spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যসর্বস্তরে বাংলা ভাষা

লিখেছেন : রফি হক

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা


রফি হক

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কথা বলি আমরা। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের অকপট ভালোবাসার কথাও বলি। কিন্তু আমরা নিজেরাই তা করিনা। মাতৃভাষার প্রতি যত রকমের হেলা, অবহেলা করা যায়, তা আমরা করি অবলীলায়। মাতৃভাষায় কথা বলা, মাতৃভাষাকে ভালোবাসা এটা সত্যি প্রেমের মতো। এরচে মধুর কিছু নেই দুনিয়ায়। একজন মানুষ— সে তাঁর মাতৃভাষায় কথা বলবে কি না বলবে— এটা তাঁর ব্যক্তিগত রুচির বিষয়। বিষয়টি ব্যক্তিগত হলেও তাঁর এই রুচির অভিপ্রায় থেকেই তাঁর দেশপ্রেম, দেশের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যের একটি পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। আরেকটু খুলে বলি—
.
আমি একজন বাংলাদেশের বাঙালি হিসেবে আমি ইংরেজিতে কথা বলব, নাকি হিন্দিতে কথা বলব সেটা আমার অধিকার। কেউ আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে জোর করতে পারে না যে তোমাকে বাংলা ভাষায় কথা বলতে হবে, বাংলায় লিখতে হবে, বাংলায় চর্চা করতে হবে। এটা বলার অধিকার নেই কারু। কারণ এই গ্লোবায়িত পৃথিবীতে আপনি স্বাধীন। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়—মানুষটা আপনি বাঙালি। বাংলাদেশ আপনার দেশ। দেশের প্রতি ভালোবাসার কী তুলনা হয়?
.
আমরা যারা বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি, যাদের মার্তৃভাষা বাংলা— আমাদের বাংলা চর্চা করা নৈতিকভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলা আমাদের প্রধান ভাষা, যার রূপ ও সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না, বিদেশে আমি প্লেনে করে এক শহর থেকে আরেক শহরে গিয়েছি শুধু বাংলাতে কথা বলবো বলে। শুধু আমি নই, আমার মতো লক্ষ লক্ষ প্রবাসী এমন লোক আছে।
অতুল প্রসাদের গানের মতো–
“মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।
তোমার কোলে, তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা”।…
.
রাজধানীতে প্রতি সপ্তাহে কোনও না কোনও আর্ট গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী হয়। খেয়াল করে দেখবেন, সেই চিত্র প্রদর্শনীর ‘শিরোনাম’, ‘উপশিরোনাম’ দেয়া হয় ইংরেজিতে। আমন্ত্রণপত্র থেকে ‘আর্ট-ক্যাটালগ, ব্রোশিউর, বা আর্টের বই পর্যন্ত ছাপা হয় ইংরেজিতে।
.
এগজিবিশনের শিরোনাম ও উপশিরোনাম এমনসব ইংরেজিতে দেয়া হয় যার অর্থ প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া শিল্পীরাও বলতে পারে না। যদি একজন শিল্পী হিসেবে, দর্শক হিসেবে যদি নাই ই বুঝলাম প্রদর্শনীর নামের অর্থ, তবে কেন এইসব শিরোনাম দেওয়া? তবে এই ধরণের প্রদর্শনী কি সাধারণ বাংলাদেশি দর্শকদের জন্য নয়? দেশের ৯৯% মানুষের জন্য নয়? কাদের জন্য তাহলে প্রদর্শনী? এই দেশের শিল্পী কবি লেখকদের জন্যও নয়? যারা বাংলা ভাষায় কবিতা লেখেন, চর্চা করেন তাঁদের জন্য নয়? এই জন্যে কি কবি লেখকদের সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েছে শিল্পীদের। সেদিনই একজন বিশিষ্ট কবি এ নিয়ে লিখেছে। এখন আর কোনো চিত্র প্রদর্শনীতে কোনো কবি সাহিত্যিক আর দেখিনা। একসময় কিন্তু এদেশে চিত্র প্রদর্শনীর মূল দর্শকই ছিল কবি লেখক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা।
.
আগেই বলেছি, মূল ধারার কবি, সাহিত্যিক ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধিকেরা–যারা বাংলা ভাষায় কবিতা ও সাহিত্য চর্চা করেন তারা এখনকার আর্ট এগজিবিশনে আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না আর। কোথাও যেন সুতো কেটে গেছে। অপর পক্ষে শিল্পীরাও আর কবি সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিকদের সঙ্গে মিলতে দেখি না আর। এ বড়ো দুর্ভাগ্যের!
.
আমাদের দেশে বর্তমানে আর্ট ক্রিটিসিজম করেন নিউজপেপার অফিসের সবচেয়ে কম মেধাবী অলস সাংবাদিকটি। এটাকে ক্রিটিসিজম বলে না। বরং এটাকে বলে পিঠ চুলকানো রিভিউ। ভাবুন আগে আর্ট নিয়ে লিখতেন— শামসুর রাহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সাদেক খান, সায়ীদ আতিকুল্লাহ, সন্তোষগুপ্ত, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মুনাতাসির মামুন, মফিদুল হক, শামসুল ওয়ারেস, রবিউল হুসেইন, সৈয়দ আজিজুল হক। এরও আগে লিখতেন : সৈয়দ আলী আহসান, ড, এনামুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী–এঁরা। এঁদের বেশিরভাগই একসময় আর্ট কলেজে পড়িয়েছেন !! বর্তমানের দিকে তাকিয়ে দেখুন।…
.
আমাদের একটা ধারণা আছে একজন বিদেশী কিউরেটর আর্ট কিউরেট করবেন আর বাংলাদেশের আর্ট ইন্টারন্যাশনাল হয়ে যাবে? ওয়ার্ল্ড আর্টের মেইনস্ট্রীমে ঢুকে যাবে বাংলাদেশ? কিংবা দাঁত ভাঙ্গা ইংরেজিতে লিখলেই আর্টের খুব নাম হবে? আমার এক বন্ধু আছে। চাইনিজ বন্ধু। আমরা একসঙ্গে জাপানের একটি মিউজিয়ামে গবেষণা করেছি আর্ট লেকচার ও আর্ট ক্রিটিসিজম নিয়ে । বন্ধুটির নাম ফেং বোয়ে। ফেং বোয়ে সমকালীন শিল্পকলায় বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রথম সারির আর্ট কিউরেটরদের একজন। ফেং বোয়ে এক বিন্দুও ইংরেজি জানে না!
.
ইংরেজিতে লিখলেই বিদেশের মিউজিয়াম এর কিউরেটর ছুটে আসবেন, আমাদের আর্টের বাহবা দিবেন বলে আমাদের ধারণা। আমি বলব এ এক ভুল ধারণা। বিশ্বের যত নাম করা মিউজিয়াম আছে, গ্যালারি আছে, যত নামকরা ইউনিভার্সিটিজ আছে তাদের লাইব্রেরিতে বাংলাদেশে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজিতে লেখা ক্যাটালগ, বই, ব্রোসিউর তারা তাদের লাইব্রেরীর জন্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করবেন বলেও আমাদের একটা জোর ধারণা আছে। এমনটি শুনতে ও ভাবতে ভালো লাগে। কিন্ত বাস্তবতা এর উল্টো। সৌজনের খাতিরে বাংলাদেশের এসব প্রকাশনা গ্রহণ করলেও বাস্তবিকভাবে সেগুলো তাদের লাইব্রেরির জন্য ক্যাটালগিংও করা হবেনা হয়ত।
.
‘বাংলা’ ভাষাটা আমাদের। বাংলা ভাষার মর্যাদা উঁচুতে উঠানো দায়িত্বও আমাদের। এ দায়িত্ব আমাকে, আপনাকে কেউ দেন নি, কিন্তু জীবনে কিছু কিছু দায়িত্ব আছে যা বিবেক থেকে বা অন্তর থেকে উৎসারিত হয়।
.
জাপানিজ, চাইনিজ, স্পেনিশ, ইটালিয়ান, ফরাসী,জার্মান শিল্পীরা এক বর্ণও ইংরেজি লিখে না। কিন্তু কেন? তারা তদের ভাষাকে সর্বস্তরে চালু করেছে। এটা তাদের গৌরব, অহংকার। তাঁরা ইংরেজিতে ক্যাটালগ, বই , লিফলেট, ব্রোশিউর কিছুই ছাপে না। এগজিবিশনের নামও ইংরাজিতে লিখে না। সবাই নিজেদের মার্তৃভাষা ব্যবহার করেন। তবু ইউরোপ আমেরিকার সকল নামকরা মিউজিয়ামে ওদের কাজ আছে। ভাষা এখানে মুখ্য নয়। কাজটা মূখ্য।
.
যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। যে দেশে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে। যে আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ -এ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। “বাংলাদেশ” নামের একটি দেশ হয়েছে। যে দেশের নিরানব্বুই ভাগ মানুষ বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। সেই নিরানব্বিভাগ মানুষকে বাদ দিয়ে কেউই কিছু হতে পারবে না । আমি শিল্পী বলে আমি একটি উচ্চতায় উঠে গেছি। বাকি মানুষ সব চাষা ভুষা জোলা তাঁতী জেলে কামার কুমার–ওদের আমার প্রয়োজন নেই। এমন ভাব বা ভাবনা- ছেলেমানুষি। এসব আলগা অহংকার দিয়ে আন্তর্জাতিক হওয়া যায় না।
.
আমরা গর্ব করতে পারি, আমাদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত জাতির নিজস্ব বর্ণমালা নেই! আমাদের আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের শিল্পীরা বাংলায় গান গেয়ে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। যখনই মুক্তিযোদ্ধারা কোনো স্বাধীন অঞ্চলে গেছেন—সেই মুক্ত অঞ্চলের মাটি ঠেকিয়েছেন কপালে। এই দৃশ্য কতটা আন্তর্জাতিক ও মর্মভেদী, আহা, রবীন্দ্রনাথ কি মনে পড়ে না তখন—
“ও আমার
দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা”।
এমন দৃশ্যে চোখের জলে চোখ ভাসেনি আমাদের?
.
সুতরাং আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেতে ভাষা কিন্তু প্রতিবন্ধকতা নয়। আগেই উল্লেখ করেছি, জাপান, চীন, কোরিয়া, জার্মান, ফরাসী, স্প্যানিশ, ইটালিয়ান শিল্পীরাও তাঁদের নিজ নিজ দেশের ভাষা নিয়েই আন্তর্জাতিক অবস্থানে গেছেন।
.
শিল্পীদের অনেক ভূমিকা আছে। শিল্পীরা সোচ্চার হোন। নিজের ভাষাকে সম্মান করুন, শ্রদ্ধা করুন। সেটাই বড় দেশপ্রেম। আমি কারু বিপক্ষে কথা বলছি না। আপনার বাংলায় লিখলে দেশের নিরানব্বুই ভাগ দর্শকই আপনাদের শিল্প এবং শিল্প দর্শন সম্পর্কে জানতে পারবে, বুঝতে পারবে।
.
এখানে আমি একটি বইয়ের কথা ও প্রদর্শনীর কথা উল্লেখ করছি, এটা উদাহরণ হতে পারে। তা হলো বাংলাদেশে বিমূর্ত শিল্পকলার পথিকৃৎ মোহাম্মদ কিবরিয়া’র একটি প্রদর্শনী করেছিল, কলাকেন্দ্রে। কলাকেন্দ্র কিবরিয়ার ওপর অসাধারণ একটি বই বের করেছে। সেখানে অসাধারণ একটি লেখা আছে বাংলা ভাষায় কিবরিয়ার ওপরে। অপূর্ব বাংলায় লেখাটি লিখেছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
.
লেখাটি পড়তে এবং বইটি কলাকেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করতে অনুরোধ করব। (যদি তাদের কাছে থেকে থাকে)। শুধু লেখা নয়, বই কী করে করতে হয়, কী কী থাকলে একটি বই “বই” হয়—সেটিও উপলব্ধি করতে পারবেন বইটি পাঠ করলে।
.
আবারও মাতৃভাষা নিয়ে সামান্য বলে লেখাটি শেষ করব।
যারা আপনাদের প্রদর্শনী আয়োজন করেন তাঁদেরকেও বিষয়টি বলুন। ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে বলুন।
.
একটি কথা মনে রাখবেন, ভাষা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল আন্দোলন করেছেন ছাত্র, জনতা, লেখক, শিল্পী, কবি, মধ্যবিত্ত নানা পেশার লোকেরা। এরাই মূলত প্রতিবাদ করেন যেকোনো অন্যায়ের, এরাই রাজপথে প্রাণ দেন। এরাই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। কোনো ধনীলোক, কোনো শিল্পপতি কোনো উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা কিন্তু রাজপথে শ্লোগান দেন না। রক্ত দেন না। প্রাণ দেন না।
.
এ দেশ আমাদের। সাধারণ মানুষের। আমরা যারা বাংলায় কথা বলি। বাংলায় লিখি। বাংলাকে ভালোবাসি। এখন এদেশের শিল্প সংগ্রাহকও বাংলাদেশের। শিল্পীও বাংলাদেশের। বেশিরভাগ দর্শকও বাংলাদেশের। তাহলে কোন মনস্তাত্ত্বিক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে শিল্পীরা শুধুই ইংরেজিতে ক্যাটালগ বা লেখা ছাপেন? এটা বোধগম্য নয়। প্রদর্শনীর শিরোনাম কি বাংলাতে দেয়া যায় না? (ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাভাষাটি রাখুন, মাতৃভাষাকে একেবারে উড়িয়ে দিবেন না)।
.
যে দেশ কিনা লালন শাহয়ের, রবীন্দ্রনাথের, কাজী নজরুলের, জীবনানন্দের, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণের। সেখানে একটি চিত্র প্রদর্শনীর বাংলা নাম খুঁজে পাওয়া যায় না– এর চেয়ে চির দু:খের আর কিছু হতে পারে না।

.
রফি হক। শিল্পী, ছাপচিত্রী, শিল্পলেখক, সম্পাদক। ভিজিটিং আর্টিস্ট এণ্ড লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো।

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বুধবার, ১৫ ফাল্গুন ১৪৩০

চিত্রকলা
শিল্পীর নাম : মোহাম্মদ কিবরিয়া (১৯২৯-২০১১)
চিত্রকর্মের নাম : অমর একুশে – ২
মাধ্যম : তুলি ও কলম
চিত্রকর্মের দৈর্ঘ ও প্রস্থ : ৩৩ সে.মি. ২৪ সে.মি.
চিত্রকর্মের সন : ১৯৯৩

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ