spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অসামান্য সৃষ্টি 'সহজ পাঠ'

লিখেছেন : আবু রাইহান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অসামান্য সৃষ্টি ‘সহজ পাঠ’


আবু রাইহান

রবীন্দ্রনাথতাঁর জীবন- দর্শনের মাধ্যমে গভীরভাবে বুঝেছিলেন যে, প্রকৃতির অনাবিল সংস্পর্শের মধ্যে বেড়ে ওঠাই হল শিশুর আনন্দ।তিনি তাঁর জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন প্রকৃত শিশুবিকাশ ও শিশুশিক্ষার কথা। প্রকৃতির কোলে মুক্তভাবে শিশুমনোবিকাশের কথা ভেবেছিলেন শেষ বয়সেও। শিশু শিক্ষাই হোক আর বড়ো মানুষের শিক্ষাই হোক প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি প্রকৃতি পরিবেশ ও সমাজ থেকে জ্ঞান সঞ্চয়ের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। খোলা আকাশ, বাতাস, গাছপালা ও জীবজন্তুর মানুষের সুপরিণতির জন্য একান্ত দরকার। একদিন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় তার স্বীকৃতি ছিল। অরণ্য আর গুরুগৃহ দুই-ই আমাদের শিক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। তাই তিনি শিশুদের সার্বিক বিকাশের কথা ভেবে শিক্ষার বিশেষভাবে উপযোগী পুস্তক সহজপাঠ (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ) একরকম শেষ বয়সে (১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দ) লিখেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ছোটদের জন্য লেখা এই ‘সহজপাঠ’।বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ এর মত রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’ আজও বাংলার শিশুদের নিকট বিশেষ পরিচিত।
প্রশ্ন উঠতে পারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ এর মতো বিখ্যাত পুস্তক থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ শিশুদের জন্য ‘সহজপাঠ’ লিখতে গেলেন কেন? বর্ণপরিচয় লেখা হয় ১৮৫৫ সালের এপ্রিল মাসে এবং দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালের জুন মাসে। ঠিক ৭৫ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ সহজপাঠ প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশ করেন বাংলার শিশুদের প্রাথমিক পুস্তকের অভাব দূর করতে।শতাব্দীর অধিককাল ‘বর্ণপরিচয়’ বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একমাত্র উল্লেখযোগ্য পুস্তক হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসার কারণ, এই পুস্তক দুখানি একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লেখা।বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে শিক্ষার্থী প্রথমে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পঠন ও লেখনের জ্ঞান অর্জন করে। পূর্বে বাংলা বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে সীমাবদ্ধ ছিল। বিদ্যাসাগর প্রথম অপ্রয়োজনীয় বর্ণগুলি পরিত্যাগ করে বাংলা বর্ণমালাকে এক স্বতন্ত্র রূপে গঠন করেন এবং কয়েকটি নতুন বর্ণ যোগ করেন।
‘বর্ণপরিচয়’ এর সাহায্যে ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি হচ্ছে অক্ষর পরিচয় এর পর পরবর্তী পাঠ সমূহের বিভিন্ন বর্ণ যোজনার সাহায্যে নতুন নতুন শব্দ গঠন সম্পর্কে নতুন পাঠ দেওয়া হয়। এই অংশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে প্রত্যেক স্বতন্ত্র পাঠে প্রথমে ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে একটিমাত্র স্বরবর্ণের ব্যবহারের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম পাঠে অ-কার, দ্বিতীয় পাঠে আ-কার, তৃতীয় পাঠে ই-কার ইত্যাদি। মধ্যবর্তী পাঠ সমূহে জটিলতর উদাহরণের উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকারের বর্ণ যোজনা শিক্ষার পর, পুস্তকের শেষ অংশে দুই বা ততোধিক শব্দের সাহায্যে অর্থ বিশিষ্ট বাক্যের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। অর্থ বিশিষ্ট ও ছন্দ বিশিষ্ট বাক্য কিভাবে শিশুর মনে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে উল্লেখ করেছেন। “কেবল মনে পড়ে, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। তখন ‘কর,খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কুল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ আমার জীবনে এইটেই আদি কবির প্রথম কবিতা। সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝতে পারি কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না- তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনও তাহার ঝংকার ফুরায় না-মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতেও পাতা নড়িতে লাগিল।”
বর্ণপরিচয়ের পরবর্তী অংশে ছোট ছোট বিষয়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলি নির্বাচন করা হয়েছে শিশুদের পরিচিত ঘটনা থেকে। কোনরূপ অসম্ভব বা শিশুদের অপরিচিত বিষয় এই অংশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যথা- “আর রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। আর শুইয়া থাকিব না।উঠিয়া মুখ ধুই। মুখ ধুইয়া কাপড় পরি। কাপড় পরিয়া পড়িতে বসি। ভালো করিয়া না পড়িলে পড়া বলিতে পারিব না।”… ইত্যাদি। এই রূপ কয়েকটি বিষয় পাঠের পর পুস্তকের শেষ অংশে গোপালের গল্প আরম্ভ হয়েছে। গোপালের গল্পের পর রাখালের গল্প। গোপাল ও রাখালের গল্প দুটি বাংলাদেশের ছেলে মেয়েদের নিকট ক্লাসিক্যাল গল্পের পর্যায়ে পড়ে। গোপাল যেমন সুবোধ,রাখাল তেমন নয়। আজও বাংলাদেশের পিতা-মাতারা তাদের ছেলেমেয়েদের গোপালের মতো হবার উপদেশ দেন। বর্ণপরিচয় লিখবার পদ্ধতিকে বলা হয় যৌক্তিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতি অনুসারে ভাষা শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীকে প্রথমে বর্ণের প্রতীকগুলি আয়ত্ত করা থেকে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে জটিলতর অংশসমূহ আয়ত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই রূপ পদ্ধতি অনুসারে লিখিত পুস্তকের সাহায্যে শিক্ষকের পক্ষেও শিক্ষাদান করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। কারণ শিশুর ব্যক্তিগত রুচি, প্রকৃতি, যোগ্যতা ও মনস্তাত্ত্বিক গঠন যাই হোক না কেন, সমস্তই উপেক্ষা করে শিশুর শিক্ষাকে একটি নির্দিষ্ট মানে উন্নত করবার জন্য চেষ্টা করা হয়।যৌক্তিক পদ্ধতিকে শিক্ষাবিদগণ এই কারণে বিষম পদ্ধতি বলেছেন। এই পদ্ধতিতে লিখিত পুস্তকের সাহায্যে শিক্ষার্থীর পক্ষেও শিক্ষকের সামান্য সাহায্য পেলে পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা পাঠ আয়ত্ত করা সম্ভব হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে পুস্তক রচনার কারণে শিশু শিক্ষার জন্য প্রাথমিক পুস্তকে শিশুদের মনে আনন্দ সঞ্চারের জন্য কোন উপযুক্ত ছড়া নেই, কবিতা নেই, উপযুক্ত ছবির কথা সে যুগে আসেই না।
শিশু মনের জাদুকর রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন বর্ণপরিচয়ে’র সাহায্যে শিশু ভাষা শিক্ষা করতে পারে বটে, কিন্তু কোন আনন্দ পায় না। আধুনিক শিক্ষাবিদগণ বলেন যে লেখা ও পড়া যাই শেখানো হোক না কেন-পদ্ধতি এমন হবে যে তার সাহায্যে শিশুর মনোবিকাশ সম্ভব হতে পারে, শিশু আনন্দ পেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছিলেন বর্ণপরিচয় পাঠে শিশু বানান শেখে উচ্চারণ শেখে কিন্তু আনন্দ পায় না। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ সহজপাঠ লেখেন এবং সহজ পাঠ লেখবার জন্য তিনি যৌক্তিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে মনস্তত্ত্বসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করেন। মনস্তত্ত্বসম্মত পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে শিশুই হচ্ছে শিক্ষার কেন্দ্রে। শিশুর ব্যক্তিগত রুচি ও ক্ষমতা অনুযায়ী পাঠ্য বিষয়ের নির্বাচন করা হয়। শিক্ষণীয় বিষয় সমূহের সঙ্গে শিশুর অভিজ্ঞতার পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য থাকে। পড়ার সঙ্গে জীবনের সামঞ্জস্য যদি শিশু খুঁজে পায় তবে পড়াটা শিশুর জীবনে দুঃখের কারণ না হয়ে শিশুর মানসিক ও শারীরিক গঠনে সহায়ক হতে পারে। শিক্ষাটা যদি জোর করে বই মুখস্ত করানো না হয় এবং তা যদি শিশুর জীবনে আনন্দ লাভের উপায় স্বরূপ হয়, তবে বইয়ের বিষয়বস্তু গ্রহণ করতে হবে শিশুর আপন অভিজ্ঞতা থেকে এবং তার অর্থও শিশুর নিকট বোধগম্য হওয়া চাই। শিশু ছন্দ ভালোবাসে, সুতরাং পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে শিশুর মনের মত ছড়া ও কবিতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিশু রং ভালোবাসে,ছবি ভালবাসে, সুতরাং পুস্তকে ছবির ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে এমন বিষয়ও যেন কিছু থাকে, যা পাঠ করে শিশু চিন্তার সুযোগ পেতে পারে।
শিশু শিক্ষার প্রাথমিক পুস্তক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সহজপাঠ লিখেছেন। সহজপাঠে রবীন্দ্রনাথ অক্ষর পরিচয়ের কোন ব্যবস্থা রাখেননি। এই জন্যই প্রথমেই তিনি লিখেছেন বর্ণপরিচয়ের পর পাঠনীয়। রবীন্দ্রনাথ সহজপাঠের প্রথম অংশে এগারোটি স্বরবর্ণের উল্লেখ করেছেন। বিদ্যাসাগর বারোটি স্বরবর্ণ সম্পর্কে বলেছেন। অর্থাৎ তিনি ৯ কেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ৯ কে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ সহজ পাঠের (১ম ভাগ) প্রথম দিকে অ, আ ইত্যাদির ব্যবহার দেখিয়েছেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছন্দের সাহায্যে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ সমূহের উচ্চারণ শেখানো। সমস্ত অক্ষর গুলিরই উচ্চারণ ছন্দের সাহায্যে দেখাতে পেরেছেন। শুধু তাই নয় জটিলতর উচ্চারণের ক্ষেত্রেও তিনি এই পদ্ধতি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করতে পেরেছেন। যেমন-
ই ঈ-এর ক্ষেত্রে
হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ
বসে খায় ক্ষীর খই।
উ ঊ-এর ক্ষেত্রে
হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ
ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ।

কিংবা ঙ-এর ক্ষেত্রে
চরে বসে রাধে ঙ
চোখে তার লাগে ধোঁয়া।

ঞ-এর ক্ষেত্রে
খিদে পায়, খুঁকি ঞ
শুয়ে কাঁদে কিয়োঁ কিয়োঁ।

রবীন্দ্রনাথ সহজ পাঠের জন্য কোন বিশেষ পদ্ধতির উল্লেখ করেননি। তিনি নির্ভর করতে চেয়েছেন শিক্ষক ও শিশুর শক্তির উপর। পাঠের প্রথমেই তিনি ছন্দের প্রয়োজন বোধ করেছেন। বিশেষ করে বর্ণের উচ্চারণ শেখাবার জন্য তার প্রয়োগ করেছেন সুন্দরভাবে। বিদ্যাসাগরের পক্ষে শিশু চরিত্রকে এইভাবে দেখা সম্ভব হয়নি। উভয়েরই জীবন দর্শন ও কর্মক্ষেত্র আলাদা। দুইজনের আবির্ভাব হয়েছে প্রায় এক শতাব্দীর ব্যবধানে। এই সমস্ত বিষয় যে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের চিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।বর্ণ যোজনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের যৌক্তিক পদ্ধতি অবলম্বন করেননি। তিনি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। শিক্ষাবিদগণ এই পদ্ধতিকে বলেন সামগ্রিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এই যে,এই পদ্ধতিতে যৌক্তিক পদ্ধতির মতো শিক্ষার্থীকে বর্ণ পরিচয় সম্পর্কে কোন শিক্ষা দেওয়া হয় না। বর্ণের পরিবর্তে অর্থবোধক শব্দ বা বাক্য লিখতে বা পড়তে শিক্ষা দেওয়া হয়।এই পদ্ধতির উন্নততর পর্যায়ে শিক্ষার্থীকে পৃথক পৃথক শব্দ বাক্যের পরিবর্তে একটি আখ্যান বা বর্ণনার সঙ্গে পরিচয় করানো হয়। ভাষা শিক্ষা দেবার এই আধুনিক পদ্ধতিকে বলা হয় আখ্যানমূলক পদ্ধতি। রবীন্দ্রনাথ সহজপাঠ প্রথম ভাগের প্রথমেই যে পাঠ দিয়েছেন,সেটি একটি সহজ বর্ণনা –
“বনে থাকে বাঘ।
গাছে থাকে পাখি।
জলে থাকে মাছ।
ডালে আছে ফল।
পাখি ফল খায়।
পাখা মেলে ওড়ে।”
সহজ পাঠের দ্বিতীয় পাঠটি এইরূপ-
“রাম বনে ফুল পাড়ে। গায়ে তার লাল শাল। হাতে তার সাজি। জবা ফুল তোলে। বেল ফুল তোলে। বেল ফুল সাদা। জবা ফুল লাল। জলে আছে নাল ফুল।”… ইত্যাদি।
নবম পাঠ থেকে উদাহরণ-
“এসো এসো গৌর এসো। ওরে কৌলু দৌড়ে যা। চৌকি আন। গৌর হাতে ঐ কৌটো কেন? “ঐ কৌটো ভরে মৌরি রাখি। মৌরি খেলে ভালো থাকি।”… ইত্যাদি। সহজপাঠে (প্রথম ভাগ) সব শুদ্ধ মোট ১০ টি পাঠ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি পাঠ গদ্য ও পদ্য এই দুইভাবে বিভক্ত। গদ্যাংশ গুলি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেকটি পাঠে একটি ঘটনার সহজ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বর্ণপরিচয় এর মত শব্দকে বাক্য থেকে আলাদা করে দেখানো হয়নি। বাক্যকে একটি সম্পূর্ণ বর্ণনার অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে। প্রত্যেক পাঠের বর্ণনার বিষয়টি নেওয়া হয়েছে শিশুর পরিবেশ থেকে, শিশুর অভিজ্ঞতার অংশ হিসাবে। প্রত্যেক মাঠে একটি গল্পের আভাস রয়েছে, যাতে পড়বার সময় শিশু আনন্দ পায়। বর্ণপরিচয়ের বর্ণ যোজনার ক্ষেত্রে যেমন সহজ থেকে কঠিন এ নিয়ে যাবার জন্য একটি ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। সহজপাঠে সেটি বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। বর্ণপরিচয় প্রথমে অ-কার পরে আ-কার, ই-কার, ঈ কার ইত্যাদি স্বরবর্নের প্রয়োগ সম্পর্কে যেমন বহু উদাহরণ পরপর দেওয়া হয়েছে। সহজ পাঠে তার ব্যতিক্রম আছে। প্রথম পাঠেই অ-কার,আ-কার, ই-কার ইত্যাদি বিভিন্ন স্বরবর্ণের প্রয়োগ একসঙ্গে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীকে নানা বিষয়ে একত্রে আয়ত্তে করবার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু বর্ণনা ভাষার বিষয় বিবেচনা করলে বিভিন্ন পাঠের মধ্যে সহজ থেকে কঠিন এ নিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা দেখা যায়।
প্রত্যেকটি পাঠের দ্বিতীয় অংশে কবিতা। ছন্দের রাজা রবীন্দ্রনাথ যে শিশুকে ভাষা শেখাবার জন্য ছন্দের উপর নির্ভর করতে চেয়েছেন এ খুবই স্বাভাবিক। সহজপাঠ, প্রথম ভাগে রবীন্দ্রনাথ যে সকল কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেছেন তা সাধারণত ছন্দ প্রধান ও বর্ণনামূলক।
প্রথম পাঠ:
“আলো হয় গেল ভয়।
চারিদিক ঝিকিমিক।
বায়ু বয় বন বন।
বাঁশ গাছ করে নাচ।”… ইত্যাদি
দ্বিতীয় পাঠ:
“কালো রাতি গেল ঘুচে,
আলো তার দিলো মুছে।
পুব দিকে ঘুম-ভাঙ্গা
হাসে উষা চোখ-রাঙা।

সপ্তম পাঠ:
“কাল ছিল ডাল খালি
আজ ফুলে যায় ভ’রে।
বল দেখি তুই মালি,
হয় সে কেমন ক’রে।”… ইত্যাদি।
গদ্য অংশের মতো কবিতার অংশে ও রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা ও ছন্দের বৈচিত্র্যের সাহায্যে কবিতাগুলিকে সহজ থেকে কঠিনে নিয়ে চলেছেন। কবিতার বিষয়বস্তু বর্ণনামূলক, শিশুর পরিবেশকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে।
‘বর্ণপরিচয়’ এর সাহায্যে যে পদ্ধতিতে ভাষা লিখতে পড়তে শেখানো হয় তাকে শিক্ষাবিজ্ঞানে বলা হয় বর্ণ ভিত্তিক পদ্ধতি। বর্ণই হচ্ছে ভাষার প্রাথমিক অংশ বা উপাদান। বর্ণ ভিত্তিক পদ্ধতিতে প্রথমে বিভিন্ন বর্ণ লিখতে ও পড়তে শেখানো হয়। পরে বিভিন্ন বর্ণের সংযোগে শব্দ গঠন, শব্দের বানান শিক্ষা দেওয়া হয়। আবার শব্দ লিখতে ও পড়তে শেখার পর বিভিন্ন শব্দের যোগে বাক্য রচনা শিক্ষা দেওয়া হয়। এই পদ্ধতির সাহায্যে শিক্ষা দেবার জন্য শিক্ষার্থীকে অংশ থেকে সম্পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। বিজ্ঞান শাস্ত্রে এই পদ্ধতিকে বলা হয় সংশ্লেষণ পদ্ধতি। বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় লিখতে এই সংশ্লেষণ পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘সহজপাঠে’ যে পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন তাকে বলা হয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রথমে একটি সম্পূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় সাধন করে পরে ওই সম্পূর্ণ বিষয়টি যে যে অংশের সাহায্যে গঠিত তার দিকে শিক্ষার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। একে রচনা ভিত্তিক পদ্ধতিও বলা যায়। অবশ্যই একে সম্পূর্ণভাবে বিশ্লেষণ পদ্ধতি বলা যুক্তি সঙ্গত নয়। কারণ পরবর্তী ধাপে সংশ্লেষণ পদ্ধতির ব্যবহারও দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং রচনা ভিত্তিক পদ্ধতিকে বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণ পদ্ধতির মিশ্রণ বলা যেতে পারে।
সহজপাঠ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অসামান্য সৃষ্টি, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তরকারি বই। পশ্চিমবঙ্গে সরকারী ও সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত স্কুলগুলিতে সহজ পাঠ আবশ্যিক পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের ভাষা যতটা উচ্চতর, সহজ পাঠের ভাষা ততই সহজ ও সাবলীল চলিত ভাষায় লেখা।সঠিক শিশু শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের শিক্ষা ক্ষেত্রের পরিধি নির্মাণ করে।শিশুপাঠ্য পুস্তক প্রণেতা হিসেবে মদনমোহন তর্কালঙ্কার হলেন বাংলার প্রথম অগ্রগন্য পুরুষ।১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় (প্রথম ভাগ) প্রকাশিত হয়।বিংশ শতাব্দীতে সর্ব শ্রেষ্ঠ সংযোজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ (প্রথম ভাগ)।শিশুদের খাবার, প্রকৃতি, গ্রাম বাংলার মাঝে নিয়ে যাওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সহজ পাঠ।সহজ পাঠ প্রথম ভাগ ৫৩ পাতার। প্রথম দিকে সব পাতায় ছবি, নন্দলাল বসুর আঁকা কালো কালি দিয়ে। চিত্রশিল্পের দিক থেকে এই সব চিত্রের অনেক গুণ আছে। দ্বিতীয় ভাগ ৬০ পাতার বই, প্রথম ভাগের মতো এতেও অনেক ছবি আছে, তবে এসব ছবির ধরন একটু ভিন্ন, ভালো ভাবে দেখলেই বোঝা যায়, প্রথম ভাগে যেখানে ছবিগুলি কালো রঙে আঁকা, সেখানে দ্বিতীয় ভাগে রেখায় আঁকা ছবি। ছবিতে এমন পরিবর্তন কেন ? তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। রবি ঠাকুর বলেছিলেন শিশু, বই পড়ার সাথে সাথে আঁকা গুলো রাঙিয়ে নিতে পারে, অর্থাৎ তিনি শিশু দের রঙের সাথেও পরিচয় করাতে চেয়েছিলেন।অতি সাধারণ কথা যা বুঝতে অসুবিধা নেই, ছোটো ছোটো শিশুরা নিজেরাই বানান করে সহজ পাঠ পড়ে, অন্যদের পড়া শোনে, খাতায় লেখে, সেখানে তাদের বাক্যগঠন, যুক্তাক্ষরের সাথে পরিচয় হয়। আর তার সাথে সাথে শিশু মনে চিরকালীন ছাপ রেখে যায় সহজ পাঠের সেই ছবি গুলি, যেমন হামাগুড়ি দেওয়া সেই বাচ্ছা শিশুটির কথাই ধরা যাক। শিশু মনে সহজ পাঠ এ সব ছাড়াও জন্মদেয়, কাজের আয়জন, কাজের পরিকল্পনা ও কাজের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রথমিক ধারণাটুকু। অনেকে মনে করেন। এমনকি মনবিজ্ঞানীরাও বলে থাকেন, শৈশবের সঠিক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানবিকতার শিক্ষা যদি শৈশবে না শেখানো যায়, তবে ভবিষ্যত জীবনে তা শেখানো খুবই কষ্টকর বিষয়, পরে যে তা শিখবে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতন ভাবে মানবিকতার প্রথমিক পাঠ গল্পের মাধ্যমে সহজ পাঠের মধ্যে দিয়ে শিশু মনে প্রবেশ করাবার চেষ্টা করেছেন।সহজ পাঠের পাতায় পাতায় ধরা পড়ে পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা, পশুপাখি ভালোবাসতে শেখা মানবিকতার একটি অবশ্যিক অঙ্গ। যারা পশুপাখির কষ্ট বোঝেনা, তাদের বিনা কারনে কষ্ট দেয়, তারা মানুষকে অন্তর থেকে ভালোবাসবে, এমন হতে পারে না।
সহজপাঠ এর প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠে এই মানবিক শিক্ষার প্রসঙ্গ বারবার এসেছে, যেমন বলা যায় প্রথম ভাগের চতুর্থ পাঠে একটি কথা যেখানে বলা হয়েছে,”পাখি কি ওড়ে? না, পাখি ওড়ে না, ওর পায়ে বেড়ি। ও আগে ছিল বনে, বনে নদী ছিল, ও নিজে গিয়ে জল খেত, দীনু এই পাখি পোষে।” রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলেননি, তবে তিনি শিশু মনে যে চিত্র স্থাপন করলেন তাতে এ কথা বলাই যায় যে শিশুটি সারাজীবন কখনও পাখি দের কষ্ট দেবে না।
অন্যদিকে সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগের একাদশ, দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ পাঠে তিনটি গল্প আছে, যেখানে আছে পারস্পরিক সাহায্যের শিক্ষার কথা। বিদ্যার্জন আর শিক্ষা লাভের মধ্যে পার্থক্য আছে। বিদ্যার্জন মানে যদি হয় ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদির তথ্য ও প্রয়োগ শিখে নেওয়া, তাহলে শিক্ষা লাভ হল জীবনে চলার পথে কি ভাবে চলতে হবে তা আয়ত্ত করা। এ প্রসঙ্গে আইনস্টাইনের একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি এক জায়গায় বলেছিলেন, ” ইস্কুল-কলেজে শেখা অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি সমস্ত ভুলে যাওয়ার পর, যা বাকি থাকে তা হলো শিক্ষা। ” আর এখানেই সহজ পাঠ কৃতিত্ব রাখে। ছেলে বেলায় পড়া সব কিছু ভুলে গেলেও, সহজপাঠের সেই শিক্ষা ভোলা যায় না।
‘সহজপাঠ’ রচনার অন্তরালে চোখ রাখলে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশবে পড়েছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’। তখন বয়স ছিল ৩ বছর ৮ মাস।তাঁরশিশু শিক্ষার যে ধ্বনি ও ছন্দ তা‘সহজপাঠ’ রচনায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। আর প্রভাব বিস্তার করেছে। আর প্রভাব বিস্তার করেছে কবির শৈশবে বেড়ে ওঠার স্মৃতির অনুভব ও অনুভূতির নানান দিক। ‘সহজপাঠ’ লেখার সময় বেশ কয়েকবার খসড়া তৈরী করেছিলেন।এসম্বন্ধে বর্ণনা রয়েছে শান্তিনিকেতনের এক প্রাক্তন শিক্ষক তথা অনুসন্ধিৎসু গবেষক পূৰ্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ’ লেখায়। পূর্ণানন্দ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ব্যঞ্জনবর্ণের পাঠ প্রথম ও স্বরবর্ণের পাঠ রচনা করেন। সহজপাঠের স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ উভয় মিলযুক্ত। সেখানে ছন্দ ও ভাবের সমর্থন ঘটেছে। কিন্তু ১৩০২ বঙ্গাব্দে রচিত তার এই খসড়াতে শুধু স্বরবর্ণের পাঠযুক্ত মিল খুঁজে পাওয়া যায়।ব্যঞ্জনবর্ণের পাঠে মিলের কিছু নিদর্শন থাকলেও তাতে কোন সচেতন প্রয়াসের প্রমাণ নেই। আবার পরিশীলীত ‘সহজপাঠ’ বইটির প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন যে, ‘বাংলাভাষায় রত্নস্বরূপ এই গ্রন্থ যেনপ্রতিভার বেলাভূমিতে সংক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র নিটোল স্বচ্ছ্ব একটি মুক্তো। এর ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে চারিত্র্য, আর সেই সঙ্গে ব্যবহার- যোগ্যতা, পরিশীলিত বিরল হওয়ার মধ্যে নিকটতম অন্যচেতনা। মহত্তম বাণীসিদ্ধির সরলতম উচ্চারণ।কী ছন্দোবদ্ধ ভাষা, কী কান্তি তার, কীরকম চিত্ররূপে মালা গেঁথে চলেছে, অথচ কঠিনভাবে প্রয়োজনের মধ্যে আবদ্ধ থেকে, শিশুমনের গণ্ডি কখনও না ভুলে বর্ণশিক্ষার উদ্দেশ্যটিকে অক্ষরে অক্ষরে মিটিয়ে দিয়ে, পদ্যছন্দের বৈচিত্র্য, মিলের অপূর্বতা, অনুপ্রয়াসের অনুরণন- সমস্তই এখানে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু সমস্তই আঁটোমাপের শাসনের মধ্যে দেখেছেন। কোনখানেই পাত্র ছাপিয়ে উপচে পড়েনি।’

বাংলা বর্ণমালায় মোট৫২টি অক্ষর রয়েছে। এরমধ্যে ১২টি হল স্বরবর্ণ। আর অবশিষ্ট হলব্যঞ্জনবর্ণ। বিদ্যাসাগর তাঁর লেখা বর্ণপরিচয়ে স্বরবর্ণে‘ঋ’ ও দীর্ঘই কে বাদ রেখেছিলেন। এমনকি বাদ রেখেছিলেন ‘ক্ষ’কেও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মদনমোহনের মতো এককবর্ণের তালিকায় সুচিন্তিতভাবে রেখেছেন ‘ক্ষ’ কে। যেমন–

শালমুড়ি দিয়ে হ ক্ষ
কোণে বসে কাশে খ ক্ষ।

ছড়া সহযোগে যে বর্ণমালাকে চেনা যায় ও মনে রাখা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল ‘সহজপাঠ’। শুধু তাই নয় শিশুর কথা বলাথেকে শুরু করে তার বেড়ে ওঠা, চারিপাশের আর্থ-সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে ছড়া, ছবি, কবিতা ও ছোট ছোট গদ্যের মাধ্যমে পরিচয় ঘটানো। যেমন-

অ, আ

ছোট খোকা বলে অ আ
শেখেনি সে কথা কওয়া।

ঘন মেঘ বলে ঋ
দিনবড়ো বিশ্রী।

শ ষ স

শ ষ স বাদল দিনে
ঘরে যায় ছাতা কিনে।

ক খ গ ঘ

ক খ গ ঘ গান গেয়ে
জেলে ডিঙি চলে বেয়ে।

ত থ দ ধ

ত থ দ ধ বলে ভাই
আম পাড়ি চলো যাই।

এইরূপ মোট উনিশটি ছড়ায় একটি দুটি বা চারটি বর্ণমালার ক্রম অক্ষর-এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই লাইনের দুই অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ দিয়ে ছড়া রচনা করেছেন। প্রতিটি ছড়া সরল-সাবলীল অর্থবহ।যা শিশুমনে সহজে এক বিশেষ ছন্দের মধ্যে দাগ কাটে। প্রতিটি ছড়ার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের কথা।গ্রামীণ জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে ছবি বর্ণমালার চেনানোর প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে।যেমন ক্ষীর, খই, দই, কুকুরের ডাক, আকাশে মেঘ, শ্রমজীবি মানুষের কর্মকাণ্ডের আংশিক ছবি- নদীতে জেলের ডিঙি, হাটে বোঝা নিয়ে যাওয়া ও দিনভর ধান কাটা, শিশু কান্না, ঢাক-ঢোল, গরুর গাড়িতে ধান নিয়ে বাড়ি যাওয়া ইত্যাদি। কোন কিছু যেন বাদ পড়েনি। এই ছড়াগুলির সাথে নন্দলাল বসুর তুলিতে আঁকা সাদা কালো ছবিগুলি এখানে আরও এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। মনে হয় একে অপরের পরিপূরক। কবি রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে শিশুদের প্রথম পাঠ্যপুস্তকে ছবির প্রয়োজনীয়তার কথাও। তিনি নিজেও এক আধুনিক চিত্রী। চিত্রশিল্পী হিসাবে তাঁর আবির্ভাব হঠাৎ বলে মনে হলেও এর পূর্বে এ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভেবেছেন। যেমন মালতী পুঁথি থেকে শুরু করে শিলাইদহ পর্ব ছুঁয়ে‘পুরবী’ কাব্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। ছড়া সহযোগে বর্ণমালা সুন্দরভাবে চেনানোর পর্ব শুরু হয় সহজপাঠের প্রথম পাঠে।

বান থাকে বাঘ
গাছে থাকে পাখি।

জলে থাকে মাছ
ডালে আছে ফল।

পাখি ফল খায়।
পাখা মেলে ওড়ে।

………………

ওরা সব মৌমাছি।
এখানে মৌচাক
তাতে আছে মধু ভরা।

এখানে শিশুদের সাথে পরিচয় ঘটিয়েছেন পারিপার্শ্বিক জীবজন্তুর সাথে। বাদ পড়েনি ছোট মৌমাছিও। বলেছেন এরা কোথায় থাকে, কি খায়, দেখতে কেমন এসব কথা। যা খুব সাধারণ বলে মনে হলেও কিন্তু দুটি অক্ষরের শব্দ দিয়েঅর্থবহ ধারাবাহিকতাকে বজায় রেখে আমাদের কাছে এক চমকপ্রদ যাদু সৃষ্টি করেছেন।পরের ছড়াটি হল-

আলো হয়
গেল ভয়।

চারিদিক
ঝিকি মিক।

দিঘি জল
ঝল মল

………

গুরুদাস
করে চাষ।

রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ জীবনের সাথে যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মমত্ববোধ রয়েছে তা সহজে বোঝা যায় তাঁর লেখা সহজপাঠ (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ) পুস্তকের প্রতিটি ছড়ায়, কবিতায় ও গদ্য পাঠের মধ্য দিয়ে। উপরের ছড়াটির মধ্যে ফুটে উঠেছে অন্ধকারকে সরিয়ে সূর্য ওঠা, প্রকৃতির শোভা, কর্মজীবন পুরুষের নানা কাজে ব্যস্ততা।

দ্বিতীয় পাঠে বর্ণনা করেছেন গ্রামের একটি পরিবারের পূজার দিন। এদিন সকাল থেকে রাত্রি পূজার আয়োজনে কে কি কি কাজ করে। রাত্রির পরিবেশ কিরূপ হয় তাও উল্লেখ করেছেন। যেমন রাতে হবে আলো। লাল বাতি, নীলবাতি। কত লোক খাবে। কত লোক গান গাবে। সাতদিন ছুটি। তিন ভাই মিলে খেলা হবে। এক্ষেত্রে শিশু শিখবে দুই অক্ষরে ছোট ছোট শব্দদের ব্যবহার ও শব্দ চয়ন। এমনকি শব্দের বানানও। শুধু তাই নয় শিশুদের প্রিয় যে দোলনা এ নিয়ে লিখেছেন- ‘ছোট খোকা দোলা চড়ে দোলে’।আবার কলাপাতার কথাও বলেছেন। যেমন- ‘মুটে আনে সরা খুরি কলাপাতা’। এখানে তিন ধরনের আধারের কথা সহজ ভাবে পর পর উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয় পাঠে- একই ভাবে শব্দ বিন্যাসের মূর্চ্ছনায় ও শব্দের তালে তালে একটি সামাজিক সম্পর্কের কথাও গদ্যে উল্লেখ করেছেন। যেমন- ঐ সাদা ছাতা। দাদা যায় হাটে,..মামা আনে চাল-ডাল। মা বলে, খাজা চাই, গজা চাই, আর চাই ছানা,…আশা দাদা তার ভাই, কালা কাল ঢাকা ফিরে যাবে। এরপরের কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ গ্রাম প্রকৃতির এক নৈস্বর্গীয় আনন্দের কথা তুলে ধরেছেন।

নাম তার মতিঝিল, বহুদূর জল,
হাঁসগুলি ভেসে ভেসে করে কোলাহল।
পাঁকে চেয়ে থাকে বক, চিল উড়ে চলে,
মাছরাঙা ঝুপ্ করে পড়ে এসে জলে।

আবার একটি রাত্রির শেষে বর্ণনা করেছেন একটি সুন্দর কবিতায়।

কালো রাতি গেল ঘুচে,
আলো তারে দিলমুছে।
পুব দিকে ঘুম ভাঙা
হাসে উষা চোখ রাঙা

………………

জলে জলে ঢেউ ওঠে
ডালে ডালে ফুল ফোটে।

এখানে রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার সময় পরপর আকাশ, আলো, সূর্য, জল, ফুল ও পাখির মধ্যে কি কি ঘটনা ঘটে অর্থাৎপ্রকৃতি কিরূপ সেজে ওঠে তা একটি দিনের বর্ণনা এই আঠারো লাইনের কবিতায় তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

চতুর্থ পাঠ-এ দুই থেকে চারটি অক্ষরে শব্দ নিয়ে একটি গ্রামের চিত্রএঁকেছেন। চলো ভাই নীলু। এই তালবন দিয়ে পথ। তারপরে তিলখেত। তারপরে দিঘি। জল খুব নীল। ধারে ধারে কাদা। জলে আলো ঝিলমিল করে।বক মিটিমিটি চায় আর মাছ ধরে।পরের কবিতাটিতে গ্রামের একটি পাড়ার বর্ণনা করেছেন কয়েক লাইনের কবিতায়। যেমন গাছপালা, দিঘির কথা তুলে ধরেছেন, তেমনি আবার কোথায় কে কি কাজে ব্যস্ত তাও কবির চোখ এড়ায়নি।

ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি
আছে আমাদের পাড়াখানি
দিঘি তার মাঝখানটিতে

তালবন তার চারিভিতে।

……………………

ঢেঁকি পেতে ধান ভানে বুড়ি
খোলা পেতে ভাজে খই মুড়ি।
বিধু গয়ালানি মায়ে পোয়
সকাল বেলায় গোরু দোয়।

আঙিনায় কানাই বলাই
রাশি করে সরিষা কলাই
বড়োবউ মেজোবউ মিলে
ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে।

নদী-দিঘি, জল-জমি, বন-জঙ্গল, আকাশ-বাতাস, ঋতু-বৈচিত্র, চাঁদ-সূর্য, গাছপালা-জীবজন্তু, ফুল-ফল, পাখী ও মানুষকে নিয়ে আরও অনেক কবিতা ও গদ্যের মধ্যে সহজ ও নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেনসম্পূর্ণ সহজপাঠ জুড়ে। যেমন পরের কবিতা ও গদ্যাংশগুলি হল- আজ খুব শীত। কচুপাতা থেকে টুপ টুপ করে হিম পড়ে।ঘাস ভিজে। পা ভিজে যায়। দুখি বুড়ি উনুন-ধারে উবু হয়ে বসে আগুন পোহায় আর গুন গুন গান গায়।

আমলকী-বন কাঁপে, যেন তার
বুক করে দুরু দুরু।
পেয়েছে খবর,পাতা- খসানোর
সময় হয়েছে শুরু।

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
…………………………

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভরো ভরো
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
…………………………

দুই কুলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে মেতে ওঠে পাড়া।

পৈতে হবে চিঠি পেয়ে মৈনি মাসি আজ এল। মৈনিমাসি বৈশাখ মাসে ছিল নৈনিতালে। তাকে যেতে হবে চৈবাসা। তার বাবা থাকে গৈলা।…………

কাল ছিল ডাল খালি
আজ ফুলে যায় ভরে।
বল দেখি তুই মালী
হয় সে কেমন করে।

ভোর হল। ধোপা আসে। ঐ তো লোকা ধোপা। গোরাবাজারে বাসা। ওর খোকা খুব মোটা, গাল ফোলা।

দিনে হই এক মতো রাতে হই আর,
রাতে যে স্বপন দেখি মানে কী যে তার।
আমাকে ধরিতে যেই এল ছোট কাকা ।
স্বপনে গেলাম উড়ে মেলে দিয়ে পাখা।

দুই হাত তুলে কাকা বলে, থামোথামো।
যেতে হবে ইস্‌কুলে, এই বেলা নামো।

উপরের কয়েকটি কবিতা ও গদ্যে যে কেবল ঋতু বৈচিত্র, প্রাকৃতিক ও সমাজিক পরিবেশকে শিশুদের কাছে তুলে ধরেছেন শুধু তাই নয়। গ্রামের পুজো ও উৎসবের কথাও বলেছেন। সেখানে যে সমস্ত স্থান – এর নাম উল্লেখ করেছেন তার অবস্থানও পরোক্ষভাবে এর গুরুত্বর কথাও বলেছেন। আবার ব্যক্তি নামের মধ্যে ধরা পড়েছে তার আর্থিক অবস্থা ‘দুখি বুড়ি’ ও তার পরিস্থিতির কথা। যেমন উনুন-ধারে উবুহয়ে বসে আগুন পোহায় আর গুন গুন গান গায়। সহজ পাঠের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পাতায় নজর রাখলে ধরা পড়ে কী সুন্দরভাবে রবীন্দ্রনাথ শিশুদেরকে পরপর বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণেরসঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছেন। আবার আ-কার, ই-কার, ঈ-কার, উ-কার, ঊ-কার, ঋ-কার, এ-কার, ও-কার, ঔ-কার এর যে ব্যবহার তা ধীরে ধীরে কবিতা ও গদ্যের মধ্যে অত্যন্ত সুন্দর ও সহজভাবে দুটি বা চারটি বর্ণের মধ্যে তুলে ধরেছেন। যেমন–

আ-কার– রাম বনে ফুল পাড়ে। গায়ে তার লাল শাল। হাতে তার সাজি।

ই-কার—বিনিপিসি,বামি আর দিদি ঐ দিকে আছে।

ঈ-কার– বুড়ি দাসী আনে জল। ………বনে নদী ছিল, ও নিজে গিয়ে জল খেত। দীনু এই পাখি পোষে।
উ-কার– জবা ফুল তোলে, বেল ফুল তোলে। বেল ফুলসাদা, চুপ করে বসে ঘুম পায়। চলো ঘুরে আসি। ফুল তুলে আনি।

ঊ-কার– বেলা হল। মাঠ ধু ধু করে। থেকে থেকে হূ হূ হাওয়া বয়। দূরে ধুলো ওড়ে। চুনি মালী কুয়ো থেকে জল তোলে। আর ঘুঘু ডাকে ঘূ ঘূ।

এ-কার– বেলা যায়। তেল মেখে জলে ডুব দিয়ে আসি। তারপর খেলা হবে। একা একা খেলা যায় না। ঐ বাড়ি থেকে কয়েকজন ছেলে এলে বেশ হয়।

ঐ-কার– শৈল এল কৈ? ঐ যে আসে ভেলা চড়ে, বৈঠা বেয়ে। ওর আজ পৈতে। ও কৈলাশ, দৈ চাই। ভাল ভৈষা দৈ আর কৈ মাছ। শৈল আজ খৈ দিয়ে দৈ মেখে খাবে।

ও-কার– ভোর হল। ধোবা আসে। ঐ তোলোকাধোবা। গোরাবাজারে বাসা। ওর খোকা খুব মোটা, গাল ফোলা।

ঔ-কার–- এসো, এসোগৌরীএসো। ওরে কৌলু, দৌড়ে যা। চৌকিআন্। গৌর, হাতে ঐ কৌটো কেন?ঐ কৌটো ভরে মৌরি রাখি। মৌরি খেলে ভাল থাকি।

চন্দ্রবিন্দু–বাঁশ গাছে বাঁদর। যত ঝাঁকা দেয়। ডাল তত কাঁপে। ওকে দেখে পাঁচুভয় পায়, পাছে আঁচড় দেয়।

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।

‘সহজপাঠে’ সামাজিক পরিবেশের মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলে ধরেছেন আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যের ভেদা-ভেদের ছবি। অভাবী জাত পেশায় শত মানুষের দুঃখময় দিনযাপন। আবার ধনীব্যক্তির আড়ম্বরপূর্ণ সামাজিক আচার অনুষ্ঠানও। প্রথম উদাহরণ স্বরূপ দুটি কবিতায় ফুটে উঠেছে অভাবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।

মধু রায়
খেয়া বায়।

জয় লাল
ধরেহাল।

অবিনাশ
কাটে ঘাস।

হরিহর
বাঁধে ঘর।

পাতু পাল।
আনে চাল।

দীননাথ
রাঁধে ভাত।

গুরুদাস
করে চাষ।

ঐ যায় ভোলামালী। মালা নিয়ে ছোটে। আবার একটি কবিতায় উল্লেখ্য-

ঢেকি পেতে ধান ভানে বুড়ি,
খোলা পেতে ভাজে খই মুড়ি।

বিধু গোয়ালানি মায়ো পোয়,
সকাল বেলায়গোরু দোয়।

এত দুঃখ দারিদ্রের জীবন-যাপনের সঙ্গে সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সহজপাঠের অষ্টম অধ্যায়ে এসেছে বিত্তশালীর কথা।

ঐকোঠাবাড়ি। ওখানে আজ বিয়ে। তাই ঢের ঘোড়া এল, গাড়ি এল, এক জোড়া হাতি এল। মেজো মেসো হাতি চড়ে আসে। ওটা বুড়ো হাতি। তার নাতি ঘোড়া চড়ে। কালোঘোড়া। পিঠে ডোরা দাগ। পায়ে তার ফোড়া, জোরে চলে না। ঢোল বাজে। ঘোড়া ঘোর ভয় পায়।

ধনী ব্যক্তিদের বিয়েতে কেমন আয়োজন হয়, কাদের সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এবং কী ধরনের যানবাহন লাগানো হয়েছে তার উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয়, এখানে শিশু মনে প্রশ্ন জাগে বুড়ো হাতি ও অসুস্থ ঘোড়াটিসম্বন্ধে। এই হৃদয়হীনতার ছবি তাদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। সঞ্চয় হয় করুণা। আবার পল্লিগ্রামে নানান সমস্যা, অভাব অনটনের অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকার প্রতিকূলতাকে মেনে নিয়ে জীবনের গতিতে বয়ে নিয়ে চলেছে। যেমন- হরি মুদি, চুনি মালী, বিধু গয়লানি ও তামিজ মিঞা।

সহজপাঠ — দ্বিতীয় ভাগ

সহজপাঠে দ্বিতীয় ভাগের শেষে যে পর্যন্ত বর্ণমালার সঙ্গে শিশুদের পরিচয় ঘটেছিল, ঠিক তারপরে পরেই সহজপাঠ–- দ্বিতীয় ভাগ-এ শুরু হয় বাকী বর্ণগুলির সাথে গদ্য ও কবিতার মাধ্যমে ধাপে ধাপে পরিচয়। যেমন – ঢং ঢং করে নটা বাজলো। বংশ ছাতা মাথায় কোথায় যাবে? আজ ‘আদ্যনাথ বাবুর কন্যার বিয়ে-তাঁর এই শল্যপুরের বাড়িতে। কেউবা ব্যাট্বলখেলছে। নিত্যশরণ ওদের ক্যাপ্‌টেন। রঙ্গলালবাবুও এখনি আসবেন। আর আসবেন তার দাদা বঙ্গবাবু।

এত সহজে ছোট ছোট শব্দ ও বাক্যপ্রয়োগে ও চয়নে বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষর শিশুদেরকে চেনানো ও এর ব্যবহার শেখানো যায় তা রবীন্দ্রনাথ বলেই সম্ভব হয়েছে। আর তাঁর পক্ষে আরও সম্ভব হয়েছে সহজপাঠে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে স্থান ও ব্যক্তিদের নাম নির্ধারণ-এর ক্ষেত্রে। যা আমাদের সকলকে মোহিত করে।

সহজপাঠ- দ্বিতীয় ভাগেও সুন্দরভাবে রবীন্দ্রনাথ ফুটিয়ে তুলেছেন পল্লিপ্রকৃতি ও পল্লিসমাজের নানান চিত্র। যা শিশুমনে গভীর দাগ কাটে এবং পরিচয় ঘটে প্রকৃতি, সমাজ ও সংস্কৃতির। কবিচেষ্টা করেছেন আমাদের এই রূপসী বাংলার রূপকে ছোটোদের কাছে তাদের মতো করে চেনাতে ও বোঝাতে। আর এই রূপের আড়ালে অবশ্য লুকিয়ে থাকা পল্লীসমাজের নানান দুঃখ, দারিদ্র, বঞ্চনা আর অপমানের কথাও। দ্বিতীয়ভাগে কবিতা ও গদ্যের মধ্যে উল্লেখ করেছেন ঋতু বৈচিত্রের কথা কবিতা ও গদ্যে বর্ণনা করেছেন। যেমন–

বাদল করেছে। মেঘের রং ঘন নীল।
বর্ষা নেমেছে। গর্মী আর নেই। থেকে থেকে মেঘের গর্জনআর বিদ্যুতের চমকানি চলেছে।

……………………

শ্রাবণ মাসের বাদ্‌লা। উস্রিতে বান নেমেছে।

সেদিন ভোরে দেখি উঠে
বৃষ্টি বাদল গেছে ছুটে,

রোদ উঠেছে ঝিল্‌মিলিয়ে
বাঁশের ডালে ডালে।

তিনটি শালিক ঝগড়া করে
রান্নাঘরের চালে।

শীতের বেলায় দুই প্রহরে
দূরে কাদের ছাদের প’রে

ছোট্ট মেয়ে রোদ্‌দুরে দেয়
বেগনি রঙের শাড়ি।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করতে ভোলেননি। এখানে দুর্গতি বলতে বন্যাকে তুলে ধরেছেন। যেমন – কর্ণফুলি নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। সর্ষে খেত ডুবিয়ে দিল। দুর্গানাথের আঙিনায় জল উঠেছে। তার দরমার বেড়া ভেঙ্গে পড়ল। বেচারা গোরুগুলোর বড়োদুর্গতি।

গাছপালা ও জীবজন্তু কবির প্রায় সমস্ত লেখায় পাওয়া যায়। যেমন-

ওইখানে মা পুকুর-পাড়ে
জিয়াল গাছের বেড়ার ধারে
হেথায় হববনবাসী,
কেউ কোথাওনেই।

………………

বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে-
আসবেনা কেউ তোমার কাছে,

অমনি যত বনের হরিণ
আসবে সারে সারে।

ওইখানেতে ময়ূর এসে
নাচ দেখিয়ে যাবে।

শালিকরা সব মিছিমিছি
লাগিয়ে দেবে কিচিমিচি,

কাঠবেড়ালি লেজটি তুলে
হাত থেকে ধান খাবে।

উল্লাপাড়ার মাঠেশেয়ালডাকছে হুক্কা হুয়া। এ ছাড়া উল্লেখ রয়েছে কুকুরের বাচ্চার ডাক, পেঁচার ডাক, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, বিড়ালের ডাক ইত্যাদি। কবি উল্লেখ করেছেন সংস্কৃতি চর্চার কথাও। সেখানে কংসবধের অভিনয় হবে। আজ মহারাজ হংসরাজ সিংহ আসবেন। কংসবধ অভিনয় তাকে দেখাবে। রবীন্দ্রনাথ বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ এক সামাজিক অনুষ্ঠানকে সহজপাঠে ঠাই করে দিয়েছেন। যেমন – আজ আদ্যনাথবাবুর কন্যার বিয়ে-তাঁর এই শল্যপুরেরবাড়িতে। কন্যার নাম শ্যামা। বরের নাম বৈদ্যনাথ। বরের বাড়ি অহল্যাপাড়ায়। ……… এখানে য-ফলা ও ই-কারের পর পর প্রয়োগ কত সুন্দরভাবে করেছেন তা সহজে অনুমেয়। আর এরকম শব্দের ব্যবহার অন্য কারোর লেখায় পাওয়া যায় না। এখন একটা খুব পরিচিত কবিতায় হাটের বর্ণনার দিকে চোখ রাখি তাহলে বোঝা যায় কি সুন্দর ও নিখুঁতভাবে একটা গ্রামীণ হাটের বর্ণনা চিত্রিত করেছেন। সেই সাথে চিত্রিত করেছেন প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ ও হাটের অবস্থানটিকে। আবার সহজপাঠের অন্য এক পৃষ্ঠায় লিখেছেন সুস্থ পরিবেশকে কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। এবং তার জন্য যৌথ প্রয়োগের কথাও বলেছেন। যেমন – আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন। সব ছেলেরা দঙ্গলবেঁধে যাবে।

আবার সহজপাঠের-চতুর্থ পাঠের গদ্যাংশে আতিথিয়তার কথা উল্লেখ পাই। যেমন চন্দননগর থেকে আনন্দবাবু আসলেন। তিনি আমার পাড়ার কাজ দেখতে চান। দেখো, যেন নিন্দা না হয়। ইন্দুকে বলে দিয়ো, তাঁর আতিথ্যে যেন খুঁত না থাকে। তাঁর ঘরে সুন্দর দেখে ফুলদানি রেখে। ……… গ্রামের প্রাকৃতিক শোভা যে কত মধুর ও হৃদয়স্পর্শী তা দশমপাঠে কবিতায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কয়েকটি পংক্তিতে।

বাঁশ- বাগানের মাথায় মাথায়
তেঁতুল গাছের পাতায় পাতায়
হাসায় খিলি খিলি।

হঠাৎ কীসের মন্ত্র এসে
ভুলিয়ে দিলে এক নিমেষে
বাদল- বেলার কথা।

আবার একাদশ অধ্যায়ে লিখেছেন এক গভীর জঙ্গলে বাঘ শিকারকে কেন্দ্র করে একদিনের সফর কাহিনী। এই গল্পের মধ্যে তুলে ধরেছেন নদী, নৌকা, মন্দির, খাওয়া দাওয়া, ঘোর অন্ধকারে বাঘের ভয়ে গাছে চড়ে রাত কাটানো, বাঘের দেখা পাওয়া, কাঠুরিয়ার আতিথিয়তা ও মানবিকতাবোধ। এসব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার স্যাপার। যা শিশুদের কচিমনের গভীরে রেখাপাত করে।

শিশুতোষ কবি রবীন্দ্রনাথ সহজপাঠে স্বপ্ন দেখার কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে শহর কলকাতার পথঘাট, ট্রামগাডি, দোকানপাঠ, হাওড়া ব্রিজের কথা উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, এই শহরের নানান স্থাপত্যর কথাও বলেছেন। শিশুদের যে পড়ার উপকরণ সামগ্রীকে স্বপ্নের মধ্যে কেমন দেখেছেন তার উল্লেখ করেছেন সাহিত্য রস দিয়ে। এই কবিতার শেষ দুই লাইন আরও বেশি মজার। তাহল –

কীসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল যেই-
দেখি, কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই।

সহজপাঠে দ্বাদশ পাঠে কবি উল্লেখ করেছেন লোকযান পালকিতে ডাক্তারের যাত্রাপথের নানা ঘটনা। যার মধ্যে জঙ্গলে ভল্লুক ও নদীতে কুমিরকে নিয়ে যে ঘটনা তা শিশু মনে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করে। সন্ধ্যায় রাস্তায় দেখা রাখাল বালক। অনেকটা পথ মাঠ পেরিয়ে শ্মশান। পালকি ভেঙে পড়া ও পরে ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই-এর যে লোমহর্ষক গল্প তা সত্যিকারের শিশুদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে তাদের অন্তরগ্রাহীতার বহিপ্রকাশ। আবার একটিছোট্ট কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন বাঙালীর দুর্গোৎসব ঠিক পূর্বেদূর-দুরান্ত এলাকা থেকে বাড়ি ফেরার দৃশ্য স্টিমার ঘাটে। এই কবিতার ছবির মত নিখুঁত দৃশ্যর কথা সাবলিলভাবে ছোটদের সামনে তুলে ধরেছেন। সেখানে বাদ পড়েনি চিনের নতুন জুতোর কসমস শব্দও। নদীরতীরে অন্ধবেনি বসে হাঁড়ি বাজিয়ে গানগাওয়ার দৃশ্যসহ অন্যান্য ছোট-খাট দৃশ্যের কথা অতি যত্নে তুলে ধরার জন্য কবিতাটির অন্যমাত্রা পেয়েছে। যেমন-

চলিল গোরুর গাড়ি, চলে পালকি ডুলি,
শ্যাকরা-গাড়ির ঘোড়া উড়াইল ধূলি।

সহজপাঠে পৃষ্ঠায় বাদ পড়েনি সমাজে দরিদ্র মানুষের সামাজিক দায়ভার ও কর্তব্যের কথা। এই দায়ভার অর্থাৎ কন্যার বিয়েকে নিয়ে। অভাবের তাড়নায় চুরি করতে গিয়ে অত্যাচারী জমিদারের কাছে লাঞ্ছনার শিকারের কথাও। যা শিশুমনে গভীরভাবে দাগ কাটে সমাজের চালচ্চিত্র ও ধনী দরিদ্রের বর্ণ বৈষম্যের কথা। সহজপাঠ- দ্বিতীয় ভাগের শেষ কবিতায়রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ণনা করেছেন এক নদীর তীরে হাট ও তার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার কথা। এর প্রতিটি লাইনে এক একটি পৃথক পৃথক দৃশ্যের কথা ভেসে ওঠে। যা বোধহয় আর কোনভাবেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যেমন –

অঞ্জনা- নদী-তীরে চন্দনীগাঁয়ে

পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জেরবাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল- ধরা – এক কোনে তারি

অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী।

এই কবিতায় কত মানুষের জীবন-জীবিকা ও নানারকমের প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হয়েছে। এখানে সমাজের নানান দিক নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন।রবীন্দ্রনাথ অন্ধ কুঞ্জবিহারীর দিনযাপনের কথা বলতে গিয়ে তার চারপাশের সমস্ত ব্যাপারটা তুলে ধরেছেন। সহানুভূতিশীল জমিদার সঞ্জয় সেন এর সম্পর্কেও বলেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহজপাঠের মধ্য দিয়ে সামাজিক ঐক্য, সামাজিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। যা শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশের ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য উপাদান। সহজপাঠে গ্রাম্য প্রকৃতির বর্ণনা,পরিবেশ সচেতনতা এমন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা শিশুকে পরিবেশের সাথে একাত্ম হতে সাহায্য করে।সহজপাঠে রবীন্দ্রনাথ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশকে চিনতে শিখিয়েছেন শিশু সাহিত্যের ভাব ও ভাষার মাধ্যমে। শিশুর অনুভব ও উপলব্ধির দ্বারা তাদের শৈশবের দরজা-জানলা খুলে দিয়েছেন।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ