প্রবীর বিকাশ সরকার
লিটল ম্যাগাজিন। আদর করে অনেকে বলেন লিটল ম্যাগ। বাংলায় ছোটকাগজ। কি অর্থে ছোট? সেই তো ঢাউস ঢাউস সাহিত্য ম্যাগাজিনও বের হয়। কোন্ মানদন্ডে ছোটকাগজ তা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। লিটল ম্যাগাজিন শব্দটি কবি বুদ্ধদেব বসু প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায় তাঁর এক প্রবন্ধে। তখন বুদ্ধদেব বসু আমেরিকা সফরে গিয়ে লিটল ম্যাগ দেখেছিলেন, পড়েছিলেন সেটাই তিনি নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায় বলে প্রতীয়মান হয়। অথবা কোনোক্রমে মার্কিন দেশীয় লিটল ম্যাগাজিন জাতীয় সাহিত্য কাগজ তাঁর হাতে এসে থাকবে। লিটল ম্যাগাজিন প্রথম কি আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল? জানা নেই, তবে অনেকে মনে করেন আঠারো শতকের মাঝামাঝি আমেরিকার বোস্টন শহর থেকে প্রকাশিত ‘ডায়াল’ কাগজটিই প্রথম লিটল ম্যাগ। এরপর নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘লিটল রিভিউ’র কথাও জানা যায়।
ভারত উপমহাদেশের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন কোনটা, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ নাকি প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’? উনিশ শতকে একাধিক সাহিত্য কাগজ প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য হলো, শনিবারের চিঠি, সওগাত, শিখা, কালিকলম, পরিচয়, পূর্বাশা, কবিতা, চতুরঙ্গ প্রভৃতি।
আমার সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের প্রথম পরিচয় ১৯৭৬ সালে। এর আগে জানতাম না এই সম্পর্কে দরকারও পড়েনি। তখন খুব শুনতাম ‘সংকলন’ শব্দটি। তাতে থাকে কবিতা, ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ। কোনো-কোনোটা ছড়ার সংকলন, কোনোটা কবিতার, কোনোটা গল্পের ইত্যাদি। কিন্তু সংকলন আর ছোটকাগজ মনে হয় এক জিনিস নয়। যদিওবা দুটোই মুদ্রিত জিনিস।
সাহিত্যের ইতিহাসে পড়েছি দেশে-বিদেশে যুগে যুগে বড় বড় কবি ও লেখকরা লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ থেকেই উঠে এসেছেন প্রতিষ্ঠার মঞ্চে। আমি যা লিখেছি ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত খুব কমই লিটল ম্যাগে লিখেছি তবে হাতীয় দিবসভিত্তিক ছড়া সংকলনে বেশ ছড়া লিখেছি একসময়, তখন সেটা একটা রীতি গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর। অবশ্য আমি বড় কোনো লেখক হতে পারিনি বা নই। হওয়ার ইচ্ছেও নেই। রাজা হয়ে গেলে রাজকীয় ঝামেলা-ঝক্কিও অনেক। নিচু হয়ে থাকাই নিরাপদ ও বন্ধুসুলভ।
তাই বলে লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ পড়ি না তা নয়, বরং আমার যথেষ্ট স্নেহ ও দুর্বলতা আছে এই প্রকাশনা মাধ্যমটির প্রতি কৈশোর থেকেই। জানি না ঠিক কেন? জাপানেও বিস্তর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়ে থাকে। প্রচুর কবি, প্রচুর লেখক এগুলোতে লিখে থাকেন। প্রচার সংখ্যাও হাজার হাজার। বিশেষ করে কবিতা ও চিত্রকলার ছোটকাগজগুলো অসাধারণ! অধিকাংশই ইনার পেইজ সাদাকালো তবে প্রচ্ছদ ও বিজ্ঞাপনগুলো বহুরঙা। প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও ম্যাগগুলো বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকে। বৈচিত্র্যময়, সুখপাঠ্য কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ থাকে অনেক। সঙ্গে মনোহরা রঙিন ও সাদাকালো অঙ্কন, ইলাস্ট্রেশন। অনেক লিটল ম্যাগকে স্বল্পায়ু নিয়ে হারিয়ে যেতেও দেখেছি। জাপানে একটি জিনিস খুব সহজলভ্য সেটা হলো কাগজ। কত বিচিত্র রঙের ও রকমের কাগজ যে এদেশে আছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ফলে লিটল ম্যাগগুলো কাগুজে বৈচিত্র্যের কারণে দেখতে যেমন চোখে আরাম লাগে তেমনি সংরক্ষণ করতেও ভালো লাগে।
বাংলাদেশের প্রতিটি শহরের আনাচে কানাচে লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ প্রকাশিত হয়ে থাকে। লেখায় ও রেখায় অবশ্যই সমৃদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা এবং হাত মকশো করার জন্য লিটল ম্যাগ নিরাপদ মাধ্যম। অবশ্য বিপদের আশঙ্কা যে একেবারে নেই তা নয়, তা নির্ভর করে সময় ও পরিস্থিতির ওপর। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রচুর লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়। লিটল ম্যাগ পুরস্কারও প্রদান করা হয় সরকারিভাবে। ২০০৭ সালে নন্দন চত্ত্বরে লিটল ম্যাগ মেলা দেখে বিস্মিত হয়েছি প্রাচুর্যতার কারণে। ওখানে বহু লিটল ম্যাগ এখনো সিল্ক স্ক্রিণ প্রিন্টে হয়ে থাকে। তাই উৎকট একটা গন্ধ করে যেটা ভালো লাগে না। তবে লেখাগুলো ভাবনার উদ্রেক করে। অনেক লিটল ম্যাগ আমি একাধিকবার কিনে নিয়ে গিয়েছি জাপানে দুই বাংলা থেকে। বন্ধুদেরকে বিলিয়ে দিয়েছি।
একসময় কলকাতাকেন্দ্রিক বেশকিছু লিটল ম্যাগ নতুন এবং পুরাতন সংখ্যা পড়তাম যেমন অনুষ্টুপ, চতুরঙ্গ, শিলাদিত্য, জিজ্ঞাসা, কৃত্তিবাস, নবকল্লোল, পরিচয়, কবিতা, কালিকলম, পূর্বাশা ইত্যাদি। বাংলাদেশেও কয়েকটি বিখ্যাত লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ একসময় ছিল যেমন মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, সমকাল, কিছুদিন রৌদ্রের মুখোমুখি, রূপম প্রভৃতি। একসময় চট্টগ্রামকে বলা হতো লিটল ম্যাগের রাজধানী, বহু ম্যাগাজিন রূপেবৈচিত্র্যে ও মনআনচানকরা লেখায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই সংস্কৃতির যৌবন এখন ঝুলে গেছে । সংরক্ষণের অভাবে সেগুলোর পাতাগুলো ঠোঙা বা চানাচুর আর বাদামের মোড়ক, কিংবা রেস্টুরেন্টের প্লেট ও হাত মোছার ন্যাপকিনস্বরূপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে কবেই!
জাপানে যেভাবে মুদ্রিত বস্তু এবং প্রকাশনাগুলো সংরক্ষণ হয়ে থাকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে তা কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতে হয় না। জাপানে পোস্টার শিরিয়োওকান বা পোস্টার জাদুঘর যেমন আছে তেমনি আছে প্রচারপত্র বা হ্যান্ডবিল সংরক্ষণ জাদুঘর। আবার সারাদেশ জুড়েই আছে অসংখ্য সাহিত্য জাদুঘর। ফলে এদেশের অগণিত কবি, সাহিত্যিক ও গবেষকরা হারিয়ে যান না যেটা হরহামেশা হচ্ছে উপমহাদেশে। কত কবি, লেখক ও সাহিত্যিকের মূল্যবান রচনা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছেও প্রতিদিন কে তার হদিশ রাখে।
বেশ কয়েক বছর আগে কুমিল্লা শহরস্থ জগৎখ্যাত রামমালা গ্রন্থাগারে অসংখ্য লিটল ম্যাগ দেখেছিলাম এলোমেলোভাবে টেবিলের ওপর স্তুপ হয়ে আছে। পুরনো যেমন ছিল তেমনি আনকোড়া নতুন কাগজও ছিল। যেমন পূর্বাশা, অলক্ত, আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী, সে আমি তুমি, অশ্রু হলো বারুদ, আপন, জাগৃতিসহ অনেক ঋতুভিত্তিক কৃশকায় সাহিত্য সংকলনও। এগুলোর কোনো যত্ন নেয়া হয় না বলেই প্রতীয়মান হয়েছিল। এখন কি রকম আছে কে জানে। নোনাও ধরে যেতে পারে। পুরো মহেশাঙ্গনটাই এখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে যেটা আসলে এরকম ছিল না কখনোই। রামমালা গ্রন্থাগার এখন পরিত্যক্ত না পাঠনিষিদ্ধ বোঝা মুশকিল।
এটাও সত্য যে, বাঙালির পাঠবিমুখতা ইতিহাসখ্যাত। আর এখন প্রযুক্তির যুগে আরও তথৈবচ অবস্থা। লিটল ম্যাগ এখনো বের হচ্ছে ঠিকই আগের মতো অগণিত নয়, প্রচারসংখ্যাও যেমন কম তেমনি চলে বলেও মনে হয় না। আগ্রহটা নেই তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যের প্রতি। তারা যে কি পড়তে ভালোবাসে বোঝা মূশকিল! সেবা প্রকাশনীর বই খোঁজে কিশোর-কিশোরীরা কিন্তু সেগুলো কি সাহিত্য? জানি না। আমরাও কৈশোরে অনেক রহস্য বা গোয়েন্দা সিরিজের বই দেদারসে গিলেছি যেমন দস্যু শশধর, দস্যু বাহরাম, দস্যু মোহন, দস্যু বনহুর, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্য গল্প, অদ্রীশ বর্ধন কিংবা ডাঃ নীহাররঞ্জন রায়ের রহস্যপোন্যাস অথবা ভৌতিক, ডাকাতির গল্প কম পড়িনি। সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা সিরিজও অনেক পড়েছি। কিন্তু পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম, দ্বীজেন্দ্রলাল, শরৎ, ফাল্গুণী, বনফুল, তারাশঙ্কর, প্রভাতকুমার, জরাসন্ধ, দৃষ্টিপাত, যাযাবর, ইকবাল, কায়কোবাদ, ফররুখ, গোলাম মোস্তফা, বন্দে আলী, জসীমউদ্দিন প্রমুখের লেখাও পড়েছি। এগুলো এখন যদিওবা ক্লাসিক। এখনকার ছেলেমেয়েরা নামও জানে না। গ্রন্থাগার নেই অধিকাংশ বিদ্যালয়ে, থাকলেও প্রবেশ করতে দেয়া হয় না ছাত্রছাত্রীদেরকে। মাদ্রাসার কথা আর বলে লাভ নেই।
একসময়কার দেয়ালপত্রিকা বা দেয়ালিকা কিংবা স্কুল ম্যাগাজিন সংস্কৃতি এখন বিলুপ্ত। এই ধারা চলতে থাকলে একসময় লিটল ম্যাগ কালচারও লুপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে হয়।