প্রচ্ছদগদ্যশাকিল রিয়াজের কবিতা

লিখেছেন : ড. মাহবুব হাসান

শাকিল রিয়াজের কবিতা

ড. মাহবুব হাসান

জীবননান্দ দাশকে ইগনোর করেছিলেন তার সমকালীন কবিরা। এমন কি তার অনুজরাও তার দিকে ফিরে তাকাননি। ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে জীবননান্দ দাশকে আমরা আবিস্কার করি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে স্বাধীনতার পর। তার আগেও তিনি আলোচিত হয়েছেন বটে, তবে তার মাত্রাটা অবারিত ছিলো না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি তার লোকজ-সম্পাতি কবিতার পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে নয়া রূপে যেনো এলেন আমাদের পাঠকের চোখের সামনে, মনের দরোজায়, অন্তরের রাজা হয়ে।

শাকিল রিয়াজকে নিয়ে আমি ঠিক এ-কথাগুলো বলবো না। বলবো তার বন্ধুরা হয়তো চেনে শাকিলের কবিতার নৌপথ, জনপথ, কিন্তু আমরা যারা এক ছটাক বাড়তি বয়সী তারা তার দিকে সুদৃষ্টি দিইনি। কেবল জানতাম তিনি ভালো লেখেন, কিন্তু কতোটা ভালো লেখেন? ভালোত্ব মাপার তো কোনো ব্যারোমিটার নেই। মন্দেরও নেই। তার পরও আমরা ভালো বলতে কোনো মাত্রাহীন সৌন্দর্যকে বুঝি না, বুঝি সেই উপলব্ধি যা একজন কবিকে তার মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে। আর সেই মহিমাটা হচ্ছে তাকে, তার সৃজনী স্টাইলকে কোন পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমরা বিবেচনা করি/করবো তার ওপর। আমাকে বা আপনাকে কেন ভিন্ন দেশের ধরুন, ইউরোপের বা আমেরিকার লোকেরা এশিয়ান বলে বা সুচিহ্নিত করে কেন বাংলাদেশি বলেন? কারণ আমার চেহারসুরত দেখে তারা এটা করেন। কেউ কেউ নৃতাত্ত্বিকভাবেও বিবেচনা করতে পারেন। এখন শাকিলের কবিতা পাঠ করলে আমরা বুঝি তিনি বাংলা সংস্কৃতির অনুবর্তী চেতনার মানুষ। তার কালচারাল কন্টিন্যুআম তারই স্বাক্ষর দেয়। কিন্তু তিনি কেবলই তার দেশ ও পরিবেশ কেন্দ্রিক নন, তার চেতনাকাশ একই সাথে আন্তর্জাতিক চেতনারও অভিসারী। একটা নমুনা উদ্ধৃত করা যাক। 

“গ্রীষ্মের রাতদিন আর ধু-ধু দৃষ্টিপাত চিনে নিয়ে আমরা দুজনই শুধু এমন রোগগ্রস্ত সড়কে হেঁটে চলি। পানিষর দিকে যেতে চাই আমরা। এই পরিত্যাক্ত নগরে শুধু পিপাসার প্রশ্রয় আছে। পানির প্রতিশ্রুতি নেই।

এই দাবদাহে এই তৃষ্ণার ভ্রূক্ষেপে নিজস্ব পিপাসা কেন জাগিয়ে তুললে মৃন্ময়ী? যেতে যেতে বৃষ্টির ধ্বনির কথা ভাবতে গিয়ে পিপাসার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে উঠেছিলে তুমি।  

মনে আছে শুধু, তোমার সুন্দর কান্নায় আমি চেপে ধরেছিলাম আমার ঠোঁট। তুমি হেসে উঠেছিলে। আর আমি কেঁদে কেঁদে ভেবেছিলাম—

এই অশ্রুমোচনের র্স্পশকে কতটুকু চুম্বন বলা যাবে?” 

কথায় সাজানো এ-কবিতায় কি সেই আন্তর্জাতিক প্রেমের চিত্রল ছায়া ফুটে ওঠেনি যা ইউরো-মেরিকান কবিতায় মেলে ? গদ্যের ছাঁচে লেখা এটি। কিন্তু সেই গদ্যের শব্দগুলো যেন নতুন কোনো কথা বলছে। ‘পানির দিকে যেতে চাই আমরা। এই পরিত্যক্ত নগরে শুধু পিপাসার আশ্রয় আছে। পানির প্রতিশ্রুতি নেই।’

নগরটি পরিত্যক্ত, তাই কি পিপাসার আশ্রয় আছে বললেও আসলে তার কোনো প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি নেই। অর্থাৎ নগর মানুষের মৌলিক চাহিদাকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখে না, দেখতে শেখে না। নগর মূলত আত্মকেন্দ্রিক এবং নিষ্ঠুর। সেই নিষ্ঠুর পরিবেশের ভেতরেও মানুষের মানবিক ও জৈবিক বোধ ও তাড়নাকে অস্বীকার করা যায় না।

“গিটারে তোমার চোখ, মৃত্যুকামী তুমি

ডাগর অনুসরণ।

স্ক্রুর মত ঘুরে ঘুরে তোমার অবাধ্য চোখ আলগা হয়ে গেলো 

মৃত্যু পষ্ট হয় এই মতে। 

মৃত্যুর সামনে এসে জীবনটা বেঁকে বসে আছে

দোয়ার ভঙ্গিমায় আমি তাই 

দু’হাতে এনেছি বয়ে দশটি আঙ্গুল 

তুমি ধার নেবে দু’টি মুঠ এই ভরসায়।

দু’টি মুঠ! তুমি ধার নেবে এই ক্ষুধা?”  

কি কঠিন উচ্চারণ শাকিলের! ‘মৃত্যুর সামনে এসে জীবন বেঁকে বসে আছে’– জীবন যে মরতে চায় না, সে রাজি নয় এই পৃথিবী থেকে যেতে সেটাই বলতে চান শাকিল। ঠিক তার পরেই তিনি লেখেন ‘দোয়ার ভঙিমায় আমি তাই/দুহাতে এনেছি বয়ে দশটি আঙুল/ তুমি ধার নেবে দু’টি মুঠ এই ভরসায়’ — এখানে লোকশব্দ মুঠ যা প্রমিত বাংলায় মুঠি হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা জানি লোকবাংলায় একমুঠ চাল/ডাল ইত্যাদি। সেই লোকশব্দ শাকিল উপহার দিচ্ছেন কাকে? সে কি তারই প্রতিপালককে? প্রতিপালককে ধার দিতে চাইছে তার এক মুঠ দোয়া? কিন্তু তার আগেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, মৃত্যুকামীকে বলছেন কবি ‘স্ক্রুর মতো ঘুরে ঘুরে তোমার অবাধ্য চোখ আলগা হয়ে গেলো’। মৃত্যু নিয়ে এমন সহজ ও অসাধারণ চিত্রকল্পটি শাকিল আমাদের অভিজ্ঞতায় ঢুকিয়ে দিলেন যা ইতোপূর্বে আমার চোখে পড়েনি, বাংলা কবিতায়। গোটা কবিতার আবহ মৃত্যুকেন্দ্রিক আর উপস্থাপনার কায়দা সহজ ভঙিমার। আমার বোধের দরোজায় তাই পঙক্তিটি এসে সজোরে ধাক্কা দেয়। আমাকে স্ক্রুর মতোই যেন খুলে দেয় নতুন চেতনা ও দেখার সরল চোখ।

“আত্মহত্যার রাবার দিয়ে মুছে ফেলি আয়ু

জীবনকে মনে করি পাপ, হাতের পাতায় যতটুকু শ্বাস লেখা 

যতটুকু আয়ুর ভাগ্য, তা থেকে ঝরাতে চাই কোনো কিছু 

কে কুড়ায় এই ঝরা? কালো বক এসে জানায় আদাব।

করতল শয্যা হয় যদি, সে শয্যায় বিবাহ-রেখার পাশে 

আরেকটি ক্ষীণ রেখা হয়ে শুয়ে থাকি চুপচাপ

কে আমাকে ডাকে? ডেকে বলে, কতটা শুয়েছ মাঝি?

কতটুকু ভান? একটা প্রাণের মাঝে কতটুকু প্রাণ?”

‘আত্মহত্যার রাবার দিয়ে মুছে’ ফেলেছেন আয়ু শাকিল রিয়াজ। এই চিত্রভাষ্যটি একবার কল্পনা করুন প্রিয় পাঠক। আত্মহত্যা নামক সামাজিক রোগের দৃশ্যকল্পটিকে কি অনন্য মমতায় অক্ষরে শব্দে আর চেতনার সারাৎসার দিয়ে নির্মাণ করেছেন শাকিল। যারা মনে করেন চিত্রকল্পই কবিতা, তারা কিন্তু এটাকে সহজে মেনে নেবেন না। বলবেন এখানে চিত্র কোথায়? আমি বলি এখানে চিত্রকে ছাপিয়ে যে কল্পনাটি আমাদের বোধের দরোজায় হানা দিচ্ছে সেখানেই লুকিয়ে আছে এর মাধুর্য।

আবার ঠিক নিচের স্তবকেই দেখতে পাচ্ছি তিনি লিখছেন ‘করতল শয্যা হয় যদি, সে শয্যায় বিবাহ-রেখার পাশে/আরেকটি ক্ষীণ রেখা হয়ে শুয়ে থাকি চুপচাপ’—-করতলের রেখাগুলোকে নিয়ে এমন ভাবনা আমার অভিজ্ঞতার বাইরে। আয়ু রেখা নিয়ে অনেকেই কবিতা লিখে থাকবেন, কিন্তু সেখানে নিজেকে ক্ষীণ রেখা হয়ে শুয়ে থাকার অভিজ্ঞান কিন্তু অন্য এক মনোবাস্তবতার পথ দেখায় আমাদের। ঠিক এখানেই শাকিল অন্যদের থেকে আলাদা। এবং তার চেতনার নিরিখটি আপাতত মনে হয় সরল ও সোজা, কিন্তু আদপে সরল-সোজা কোনোটাই নয়। তিনি গভীরভাবে অন্বেষণ করেন জীবনকে, বাস্তবকে চেনেন নতুন চোখে দেখে এবং তাকে সেইভাবে বর্ণনা করেন তার ভাষায়।

“সংসার নিয়ে ভাংচুর যত খেলতে খেলতে 

দুটি কান্নায় তিনটি হাসিতে লুটিয়ে পড়তো 

             ছেড়া আর এক ছেড়িতে

সংসার মানে ভাংচুর তারা বুঝেছিল ঢের দেরিতে। 

কিভাবে বুঝলো ছেড়া আর ছেড়ি, ছেলেটি মেয়েটি?

শয্যার পাশে ছিল কি ছিল না

               চোখে তো ছিলই অভিলাষ

আজ গুণে দেখে সব মৃতবৎ

                মেয়েতে কান্না ছেলেটিতে উল্লাস।”

মানব জীবনের গূঢতম এলাকা হচ্ছে যৌবনকাল। এই বয়েসে কি হয়, কি হতে পারে এবং কতোরকম অভিমান ও ভুলচুক তারই এক দলিল যেনো এই কবিতা। প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে-সংসার, মান-অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি, অভিলাষ— সবই একসময় মৃতবৎ হয়ে ওঠে। মত-পার্থক্যের কারণে, পরস্পরের ভেতরে ইগোর কারণে নিজেদের চমৎকার যৌবনকালকে তারা মিসমার করে ফেলে। এ-কবিতা তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

শাকিলের জন্য আরো স্পেস দরকার, তার কবিতার রাজ্যে অনুপ্রবেশ দরকার আমাদের। কারণ একজন কবির হৃদয় হচ্ছে তার সৃষ্টি, তার অনুভবমালার নির্মাণ। সেই নিমাণের কারুকাজ চিনতে ও জানতে হলে চাই অভিনিবেশ আর সেই বোধ যা একজন পাঠকের কাছে আমরা দাবি করতে পারি।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. শাকিল রিয়াজ আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন কবি। তাঁর কবিতা নিয়ে চমৎকার আলোচনা বেশ ভালো লেগেছে। অনেক অনেক ভালোবাসা শ্রদ্ধেয় কবি মাহবুব হাসান ভাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা