একাকী দূরবীন
সোফিয়া বলতো,
একটি রাত যেন ভেঙে-পড়া দালানবাড়ি। নিঃশব্দ অন্ধকারে হামাগুড়ি-দেয়া শিশুর ঘুমিয়ে-পড়া বুকের রোদন।
তবুও শূন্যতাকে জাগিয়ে তোলে সোফিয়া।
পৃথিবীর তিন ভাগ জলের ওপর শীতের জমানো বুক।
যারা সুর শুনে কবোষ্ণ রাতে
তাদেরও মনে রাখে দরজার ছায়া!
আমি নই, গেয়েছিল সে-গান অন্য কেউ, হয়ত বা সোফিয়া:
দুঃখ তুর ডানাগুলো উড়িয়ে দে।
আকাশের তারাদের বলে দে,
আমি আর আসব না।
সোফিয়া বলতো,
শিশিরের দুঃখ কেউ জানে না;
অমঙ্গল রাত্রির কথা ভেবে সবাই দুহাতে বুক চেপে রাখে।
একদিন সাত বসন্তের পর
যখন বৃষ্টি হয়
সেই দালানবাড়িতে গানের প্রতিধ্বনিগুলো আর ফিরে আসে নি। ক্রমশ ম্লান-হওয়া দূরের বাতিগুলো নিভে গিয়েছিল।
একে-একে মুছে গিয়েছিল সব স্মৃতি, হলুদ ফুলের গায়ে লেখা বালিকার নাম।
পৌরাণিক পাঠের মতো
রাত্রি শেষে আবারও বৃষ্টি হয়।
অন্তিম ছায়া, পদচিহ্ন–ধূয়ে যায় সব।
পেছনে শুধু পড়ে থাকে একাকী দূরবীন।
ইলহাম
আরব বালিকা ইলহামের জন্য
মরোক্কোর কোনো এক গাছে ফুল
ফোটে শুনেছি।
আমার তো সাধ্য নেই। আতিয়ার কাছে শুধু শুনেছি
সেই ফুল নুয়ে পড়ে
নীল আসমানে যে দিন রাত খুব গাঢ় হয়।
আতিয়া বলেনি সে ফুলের নাম।
তবুও জুঁইফুল ভেবে আমি
একটি কুয়াশার চুমু এঁকে দিই তার বুকে।
ইশ্রাফিলের সিঙ্গার ফুতে উড়ে যাবে যে-দিন পৃথিবী, জীবাশ্মের চোখের কোঠরে ফুটবে না মরুফুল।
যে-দিন অনেক দূরের চাঁদ ভেঙে যাবে জলজোছনায়,
যে-দিন আরববালকের স্বপ্ন উবে যাবে গোধূলিতে, তার কাজল দিয়ে আঁকা দুঃখগুলো ;
সেদিন নিশ্চয় আমি থাকব না।
নিশ্চয় আমি ইলহামের জন্য শোঁকগাথা লিখে যাব তার আগে।
যদি চন্দ্রগ্রহণের ছায়া ঢুকে পড়ে বুকে তবুও লিখে যাব।
তোমাকে ঈশ্বর যা দিয়েছে আমাকে তা দেয়নি।
আমি এক জন্মান্ধ পাথর।
কুয়াশায় ডুবে-যাওয়া নদী।
অনেক দূরে, আলোকবর্ষের মতো, প্রতিটি তারা জানে আমার কোনো ডানা নেই।
জীবাশ্মের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে যেন রাতের অনিদ্রাগুলো ঢুকে পড়ে। তবুও
শামুকের মত সংকুচিত হয়ে আসা
চোখে তোমার জন্য লুকিয়ে রেখেছি অশ্রু।
হে মৃত্যু, আমাকে কি ইলহামের পাশে একদিন ঘুমিয়ে দেবে না?
পাতারা ঘুমিয়ে পড়ে।
ধীরে-ধীরে চন্দ্রগ্রহণের রাত কোটি-কোটি টুকরো হয়ে যায়!
গ্রাফিতি
গ্রাফিতিগুলো রয়ে যায় ধূসর হতে-হতে।
দেয়াল জানে না কী লেখা ছিল। একা পড়ে থাকে বিবর্ণ পাতা।
দেয়াল দাঁড়িয়ে থাকে নিস্তব্ধ একটি রাত্রির ভেতর জোনাকির মতো।
চাঁদ ওঠে।
একটি উল্কা ঝরে সে-পাতায়।
মানুষের নিস্তব্ধাকে ভেঙে কোনো ছায়া আর এগিয়ে যায় না। দূর থেকে একটি বৃক্ষের কান্নাধ্বনি শুধু শোনা যায়।
হত্যাকারী একটি ধারালো ছুরি
পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
দেয়ালের গ্রাফিতিগুলোর রঙ মুখস্থ করে তবু আকাশ।
গ্রাফিতিগুলো রয়ে যায় ধূসর হতে-হতে।
ব্রাইটলিঙের হাতঘড়ি
মেঘ তোমাকে ডেকেছে,
আমাকে ডেকেছে নদী। আমার সেক্সোফোনে তাই
আঙুল-জড়ানো দুঃখ।
রাত হলে শোনো—কুকুরের ঘেউ-ঘেউ শব্দ,
আকাশের নিচে পড়ে-থাকা বাসন-কোশন;
বৈদ্যুতিক বাতি অথবা ব্রাইটলিঙের হাতঘড়ি।
আমার তো ঘড়ি নেই;
তোমার ঘড়িতে দেখে নিও
আলোকবর্ষ মানে কত দিন।
ট্রেনের চাকার নিচে কেটে গেছে
বাড়ি ফেরার টিকেট।
এই শহরে আমার হাতব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই।
তবুও একজন বেশ্যা এসে বলল,
পঞ্চাশ ডলারে আজ সে রাত কাটাবে।
চাঁদও ভুলে গেছে যে, আমি টিকেট হারিয়ে ফেলেছি।
তোমার শহরেও কি চাঁদ ট্রেনের চাকার মতো ?