প্রচ্ছদপ্রবন্ধসায়ীদ আবুবকরের কবিতা : মহাকালের ফলকে উৎকীর্ণ এপিটাফ

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

সায়ীদ আবুবকরের কবিতা : মহাকালের ফলকে উৎকীর্ণ এপিটাফ

আবু তাহের সরফরাজ

কবিতা ‘কবিতা’ হয়ে ওঠার কৃৎকৌশল কি? খুব সুনির্দিষ্টভাবে এই প্রশ্নের জবাব দেয়া মুশকিল। কবিতা লেখা যায় না, কবিতা হয়ে ওঠার বিষয়। কিভাবে হয়ে ওঠে একটি কবিতা? কবিতা নিজেই আসলে প্রকাশ ঘটে কবির মাধ্যমে। কবির অবস্থা তখন ঘোরগ্রস্থ। কবির বোধের গহীন অন্ধকারে আলোর মতো হঠাৎ জ্বলে ওঠে কোনো বিশেষ একটি বোধ। এরপর সেই বোধ স্ফুরিত হতে থাকে। নিজের প্রকাশ ঘটাতে চায়। এ সময় বেগ তৈরি হয় কবির ভেতর। কী রকম ঘোরের ভেতর যেন চলে যান কবি। বোধকে ভাষায় নির্মাণ করতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা ফুলের সুবাসকে ভাষায় শরীর দেয়ার মতো। খুবই মুশকিলের কাজ। প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। কিন্তু প্রকৃত কবির বেলায় কাজটি প্রাকৃতিকভাবেই সহজে ঘটে যায়। কবিতা খুবই স্বাভাবিক গতিতেই কবির ভেতর থেকে ভাষায় রূপ নিতে থাকে। কবি কেবল নিমিত্ত হয়ে লিখে যেতে থাকেন বোধের অনুরণন। কিন্তু আরেক শ্রেণির কবি আছেন, যাদের বোধে কবিতা সেভাবে স্ফুরিত হয় না। কিন্তু কবিতা যে তাকে লিখতেই হবে, না-হলে তিনি কবি হয়ে উঠবেন কিভাবে! ফলে, কবিতাকে বিনির্মাণ করতে চেষ্টা করতে থাকেন তারা। এতে হয় কি, শেষমেষ কবিতার মতো করে যা লিখিত হয় তা কবিতা হয়ে ওঠে না। হয়ে ওঠে কবিতার মতোই কিছু একটা। এই দুই শ্রেণির মাঝামাঝি আরেক শ্রেণির কবি আমাদের চোখে পড়ে। তাদের বোধের জগতে কবিতা স্ফুরণ তোলে। তারা টেরও পান সেই ঢেউ। কিন্তু বোধের প্রকাশ তারা ভাষায় রূপ দিতে পারেন না। তবে চেষ্টা করেন। বোধের অস্ফুট স্বর শুনতে চেষ্টা করেন কান পেতে। কিছু শুনতে পান, কিছু শুনতে পান না। ফলে, কিছুটা তাড়না আর কিছুটা নিজের চেষ্টা থেকে তারা বোধের মরমে লুকনো স্ফুরণকে লিখতে চেষ্টা করেন। পাশাপাশি এও সত্যি যে, কবিতা দূরবিশ্বের থেকে অস্ফুট স্বরে ভেসে আসা কিছু ইঙ্গিত। সেই ইঙ্গিতকে ভাষায় রূপদান করা সত্যিই দুরূহ। বলেছি যে, কোনো কোনো কবিতা প্রাকৃতিকভাবেই কবির মধ্যদিয়ে নির্মিত হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখানেও কিছুটা ধরা না-ধরার খেলা থাকে। কবি তো আর ত্রিকালদর্শী নয়, কবি শেষ পর্যন্ত মানুষ। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, কবিতা তৈরি হয় কিছুটা আভাসে, আর কিছুটা আয়নায় দেখা স্বচ্ছ প্রতিবিম্বের মতো চিত্রময়তায়। কবির জীবনবোধের সাথে কবিতার ইঙ্গিত ও চিত্রময়তার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। কেননা, কবির অন্তর্জগত হচ্ছে কবিতার রসায়নাগার। অদৃশ্যলোক থেকে যে ইঙ্গিত কবি পান, সেই ইঙ্গিত জারিত হয় কবির অন্তর্জগতে। এরপর সেখান থেকে বোধকে ভাষায় চিত্রিত করেন কবি, যাকে আমরা কবিতা বলে থাকি। এই কবিতা অনেক রকম। যত রকম মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করছে, তত রকম। আর এ কারণেই কবিতার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করতে যাওয়াও এক ধরনের বোকামি। আরও দেখা যায়, একটি কবিতা একেক পাঠকের কাছে একেক ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। কী রকম? সায়ীদ আবুবকরের ‘বৃষ্টি’ কবিতা থেকে এক টুকরো পড়া যাক:

কী আশ্চর্য এই জল, শূন্যের গহ্বরে
ঊর্বশীর মতো এলো নেমে সে হঠাৎ
ফসলের মাঠ আর ধু-ধু তেপান্তরে…

আমাদের খোলা চোখে দেখা বৃষ্টি আর ওপরের বাক্যগুলোয় বর্ণিত বৃষ্টি যে এক নয়, তা বোদ্ধা পাঠকমাত্রই স্বীকার করবে। বৃষ্টি আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গ্রোথিত। নানা রূপে ও অভিজ্ঞতায় বৃষ্টিকে আমরা দেখেছি। বৃষ্টি নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য কবিতা। সেসব কবিতাও আমরা পড়েছি। এত যে পরিচিতি বৃষ্টি, সেই বৃষ্টিকে কবি বলছেন ‘আশ্চর্য জল’। এই দুটি শব্দ পড়ার সাথে সাথেই পাঠক বুঝতে পারেন, বৃষ্টির যে রূপ তার পরিচিত তা ছাড়াও আরেক কোনো রূপ বৃষ্টির আছে। সেই রূপ দেখতে পাঠককে প্রস্তুত করতে করতেই কবি বলেন, ‘ঊর্বশীর মতো এলো নেমে সে হঠাৎ’। বলা দরকার, এখানে ‘ঊর্বশীর মতো সে নেমে এলো হঠাৎ’ লিখলে বাক্যের বিন্যাস সমতল হতো, পড়ার সময় শব্দের গতিও ব্যহত হতো না। সাধারণত ষাটের দশকের কবিতায় ক্রিয়াপদকে ওইভাবে লেখা হতো। শামসুর রাহমানের বেশিরভাগ কবিতাতেই এই ঝোঁকটির প্রাবল্য দেখা যায়। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের একজন কবির কবিতায় এই ঝোঁকটি চোখে পড়ার মতো। কারণ, ষাটের দশকের কবিতার পাঠক আর এই সময়ের কবিতার পাঠক একই পাঠক নয়। প্রজন্ম বদলেছে। বদলেছে কবিতার ভাষা ও প্রকরণ। বিশেষ্যের আগে ক্রিয়াপদের এ ধরনের ব্যবহার সায়ীদ আবুবকরের কয়েকটি কবিতাতে পাঠকের চোখে পড়বে। যাই হোক, শূন্যের গহ্বর থেকে ঊর্বশীর মতো হঠাৎ করেই বৃষ্টি নেমে আসে ফসলের মাঠে আর তেপান্তরে। এখানে বলা দরকার, ঊর্বশী ও তেপান্তর আমরা কেউ-ই দেখিনি। কিন্তু শব্দ দুটি আমাদের প্রত্যেকের খুব কাছের। এমনকি, ঊর্বশী ও তেপান্তরের চিত্ররূপ প্রত্যেক বাঙালির কল্পনায় বিশিষ্ট একটি রূপে চিত্রিত হয়ে আছে। কবি আমাদের সেই কল্পনাকে উসকে দিচ্ছেন বৃষ্টির ধারা স্নানে। পাঠকের বোধের খুব কাছাকাছি বসে নিকট আত্মীয়ের মতোই যেন কবি বর্ণনা করছেন বৃষ্টির এই রূপ। পাঠক নতুন রূপে বৃষ্টিকে দেখে, যা আগে এইভাবে দেখা হয়নি। বৃষ্টির এই যে ব্যঞ্জনা কবি তৈরি করলেন তার ইঙ্গিত তিনি পেয়েছেন দূর বিশ্বের থেকে। সেই ইঙ্গিতকেই তিনি ভাষায় রূপ দিচ্ছেন বৃষ্টিকে একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ধরে। সাধারণ একটি বিষয়কে শিল্প নৈপুণ্যে অসাধারণ করে তুললেন কবি। সায়ীদ আবুবকরের বেশির ভাগ কবিতাতেই এই প্রয়াসটি পাঠকের চোখে পড়বে। খুবই পরিচিত সাদামাটা বিষয়কে তিনি কবিতায় পরম যত্নে অসাধারণ করে উপস্থাপন করেন। পাঠক চেনা রূপকেই নতুন রূপে আবিষ্কার করবে তার কবিতায়। আর ভাববে, আরে, এভাবে তো ভেবে দেখিনি!

আর কোনো যিশু নেই, মনে রেখো, ক্রুশের কাঁটায়
কুসুমের মতো গেঁথে নেবে সব পাপ;
আর কোনো বুদ্ধ নেই, বোধিবৃক্ষের ছায়ায় বসে
চৌপ্রহর বাজাবে বোধের বাঁশি;
আর কোনো কৃষ্ণ নেই, রাধার তৃষ্ণার্ত চোখে
ঢেলে দেবে এক মেঘ ভালোবাসা জল;
আর কোনো মহম্মদ নেই, ক্ষুধার্ত অগ্নির হাত থেকে
ছুটে এসে রক্ষা করবে তোমাকে।

শুধু এক প্রেমবাদী কবি ছাড়া
আর কোনো ত্রাণকর্তা নেই, মনে রেখো।

‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইয়ের ফ্ল্যাপে এই পঙক্তিগুচ্ছ পাওয়া যাবে। আমার কাছে মনে হয়েছে, পঙক্তিগুলো মহাকালের আয়নায় উৎকীর্ণ এপিটাফ। মানুষ এখন চূড়ান্ত অধঃপতনের গহ্বরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে এমন কেউ নেই, যে তাকে টেনে ধরে উদ্ধার করবে। গোটা বিশ্বেই মানবতাকে পিষে মারছে অতি ধূর্ত কতিপয় মানুষ। মানুষ এখন কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যেকেই নিজের নিজের হিংসার চাকু ধার দিচ্ছে আরেকজনের বুকে আমূল বিদ্ধ করবে বলে। এই পরিস্থিতি এমনই এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে যে, কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। ইহুদিবাদী ইজরায়েল মুসলিম অধ্যুষিত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে মানবতার আর্তনাদ করে ভারি করে তুলেছে পৃথিবীর বায়মণ্ডল। বিশ্ববাসীর চরম দুঃসময়ে যাত্রাপালার বিবেক চরিত্রের মতো সায়ীদ আবুবকর উচ্চারণ করছেন, প্রেমবাদী কবি ছাড়া আর কোনো ত্রাণকর্তা মানুষের নেই। আসলে পৃথিবীর বয়েস হয়ে গেছে। কিয়ামত আমাদের নাকের ডগায়। এই সময়ে মানুষের সব পাপ শুষে নিতে আর কোনো যিশু ধরাধামে আসবেন না। গৌতম বুদ্ধও এখন আর আমাদের মাঝে নেই। যিনি মানুষের বোধকে উজ্জীবিত করে তুলবেন। শান্তির জন্য আমাদের তৃষ্ণার্ত চোখে ভালোবাসা ঢেলে দিতে আসবেন না আর কোনো কৃষ্ণ। বিশ্বমানবতার শান্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (স.) ছুটে এসে আগুনের গহ্বর থেকে আমাদেরকে রক্ষা করবেন না। সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন কেবল কবিরাই। কারণ, কবিরা এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে প্রেমের বার্তাবাহক। যদিও উল্লিখিত সকল মহাপুরুষই প্রেমের প্রচারই করে গেছেন মানুষের মাঝে। কিন্তু তাদের অনুপস্থিতিতে সেই দায়িত্ব এখন পালন করছেন কবিরা। সায়ীদ আবুবকর আসলে বলতে চাইছেন, হিংসাত্মক এই পৃথিবীতে একমাত্র প্রেমই মানুষের ভেতর শান্তি এনে দিতে পারে। আরেকজনকে অপর না ভেবে প্রেমের বন্ধনে যদি বাহুডোরে বেঁধে নেয়া যায় তাহলে একে অন্যের প্রতি হিংসাবোধও প্রতিরোধ করা যায়। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? ‘লিফলেট’ কবিতায় কবি বলছেন:

তবু তারা এঁটে দেয় হৃদয়ের খিল,
নিথর লাশের মতো পড়ে থাকে স্বপ্নহীন, অদৃষ্টের খাটে।

জি, প্রেমের বার্তা নিয়ে কবি মানুষের হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়লে মানুষ সেই দরজায় খিল এঁটে নিথর লাশের মতো পড়ে থাকে। দেখে মনে হয়, কারো চোখে কোনো স্বপ্নই আজ আর নেই। কিন্তু নতুনভাবে জেগে ওঠার, সম্ভাবনার সূর্যকে নতুনভাবে উদিত হতে দেয়ার সুযোগ করে দিতে মানুষকেই তো উদ্যোগী হতে হবে। মনে পড়ছে ফররুখ আহমদের সেই বিখ্যাত বাক্য, ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?’ এর জবাব দেয়ার মতো কেউ জেগে নেই। সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু কবি তো ঘুমোতে পারেন না। তিনি যে মহাপুরুষদের উত্তরাধিকারী। তাকে তো ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। সায়ীদ আবুবকরের কবিতা তাই মানবতার জয়গান হয়ে ওঠে। তিনি যেহেতু বৃহত্তর মানুষকে জাগাতে চান সেহেতু তার কবিতা সহজ শব্দের বিন্যাসে প্রেমের বার্তা প্রচার করে। কী বলছেন, কিভাবে বলছেন, সেদিকে যথেষ্ট সজাগ সায়ীদ। তার কবিতায় শব্দের ঘোরপ্যাঁচ নেই। শব্দকে কবিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কোনো তাড়াও তার নেই। তিনি কেবল মনোযোগ দেন, তার কবিতা সত্যের উচ্চারণে কতটা উচ্চকিত, সেদিকে। কবি বড় আক্ষেপ নিয়ে উচ্চারণ করছেন:

জাগো জাগো বলে আমি বাতাসে বাতাসে আপ্রাণ ছড়াই যেন ঘুগরার ডাক;
এক ঘর জেগে ওঠে, কোটি ঘর পড়ে থাকে নিশ্চল নির্বাক
অতলান্ত ঘুমের ভেতর। আজ তাই শোনিতের অক্ষরে অক্ষরে
লিফলেটি লিখি এই, সারা রাত ধরে।
কী নির্মম পরিস্থিতি, ভাবা যায়? কবি ডাকছেন, অথচ ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে না কেউই। ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে রক্তের অক্ষরে কবি রাত জেগে লিখতে থাকেন লিফলেট। কবিতার ভেতর দিয়ে সায়ীদের এই অভিব্যক্তি আমাদেরকে সচকিত করে। আজকের বিশৃঙ্খল পৃথিবী কেন শৃঙ্খলায় স্থিত হচ্ছে না, সে বিষয়েও আমাদেরকে সম্যক ধারণা পাইয়ে দেয়। পাঠক আবিষ্কার করবে, তিনি আসলে সমাজ-সচেতন কবি। কবিতা তার কাছে কেবল শব্দের বিন্যাস নয়, নিজের বিশ্বাস, মাটি, মানুষ ও মহাকালকে ধারণ করে কবিতা সায়ীদের কাছে জীবনবোধ।
নারীপ্রেম, ইতিহাস ও মিথ, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ের হদিশ আমরা পাই সায়ীদের কবিতায়। তার কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পাঠক সহজেই কবিতার ভেতর ডুব দিতে পারে। সহজেই বুঝতে পারে কবিতার ইঙ্গিত। নব্বইয়ের বেশিরভাগ কবির কবিতা সহজবোধ্য নয়। শব্দের জাঁকজমকে কবিতার ইঙ্গিত চাপা পড়ে থাকে কোথায় যেন। সায়ীদের কবিতায় ইঙ্গিত প্রকাশ্য, একইসঙ্গে শব্দের জাঁকজমকও প্রকাশ্য। এখানে জাঁকজমক বলতে আমি আসলে বোঝাতে চাইছি, শব্দের শিল্প সৌন্দর্য। শব্দের জৌলুশ নয়। শব্দের জৌলুশ দিয়ে সায়ীত পাঠকের চোখ ঝলসে দিতে আগ্রহী নন। বরং তার আগ্রহ, পাঠকের বোধের জগৎকে উজ্জীবিত করা। পাঠককে স্থবিরতা থেকে প্রাণস্পন্দনে সজীব করে তোলা। কবিতার ভেতর দিয়ে সায়ীদ পাঠকের সঙ্গে আত্মীক সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করেন। আর তার জন্য তিনি তৈরি করেন শব্দের সাঁকো। সুতরাং, শব্দকে তিনি স্বভাগত শিল্পকুশলতায় সংযত করেন।
কবিতায় যেসব উপমা সায়ীদ ব্যবহার করেন সেসব উপমা পাঠকের প্রতিদিনের চেনাজানা জীবন থেকেই নেয়া। ফলে, সেসব উপমা এবং উপমার চিত্রময়তা পাঠককে নিবিষ্ট রাথে সায়ীদের কবিতার প্রতি। পাঠকের মনোযোগ এতটুকু বিঘ্নিত হয় না। ‘প্রেমান্ধের ডাক’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

ভালোবাসা সমুদ্রের ঢেউ। বুকে সেই ঢেউ নিয়ে সমুদ্রের মতো আমি
নদী নদী বলে ডাকি। মানবী হে, তুমি সেই ডাক শুনে
সাহসের নদী হয়েছিলে।

সমুদ্রের ঢেউয়ের উপমায় ভালোবাসার যে দৃশ্যরূপ কবি এঁকেছেন, তা পাঠকের মাথার ভেতর সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের মতো আছড়ে পড়ে। যে পাঠক কখনো সমুদ্র দেখেনি, তার মাথার ভেতরও এই গর্জন আছড়ে পড়ে। কেননা, শিল্প আর জীবন একটি আরেকটির আয়না ও প্রতিবিম্ব। খেয়াল করার বিষয়, সমুদ্র বুকে নিয়ে কবি নদীকে আহ্বান করছেন। প্রেমিকা তার ডাক শুনে সাহসের নদী হয়ে ওঠে। প্রেমিকাকে সমুদ্র বলে নদী কেন বলছেন কবি? এর জবাব পেতে আসলে সায়ীদের কবিতাগুলোর পাঠ জরুরি। তার কবিতাগুলো পড়লে পাঠক আবিষ্কার করতে পারবেন, আকাশের মতো বিস্তৃত একটি হৃদয়। যে হৃদয় সায়ীদের। মানুষের ভালোবাসা পেতে ও ভালোবাসা দিতে তিনি সবসময় মুখিয়ে থাকেন। সেই যে বিনয় মজুমদার যেমন বলেছিলেন, ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ হ্যাঁ, সায়ীদ জানেন যে, তার সমুদ্রবিস্তারী ভালোবাসা ধারণ করার মতো সমুদ্র তার প্রেমিকা নয়। বড় সে আসলে ছোটখাটো একটা নদী। ‘সুলতানা ১’ কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘সে এমন মেয়ে, যার নদীচোখে চেয়ে পৃথিবীর নদীগুলো লজ্জায় আরো বেশি নদী হয়ে যায়।’ বোঝাই যাচ্ছে, প্রেমিকাকে নদী হিসেবে উল্লেখ করলেও সেই নদী পৃথিবীর নদীগুলো থেকে অনেক অনেক বড়। কত বড়, সে হিসাব আমাদের মতো মানুষ বাইরে থেকে মেলাতে পারব না। জগতের সকল প্রেমিক-প্রেমিকার ভেতর ব্যক্তিগত কিছু বোঝাপড়া থাকে, যা বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। কেবল অনুমান করা ছাড়া। আর কে না জানে, অনুমান অনেক সময় মিথ্যে হয়। আর তাই, পাঠক ও পাঠিকাগণকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করব, আমার মুখে শুনে সায়ীদ আবুবকরের কবিতা বিষয়ে অনুমান না করে তার কবিতা পাঠ করুন। আর উপলব্ধি করুন, মহাকালের ফলকে তিনি কী এপিটাফ উৎকীর্ণ করে যাচ্ছেন।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. এই প্রথম সায়ীদ আবুবকরের কবিতার স্বাদ পেলাম আবু তাহের সরফরাজের বিশ্লেষণে। সায়ীদ যে এমন কবিতা লেখেন আমার জানা ছিলো না। আসলে, আমি বা আমার দশকের কবিরা নতুন প্রজন্মের কবিতা পাঠে তেমন কোনো মনোযোগ দিইনি। আবার এই একই কথা আমার ও আমাদের দশকের কবিতা নিয়ে ষাট ও পঞ্চাশ এর কবিতা পাঠে মনোযোগ দেননি । ফলে একটা পাঠ-গ্যাপ রয়ে গেছে। এ-থেকে তৈরি হয়েছে এক অন্যের প্রতি অনীহা। এই অনীহা থেকে য়ে মহাসামুদ্রিক ফাটল, যা আমরা জানি কিন্তু দেকিনি কখনোই, সেই ফাটলের শিকার হয়েছি আমরা অনেকে। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে আমাদের। সরফরাজকে ধন্যবাদ তার নিবিড় পাটের ভেতর দিয়ে একজন কবিকে আলোতে নিয়ে আসার অভিনিবেশের জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা