিকে পাঠক-বান্ধব করে তুলবার জন্য অর্থাৎ রচনাগুলোকে সবচেয়ে পাঠোপযোগী করবার জন্য সম্পাদকের আন্তরিকতার ও নিষ্ঠার যে কমতি নেই তার ছাপ পত্রিকাটি হাতে নিলে যে কেউই অনুভব করবেন।

এর প্রকাশনা সৌকর্য ও সম্পাদনার পেশাদারিত্বের কারণে এর লিটল ম্যাগাজিনত্ব নিয়ে কেউ সন্দেহ পোষণ করতে পারেন। কিন্তু আমি নিঃসংশয়ে একে লিটল ম্যাগাজিন বলব এর বৈশিষ্ট্যগত স্বাতন্ত্র্যের কারণে। কিছু সৃজনশীল লেখা একত্র করে যেভাবে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা হয় ঊষালোকে-এর অভিপ্রায় তা নয়। ‘ঊষালোকে’-এর মধ্যে যে অভিপ্রায় লক্ষণীয় তা হচ্ছে প্রধানত বাংলাদেশের সাহিত্যের অনালোকিত প্রদেশে আলো ফেলে পুনর্বিচার করা, অথবা পুরনো সাহিত্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে নতুনভাবে হাজির করা। লিটল ম্যাগাজিন গতানুগতিকতাকে বয়ে চলবে না, কোনও-না-কোনও নতুন চোখে সে তাকাবে। এই পত্রিকাও গতানুগতিক পথে চলে নি। চলেছে পুর্নমূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনার ভিন্ন পথে। সে-কারণে একে যথার্থ লিটল ম্যাগাজিনই বলতে হবে।

৩.

মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ একমাত্র প্রকাশিত কবিতা-সংকলন ‘আবেগের কথাই যদি বলো’-র কবি; এবং তাঁর রয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থ ‘আবদুস সাত্তার’। ‘ঊষালোকে’র যে সংখ্যাগুলো তিনি সম্পাদনা করেছেন সেগুলোকে আরো ভালোভাবে বিন্যস্ত করে দিয়েছেন বইয়ের রূপ। বইগুলো হলো: ‘হুমায়ুন কবিরের নদী ও নারী: প্রকৃতি ও সংগ্রামী সত্তার দুই ডানা’, ‘বাংলার কাব্য: বহুমুখী বিশ্লেষণ’, ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলী বাকের উপকথা: জীবন ও শিল্পের মিথস্ক্রিয়া’, ‘শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা’: লৌকিক জীবনের গাথা’, আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ: মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও তাঁর উপন্যাস’, ‘রোকেয়া মানস ও সাহিত্য মূল্যায়ন’, ‘জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি’, ‘মাহমুদুল হকের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস জীবন আমার বোন: মূল্যায়ণ ও বিশ্লেষণ’।

তাঁর কাছ থেকে জানতে পেরেছি সবগুলো বইই তিনি নিয়ে আসবেন বইমেলায়! নিউ ইয়র্ক বা আশেপাশের রাজ্যগুলো থেকে যাঁরা আসবেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা বইগুলো তাঁদের সংগ্রহে রাখতে চাইবেন। ঢাকায় গিয়েও সবগুলো বই একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেদিক থেকে নিউ ইয়র্কে একত্রে সবগুলো বই পেয়ে যাওয়া একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ