| মাহমুদ নোমান |
ভাষার গীতলতা স্বতস্ফূর্তভাবে বয়ে গেছে কোনও টানাহেঁচড়ার বাতিক নেই, কোনও চমক দেওয়ার জন্য জোরজবরদস্তির পেট কষাকষি নেই, কেবলি গল্পের গতি প্রকৃতি বুঝে পূর্ণতার দিকে ভাসান ভেলা জীবন নামের মুহূর্তের নদীতে; আন্তরিক বলনে চেনা অচেনা পরিবেশ পরিস্থিতি সহজ সরলে বলে দিতে পারার সৌন্দর্যে মুগ্ধ করেছে সুলেখক লুনা রাহনুমা; উপরোক্ত কথাসব আওড়ানো কেবল লুনা রাহনুমার সৃষ্টি ‘ সুখ নদী দুখ নদী’ উপন্যাস পাঠ পরবর্তী উপলব্ধি…
আমি মনে করি একজন লেখকের সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ভাষা। বলা যেতে পারে ভাষা ব্যবহারে লেখকের পরিচয়। গল্পটি আপনার কাছে গুরুত্ব বহনে একেকরকম হতে পারে এটা স্বাভাবিক কিন্তু ভাষায় গল্পটির উপস্থাপনা মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়; লুনা রাহনুমার ভাষার সুষম বণ্টন পাকাপোক্ত, সাদামাটার মধ্যে লাবণ্য ধরে, ভাষার মধ্যে আত্মিক উপলব্ধি সঞ্চার করে অন্তত মানুষের জন্যই, মানুষের কথাগুলোই সাহিত্য এটি উপস্থাপন করে লুনা রাহনুমা;
‘ সুখ নদী দুখ নদী’ উপন্যাসে প্রত্যেক মানুষ যে একটা নদী বয়ে বেড়ায়, নয়তো দুখে জল আসে কোত্থেকে আবার সুখে হেসে উঠে যেন সেই নদী, চিকচিক করে উঠে। তাহলে সেই নদীটা মূলত উপলব্ধির, উপভোগ আর অনুভবের; তবে লুনা রাহনুমা বললো যে ‘সুখ নদী আর দুখ নদী’ তাহলে নদী কী দু’টো! নাহ্, নদী একটাই- ঐ যে বললাম উপলব্ধি, উপভোগ আর অনুভবের নদী; হ্যাঁ, একটাই নদী যখন সুখ আসে সুখের যখন দুঃখ আসে তখন দুখের নদী ধারণ করে। এখানে উপন্যাসের নামকরণে লুনা রাহনুমা মনোজগতের বিশ্লেষণে চমৎকার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন…
‘সুখ নদী দুখ নদী’ উপন্যাসের চরিত্রগুলো আর পরিবেশ খুব পরিচিত লেখকসমাজের এমনকি পরিস্থিতি পর্যন্ত খুব চেনাজানার। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর যৌবনকাল আর বৃদ্ধ হওয়া কেবল শাহবাগ নিউমার্কেট মিরপুর উত্তরা এসব এলাকায় ঘুরপাক খেয়েছে। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র মণিকার পিছপিছ কেবল একবার আয়ারল্যান্ডের পরিবেশ উপস্থিত হয়েছে মণিকার প্রথম পুরুষ শুভ’এর বদৌলতে; এমন চেনাজানা পরিবেশের জন্য এই উপন্যাসে পাঠকের মনঃসংযোগ স্থাপনটা সহজাত ঘটে যেন;
০২.
‘ সুখ নদী দুখ নদী’ উপন্যাসের কাহিনী তেমন চমকপ্রদ কিছু ঘটায়নি সত্যি তবে উপস্থাপনা আর সংস্কৃতি-ঐতিহ্য মানুষের চাওয়া-পাওয়া এমনকি উপলব্ধি অনুভবের প্রকাশ ঘটেছে নানন্দিকতার কৌমার্যে; এই কাহিনী পাঠকের নয়তো পাঠকের আপনজনের মনে হবে সুনিশ্চিত। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র মণিকার জীবন কাহিনী বলা যায় এই উপন্যাসকে। মণিকার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু শুভ এর সাথে প্রেম পরিণয় আর দুই পরিবারের অজান্তে কাজি অফিসে গিয়ে নিজেরা নিজেরা বিয়ে করা এই উপন্যাসকে শুরু এনে দিয়েছে। তবে বলনে লুনা রাহনুমা মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন যেন দক্ষ পরিচালক একেকটা দৃশ্য নিজের মতো করে দেখিয়েছেন। যেমন উপন্যাসের শুরুতে মণিকা সাজতে বসেছে দ্বিতীয় প্রেমিক অন্তুর জন্য, অন্তুর জন্মদিনে অন্তুর সাথে বিয়ের দিন ধার্য করা দিনেই হঠাৎই শুভ উপস্থিত অনেক বছর পরে, কী টানটান টিউনিংয়ে এমন চরিত্রে উপস্থিতি এনেছেন, যেই ঘটনাটি অনেক আগে ঘটে গেছে কিন্তু এনেছে পরে অথবা মাঝখানে, এটিই উপন্যাসকে করেছে বিশিষ্ট; যেমন – সবাই মুরগি রান্না করে তবে একেকজনের হাতের স্পর্শে স্বাদ কীভাবে বদলে যায়, এখানেই রান্নার বাহাদুরি…
০৩.
শুভ সময় চেয়েছিল কিন্তু মণিকা শুভকে সময় দেয়নি একটা চাকরি পেয়ে বেকারত্ব ঘোচানোর, কেননা মণিকার মনে সাময়িক উত্তেজনা কিংবা সোনালি সময়েরই ঢেউয়ে শুভকে হারানোর ভয় আঁকড়ে ধরেছিল। কাজি অফিসে বিয়ের পরে যে যার ঘরে এসে কেউ ঘরে জানায়নি, কেননা শুভ এক বছর সময় চেয়ে নিয়েছে। এরমধ্যে শুভ স্কলারশিপ পেয়ে আয়ারল্যান্ড গেছে, সেখানে ঘটে উপন্যাসের মূল সমস্যাটা- আয়ারল্যান্ডে গ্রিনকার্ড কিংবা উন্নত জীবনের আশায় আয়ারল্যান্ডের নাগরিক এন্ড্রিয়াকে বিয়ে করে বসে শুভ! এরপরে মনের দূরত্ব বজায় রেখে চলে মণিকা চাপাকান্নায়; এরমধ্যেই নতুন করে জীবন শুরু করতে অন্তুর সাথে সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে পরিচয় একসময় প্রেমে উপনীত হলে একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেদিন শুভ সরাসরি বিদেশফেরত হয়ে মণিকার বাসায়! উপন্যাস জমে যায় – অন্তুর জন্মদিন উপলক্ষে রেস্টুরেন্টে দেখা করে সেদিন বিয়ের দিন ধার্য করার কথা,সেদিনই জানান দেয় মণিকার আগে একবার বিয়ে হয়েছে প্রথম পুরুষ প্রথম স্বামী হচ্ছে শুভ; উপন্যাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয় আরও অন্তু হঠাৎ প্রেমিকা মণিকার গোপন কথা মণিকার মুখে এতোদিন পরে শুনে বাজে গালিতেও ক্ষান্ত হচ্ছে না যেন; সম্পর্ক এতে দুইদিকে চলে যায়, এদিকে শুভকেও আর গ্রহণ করার ইচ্ছে জাগছে না ক্রোধে কিংবা অভিমানে। এরপর ফুপু রুনুর দেখামতে বশির আহমেদের সাথে মণিকার বিয়ে হয় অর্থাৎ তৃতীয় পুরুষ আর দ্বিতীয় স্বামী। বশির আহমেদের সাথে ভালোই কাটছে মণিকার এমনকি দুজন পোড়খাওয়া মানুষের দুজনেই সহাবস্থান। কেননা বশির আহমেদের প্রথম স্ত্রী ডেলিভারির সময় মারা গিয়েছে। ফলস্বরূপ কণ্যা সন্তান তৃণাকে পেয়ে মণিকার সময় বেশ যাচ্ছে। সুখের নদী তখন যেন টইটম্বুর। এরপর হঠাৎই বশির আহমেদের মৃত্যু উপন্যাসের মোড় ঘুরিয়েছে, আবার হাহাকার মণিকার জীবনে। এখানে ছায়ায় আশ্রয় হয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো বন্ধুদের এক জায়গায় বসে মাসের একটা দিনে আড্ডা, সেখানেই আবার শুভ এর সাথে দেখা। এইদিকে শুভও সিঙ্গেল। আয়ারল্যান্ডের নাগরিক এন্ড্রিয়ার সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেক আগে। সেই ঘরে ম্যাট নামের একটা ছেলে আছে। ম্যাটকে দেখতে যায় মণিকা আর শুভ। এন্ড্রিয়া দেখতে আসে বয়ফ্রেন্ড জেমসকে নিয়ে। কী খোলামেলা কথাবার্তা অতীত নিয়ে বর্তমানের বাস্তবতার সামনে। এমনকি ম্যাট একটা রাত থাকেনি শুভ আর মণিকার রাত যাপনের ইমোশনে ব্যাঘাত ঘটবে বলে! এমন ভাবা যায় আমাদের সমাজে? আমাদের সমাজ আর ইউরোপের সমাজের ভাব-গতিক চমৎকার দৃশ্যকাব্যে তুলে ধরেছেন লেখক লুনা রাহনুমা….
শেষজীবনে শুভ আর মণিকা একসাথে জীবন কাটাতে লাগল। এদিকে তৃণাকেও বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তৃণার পছন্দের অনিকের সাথে। গাজীপুরে শুভ নির্মাণ করেছে শুভ-মণি নামের প্রাসাদ,সেখানে পুরনো বন্ধুদের এখন আড্ডা স্থল, শেষদিকে এসে লেখকের উপলব্ধি স্মরণযোগ্য-
‘মহাবিশ্বের কাছে ক্ষুদ্র কণিকার মতো এই সামান্য কিছু সৃষ্টি মাতোয়ারা হয় নিজেদের উল্লাস উদযাপনে,কালের সময়ের সময়ের কাছে যা হয়তো মুহূর্তের ভগ্নাংশ মাত্র। তবুও তো এমনই হয় মানুষের জীবন। এমনই তো হ জীবনের নানা আপস এন্ড ডাউনস। একেক স্তরে জীবন আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিলেও আরও বেশি করে ফিরিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না তৃপ্তিদায়ক ঐশ্বর্য, পুনর্বার,বহুগুণে। একদিন নির্দয়ের মতো কেড়ে নেওয়া সময় তাই আবার মিলিয়ে দিয়ে যায় ভালেবাসার মানুষকে জীবনের সাথে বুকের কাছে, পরম নিবিড়তায়, মমতায়,অনুরাগে, অনুষঙ্গে, আশ্লেষে,প্রেমে ও ক্ষমায়। এই জীবন বয়ে চলার পথে কাছে আসে অনেক মানুষ, আবার দূরে চলে যায় অনেকে…..’
ভাষায় আন্তরিকতা আর বোধের আলো ছড়িয়ে দিয়ে মননের মাধুর্য প্রস্ফুটিত হয় লুনা রাহনুমার লেখায়। বেশ স্মার্ট শব্দগুচ্ছে টানটান ভাষার কথন, সহজে হৃদয় পশে….
|||
সুখ নদী দুখ নদী
লুনা রাহনুমা
চলন্তিকা প্রকাশন
প্রচ্ছদ- সজীব ওয়ার্সী
মূল্য ৩০০টাকা