ড. ফজলুল হক তুহিন
চিত্রা নদীর সঙ্গে আজীবনের প্রেম, নাড়ির সম্পর্ক; তাই বিদেশ-বিভুঁই ঘুরে এসে সেই নদীতীরে কৃষক, জেলে, কামার, কুমারের জীবনের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধের তাগিদে সুলতানের ফিরে আসা, স্থায়ী ঘরবাঁধা। এসএম সুলতান এমন একজন শিল্পী যাঁর কাছে শিল্পকর্ম ও জীবন অভিন্ন। প্রথম জীবনে পাখির মতো উড়ে উড়ে বেড়িয়েছেন এবং পাখির মতো আকাশ থেকে জীবন-জগতকে দেখেছেন। অবলোকন করেছেন সবুজাভ দিগন্ত, সুন্দর গ্রাম, সুখী মানবসমাজ, সবকিছু কেমন ছবির মতো ল্যান্ডস্কেপ। দ্বিতীয়ত, জীবনে উপলব্ধি আসে বাংলাদেশ তো এমন নয়, ছিল না কখনও; আর কামনা করেন না এমন নান্দনিক দৃশ্যময়তা। তাই বাউণ্ডুলে সুলতান ফিরে আসেন আপন জগতে, শেকড়, উৎসভূমিতে।
বঙ্গদেশে, পূর্ববাংলায় বা বাংলাদেশে আবহমান কাল ধরে যে ধরনের গ্রামীণ অবকাঠামো, কৃষিব্যবস্থা, শস্যসম্ভার, ঋতুভিত্তিক চাষাবাদ প্রণালী, আদিম কৃষি উপকরণ প্রচলিত, এক কথায় উৎপাদনব্যবস্থা ও পদ্ধতি যে ধারায় বিরাজমান, তাকে প্রচলিত অর্থে নান্দনিক ও আধুনিক বলা যায় না। এই ব্যবস্থা গ্রামীণ বর্তমানতাকে সুন্দর দৃশ্য বা ল্যান্ডস্কেপরূপে চিহ্নিত করা অসঙ্গত। অবশ্য অনেক পরিবর্তন হয়েছে ও হচ্ছে। তবু তাকে তথাকথিত নান্দনিক বলা যুক্তিযুক্ত নয়। বঙ্গদেশে চিত্রকলার আধুনিকতা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আগত; স্থানিক সমাজ থেকে উদ্ভূত নয়, সৃষ্ট নয়। ফলে বাংলাদেশের নদীনির্ভর ও আবাদকেন্দ্রিক প্রকৃতি, মানুষ, উৎপাদনব্যবস্থা ও সংস্কৃতির নিজস্ব রঙ-রেখা-ঢং শিল্পীদের আপন চোখে সম্পন্ন হয়নি; যেটুকু হয়েছে তা দূর থেকে দেখা পর্যটকের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার মতো। পাখির চোখের মতো উপর থেকে দর্শন, যা বাস্তবতাকে অস্বীকার করার নামান্তর।
এই দেখা দুই ধরনের : নান্দনিক ও দার্শনিক। পশ্চিমের ধার করা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলাদা হয়ে যান জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ও এসএম সুলতান। সুলতান দৃষ্টির বৈভব অর্জন করেন আপন চোখে নিজস্ব স্থানিক বাস্তবতাকে কল্পনা, ইচ্ছা ও স্বপ্নের রং মিশ্রণ করে। এ-ক্ষেত্রে তাঁকে ব্যাঙদৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করা যায়; যে প্রাণী মাটিলগ্ন ও মাটিবর্তী হয়ে সবকিছু দেখে।
সুলতানের ছবিতে দেখা যায় বিশাল ক্যানভাসে কৃষকের উপস্থিতি: কর্ষণের দৃশ্য, বীজবোনা-রোদেপুড়ে ধান রোপণ, নিড়ানি দেয়া, ফসল কাটা, গরুর গাড়েতে বা মাথায় করে ফসল নিয়ে বাড়িফেরা, গরুর মাড়াই-ঝাড়া, ঢেঁকিতে ধানভানা ইত্যাদি বাস্তব কর্মযজ্ঞের দৃশ্যকল্প। এই কিষাণের সঙ্গে কিষাণির সার্বক্ষণিক উপস্থিতিতে সম্মিলিত আবাদ-মেহনত-কর্মকৌশল। জমিন ও নারী একই সঙ্গে বিরাজমান; কারণ-শস্য ও সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র যথাক্রমে জমিন ও নারী। প্রাচীন কৃষিব্যবস্থা ও বিশ্বাসে নারী ও জমিনের উর্বরতাকে সমান্তরাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর কিষাণ-কিষাণির স্বাস্থ্য পেশিবহুল এবং ভঙ্গি ঋজু-দৃঢ়-কর্মঠ।
এ ধরনের শারীরিক ধরন তার কাম্য, তিনি স্বপ্ন দেখেন এই রকম; সঙ্গে প্রেরণা জুগিয়েছে অতীতের কৃষি সমৃদ্ধির ইতিহাস। কোনো কমনীয়-নমনীয় সুন্দরের রং-রেখা ও ভঙ্গির আশ্রয় নেননি শিল্পী। একই সঙ্গে নদীতে-খালে-বিলে লোকযন্ত্রের সাহায্যে মাছধরা, কামারের কৃষিযন্ত্র তৈরি করা, কুমারের মাটির পাত্র-বাসন-কোসন-হাঁড়িপাতিল বানানো ইত্যাদি গ্রামজীবনের নানান উপকরণ নির্মাণের ছবি তিনি আঁকেন অত্যন্ত কাছে থেকে। গ্রামবাংলার শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী জীবনের দর্পিত উপস্থিতি ও কাক্সিক্ষত রূপকল্প সুলতানের কাজের প্রধান দিক। এখানে আছে একদিকে ঐতিহ্যের রূপায়ণ, সরলতা, সজীবতা ও সচলতা; অন্যদিকে মূর্ত রূপের প্রাধান্য– এসব বৈশিষ্ট্য পশ্চিমের শিল্পকলায় নেই; সেখানে আছে শেকড়ছিন্ন, জটিল ও বিমূর্ত ধারা। সুলতান তাই গ্রামবাংলার সরল নায়ক যে সংগ্রামী জনতার জীবন-জীবিকার এবং ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির রূপায়ণ ঘটিয়েছেন রঙ-রেখার সাহায্যে তা একান্ত বঙ্গীয় ও এশীয়।
বাউণ্ডুলে শিল্পী তাই ফিরে আসেন সংগ্রামী শ্রমজীবী সরল মানুষের কাতারে; পাখির মতো উড়ে উড়ে দিগন্তে হারিয়ে যান না। সেজন্য স্থানীয় কৃষিনির্ভর ও নদীনির্ভর প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের বাস্তবতা, স্বপ্ন, কল্পনা, কামনা ও প্রজন্মধারার গর্বিত রঙ-রূপের বৈভব তাঁর ক্যানভাসে উদ্ভাসিত। দূরের ও অতীতের কল্পিত গ্রামবাংলা ও মানুষ তিনি আঁকেননি; বিষয়ও করেননি তাদের; বরং নিজের পায়ের নিচের মাটি ও মাটিলগ্ন আবাদি জমিনের বাস্তবতাকে ধারণ ও প্রকাশ করেন বর্তমানতায় ও বাস্তবতায়।
কোনো ধরনের অতীত ও কল্পনার দৃশ্যকল্পে সরল নায়কদের নির্মাণ করেননি শিল্পী। তাই বলে শিল্পরূপের কোনো অভাব ঘটেনি সেখানে। সেটা নিয়ে শিল্পী ভাবেনওনি কখনও। সুলতান তাই একক অনন্য শিল্পী, আলাদা একটা শিল্পধারা নির্মাণের ক্ষেত্রে।
জগৎ ও জীবনকে দেখার ক্ষেত্রে সুলতান পশ্চিমের ধার করা শৈল্পিক পথ ও পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করেন এবং ফিরে আসেন স্বাতন্ত্রিক বঙ্গীয় ধারায়; যে ধারার সূচনা জয়নুল আবেদিনের মাধ্যমে। তাই সুলতান গ্রামবাংলাকে নান্দনিক ও দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখেননি। জমিন বলতে তিনি স্বস্তি-মুক্তি-দৃষ্টিনন্দনের জায়গা নয়; এই জমিন গ্রামের সেই সরল নায়কের জীবনযুদ্ধের ক্ষেত্র। জমিন বলতে তিনি কর্ষণ-আবাদ-বিবাদ-রক্তপাত-মেহনত-স্বত্ব-খাজনা-দখল-শস্য ও খোরাকির আধার ভাবেন। কোনো ধরনের বেড়ানো বা দৃষ্টির রিলিফ বা কাব্যচর্চার জায়গা নয়; জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই জমিন। এক কথায়, মানুষের বাঁচা-মরার লড়াইয়ের ক্ষেত্র হলো জমিন বা প্রকৃতি। নিসর্গ বলতে পশ্চিমে যা বোঝায়, বাংলার প্রকৃতি মোটেই তা নয়। সুলতান আসলে জমিনকে সব ধরনের উৎপাদনের জায়গা হিসেবে বিবেচনা করেছেন; আর এই জমিন-ই হলো সুলতানের প্রকৃতি।
প্রকৃতিকে কোনো ধরনের দৃষ্টিনন্দন, সৌন্দর্য চর্চা বা দর্শনচর্চার উৎস ভূমিরূপে দেখেননি শিল্পী- এই দেখা ইউরোপ-আমেরিকার; প্রাচ্যের নয়। সুলতান তাই আপন দৃষ্টিতে আপন প্রকৃতি আপন লোকদের জীবনজগৎ এঁকেছেন বিশাল হৃদয়ে, বিস্তৃত ক্যানভাসে। পশ্চিম থেকে আগত আধুনিকতার সঙ্গে সুলতানের আধুনিকতার তফৎ এখানেই। সুলতানের অঙ্কিত বাংলার জমিন তাই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভূগোল থেকে, যে ইতিহাস এবং ভূগোলের মধ্যে আছে কৃষকের সঙ্গে জমিন-ধানক্ষেত-হালবলদ ও জমিন দখলের সম্পর্ক। তাই সুলতানের কাজে কিষাণ ও ভূমি একটি ‘আবহমান বর্তমানতা ও বাস্তবতা’ নিয়ে উপস্থিত। ইংরেজ-ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্যে অঙ্কিত কাব্যিকতা ও দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য থেকে তা আলাদা। তিনি নিজস্ব শিল্পভুবনের ‘সুলতান’– যেখানে কৃষক গ্রামীণ জীবনের আবহাওয়ায় ঋদ্ধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি পুঁজিবাদ-বিমুখ ও বিরোধী।
সুলতানের ছবির ধারা একান্ত স্থানিক ও দেশজ; আবার আবহমান। একে ‘দেশজ আধুনিক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিদগ্ধ শিল্পসমালোচক বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর– ‘দেশজ আধুনিকতা : সুলতানের কাজ’ গ্রন্থে। সুলতানের ছবির আঙ্গিক একই সঙ্গে দেশজ আধুনিক ও আবহমান। এই আধুনিকতা আমাদের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র আধুনিকতা; বৈশ্বিক আধুনিকতা থেকে আলাদা এই ধারণা। তাঁর সৃষ্ট প্রকৃতি ও মাটি-নদীবর্তী মানুষেরা তাই আমাদের একান্ত আত্মীয়। শিল্পী যেমন ফিরে এসেছেন আপন জগতে, তেমনি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন বৈশ্বিক আধুনিকতা। সেজন্য তাঁর কাজে কৃষক, পশুপাখি, হালবলদ, নৌকা ইত্যাদির প্রতীক ফিরে যাওয়া, প্রত্যাখ্যান এবং নির্মাণ করার। এসব থেকে তৈরি হয়েছে নিজস্ব স্থানিক আধুনিকতার দুই পরিপ্রেক্ষিত এবং দুই পরিপ্রেক্ষিত উদ্ভূত স্থানিক বাঙালি সংস্কৃতি। বৈশ্বিক আধুনিকতার বিপরীত হচ্ছে স্থানিক আবহমানতা, এই আবহমানতা রুখে দাড়িয়েছে মেকি ও ফাঁপা আধুনিকতার বিপক্ষে। সেজন্য স্থানিকতা একই সঙ্গে আবহমানতা এবং প্রতিরোধ।
জাহাঙ্গীরের মতে, এই প্রতিরোধ থেকে তৈরি হয় জীবনদর্পিতা : জমি-ধান-সন্তান-হালবলদ ও প্রেয়সীর জন্য রুখে দাড়ানোর ভঙ্গি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা আধুনিকতার যে সংজ্ঞা তৈরি করেছে, সে সংজ্ঞায় স্বাভাবিকতা, সরলতা, স্বতঃস্ফূর্ততা প্রয়োজনীয় শর্ত নয়। সেজন্য এসব গ্রাম্যতার সঙ্গে যুক্ত কিংবা গ্রাম্যতার সমান্তরাল হিসেবে বিবেচিত। এই প্রক্রিয়ায় বৈদগ্ধ্য নাগরিকতার সঙ্গে এবং স্বাভাবিকতা গ্রাম্যতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ফলে ‘আধুনিক সমালোচকরা’ গোবিন্দ দাস এবং জসীমউদ্দীনকে ‘আধুনিক’ বলতে নারাজ এবং কুণ্ঠিত।
সুলতান তাই পাখিচোখ থেকে ব্যাঙদৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বিপরীতে স্থাপন করেন দেশজ আধুনিকতা। ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্রে গ্রামীণ সংস্কৃতি অধঃস্তন করার যে শিল্প ও মনোভঙ্গি বিরাজমান, তাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং নির্মাণ করেন নিজস্ব শিল্পভুবন। বুর্জোয়াদের নির্মিত নান্দনিক ও বোহেমিয়ান গ্রামীণ কল্পরাজ্য বা স্বর্গরাাজ্যের বিপরীতে সুলতানের কাজ বাস্তবতা ও বর্তমানতায় উজ্জ্বল। সুলতান উপনিবেশের এসব প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে ‘দেশজ আধুনিক’ আঙ্গিকে নিজস্ব শিল্পজগত্, চৈতন্য ও পদ্ধতি নির্মাণ করেন।