তৈমুর খান
এক.
১.Teach me only teach love!
২.I will speak thy speech, love.
রবার্ট ব্রাউনিং A woman last word কবিতায় এই পংক্তি দুটি উল্লেখ করেছেন। আমাদের বেঁচে ওঠা, আমাদের শিক্ষিত হওয়া, আমাদের কথা বলা যাবতীয় জীবন ধর্মের ভেতরই One way of love-কেই দেখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ব্রাউনিং এর মতো তিনিও বলেছেন My whole life long I Learned to love. তাঁর সমস্ত কবিতাই ‘নীরা, তুমি হারিয়ে যেওনা’র আকুতিতে ভরা। নীরা প্রেমময়ী নারী প্রকৃতির সমূহ প্রতীক। সারা জীবন তার কাছেই প্রেম নিবেদন । জন্মের পর থেকেই প্রেমের শিক্ষা এবং মৃত্যু পর্যন্ত প্রেমের নিবেদন। জীবনের একটি পথ—সেই পথ শুধু প্রেমের।
সুতরাং কবিতা জীবনের এমন এক ক্রিয়াকর্ম যার মধ্যে অনুভূতির প্রতিটি রসায়ন জারিত হয়, প্রতিটি মুহূর্ত নিষিক্ত হয়, শব্দ সেইসব অনুভূতি ও সময়ের নিরীক্ষণকে বন্দি করে রাখে। কবিতা সেই কারণেই আবেগ ও শূন্যতার শিল্প হয়েও মানবচৈতন্যের ব্যক্তিপ্রজ্ঞায় সত্য অন্বেষণের পথেই অগ্রসর হয়। একজন নারী যেমন বহু নারীর সমন্বয়, একটি নাম যেমন বহু নামের প্রতীক—তেমনি, তেমনি প্রেমও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। শুধুমাত্র মনে রাখা দরকার, প্রেমের প্রজ্ঞা কখনো ধ্বংস হয় না। জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় নায়কের হৃদয়েও প্রেম ছিল, কিন্তু তার ক্লান্তি আর অবসাদ তাকে বিপন্ন করে তুলেছিল। বলেই ‘হৃদয়ের ভার’ সইতে পারছিল না। যৌনতা যদি ক্ষণিকের শুধু ইন্দ্রিয়জ আনন্দের অনুভূতি হয়, তবে প্রেম চিরন্তন। প্রেম যদি সমুদ্র হয়, যৌনতা সেখানে তরঙ্গ মাত্র, উঠেই আবার মিলিয়ে যায়। যৌনতায় মোহ থাকে, প্রেমে থাকে ত্যাগ। যৌনতা প্রেমকে সামর্থ্য দিতে পারে, প্রেম যৌনতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। যৌবন চলে গেলেও প্রেম ঘর ছেড়ে যেতে পারে না। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেমই জেগে থাকে, যৌনতা ঘুমিয়ে যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বয়স-বিকেলের আলোয় যখন নিজের প্রেম আর যৌনতার মাঝখানে দাঁড়ালেন তখন তিনি লিখলেন:
“আর কিছু নয়,দু’আঙুলের ডগায় নুন তোলার মতন
দাও ভালোবাসা!”
তিনি স্মৃতিচারণা করলেন:
“কবে লিখেছিলাম এমন,পঁচিশ বছর আগে?
কাকে, কার উদ্দেশ্যে, মনে নেই।”
তখন তিনি কী করেছিলেন— তাও জানালেন:
“শরীর চেয়েছে শরীর,দিয়েছি, নিয়েছি”
কিন্তু বর্তমানে সেই শরীরের কী খবর—তাও তিনি জানালেন:
“শরীর ডানা মেলে উড়ে গেছে,বিছানায় কয়েক ফোঁটা
ভিজে দাগ”
(দাও সামান্য: বাতাসে কিসের ডাক শোনো)
একলা দাঁড়িয়েও তিনি আজ আর যৌনতা নয়, প্রেমেরই প্রার্থনা করেন—যে প্রেম আত্মার, শাশ্বতকালের, যে প্রেমের মধ্যে বয়ে গেছে Is a deep study of incompleteness. কবিতার মতো জীবনও অসম্পূর্ণ তা পূর্ণতার দিকেই সর্বদা ধাবিত হতে চায়; কারণ ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ (১/১৬৪/৪৬)। অর্থাৎ পরম সত্য বা সত্তা ‘এক’ এবং সেখানেই “প্রাক তু ব্রহ্মাত্মত্বদর্শানাৎ বিষয়াদি-প্রপঞ্চো ব্যবস্থিত-রূপো ভবতি।” (৩/২/৪, শঙ্করভাষ্য), অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের যতদিন পর্যন্ত ঐক্যানুভূতি না হয়, ততদিন পর্যন্ত জগৎ-প্রপঞ্চের সবকিছু অবাধিতই থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই জগৎ-প্রপঞ্চ থেকেই যাত্রা করেছেন পরম ব্রহ্মানন্দের দিকে। তাঁর প্রেমানুভূতির রূপান্তর তাই দেহ ছেড়ে বিদেহ, শরীর ছেড়ে অশরীরী লাভ করেছে।
দুই.
নবীন যৌবনের সমারোহে যে স্বাক্ষর তিনি চেয়েছিলেন বাঁচার বঞ্চনা সয়ে সয়ে, সেখানে তার আকাঙ্ক্ষাও ছিল প্রবল প্রখর সূর্যের মতোই। বহু যুগের ঘুমভাঙা চোখে তিনি তরুণ গরুড়ের ক্ষুধা নিয়ে জেগে উঠেছিলেন। হাতে ছিল অর্ফিয়ুসের বাঁশরীর মতো সুরও,যার দ্বারা মৃত মানুষ জেগে উঠতেও পারে। প্রবল প্রেমের বন্যায় কালচিহ্নের স্বরূপ ‘তুমি’ সর্বনামটিকে প্রতিষ্ঠা করে নারী ও প্রেমিকার, নীরা ও স্ত্রীর এবং স্বকীয়া বা পরকীয়ার অনন্ত মূর্তিকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। সম্বোধন সূচক একটি মাত্র শব্দে তিনি তাঁর যৌবনযাপনের অবলম্বন হিসেবে যে পথ অন্বেষণ করেছিলেন তা ছিল প্রেমেরই পথ। শরীরীমায়া দূর হলে যে প্রেমেরই অবস্থান সেখানে এবং এক বিষাদ ও শূন্যতার হাহাকার তা কোনো সময় জানা গেছে; আবার কোনো সময় তাকে উল্লঙ্ঘন করেছেন। প্রথম কাব্য ‘একা এবং কয়েকজনে’ তিনি ‘তুমি’ কবিতায় লিখেছেন:
“তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখে জয়ের স্বাক্ষর।”
‘বন্দী জেগে আছো’ কাব্যের ‘তুমি’ কবিতা লিখেও তিনি সেই প্রেমকে আবহমান কালের প্রেক্ষাপটে নিয়ে গেলেন। তিনি হলেন পুরোহিত, বন্দনা করলেন ‘তুমি’র:
“তুমি শুভ্র,বন্দনীয়,নারীর ভিতরে নারী, আপাতত একমাত্র তুমি,
বাথরুম থেকে এলে সিক্ত পায়ে, চরণকমলযুগ চুম্বনে মোছার যোগ্য ছিল—
তিন মাইল দূরে আমি ওষ্ঠ খুলে আছি, পূজার ফুলের মতো ওষ্ঠাধর
আমি পুরোহিত, দেখো, আমার চামর বাহু, স্বতোৎসার শ্লোক
হৃদয় অহিন্দু, মুখ সেমেটিক, প্রেমে ভিন্ন কোপটিক খৃস্টান”
সমস্ত প্রেমিক হৃদয়, সমস্ত সভ্যতার, সমস্ত ধর্মের, সমস্ত যুগের অনুভূতিকে তিনি মিলিয়ে দিলেন। প্রেমিক ঋষি হয়ে আরাধনা মন্ত্রকে ব্রহ্মমন্ত্রে পরিণত করলেন। রক্ত-মাংস-ইন্দ্রিয় সরে গিয়ে জীবন জাগাতে চেয়ে কবি জীবনকেই ক্ষয় করে ফেললেন। শরীরের গান পূজার মন্ত্রে বদলে গেল।
অরুণা ও রুনির নীলঘুম দেখতে দেখতে চিরকুমারী নারীর মুখ কবি মনে করেছেন। তাদের পেটে এখনো সন্তান আসেনি, অথবা এখনো কেউ তাদের কর্ষণ করেনি। কবি সেই কুমারীদের কাছে তাঁর ভোগের অস্ত্র নিয়ে যেতে চান না। স্থূল পার্থিব শরীরও কবির কাম্য নয়। কিন্তু যে শাদাবাড়িতে ওরা ঘুমোচ্ছে তার দরোজায় পাহারা দিচ্ছে এক অদৃশ্য কঙ্কাল, যার হৃদয় নেই, মন নেই, অস্ত্র নেই। সে-যে ভ্রম, প্রপঞ্চ জাদুকরের মতো কবি তা জানেন। আসলে পরম প্রেমের সঙ্গে মিলিত হতে ইন্দ্রিয় প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় মায়াতীত হওয়া, এটাই তো ‘স্বরাজ্যসিদ্ধি’। ‘শাদাবাড়ি’ আসলে ‘ব্রহ্মের বিবর্ত’—পূর্ণতা সেখানেই অপেক্ষা করছে। কবি তখন প্রেমিক থেকে ব্রাহ্মণ(ব্রহ্মজ্ঞান সম্পন্ন) পবিত্র হয়েই যেতে চান:
“আমি অরুণার ঘুমে এক ঘুম ঘুমোতে চাই আজ মধ্যরাতে
অরুণার শাড়ি ও সায়ার ঘুম, বুকে ঘুম, কুমারী জন্মের
পবিত্র নরম ঘুম, আমি ব্রাহ্মণের মতো তার প্রার্থী।”
(কঙ্কাল ও শাদাবাড়ি: বন্দী জেগে আছো)
ব্রহ্মের তো কোনো কলঙ্ক নেই, মালিন্য নেই, চিরকুমারিত্ব নিয়ে সে অনন্তের স্বরূপ। জগৎ-জীবন তো imperfect, ব্র়হ্মে বিলীন হলে তবেই perfection আসে। বোধের গতিময় এই পরিবর্তনের চিত্রকে সুনীল তাঁর সৃষ্টিতে বারবার অনুধাবন করেন। বাস্তব জীবনের ক্রিয়া-কলাপে আধ্যাত্মিক জীবনের অন্বয় নিয়ে আসেন। তাই শাড়ি, সায়া ও বুকের ঘুমের ভেতর অরুণার সৃষ্টিতত্ত্বের উৎস লুকিয়ে থাকে। জগৎ-জীবনকে প্রতিপালনের ও প্রতিসাধনের অদ্ভুত দর্শন ও রহস্য থাকে। সেই মহাপ্রেমের কাছে পৌঁছাতে চান।
তিন.
‘দাঁড়াও সুন্দর’ কাব্যের ‘নারী ও শিল্প’ কবিতায় ঘুমন্ত নারীর এই অনন্ত রূপের মধ্যে আবার শিল্পকেও খুঁজে পেয়েছেন। নারী যে সৃষ্টিতত্ত্বের শিল্পই তা মোনালিসা থেকে খাজুরাহোর মূর্তিগুলিতে প্রমাণিত। কবি এই কবিতায় লিখলেন:
“নারী ও ঘুমন্ত নারী এক নয়
এই নির্বাক চিত্রটি হতে পারে শিল্প, যদি আমি
ব্যবধান ঠিক রেখে দৃষ্টিকে সন্ন্যাসী করি
হাতে তুলে খুঁজে আনি মন্ত্রের অক্ষর
তখন নারীকে দেখা নয়, নিজেকে দেখাই
বড় হয়ে ওঠে বলে
নিছক ভদ্রতা বশে নিভিয়ে দিই আলো”
শিল্পকে প্রেমের এবং প্রেমকে সন্ন্যাসীর অক্ষরমন্ত্রে পর্যবসিত করেছেন কবি। ‘নির্বাক চিত্রটি’ তো স্তব্ধতার অবিরাম ক্ষেত্রে সিদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। সন্ন্যাসী দৃষ্টি নিয়ে দেখা তো সাধকেই রূপান্তরিত হওয়া যা নির্মোহ, প্রসারিত— কেননা তারপরেই see-life থেকে self-life-এর দিকে কবি নজর দেন। তখন আর চোখে দেখা নয়, তৃতীয় নয়নে দেখতে হয়, হৃদয়ে দেখতে হয় বলেই লিখেছেন:
“নিছক ভদ্রতা বশে নিভিয়ে দিই আলো।”
অন্ধকারেই রবীন্দ্রনাথও দেখতে চেয়েছিলেন ‘যখন আলোক নাহিরে’ বলে। সুনীলও সেই চিরসত্যের উৎসে একই বোধে নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন। প্রেম যে নারীতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, নীরাতেও থাকেনি—আবহমান কালের পর্যায়ে অশরীরী বোধের সামীপ্য আদায় করে নিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। কার্লাইল ভিন্ন প্রসঙ্গে একটি কথা বলেছেন: It is a great thing for a nation that it gets an articulate voice.এখানে আত্মিক প্রেমের ক্ষেত্রেও সুনীলের বক্তব্যটি articulate voice-এর নামান্তর। প্রথম যৌবনের কবিতাগুলিতে শরীরী দীপ্তি থাকলেও মহতী প্রজ্ঞার একটি সাবলীল গতিও আছে , যার দ্বারা সহজেই তিনি স্থুল ভোগাকাঙ্ক্ষাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। তাঁর শিল্পে বিষাদ প্রতিমা গড়ে উঠেছে কোথাও, প্রেমে নৈরাশ্যের হাহাকারও আছে, নিছক শরীরের রগরগে উত্থানও আছে। কিন্তু এসবের পাশাপাশি আছে—আলোর ইশারা—’জাগরণ হেমবর্ণ’, নীরার জন্য স্তোত্র রচনা, উদাসীন সঙ্গম শেখার আকুতি।
চার.
আমরা জানি আমাদের দুর্বলতাই আমাদের আত্মিকসংকটের পথে ঠেলে দেয়। যতক্ষণ না নিজ সত্তাকে সংবদ্ধ দৃঢ় করতে না পারব ততক্ষণই আমরা বিচ্ছিন্ন, বিপন্ন বিমূঢ় যুগের সন্তান হয়েই থাকব। এই বিষণ্ণ-বিমূঢ়তাকেই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন বলেই লিখেছিলেন:
“বীর্য দেহো তোমার চরণে পাতি শির
অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির।”
এই বীর্য পৌরুষ জাগাবার, ব্রহ্মবোধে উপনীত হবার এবং মোহ ও ভোগ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা। মিল্টন ‘প্যারাডাইস লস্ট’ কাব্যে লিখেছেন:
“What besides
Of sarrow and dejection and despair
Our frailty can sustain.”
এই দুঃখ-বিষাদ-হতাশা জীবনের পরাজয়ের গ্লানি থেকে উত্তরণের মন্ত্রটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানতেন, বলেই শরীরকে তিনি মহৎ প্রেমে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবেই দেখেছেন। স্বকীয়া, পরকীয়া বা পরনারী বা সুন্দরী যুবতী তাঁর প্রেমের বিষয় হয়ে ওঠেনি। নীরাকে প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে প্রেমকে তার মধ্যে শুধুমাত্র কেন্দ্রীভূতও করতে চাননি। নানা সময়ে বহু নারীর সান্নিধ্য সাহচর্য পেয়েছেন। তারাই কবির কবিতা রচনার প্রেরণাধাত্রী হয়েছেন। ‘পরকীয়া ও স্বকীয়া’ একই শিরোনামে ‘কবিতা প্রতিমাসে'(জুন ২০০৫) পত্রিকায় জানিয়েছেন: “নারীরা নানা রূপে, নানা চেহারায় আমার জীবনে ও কবিতায় এসেছে। আগেই বলেছি, কখনোই তারা একজন নির্দিষ্ট নারী হিসেবে আসেনি; তারা নানা নারীর নির্যাস হিসেবে এসেছে।” অতএব প্রেমের কবিতায় সুনীলকে বেঁধে রাখা যায় না। তাঁর আত্মিকজীবনের স্বয়ংঋদ্ধ মর্মর যখন ভাষা পেয়েছে—তখনই তা প্রেমের কবিতা হয়ে উঠেছে। এই প্রেম শুধুমাত্র নিজেরই রূপান্তর ঘটানোর প্রক্রিয়া। তাই কখনো দেশপ্রেম, কখনো মানবপ্রেম, কখনো ভাষাপ্রেম, কখনো জাতিপ্রেম কবিকে বিচলিত করেছে। নীরার অসুখ হলে কলকাতার অসুখ হয়, নীরা ভালো না থাকলে কেহই ভালো থাকে না—এ প্রেম তো ব্যক্তির নয়। দেশ থেকে নির্বাসন দিলে কবি ঠোঁটে অঙ্গুরী ছোঁয়াবেন এবং বিষপান করে মারা যাবেন— এ-প্রেমও সংকীর্ণ স্বার্থান্ধ প্রেম নয়। কবিতার জন্য অমরত্ব তাচ্ছিল্য করা—এই প্রেমেরও কি ইতিহাস আছে? হয়তো নিজের সঙ্গে নিজেরই গভীর প্রেমের সম্পর্ক সুনীল গড়ে তুলেছিলেন। এই আত্মপ্রেমের চূড়ান্ত পর্যায়গুলিও তিনি কবিতা করে তুলেছেন। নিখিলেশের সঙ্গে তাঁর সত্তাকে ভাগ করে নিয়েছেন, মুখোমুখি দেখেছেন, বুঝতে চেয়েছেন, ডাকও দিয়েছেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত “কেউ এলো না সঙ্গে,না প্রশ্ন না ছায়া, না নিখিলেশ না ভালোবাসা।”
পাঁচ.
আত্মরতির দৈর্ঘ্য মাপতে মাপতে কবি শূন্যতাতেই গিয়ে উপনীত হন। পার্থিব সত্তা অপার্থিব সত্তায় ‘বড়ো আমি’র ভেতর ডুবে যায়। ‘ছোটো আমি’ এই ঘর-সংসার, নারী ও শরীরের ভেতর রাস্তা খোঁজে আর হতাশ হয়, তখন সেই ক্লান্ত বিষণ্ণ হতাশাকে মুক্তি দিতেই ‘বড়ো আমি’র উদয় :
“কেউ শরীরবাদী বলে আমায় ভর্ৎসনা করলে, তখনই ইচ্ছে হয়
অভিমানে অশরীরী হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাই!
আবার কেউ ‘অশরীরী’ শব্দটি উচ্চারণ করলে আমি কান্নার মতন
ভয় পেয়ে তীব্র কণ্ঠে বলি,শরীর, তুমি কোথায়? লুকিও না,
এসো, তোমাকে একটু ছুঁই!”
(শরীর অশরীরী: বন্দী জেগে আছো)
‘শরীর’ দৃশ্যমান পার্থিব জগৎ, রক্ত-পুঁজ-হাড়-মজ্জার দেহ কাঠামো; কিন্তু অশরীরী ব্রহ্মশরীর, অদৃশ্য, অপার্থিব অনন্ত সত্তার আধার। ইহজগৎ থেকে পরজগতে পদার্পণের ভয় বা আড়ষ্টতা সকলেরই থাকে। কবিও মানবদেহ ধারণকারী, তাই তাঁরও এই দোলাচল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাতেই মুক্তি অপেক্ষা করে আছে। কারণ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার পথটি সমাজ-পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে ঋষি পরাশরদের মতো সন্ন্যাসীরও দেখা মেলে। কিন্তু সমাজ-পুলিশ পাহারা দেয়; আসঙ্গ লিপ্সাকেও অস্বীকার করা যায় না। তা তো চরিতার্থে উন্মুখ হবেই। এটাই জৈব ধর্ম, শরীর প্রেমের প্রতীক। কিন্তু কবি?
“না, শরীর নয়, আমি এখন আকাশের নিচে
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, সমস্ত অন্তরীক্ষ জুড়ে তালগাছের মতন
দীর্ঘ কোনো কণ্ঠস্বর আমায় বলছে দাঁড়াও!”
এই সময় যদি চোখে জল আসে, পায়ে ধুলো লাগে, গায়ে বাতাস ছোঁয় , চোখ নীল আকাশ দেখে—সবই শরীর। কবি জানালেন:
“আহা শরীরের দোষ নেই, সে অশরীরীর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে।”
সমূহ প্রেমের প্রকাশ তো এখানেই, আমরা প্রত্যেকেই দীর্ঘ কণ্ঠস্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের প্রবৃত্তির গান একসময় থেমে গেছে। পার্থিবের মোহনীলাঞ্জন কেটে গেছে। তখন পৃথিবীটাই ‘বিদেশ’। অশরীরীর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কবির কণ্ঠেই স্বীকারোক্তি দিই:
“এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?”
(সত্যবদ্ধ অভিযান)
অথবা—
“এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?”
⋮ (ঐ)
শরীরের সঙ্গে যুদ্ধ করে শরীর ছেড়ে চলে গিয়ে যেমন আবার শরীরের কাছেই ফিরে আসতে হয় উদাসীন সঙ্গমের জন্য, তেমনি পার্থিব আসক্তি থেকেই নিরাসক্তির মন্ত্র নিতে হয়। চারিপাশে অপ্সরাদের নাচ না থাকলে যেমন ধ্যান জমে না, ঠিক তেমনই বাঁধন না থাকলে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও বৃথা।
ছয়.
একশো আটটা নীলপদ্ম তুলে আনা কবিকে , ষাঁড়ের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা কবিকে বা ভুবন ডাঙার মাঠে ফুসফুস ভরে বাতাস নেওয়া কবিকে শেষ পর্যন্ত ভাবতেই হয়েছে:
“শরীর ছেলেমানুষ, তার কত টুকিটাকি লোভ”।
যখন সব কামের আগুন নিভে গেছে, বিছানা বদল হয়েছে—তখনই এসেছে ভালোবাসা :
“ঠান্ডাবুকের কাছে স্বেদময় মুখ
ঊরুর উপরে আড়াআড়ি ফেলে রাখা
এইমাত্র লোভহীন হাত
চরাচরে তীব্র নির্জনতা,এই তো সময় ভালোবাসার—
ভালোবাসা মানে ঘুম, শরীর-বিস্মৃত পাশাপাশি
ঘুমোবার মতো ভালোবাসা।”
(ভালোবাসা: বন্দী জেগে আছো)
এক শান্ত-সমাহিত নিস্তব্ধতাই যেন At last the waves stilled. অথবা, Still as the grave— যেখানে জীবনের চূড়ান্ত বিনম্রতাই প্রকাশ পায়, অথবা চিরবিশ্রামের সম্মোহনে চলে যায়। ভালোবাসা তো জীবনের মুক্তি রচনাই,অসীমে বিলীন হওয়ার অপেক্ষার সাধনা। সব যুগের সব শিল্পী-কবির মধ্যেই এই সাধনা দেখা গেছে বলেই জীবনানন্দ দাশও ‘অবসরের গান’ কবিতায় লিখেছেন:
”অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়,
পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়;
সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে,
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে,
এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে!”
ক্লান্ত বিষণ্ণ সভ্যতার রূপ আর জীবনের ভোগ প্রাচুর্যের নিরন্তর আয়োজন থাকা সত্ত্বেও ‘ঘুমাবার সাধ ভালবেসে’-ই জীবনের আয়ু ফুরিয়ে আসে। ‘কোনোদিন জাগিবে না আর’ এই অঙ্গীকার নিয়েই ভালোবাসার দরোজায় করাঘাত করা। এই দিক থেকে বিচার করলে সব কবিতাই ভালোবাসার মন্ত্র এবং ঘুমাবার আকাঙ্ক্ষায় সম্পৃক্ত। মুখোমুখি অন্ধকারেই বনলতা সেন যেমন থাকে, তেমনি নীরাও থাকে। কিন্তু এই নারী প্রতীক শিল্প, অনন্ত কবির শিল্প— যা হল ‘এ শিল্প মধুর কিন্তু ব্যক্তিগত নয়’—এদের নির্বাসনও নেই। পৃথিবী যতদিন থাকবে, মানুষ যতদিন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে—এই নীরা এবং বনলতাও থাকবে। তাদের মৃত্যু নেই, দেশ-কাল শরীর-অশরীর ব্যবধান নেই। শিল্পীর তুলির রং, কবির কলমের ফুটকি-রেফ্-বর্ণ তাদের দিকে লক্ষ্য করে ছুটে যাবে। মূর্তি ফুটে উঠবে। বুকে মাংসের গন্ধ, যোনিতে কোমল জ্যোৎস্না লেগে যাবে, মধুকূপি ঘাসের মতো রোম গজাবে, জঙ্ঘা-ঊরু-বুকের উত্থান ঘটবে; সবই স্থূলশরীরময় যৌবনের ফেনায়িত আবরণ। এসবই হয়তো প্রেমের আয়োজন। প্রেমিক তো পূজারী, ব্রাহ্মণ। পৃথিবী যখন এই মাংসময় যোনিসম্ভূত, স্তনদায়িনী তখন তো কবিকে শ্লোক উচ্চারণ করতেই হয়। সেই আদিজীবনের অনন্ত দৃষ্টিতে সুনীল আমাদের চোখ খুলে দেন। আর জীবনের দৌড় শেষ হলে ঘুমাবার আয়োজনে চোখ বন্ধ করার মগ্নবিশ্রামের ইঙ্গিত দেন। যাকে আমরা অশ্লীল বা স্থূল শরীর বা নগ্নতার প্রকাশ বলি, আসলে তা সমূহ রূপেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ, তাকে উপলক্ষ করেই অরূপ সঞ্চারী বেদনায় আমরা কাতর হই। বোধের অতলান্ত সংসর্গে এক দার্শনিক বাস করেন, তিনি তো সর্বদা একহাতে আমাদের ডাকছেন, অন্যহাতে নিবৃত্ত করছেন। আমরা স্বভাবতই দ্বিধান্বিত। কাঁদা-হাসা ক্রিয়া দুটিকে সঙ্গে নিয়ে এগোচ্ছি। রাস্তা খুবই কাছে, তবু বহুদূর মনে হচ্ছে। কারণ একটাই ‘পিছুটান’ —”কী যেন বাকি রয়ে গেল, কী যেন, আঃ এত পিছুটান!”