আহমদ মতিউর রহমান
সানাউল্লাহ নূরী আমাদের সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জগতের একটি আলোকিত নাম। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি অনেকগুলো সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে জাতির অভিভাবকের দায়ত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ইহসান-এর সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্বের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনর তিনি অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার তমদ্দুন মজলিসের চার স্তম্ভের অন্যতম ছিলেন সানাউল্লাহ নুরী। কিন্তু ইতিহাস তার নামটি সেভাবে স্মরণ করে না। এই চারের অন্যরা ছিলেন তমদ্দুন মজলিশের নেতা অধ্যক্ষ আবুল কাসেম, কথা সাহিত্যিক ও এই সংগঠনের অপর নেতা শাহেদ আলী এবং সৈনিক সম্পাদক ও তমদ্দুনের আরেক নেতা অধ্যাপক আবদুল গফুর। সাপ্তাহিক সৈনিকেরও তারাই কুশীলব। ভাষা আন্দোলনের কাজে সার্বক্ষণিক ব্যাপৃত থাকতেন। তারা পুরনো ঢাকার উর্দূভাষী এলাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীর স্বপক্ষে প্রচারাভিযান চালাতেন। পুরনো ঢাকার উর্দূভাষী লোকজন কোনো কোনো সময় তাদের উপর চড়াও হতো। তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছেনও একাধিকবার। ১৯৪৮-১৯৫২ তিনি ওৎপ্রোতোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন ভাষা আন্দোলনে। সাপ্তাহিক সৈনিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে তার অসংখ্য লেখা এবং প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
কর্মজীবনে তিনি দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জনতা, দৈনিক বাংলা, দৈনিক গণবাংলা, দৈনিক দেশ, দৈনিক দিনকাল ও সাপ্তাহিক কিশোর বাংলার সম্পাদকসহ বাংলা ভাষার বিভিন্ন পত্রিকার বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে দায়িত্বরত ছিলেন। তিনি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন স্বাধীনতা পরবর্তী পাঠকপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক বাংলায়, দায়িত্ব পালন করেছেন সিনিয়র সহকারী সম্পাদকের। নিয়মিত কলাম লিখতেন সানু ছদ্মনামে। তার কলামে সাবলীল ভাষায় উঠে আসতো মাটি, মানুষ, স্বদেশ, স্বজাতি, নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কথা। এর আগে পাকিস্তান আমলে তিনি স্বনামধন্য ফ্রাঙ্কলিন পাবলিশার্সে অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন এবং বিশ্ব সাহিত্যের অনেক কালজয়ী বই অনুবাদ করেছেন। দৈনিক বাংলায় সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে তাকে নতুন প্রকাশনা সাপ্তাহিক কিশোর বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিশোর বাংলা এদেশের প্রথম প্রকাশিত কিশোর সাপ্তাহিক। তার যোগ্য সম্পাদনায় পত্রিকাটি ট্যাবলয়েড সাইজে সম্পূর্ণ রঙিন আঙ্গিকে ১৬ পৃষ্টার কলেবরে প্রকাশিত হতো। সচিত্র সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা তরুণ সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
দৈনিক বাংলা থেকে ১৯৭৮ সালে তিনি বিদায় নেন এবং যোগ দেন নতুন প্রকাশিত পত্রিকা “দৈনিক দেশ” এ। সেগুনবাগিচায় নতুন অফিস সাজানো, পত্রিকার জন্য সাংবাদিক ও অন্যান্য স্টাফ নিয়োগ ইত্যাদিতে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অতীতে সম্পাদনা ও সাংবাদিকতায় তিনি যে বিস্তর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তার পুরোটাই তিনি প্রয়োগ করেন দৈনিক দেশের সুষমামন্ডিত প্রকাশনায়। নিজে লিখেছেন অন্যদের দিয়ে লিখিয়েছেন। দেশ, কৃষ্টি, খাল কাটা ও স্বনির্ভরতা অর্জনের বিষয়ে তার নির্দেশনা ও সম্পাদনায় প্রতি দিনই একাধিক সম্পাদকীয় ও ফিচার প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৭৮-১৯৭৯ সনে “দৈনিক দেশ” দেশের প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী ঘরানার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার জন্ম দেয়। পত্রিকাটি অল্প সময়ে বিপুল পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীকালে তিনি দৈনিক জনতার সম্পাদক পদে যোগ দেন। দৈনিক জনতাও তার যোগ্য ও কুশলী সম্পাদনায় পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। একসময় তিনি দৈনিক জনতা ছেড়ে দৈনিক দিনকালের সম্পাদক পদে যোগ দেন। সম্পাদক হিসেবে তার লেখা কলামগুলো সংকলিত হলে বিশাল এক জ্ঞান ভান্ডার উদঘাটিত হবে। কেননা সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি অনেক বিষয় ছিলো তার অধিত। তিনি প্রানবন্ত ভাষায় কঠিন কঠিন বিষয়কে পাঠকদের কাছে উপভোগ্য করে তুলে ধরেছেন। তার লেখা মানেই প্রচুর তথ্য এবং উপাত্তের সন্নিবেশ।
২.
সানাউল্লাহ নুরীর জন্ম ১৯২৮ সালের ২৮ মে বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর ফ্যালকন গ্রামে। তার বাবার নাম মাওলানা সালামতউল্লাহ আর মায়ের নাম মনসুরা বেগম। তার শৈশব শিক্ষা শুরু হয় ল²ীপুর জেলার রামগতি উপজেলার হাজিরহাট জুনিয়র অ্যাংলো ইংলিশ অ্যারাবিক মাদরাসায়। তিনি পড়ালেখাকালেই কবিতা লেখা শুরু করেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি দু’জন বিখ্যাত ইংরেজি কবি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ এর ‘লুসিগ্রে’ ও কীটসের ‘ফায়ারিং সং’ কবিতার অনুবাদ করেন। স্কুলে অধ্যয়নকালেই তিনি ছোটগল্প, নাটক ও উপন্যাস রচনায় হাত দেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় উপন্যাস ‘আন্ধার মানিকের রাজকন্যা’ লেখেন যা ১৯৫২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা বঙ্গোপসাগরের রূপকথা, চীনে পুতুলের দেশ, বুদ্ধি শেখার গল্প, দারুচিনি দ্বীপের দেশে, মঙ্গলগ্রহে সানির পাঠশালা, হাজার এক রাতের শহর শিশু-কিশোরদের প্রিয় বই। ‘দারুচিনি দ্বীপের দেশে’ সপ্তম শ্রেণির সাহিত্য পুস্তকে প্রায় দেড় যুগ যাবৎ পাঠ্য ছিল। ‘বিশ্বের প্রথম রিপোর্টার’ নূরীর আর একটি সেরা বই। সম্প্রতি বইটি পুন প্রকাশিত হয়েছে। রকমারি ডট কমে এটিসহ কয়েকটি বই পাওয়া যায়। তাঁর আমু দরিয়ার বুড়ো, একদিনের রাজা, উড়তে উড়তে পরীর দেশে-ভ্রমণ কাহিণী, সোনার হরিণ চাই -উপন্যাস, ‘বোশেখ আসে পাগলা ঘোড়ায়’, ‘মেঘের নৌকায় চাঁদের ছেলে’ ছড়ার বই, নিঝুম দ্বীপের উপাখ্যান, আন্ধার মানিকেন রাজকন্যা, সুজা বাদশাহ বই কয়টি নাম করেছে। তিনি ৮টি উপন্যাস, ৭টি গল্প ও শিশুতোষ গ্রন্থ, ৩টি ভ্রমণ কাহিনী, ৪টি ঐতিহাসিক গ্রন্থ, সাংবাদিকতা বিষয়ে ২টি গ্রন্থ, রাজনৈতিক বিষয়ে ২টি গ্রন্থ, ২টি কাব্য গ্রন্থসহ ৬০টি গ্রন্থ রচনা করেন। তার বইয়ে মধ্যে আরো রয়েছে ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতা’ , ‘নোয়াখালী-ভুলুয়ার ইতিহাস ও সভ্যতা’ ও ‘উপমহাদেশের শত বর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধ’। কিন্তু এর অনেকগুলোই এখন আর বাজারে নেই। বইগুলো পুনপ্রকাশিত হওয়া দরকার। বের হওয়া দরকার রচনাসমগ্র।
৩.
সানাউল্লাহ নূরীর লেখায় প্রিয় জন্মভ‚মি বাংলাদেশের প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে। শব্দ চয়ন ও ছন্দ বিন্যাসে সানাউল্লাহ নূরী ছিলেন ছোটদের অতিপ্রিয় একজন লেখক। তিনি নতুন নতুন শব্দ উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে তাঁর ছড়া-কবিতায় ছোটদের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর লেখা প্রতিটি শব্দ এবং লাইন যেন ছন্দে ছন্দে দোল খায়। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ যে কোনো রচনাতেই তিনি শিশুদের মন মেজাজ, বয়স এবং পরিবেশ যাচাই করে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ফলে সার্থক শিশুতোষ রচনাকার রূপে বাংলা শিশুসাহিত্যে তিনি আসন করে নিয়েছেন। যেমন তাঁর শিশুতোষ রচনা–
বোশে আসে পাগলা ঘোড়ায়
উথাল-পাথাল ঘূর্ণি হাওয়ায়
ধুলো উড়ায় কুলো উড়ায়
তাঁর ‘বোশেখ আসে পাগলা ঘোড়ায়’ ও ‘মেঘের নৌকায় চাঁদের ছেলে’ ছড়ার বই দু’টি এবং তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘আন্দোলিত জলপাই’ ও ‘শান্তির পদাবলী’ প্রমাণ করে তিনি একজন শক্তিমান কবি ও শিশু সাহিত্যিক।
সানাউল্লাহ নূরীর মধ্যে ছিলো গল্প বলার মজলিশী ঢং। ছোট ছোট বাক্যে চলতি ভঙ্গিতে নানান শব্দের মিশ্রণে তিনি বাংলা শিশু সাহিত্যে একটি নতুন সংযোজন করেছেন। ছোটদের আসর সাজিয়ে যেন গল্প দাদু অতি কাছ থেকে মাথা নেড়ে, হাত ঝেড়ে, একটু একটু করে গল্পের ঝুড়ি উজাড় করে দিয়েছেন। সানাউল্ল্হা নূরীর কথা বলার ঢং চলাফেরা সবকিছুতেই শিশুতোষ ভাবছিল। ফলে তিনি শিশুদের সাথে মিশতে পারতেন। আর শিশুদের মনের কোঠরে লুকায়িত তথ্যগুলো আহরণ করেই তিনি রচনা করেছেন শিশুসাহিত্য্। এ কারণে তিনি একজন সার্থক শিশু সাহিত্যিক। সাংবাদিকতা পেশায় দীর্ঘ দায়িত্ব পালনের সুবাদে তিনি পৃথিবীর বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন। গাদ্দাফির লিবিয়া সফর থেকে ফিরে তিনি আমাদের সেই সফরের গল্প শুনিয়েছিলেন।
তার উপন্যাস ও ছোটগল্পে এই দেশ ও সমাজের চিত্র উঠে এসেছে। তিনি অনুবাদে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে এ দেশের সাহিত্যের যোগ ঘটিয়েছেন। তার দারুচিনি দ্বীপের দেশে বইটিও একটি অনবদ্য সৃষ্টি। বইটি আবার পাঠ্য তালিকাভুক্ত হওয়ার দাবি রাখে। রাজনৈতিক ও ইতিহাসমূলক বইগুলোর তার বুদ্ধিদীপ্ততার স্বাক্ষর বৈকি।
সানাউল্লাহ নূরী শিশু বান্ধব এক নিবিষ্ট মানুষ ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি ১৯৭৪ এর ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৮ সনের ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগর ভিত্তিক শিশু-কিশোর সংগঠন দিশারীর শিক্ষা-সাহিত্য উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৮ সনের ১৭ ডিসেম্বর থেকে আমৃত্যু তিনি জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন ফুলকুঁড়ি আসরের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
৪.
সাহিত্যি সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে সানাউল্লাহ নূরী বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মননা লাভ করেছেন। তিনি ১৯৮২ সনে রাষ্ট্রের অন্যতম সর্বোাচ্চ ও মর্যাদাবান পুরস্কার একুশে পদকে ভ‚ষিত হন। এটা ভাষা আন্দোলনে তার অংশ গ্রহণের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি । এছাড়া তিনি লাভ করেন বাংলা সাহিত্য পরিষদ পদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, কালচক্র স্বাধীনতা পদক ইত্যাদি সম্মাননা। ১৯৯৩ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্মৃতি পরিষদের শিল্পাচার্য পদক পান। ১৯৯৫ সালে পশ্চিম বাংলার “ড: দীনেশ চন্দ্র সেন গবেষণা পরিষদ” প্রদত্ত দীনেশ সেন স্বর্ন পদকে ভ‚ষিত হন। তার জীবন কাহিনি নিয়ে ছোটদের জন্য বই লিখেছেন শরীফ আবদুল গোফরান। বইয়ের নাম সবার প্রিয় সানাউল্লাহ নূরী। তার পুর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ বের হওয়া দরকার।
তিনি টানা ৫০ বছর সাংবাদিকতা করেন। ১৯৮৮ সালে গঠিত “বাংলাদেশ কাউন্সিল অব এডিটরস” এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সানা উল্লাহ নূরী। ১৯৯৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি দৈনিক দিনকালের সম্পাদক পদে দায়িত্বপালন করেন। এর পর অসুস্থতার কারণে সাংবাদিকতা থেকে অবসর নেন সানাউল্লাহ নূরী। ২০০১ সালের ১৬ জুন ৭৩ বছরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।