মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র হিসেবে ‘শতভিষা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে, আলোক সরকার ও দীপংকর দাশগুপ্তের যৌথ সম্পাদনায়। এঁদের সঙ্গী ছিলেন তরুণ মিত্র। সম্পাদকের নাম পত্রিকায় ছাপা হত না। প্রকাশক হিসেবে দীপংকর দাশগুপ্তের নাম ছাপা হত। কবিতা পত্রিকা সে সময়ে ছিল মাত্র দুটি। বুদ্ধদেব বসু-র ‘কবিতা’ (১৯৩৫) আর শুদ্ধসত্ত্ব বসু সম্পাদিত ‘একক’ (১৯৪১)। ষোল পৃষ্ঠার স্বল্প কলেবরের ‘শতভিষা’ প্রকাশের পরে পরেই আরো বেশ কয়েকটি কবিতা পত্রিকা প্রকাশের উৎসাহ বাড়ে। এর দুবছরের মধ্যে প্রকাশিত হয় ‘কৃত্তিবাস’ (১৯৫৩)।
‘শতভিষা’র প্রকাশ সম্পর্কে পরবর্তীকালে আলোক সরকার লেখেন, ‘বুদ্ধদেব বসু-র ‘কবিতা’ সেই ধরনের কবিতা বিষয়েই পক্ষপাত প্রমাণ করতো যা তিরিশের দশকের কবিদেরই প্রতিধ্বনি, নতুন কোনো কাব্যআন্দোলন যে শুরু হতে পারে, এমন ধারণা ‘কবিতা’ পত্রিকার ছিল না। এই অবস্থায় ‘শতভিষা’ যা আধুনিকতাকে প্রবহমানতার অর্থেই একদিক থেকে গ্রহণ করেছিল, তার প্রকাশ যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল সেটা বুঝতে পারা যায়।’ (‘শতভিষা’ রজতজয়ন্তী সংখ্যা, ১৩৮৬)।
‘শতভিষা’র প্রথম সংখ্যায় তরুণ কবিদের পাশাপাশি প্রবীণ কবিদের কবিতা, বিদেশি কবিতার অনুবাদ ছাপা হয়। পত্রিকা শেষে যুক্ত ‘পূর্বরঙ্গ’ নামের সম্পাদকীয় গদ্য। ‘শতভিষা’র পক্ষে এটি লেখেন দীপংকর দাশগুপ্ত। সেখানে ঘোষিত হল ‘রসোত্তীর্ণ’ কবিতাকেই তাঁরা মর্যাদা দিতে চান; তার বিষয়বস্তু ‘চাঁদ ফুল পাখি’ কিংবা ‘মিছিল ধর্মঘট’ যা-ই হোক। কেন এই কথাগুলি সেদিন ‘শতভিষা’-কে বলতে হয়েছিল এর উত্তরের মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে ‘শতভিষা’র সময়কালের প্রেক্ষিতটি নিহিত। এক সাক্ষাৎকারে দীপংকর দাশগুপ্ত জানান, ‘এটা বলেছিলাম এই জন্যে যে তখন ‘অগ্রণী’ ‘পরিচয়’ ইত্যাদি যে সব কাগজ ছিল ‘বিপ্লবী কবিতা চাই’, ‘জনগণের কবিতা চাই’ ইত্যাদি সব বলত। তাতে কোনো আপত্তির কারণ নেই কিন্তু সেটাই লিখতে হবে এবং একমাত্র সেটাই লিখতে হবে’ আপত্তি এখানেই। (‘কথা’ মাঘ, ১৪০০। এই বক্তব্য বিষয়টি আলোক সরকার আরও স্পষ্ট করেন একই সাক্ষাৎকারে, ‘সেই সময় তথাকথিত বামপন্থী কবিতার খুব একটা জোরালো আন্দোলন চলছিল। সেই সময় অনেকেই ওই ধরনের কবিতা লিখতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। আমরা কখনো এটা ভাবতাম না যে এই রকম কবিতা লিখলেই তিনি খুব খারাপ কবি। তবে এ রকম যে লিখতেই হবে এরকম কোনো শর্ত গ্রহণ করতে আমরা রাজি ছিলাম না।’ এবং তখনই আলোক সরকারদের মনে হয়েছে ‘আমরা কবিতাকে আবার কবিতার কাছে ফিরিয়ে আনব।’ কবিতাকে বহির্জাগতিক কোলাহল থেকে অন্তর্মুখীনতার দিকে, শুদ্ধতার দিকে নিয়ে আসাটাই ছিল ‘শতভিষা’-র আত্মপ্রকাশের প্রধান উপলক্ষ।
‘শতভিষা’র প্রথম পরিকল্পনা নেন আলোক সরকার এবং দীপংকর দাশগুপ্ত, রাসবিহারি আর মহিশুর রোডের মোড়ে একটি ছোট্টো চায়ের দোকানে। পরে পরিকল্পনাটি প্রসারিত হয় আলফা কাফে-র আড্ডায়। সেখানে আড্ডা দিতেন সমকালের বিভিন্ন পেশার ও নেশার মানুষেরা। শুরু থেকে ‘শতভিষা’র সঙ্গে যারা ছিলেন, প্রায় সকলেই আলফা কাফে-র সদস্য। আলোক সরকার তখন সদ্য বি.এ. পাশ করা বেকার যুবক, দীপংকর দাশগুপ্ত দৈনিক ‘গণবার্তা’র শিক্ষানবিশ সাংবাদিক, মাসিক দশ টাকা হাত খরচ পান। এদের সঙ্গে আলফা কাফেতে আড্ডায় বসেন তরুণ মিত্র, শংকর চট্টোপাধ্যায়, অজিত বকসী, অশেষ চট্টোপাধ্যায়, বিমল রায়চৌধুরী, সত্যেন্দ্র আচার্য, নন্দদুলাল ভট্টাচার্য। আলোক সরকার লিখেছেন, ‘দীপংকরের মাসিক দশ টাকা আয় আছে, আমার পোস্ট অফিসে দশ টাকার অ্যাকাউন্ট ছিল, তার থেকে পাঁচ টাকা তোলা গেল, তরুণ মিত্র দিল তিন টাকা, সত্যেন্দ্র আচার্য তিন টাকা, রণজিৎ সেন তিন টাকা–চব্বিশ টাকা দিয়ে কাজ শুরু হল।’ দীপংকর দাশগুপ্ত সংগ্রহ করে আনেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা; অরুণকুমার সরকারের খাতা থেকে কবিতা চুরি করেন আলোক সরকার। ‘তরুণ মিত্র-অশোক মুখোপাধ্যায়ের মাস্টারমশাই’ নরেশ গুহ-র কবিতা পাওয়া গেল। কবিতা নেওয়া হল অরবিন্দ গুহ-র কাছে। অরবিন্দ গুহ তখনি বিখ্যাত তরুণ কবি। মৃণালকান্তি তখনও পরমানন্দ সরস্বতী হননি। তাঁর কবিতা সংগ্রহ হল। মানস রায়চৌধুরী, কল্যাণ সেনগুপ্ত, পূর্ণেন্দুবিকাশ ভট্টাচার্য, শংকর চট্টোপাধ্যায় এদের কবিতা নেওয়া হল। মানস রায়চৌধুরী তখন স্কুলের ছাত্র। ১৯৫১-র সেপ্টেম্বরে ‘শতভিষা’-র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল ‘শারদীয়া সংকলন ১৩৫৮’ হিসেবে। মূল্য ছয় আনা। কভারে ‘প্রেস থেকে ধার করা ব্লকের ছবি’; সূচিপত্র নেই, পৃষ্ঠা সংখ্যার উল্লেখ নেই। অ্যান্টিক কাগজে ছাপা ছোট্টো এক ফর্মার পত্রিকা। বিজ্ঞাপনবিহীন। সম্পাদকের নাম অনুল্লেখিত। প্রকাশক দীপংকর দাশগুপ্ত। প্রকাশস্থান ১-এ, বিজয় মুখার্জি রোড, কলকাতা-২৬। মুদ্রক পূর্ণিমা প্রেস, ৪৮-এ, হালদার পাড়া রোড, কলকাতা-২৬। প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
দুটি কবিতা’। এদের পাশাপাশি তরুণ কবি অরবিন্দ গুহ, কল্যাণ সেনগুপ্ত, আলোক সরকার। ‘ওঁরাও এবং সাঁওতালী কবিতা অবলম্বনে’ ‘লোকগীতিকা’ নামের কবিতা মানস রায়চৌধুরীর। তরুণ মিত্রের অনুবাদে ইয়েটস-এর ‘The Lover Tells of the Rose in His Heart’। সব শেষে ‘পূর্বরঙ্গ’ নামে সম্পাদকীয় গদ্য। প্রথম সংখ্যা প্রকাশের ঠিক তিন মাস পরে দ্বিতীয় সংখ্যা ১৩৫৮ প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যার কবিদের পাশাপাশি আরও নতুন কবিরা এলেন বটকৃষ্ণ দে, সত্যেন্দ্র আচার্য, কবিতা সিংহ প্রমুখ। প্রথম সংখ্যায় ঘোষিত লেখার বিষয়বস্তু, পত্রিকার কলেবর পরবর্তী সংখ্যাগুলিতে সাধারণভাবে অপরিবর্তিতই থাকে। ষোল পৃষ্ঠার পরিসরে নবীন প্রবীণদের কবিতা, অনুবাদ কবিতা, কবিতা বিষয়ক গদ্য। ক্ষীণকলেবর বৈশিষ্ট্য-উজ্জ্বল ‘শতভিষা’-র প্রকাশ সম্পর্কে ‘কৃত্তিবাস’ (১৩৬৪, বৈশাখ) এ লেখা হয় ‘সাম্প্রতিককালের কবিদের বিশেষ অন্তরঙ্গ পত্রিকা শতভিষা। এই অনতি প্রচারিত জাঁকজমকহীন পত্রিকাটিতে কোনো বিজ্ঞাপন গ্রহণ করার রীতি নেই, পৃষ্ঠা সংখ্যা মুদ্রিত থাকে না, অধিকাংশ সংখ্যাতেই প্রবন্ধের স্থান সংকুলান হয় না, শুধু কবিতা এবং পুস্তক সমালোচনা। শতভিষা-ই সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র পত্রিকা যা পাঠক বা ক্রেতার মুখাপেক্ষী নয়। শতভিষা শুধু কবিদের পত্রিকা।’
তিনজন ‘শতভিষা’র সম্পাদনার কাজ দেখতেন। আলোক সরকার, দীপংকর দাশগুপ্ত এবং তরুণ মিত্র। আলোক সরকার শুদ্ধ কবিতায় আগ্রহী, অতিরিক্ত মননধর্মী এবং অন্তর্মুখী। দীপংকর দাশগুপ্ত পরিশীলিত ছান্দসিক, আধুনিক। ‘বানান বিষয়ে, ছন্দ বিষয়ে দীপংকর চিরদিন কট্টর আধুনিক কিন্তু সেই আধুনিকতা কোনো উন্মত্ততা নয়, যুক্তিবহ শৃঙ্খলাবদ্ধ ক্রমঅগ্রসরমানতা, নির্বোধ অশিক্ষিত ভেঙেচুরে দেবার প্রয়াস নয়’— লিখেছেন আলোক সরকার। তরুণ মিত্র ছিলেন বিদেশি সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক। ‘শতভিষা’-র পাতায় তাঁর অনুবাদ কবিতা, বিদেশি সাহিত্য পর্যালোচনায় তার পরিচয় ছড়িয়ে আছে। অন্য সম্পাদকদ্বয়কে এবিষয়ে সব সময় তিনি ওয়াকিবহাল রাখতেন। পঞ্চাশের কবিরা পরবর্তীতে যারা প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন তাদের প্রায় সকলেই শতভিষা’য় প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। ‘শতভিষা’র তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশের আগে দীপংকর দাশগুপ্ত অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতা চেয়ে চিঠি লেখেন। তৃতীয় সংখ্যায় ছাপা হয় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতা ‘আমার ঠাকুমা’। এরপর থেকে ‘শতভিষা’র পাতায় অলোকরঞ্জনের অবিরল আত্মপ্রকাশ। আলোক সরকার লিখেছেন, ‘একবার একটি কবিতায় অলোকরঞ্জন ‘বাঁশি’ বানানে দীর্ঘ ই-কার
ব্যবহার করেছিলেন, ছাপানোর সময় দীপংকর হ্রস্ব-ই করে ছাপেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে খুব সাময়িক ছোটোখাটো একটা মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।’ অলোকরঞ্জন ‘শতভিষা’য় নিয়মিত লিখলেও আলোক সরকার কিংবা দীপংকর দাশগুপ্তের সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় ১৯৫৩-র শেষের দিকে। এরপর থেকে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ‘শতভিষা’র বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ‘শতভিষা’র দুটি সংখ্যা (চতুর্বিংশ, বৈশাখ ১৩৬৬ এবং অষ্টাবিংশ ফাল্গুন, ১৩৬৮) সম্পাদনাও করেন। একই সময়ে ‘শতভিষা’-র ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে ওঠেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। ১৯৫৪-র পর থেকে প্রণবেন্দু ‘শতভিষা’র নিয়মিত লেখক। ১৯৫৪-৫৮ অবধি ‘শতভিষা’কে ঘিরে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, তরুণ মিত্র, দীপংকর দাশগুপ্ত আলোক সরকার। ‘শতভিষা’য় প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১১ সংখ্যক শারদীয়া ১৩৬১ সংখ্যায়। কবিতার নাম ‘প্রতিশ্রুতি’; কবিতার একটি লাইনে ‘কাম’ শব্দটি ছাপার ভুলে ‘কাজ’ হয়ে যায়।যেহেতু তখন সবার ধারণা ‘শতভিষা’ ইন্দ্রিয়-উত্তেজক কবিতার বিরোধী, তাই প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের ধারণা এই শব্দবদল ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়। কিন্তু আলোক সরকার পরবর্তীকালে জানান, ‘ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, কোনো ভিত্তিই নেই।’
১৯৫৬ থেকে ‘শতভিষা’য় সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত লিখতে শুরু করেন। ১৯৫৭-তে তারাপদ রায়। তারাপদ রায় সে সময় ‘শতভিষা’ এবং ‘কৃত্তিবাস’ দুটিতেই নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করে ‘কৃত্তিবাস’-এ লেখেন, ‘দুটি পত্রিকার (‘শতভিষা’ এবং ‘কৃত্তিবাস’) সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত তারাপদ রায়। তাঁর বিবাহের পর তাঁর স্ত্রী যখন সত্তানসম্ভবা হন, সেই সময়েই তিনি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে তাঁর কন্যা জন্মালে নাম রাখা হবে শতভিষা, পুত্র হলে কৃত্তিবাস।’ (‘কৃত্তিবাস’ অক্টোবর-নভেম্বর, ১৯৭৬)।
দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুধেন্দু মল্লিক, উৎপলকুমার বসু, কবিতা সিংহ, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন ‘শতভিষা’র নিয়মিত লেখক। তুলনায় কম লেখা ছাপা হয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। বিনয় মজুমদার শেষের দিকে নিয়মিত লিখেছেন। ষাটের দশকের সামসুল হক, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, মৃণাল দত্ত, রত্নেশ্বর হাজরা, কালীকৃষ্ণ গুহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, পুষ্কর দাশগুপ্ত, সুব্রত রুদ্র, রাণা চট্টোপাধ্যায়, পরেশ মণ্ডল এঁরাও নিয়মিত। ‘শতভিষা’ ষষ্ঠ সংকলন শীত-বসন্ত ১৩৫৯ সংখ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা ছাপা হয়, ‘ঝর্নাকে’। পরবর্তী সময়ে আলোক সরকার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘১৯৫২ সালের শেষ দিকে ‘শতভিষা’র পঞ্চম সংকলন প্রকাশের আগে আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামের একজন কবির কবিতা পাই। তাঁর নাম আগে কখনো শুনিনি; কিন্তু কবিতা পড়ে দীপংকর উচ্ছ্বসিত। এরপর থেকে যখনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা এসেছে দীপংকরের সমান উচ্ছ্বাস দেখেছি।’ কিন্তু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রেরিত কবিতা পছন্দ হয়নি দীপংকর দাশগুপ্তের, ছাপতেও কুণ্ঠা। কিন্তু আলোক সরকার আবার শক্তির কবিতার পক্ষে। ‘শতভিষা’য় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম আত্মপ্রকাশ ষোড়শ সংকলন বসন্ত ১৩৬২ সংখ্যায়। কবিতার নাম ‘যুবরাজ’।
‘শতভিষা’য় শঙ্খ ঘোষের প্রথম লেখা ছাপা হয় ১৩৬৬-র ২৪তম সংখ্যায়। কবিতার নাম ‘ঘর’। ‘শতভিষা’ সম্পাদকদের স্বীকারোক্তি, ‘আমরা তাঁর কবিতা পেতে চাইতুম কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না। তাঁর ঠিকানা সংগ্রহ করতে করতেই ‘শতভিষা’র অনেকগুলি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে গেল।’ ‘শতভিষা’য় জীবনানন্দ দাশের প্রথম লেখা পাওয়া যায় চতুর্থ সংখ্যায় – শরৎ ১৩৫৯-এ। কবিতার নাম ‘রশ্মি এসে পড়ে’। এরপর থেকে তাঁর বেশ কয়েকটি লেখা ‘শতভিষা’য় পাওয়া যায়। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় কবির শেষ প্রকাশিত কবিতা ছাপা হয় ‘শতভিষা’র ১১নং সংকলনে, ‘কার্তিকের ভোরে ১৩৪৫’ এই নামে। বুদ্ধদেব বসু-র ‘কবিতা’ পত্রিকায় পরে কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয় অন্যান্য আটটি কবিতার সঙ্গে। (দ্রঃ ‘কবিতা’ পৌষ, ১৩৬১)। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতা সংগ্রহের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আলোক সরকার, ‘জীবনানন্দের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে একদিন সাহস করে এগিয়ে যাওয়া গেল। সরু গলি দিয়ে ঢুকে দরজার কড়া নাড়তেই এলেন উঁচু করে কাপড় পরা, কাপড়ের খুঁট গায়ে জড়ানো স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি। এই জীবনানন্দ দাশ, রাসবিহারি এভিনিউ-এর পথে অসংখ্যবার দেখেছি, কাপড়ের কোঁচা শক্ত হাতে ধরে আড়চোখে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে পথ চলেছেন। ‘শতভিষা’র জন্যে কবিতা চাইতে বল্লেন, আর কে কে লিখছে? প্রেমেন লিখছে? আমি বললুম উনি তো কবিতা তেমন লেখেন না, গান লেখেন। শুনে দেড় মিনিট ধরে এক অলৌকিক হাসি হাসতে থাকলেন, সে হাসিতে সমস্ত শরীর কাঁপে, দাঁত দেখা যায় না। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন এক সপ্তাহ পর কবিতা দেব। ঠিক এক সপ্তাহ পরেই দিয়েছিলেন। আমরা যতবার তাঁর কাছে কবিতা চেয়েছি, কখনো ফেরাননি।’ বিষ্ণু দে নিয়মিত লিখেছেন ‘শতভিষা’য়। ‘প্রুফ দেখাবার কঠোর নির্দেশ’ জানিয়ে বুদ্ধদেব বসুও কবিতা দিতেন নিয়মিত। লিখতেন ‘পূর্বাশা’ সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। সুদুর বস্টন থেকে কবিতা পাঠাতেন ‘বাঙালিবাবু’ অমিয় চক্রবর্তী। লিখতেন অজিত দত্ত-ও। ‘শতভিষা’র প্রত্যেক সংখ্যায় কবিতাগুচ্ছের পাশাপাশি থাকতো কবিতা বিষয়ক গদ্য, কবিতাগ্রন্থের সমালোচনা। কখনো বিদেশি কবিতা পর্যালোচনা। গদ্যগুলি লিখতেন আলোক সরকার, তরুণ মিত্র, দীপংকর দাশগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, পূর্বসূরি অরুণকুমার সরকারও ‘শতভিষা’য় গদ্য লিখেছেন। ‘শতভিষা’ কখনো কোনো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেনি। কেবল ২৯ সংখ্যাটি (পৌষ, ১৩৬৯) ছিল একটি গদ্য সংখ্যা। ততদিনে ‘কৃত্তিবাস’-এর ১৬ নং সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ‘যৌনকাতর’ ক্ষুধার্ত সেই সংখ্যার প্রতিক্রিয়ায় কবিতা কেমন হবে এবিষয়ে ‘শতভিষা’র দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করতেই ২৯ সংখ্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই সংখ্যায় তিনটি প্রবন্ধ ছাপা হয়; অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘স্থির বিষয়ের দিকে’, আলোক সরকারের ‘শিকড় অভিলাষী চৈতন্য’ এবং দীপংকর দাশগুপ্তের ‘কবিতা: আধুনিক কবিতা’। ওই সংখ্যাতেই ঘোষণা করা হয় ‘শতভিষা’ থেকে ছয়টি প্রবন্ধের একটি সংকলন প্রকাশিত হবে ‘কবিতার স্বাধিকার’ নামে। এতে লিখবেন অরবিন্দ গুহ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, আলোক সরকার, তরুণ মিত্র, দীপংকর দাশগুপ্ত এবং শঙ্খ ঘোষ। পরে সংকলনটি সম্ভবত আর প্রকাশিত হয়নি। ‘শতভিষা’ প্রকাশলগ্ন থেকেই ছিল বাহুল্যহীন। কোনোরকম বিজ্ঞাপনিক উচ্চকণ্ঠ তার ছিল না। তাই নিজেদের উদ্যোগ-আয়োজনের অনুষ্ঠান, তার সংবাদ পরিবেশনেও তার ভাষা সংযত, বাহুল্যবর্জিত, অবিজ্ঞাপনিক। ‘শতভিষা’র চেহারার মধ্যেও ছিল বাহুল্যহীনতার ছাপ। সমকালে ‘কৃত্তিবাস’ অঙ্গসৌষ্ঠবে ঝকঝকে, নিপুণ তার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা, প্রকাশ পরিকল্পনা। পাশাপাশি ‘শতভিষা’র প্রচ্ছদপট আড়ম্বরহীন, সাধারণ লিপিকরণমাত্র। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ ছিল প্রেসের লেটারিং-এর ব্যবহার। তৃতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ করেন অজিত বকসী। চতুর্থ সংখ্যা থেকে নবম সংখ্যা পর্যন্ত অশেষ চট্টোপাধ্যায় কৃত লেটারিং-এর ব্যবহার। দশম থেকে সতেরো সংখ্যা পর্যন্ত প্রচ্ছদ লিপিকার মণীন্দ্র মিত্র। ১৮-২৬ সংখ্যার প্রচ্ছদ শিল্পী সমীর রায়। ২৭ থেকে ৪০ সংখ্যা পর্যন্ত প্রচ্ছদ শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত।
১৩৫৮ শারদীয়া সংকলন থেকে শুরু করে ১৩৭৯ চল্লিশতম সংখ্যা পর্যন্ত আলোক সরকারদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে ‘শতভিষা’য় সম্পাদকের নাম ছাপা হত না। ২৪ সংখ্যা পর্যন্ত (বৈশাখ, ১৩৬৬) প্রকাশক হিসেবে নাম ছাপা হয় দীপংকর দাশগুপ্তের। ২৫ সংখ্যা (অগ্রহায়ণ, ১৩৬৬) থেকে (২৮নং-এ আবার প্রকাশক দীপংকর দাশগুপ্ত) ৩১ সংখ্যা (আষাঢ়, ১৩৭১) পর্যন্ত প্রকাশক আলোক সরকার। ৩২ সংখ্যা (মাঘ, ১৩৭১) থেকে ৪০ সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে তরুণ মিত্রের নাম। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৩ অবধি ‘শতভিষা’ নিয়মিত যথাসময়ে প্রকাশিত হত বছরে চারটি সংখ্যা। ১৯৫৩ থেকে বছরে দুটি। এবং এর পরে অনিয়মিত প্রকাশ। ১৯৬৪ সালের পর আর একবার নতুন উদ্যমে আবার শুরু করেন সম্পাদকত্রয়। কিন্তু আলোক সরকার জানিয়েছেন ততদিনে তিনি ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত। পাশাপাশি ‘কৃত্তিবাস’ তখন কবিদের কাছে বিশেষ জনপ্রিয়। তরুণ কবিদের উচ্ছ্বাস ‘কৃত্তিবাস’কে কেন্দ্র করে। ‘শতভিষা’ কোনোদিনই সর্বসাধারণের পত্রিকা হতে চায়নি, জনপ্রিয়তাও তার আকাঙ্ক্ষা নয়। ‘শতভিষা’ সম্পর্কে যাঁরা আগ্রহী তাঁরা স্বীয় প্রচেষ্টায় পত্রিকা সংগ্রহ করবেন।’ ১৯৬৭-তে প্রকাশিত ৩৫তম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে এই কথাগুলি যে একটা ক্লান্তি-অবসাদ থেকে, একটা অভিমান থেকে, আলোক সরকার পরে তা স্বীকার করেছেন। মানস রায়চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে যথার্থই বলেন, “কৃত্তিবাস’ বড় রাজপথের, আর শতভিষার রাস্তাটা নিঃসঙ্গ গলি সেখান দিয়ে মানুষ একা হেঁটে যাচ্ছে এরকম একটা নিঃসঙ্গতার ব্যাপার শতভিষার সর্বাঙ্গে ছিল। …’শতভিষা’ কিন্তু একটা বিশেষ স্বাদের, বিশেষ ভঙ্গির এবং বিশেষ আত্মআবিষ্কারের নমুনা তুলে ধরতে পেরেছে সর্বকালের কাছে, যতই শীর্ণ তার অস্তিত্ব হোক, যা সেই সময়কার কিছু সংখ্যক কবির কাছে, যা পরবর্তীকালেও খুব একটা কম আকর্ষণীয় ছিল না। যদিও কৃত্তিবাস অনেক বেশি এবং অনেক উল্লেখযোগ্য কবির জন্ম দিয়েছে পরবর্তীকালে, সে হিসেবে ‘শতভিষা” হয়তো তেমন আন্দোলন হয়ে ওঠেনি। অত মৃদু উচ্চারণ দিয়ে আর যাইহোক আন্দোলন তৈরি করা যায় না।’ (‘নির্বেদ’ সংকলন ২৫, অক্টোবর ১৯৮৬)। সত্যি অর্থে ‘শতভিষা’ শেষের দিকে ছিল অনিয়মিত, অল্প পরিসর, ফলে সব কবিদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী হতে পারেনি। কোনোরূপ অতিকথন তার ছিল না। বিলিব্যবস্থা ছিল দুর্বল। এসব কারণে প্রথম দিকে অনেক কবি ‘শতভিষা’কে আশ্রয় করেছিলেন তাঁরা চলে যান অন্য প্ল্যাটফরমে। ‘শতভিষা’ জন্মলগ্ন থেকেই আধুনিকতার বোধটিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চেয়েছে। আধুনিকতাকে ‘শতভিষা’ দেখেছিল প্রবহমানতা অর্থে। যা ব্যক্তিত্ব চিহ্নিত,নতুন তাই আধুনিক। এবিষয়ে ‘শতভিষা’র বক্তব্য, “শতভিষা’ প্রকাশের সময় আমরা আধুনিকতার প্রকৃত তাৎপর্যের কথা মনে রেখেছিলুম। আধুনিকতার অন্তর্লীন সত্য নির্মাণনিবেশী বিশ্লেষণী মন্ময়তা, কিন্তু দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে আধুনিকতা ক্রমঅগ্রসরমানতার ধর্মে দীক্ষিত।… কেবল সংস্কারবশত প্রাচীনতাকে পরিহার করা যেমন নির্বুদ্ধিতা, সেইরকম সমসাময়িক আধুনিকতাকে আঁকড়ে ধরে থাকা। আমরা এটা স্পষ্টই বুঝেছিলুম একজন শিল্পীর কাছে সমসাময়িক কাল, সমসাময়িক শিল্পধারণা নিশ্চিতই প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অস্বীকার্য।’ (‘শতভিষা’ রজতজয়ন্তী সংখ্যা, ১৩৮৩) বুদ্ধদেব বসুর ‘অতিরিক্ত যৌনচেতনা’, সমর সেনের নগরমনস্ক সপ্রতিভতা কিংবা জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-র কাব্যপ্রতিন্যাস তাঁদের অপ্রয়োজনীয় ও বহুব্যবহার পীড়িত মনে হয়েছিল। ‘শতভিষা’ ৩৩-এর সম্পাদকীয়তে বলা হল, ‘সময়ের হাতে তিরিশের দশকের কবিদের ব্যবহৃত কৌশলগুলির দিন যে ফুরিয়ে গিয়েছে ‘শতভিষা’ তা উপলব্ধি করেছিল’; তিরিশের দশকের কবিদের যৌনকাতরতা, মূল্যবোধে অনাস্থা, ব্যঙ্গবিদ্রুপ, অতিরিক্ত সমাজভাবনা, তরলকাব্যময়তা ইত্যাদি আপাত লক্ষণগুলি যে আর ব্যবহৃত হবার নয় এ সত্য অভ্রান্ত জেনে বাংলা কবিতার মুক্তির জন্য ‘শতভিষা’ প্রয়োজন অনুভব করেছিল নতুন পথসন্ধানের। ‘শতভিষা’ যে নতুন কবিতাভাবনার কথা ভেবেছিল একে আলোক সরকার বলতে চেয়েছেন ‘বিশুদ্ধ কবিতা’। অর্থাৎ যা কিছু কবিতা নয় তাকে কবিতা থেকে বাদ দিতে হবে। এর আগের দশক রাজনৈতিক আলোড়নে অস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মন্বন্তর, দেশবিভাগ উদ্বাস্তু সমস্যা এসবের আলোড়নে বাংলা কবিতা তখন অতি চিৎকৃত স্লোগানমুখর। এই পটভূমিতে ‘শতভিষা’র বিশুদ্ধ কবিতার ধারণা।
নিজেদের মধ্যে কোনোরকম পরামর্শ ছাড়াই ‘কৃত্তিবাস’-এর কবিরা লিখতেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ভাষায় ‘স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা’। ‘শতভিষা’র কবিরাও বিশেষ ধরনের কবিতাভাবনায় তাড়িত হয়ে কবিতা লিখতেন এবং এজন্য নিজেদের মধ্যে কোনো যৌথ পরামর্শ ছিল না নিশ্চয়। আলোক সরকার লিখেছেন, ‘পত্রিকা সম্পাদক কেন বলে দেবেন কীভাবে
কবিতা লিখতে হবে। তবে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ যেমন মূলত ছিল রবীন্দ্রপ্রভাব উত্তীর্ণ আত্মউজ্জীবিত কবিদের আসর, সেখানে জীবনানন্দ দাশের পাশাপাশি বিষ্ণু দে-র বসতে অসুবিধা হত না, আমাদের পত্রিকাও ছিল বিশুদ্ধ কবিতা অর্থাৎ অবিমিশ্র কবিতার ধর্মে দীক্ষিত। এই একটি সূত্র ‘শতভিষা’র সব কবিকে গ্রথিত
করেছে। এবং প্রাতিস্বিকতা, শিকড় নিবিষ্টতা। তা কোনোভাবেই পূর্বসূরিদের প্রভাব জীর্ণ নয়।’ কবিতার এই নতুন ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে চল্লিশের কবিদের মনে হয়েছে ‘বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্র ধারা প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে বিশেষ শক্তি সঞ্চয় করে ইতিমধ্যেই বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে।’ এই বক্তব্যের সূত্র ধরে অরুণকুমার সরকার ‘বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্র ধারা’ (শতভিষা-১৮) প্রবন্ধে জানান ‘শতভিষা’র কবিরা তিরিশের কবিতার পুনরুক্তি যেমন করেননি তেমনি চল্লিশের দশকের বিশৃঙ্খলা সংশয় যন্ত্রণার অপব্যয়িত সময়ের অনুরণন ঘটাননি। যা স্বাভাবিক সহজ স্বচ্ছন্দে তাকে গ্রহণ করেছেন এই কবিরা। এঁদের কবিতা যেমন যৌনতার উল্লাস নয়, তেমনি নয় প্রচলিত শাস্ত্রশাসনও। সময়ের সহজ ছন্দকে এঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন বলেই ‘আধুনিক হবার প্রয়োজনে এঁদের কাউকে নালানর্দমায় স্নান করতে হয়নি, আশ্রয় নিতে হয়নি উপর চালাকির।’ সমকালের দুটি কবিতা পত্রিকা ‘শতভিষা’ এবং ‘কৃত্তিবাস’-এর লেখকগোষ্ঠী প্রায় একই ছিল। এই দুটি পত্রিকার মধ্যে বাহ্যত কোনো বিরোধ কখনো দেখা যায়নি। কৃত্তিবাসের পাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, তরুণ কবিরা একটার পরিবর্তে দুটি পত্রিকা পেয়েছিল আত্মপ্রকাশের জন্যে। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের শেষে ষাটের শুরুতে ‘কৃত্তিবাস’-এর ১৬নং সংখ্যা প্রকাশিত হলে ‘শতভিষা’ এবং ‘কৃত্তিবাস’-এর মধ্যে একটা মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৬ সংখ্যার পর থেকে ‘কৃত্তিবাস’ অর্জন করে একটি রাগি চেহারা। যৌনতা পাপবোধ নরকবিলাসের অতি প্রাদুর্ভাবে ‘কৃত্তিবাস’ হয়ে ওঠে ‘ক্ষুধার্ত’ ‘কামার্ত’ কবিতার সংকলন। ‘শতভিষা’ এই ব্যাপারটি সমর্থন করেনি। ‘শতভিষা’র মতে ‘কৃত্তিবাস’-এর এই অতিরিক্ত জৈবিক প্রবণতা প্রকৃতপক্ষে, তিরিশের কবিতার পুনরাবৃত্তি, ‘কল্লোল’-এর ভাবনার দিকে মুখ ফেরানো। ‘কৃত্তিবাস’ ষোড়শ সংখ্যার প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশিত হয় ‘শতভিষা’-র ২৯ সংখ্যক গদ্য সংখ্যাটি। সেখানে লিখলেন আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, দীপংকর দাশগুপ্ত। আলোক সরকারের প্রবন্ধে বলা হল, ‘অভ্যাসের আনুগত্যে আজকের দিনের কিছু কবি কবিতায় এখনো তথাকথিত অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন, এমনকি সকল কবি এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে কামুক হয়ে ওঠেনি এই আক্ষেপ উচ্চারণ করছে এমন একাধিক কবিতা একবছরের মধ্যেই প্রকাশিত হতে দেখেছি। যা কিছু প্রাকৃতিক সত্য, যেমন আমাদের যৌনকামনা, বস্ত্রের অন্তরালে আমাদের শরীর, সকল অর্জিত সংস্কৃতি-সভ্যতার শাসনের ঊর্ধ্বে
আমাদের হিংস্র-লোলুপ স্বার্থপর কামুক প্রবণতাগুলির উচ্চারিত বিজ্ঞাপনিক তালিকা রচনায় উদ্ব্যস্ত।’ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখলেন, ‘তখনই আক্ষেপ না করে উপায় থাকে না যে ইতিহাস পুনরুক্ত হয় না জেনেও ঘড়ির কাঁটা কৃত্রিম আগ্রহে আবার পিছনে ফিরেছে বর্তমান নবীন কবিদের বড় একটি অংশ আবার বিগত প্রথম ও তৎপরবর্তী কবিতার কাছে, আধুনিকতার সহজপাঠ নিতে উদগ্রীব হয়েছেন। সেই অনুগামিতার ফল এই স্বকপোলকল্পিত অবক্ষয়, সস্তা দেহাত্মবাদ, বিকারোক্তি প্রবণতা, অতিকথন, বাইরে থেকে বলা, কুড়িয়ে পাওয়া অপ্রেমে জীবাত্মাকে ঝালিয়ে নেওয়া এবং ক্লিশে নিঃস্ব আরো অগণিত ইত্যাদি।’
আজকের বাণিজ্যিক পত্রিকা অনির্ভর লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের যে সম্পন্ন চেহারা, তার সূচনা করেছিল ‘শতভিষা’। ‘শতভিষা’র প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটি কবিতার কাগজ প্রকাশিত হয় রোহীন্দ্র চক্রবর্তীর ‘কবিতাপত্র’, সত্যেন্দ্র আচার্য অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর ‘সব শেষের কবিতা’, ভূমেন্দ্র গুহরায়, স্নেহাকর ভট্টাচার্য, জগদিন্দ্র মণ্ডলের ‘ময়ুখ’ এবং দুবছর পরেই ‘কৃত্তিবাস’। পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কবিপত্র’ কাগজটি যে ‘শতভিষা’র অনুপ্রেরণার ফসল তা জানা যায় সম্পাদকের বক্তব্য থেকে (‘কবিপত্র’-৪০)। এই কৃতিত্বের দাবি জানিয়ে ‘শতভিষা’-র ৩৩নং সংকলনের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘একটি কথা ভেবে শতভিষা বিশেষ গৌরব অনুভব করে। বাংলা সাহিত্যে আক্ষরিক অর্থে লিটল ম্যাগাজিনের ধারা শতভিষারই প্রবর্তন।’
১৯৫১ সালে ‘শতভিষা’ যে ষোলপাতার কবিতাপত্রিকা প্রকাশের শুরু করেছিল, তার ধারা বাংলা সাহিত্যে আজও অব্যাহত। ১৯৫১-র পর থেকে বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের ক্ষুদ্র পত্রিকা কত প্রকাশিত হয়েছে তার সংখ্যা নির্ণয় সহজ নয়। বাংলা সাহিত্যে এই ক্ষুদ্র পত্রিকাগুলির ভূমিকা অসামান্য। অল্প অর্থব্যয়ে ছোটোছোটো কবিদের দল তাদের মুখপত্র প্রকাশ করছে এবং প্রতিষ্ঠা অর্জন করছে। তাদের আর অশিক্ষিত ব্যবসায়িক পত্রিকাগুলির মুখাপেক্ষী হবার প্রয়োজন নেই। ‘শতভিষা’র আনন্দ এইটুকু যে সে-ই প্রথম এই ধরনের পথের নির্দেশ দেয়।’ ‘শতভিষা’র এই দাবি অসংগত নয়। অদ্বিধায় একথা বলা যায় স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যের জগতে ‘শতভিষা’ প্রথম যথার্থ কবিতাপত্রিকা। আজকের সম্পন্ন লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পথিকৃৎ।