প্রচ্ছদগদ্যসাইয়েদ জামিল এর 'ফালতু' কবিতা

লিখেছেন : মুসা আল হাফিজ

সাইয়েদ জামিল এর ‘ফালতু’ কবিতা


মুসা আল হাফিজ

খুঁজে খুঁজে এ সময়ের কবিতা পড়বার পাঠক মাঝে মাঝে মাথা তোলে। বিষয়ে ও কাজে উড়নচণ্ডী আমি এক জায়গায় স্থির থাকবার কৃষিবসতিতে থাকিনি। যাযাবর বেদুইনই হয়ে আছি। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে দিন শেষে কি কবিতার কাছেই ফেরা হয় না? প্রখর রোদে বা বিষকেউটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে সঙ্কট উজানোর উত্তেজনা, সেখানেও কি অভিব্যক্তি কবিতা রচনা করে না? তা করে। এবং এই পথ ধরে আমরা গড়বার, ভাঙবার, লড়বার এবং জন্ম নেবার ইতিহাসে কবিতাকে দেখি নির্ধারনী ভূমিকায় নৃত্য করছে। এই ইতিহাসটাই রাজনীতির গান। বৃহত্তর মানুষের হয়ে উঠার গোটা পথ, গোটা পরিক্রমায় সে আছে। এ পথে মানুষের তৈরী প্রথম রাষ্ট্র হলো পরিবার, শেষ পরিবার হলো রাষ্ট্র, অনেকেই বিশ্বরাষ্ট্রের আকাঙ্খার কথাও বলতে পারেন, বিশ্বগ্রামের কথা বলতে পারেন।
পরিবার, রাষ্ট্র বা বিশ্বগ্রাম। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান… সবই এখানে। হ্যাঁ। এই সবের অন্তরতলেও বয়ে গেছে কবিতার রক্ত। কবিতা এই সমস্ত কিছুর মধ্যে খেলা করে বিস্ময়ে ও জীবনমন্থনের আবেগে, প্রশ্নে, ঘামে , কামে এবং শিহরনে।
কথাগুলো বললাম কবি সাইয়েদ জামিলের একটি কবিতাকে উপলক্ষ্য করে। তার কবিতাটির নাম— ‘যথারীতি সাবজেক্টিভ এবং একটি ফালতু কবিতা’। পড়ে তো সংবেদের সেতারে খেলে গেলো বিদ্যুৎ। রাজনীতি, ইতিহাস ও জীবনের আবর্তনের বিবাহ ঘটেছে কবিতাটির মাঝে।জামিলের কবিতায় ভাষায়, বিষয়ে ও বয়নে উলঙ্গ রুদ্রের খেলা দেখা যায়। ‘একটি মাতাল রিকশায় চেপে, বাতাসে চুল উড়িয়ে,
প্রত্যেক গোধূলিতে নৈসর্গের ভেতর দিয়ে মায়াদের বাড়ি’ যান জামিল। কিন্তু এটা তার কল্পনা। এরকম কল্পনায় কবি স্বস্তি পান। প্রকৃতপক্ষে এই কবি সঙ্কটের সম্মুখ সমরে থাকতে পছন্দ করেন। রাহাত ইন্দুরি বলেছিলেন, ফয়সালা জো কুচ হো, মঞ্জুর হো না চাহে / জঙ্গ হো ইয়া ইশক হো ভরপুর হো না চাহে। সিদ্ধান্ত যাই হোক, কবুল বলা চাই। যুদ্ধ বা প্রেম হোক, সবটুকু হওয়া চাই। জামিল সবটুকু দিয়ে সবটুকু নিতে চান। হোক তা সংগ্রামে, হোক প্রেমে বা কামে।
বাস্তব সঙ্কটকে জানেন এই কবি। ফলে ‘ঘর থেকে মায়ার উদ্দেশ্যে বার হলেই’ দেখেন ‘পৃথিবী থেকে রিকশা উধাও / আর, এক চালকবিহীন উন্মাদ বুলডোজার ছুটে আসে আমার দিকে।’ তখনই আসল ভূমিকা উদযাপন করতে হয়। জামিলের ভূমিকা হলো— ‘আমি পিষে মরবার আগেই লাফ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসি।’
ভেরি গুড। আমরা একজন বাস্তবতার মধ্যে জ্বলন্ত কবির সাথে আছি। এই বাস্তবতার একটা অতীত দৃষ্টি থাকতে হয়, একটা ভবিষ্যত। দুই দৃষ্টিকে বর্তমান দৃষ্টির মধ্যে হাজির করলেই কেবল একটি ঘটনাকে কবিতার দ্বারা অন্তঃসত্তা বানানো যায়। নতুবা ঘটনার শিশুতোষ বিবরণ দেওয়া হয় নতুবা সাংবাদিকতা করা হয়। জামিল তার ‘ফালতু কবিতা’-য় না শিশুতোষ, না সাংবাদিক। কবিতাটি পূর্বপুরুষের রোমন্থনের মধ্য দিয়ে শুরু। বাবা আতাউর রহমানের বাবা ইয়াসিন আলি মোল্লা দেশপ্রেমিক ছিলেন। তার বাবার বাবার বাবা ছিলেন পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। তার এক স্ত্রী ছিলেন আকবারুন নেছা, আরো দুই উপস্ত্রী ছিলো। এই দুই উপস্ত্রী দিয়ে রহস্যের বিস্তার। দেশপ্রেমের বয়ানে তাদেরকে পাওয়া যাবে। জামিল তার পূর্বপুরুষকে বলেন, ‘তোমার দেশপ্রেমের বিষয়টি অত্যন্ত হাস্যকর। /
তুমি জন্মেছো ভারতবর্ষে। / তারপর পাকিস্তানকে স্বদেশ বলেছো। এবং তারপর
বাংলাদেশকে।’
এরপর তার প্রশ্ন—
আমি জানি না, দেশপ্রেমিক হ’তে হ’লে ঠিক কতোগুলো দেশকে বলতে হয় স্বদেশ। ক্যানো দেশ প্রেমিককে প্রেমিকার মতো বারবার পাল্টাতে হয় দেশ! ক্যানো তুমি একটি স্বদেশ নিয়ে সন্তুষ্ট হ’লে না?আসলে, স্ত্রী আর উপস্ত্রীর মতো তুমি সৃষ্টি করতে চেয়েছো কেবলি খণ্ড খণ্ড আনন্দ-উদ্যান।
সেদিন লিখেছিলাম, ‘ভাষা ও দেশ মানুষের প্রয়োজনে তৈরী। একে দেবতা বানাবেন না। কথাটির মধ্যে সত্য আছে। জামিলের কবিতাও দেশপ্রেমের আপেক্ষিকতা ও মানুষের প্রয়োজনের অনুভবের বিচিত্র ধরন ও বাকবদলকে প্রশ্ন করছে। এ অবধি তার বিবরণ অনেকটা সাংবাদিকতার মধ্যে আছে। কিন্তু এরপর আসল জামিল বেরিয়ে আসবেন। কবির জিজ্ঞাসা, তীব্রতা ও তরঙ্গ নিয়ে। পরের আলাপে জটিল আবর্তন হাজির হয় এবং কবিতাটি ঘটনাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। সে আর অতীতে থাকে না, হয়ে উঠে তীব্র বর্তমান , তীব্র ভবিষ্যৎ কিংবা একই সাথে তিনই। ফালতু কবিতার শেষ কথাগুলো পুরোটাই পড়া যাক—
ভাগ্যিস, তোমার জীবন ও যৌবন নবী নুহের জীবন ও যৌবনের মতো নয়শতো বছর প্রলম্বিত হয় নি। এ-রকম প্রলম্বিত হ’লে প্রত্যেক শতকেই, আমি নিশ্চিত, একজন স্ত্রী এবং দুজন উপস্ত্রী থাকতো তোমার। এবং তুমি
প্রেমিকার মতো পাল্টাতে স্বদেশ। প্রত্যেক শতকেই তুমি জন্ম নিতে একটি ভারতবর্ষে। এবং তারপর একটি পাকিস্তান থাকতো তোমার। এবং তারপর একটি বাংলাদেশ। নয়শতো বছরে তোমার স্বদেশের সংখ্যা হ’তো সাতাশ। আমি কি ভুল বললাম, মোল্লা ইয়াসিন আলি?
দেশপ্রেমকে দেবতা বানিয়েছে আধুনিকতা। জাতিরাষ্ট্র ধারণার মধ্যে এই ছ্যাবলামি রয়েছে। কিন্তু এই দেবতা কত ভঙুর। ভাঙা-গড়ার কী নদীমাতৃক খেলা। রাষ্ট্র একটা বিদ্যমানতা। কিন্তু চিরন্তনতা নয়। সে আপেক্ষিকতায় মোড়ানো । এই সত্য মানুষের সেই প্রয়োজনের আত্মায় নিহিত আছে, যেখান থেকে তারা শুরু করেছিলো রাজনৈতিক নির্মাণ।
সাইয়েদ জামিলের কবিতায় রাজনীতি ও ইতিহাস আছে। একে অভিনন্দিত করছি।
শৈল্পিক অভিব্যক্তির একটি ফর্ম হিসাবে কবিতা তার সময়ের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে আয়নায় তুলে ধরবে। সামাজিক পরিবর্তনের জন্য একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে এবং সম্মিলিত স্মৃতি সংরক্ষণের একটি গতিশীল স্রোত তৈরী করবে। সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও বৌদ্ধিক প্রবাহ কবিতার জলবায়ুতে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখবে। এর মধ্য দিয়ে সে আলিঙ্গণ করবে জটিল রাজনৈতিক ধারণা, ক্ষমতা, সংঘাত, প্রতিরোধ এবং রূপান্তরের মাত্রাগুলোর সাথে, নিজস্ব মুদ্রাগুলোর সাথে।
অন্যান্য খাসলতের পাশাপাশি সাইয়েদ জামিলের কবিতা এই প্রবণতাকে নিজের বউ বানাতে চায়।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. জামিলের কবিতা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আমি তার কাব্যঢঙ পছন্দ করি। তবে ইসলাম বিষয়ে ঐতিহ্যপন্থী শুদ্ধাচারে তার আচার না থাক, অবজ্ঞা বা রিজেকশন যা খেয়াল করি তা বালসুলভ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা