প্রচ্ছদপ্রবন্ধস্বাধীন ভারতে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়

লিখেছেন : তৈমুর খান

স্বাধীন ভারতে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়


🍁
তৈমুর খান
🍁

ভারত স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিমদের নিয়ে যত রাজনীতি হয়েছে তত তাদের উন্নয়নের কথা ভাবা হয়নি। বিশেষ করে পাকিস্তান থেকে বাংলা ভাগের পর এবং বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা আজও বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। যে বিষবাষ্পে আজও শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে আমাদের কষ্ট হয়। দেশভাগের পর বহু অভিজাত মুসলিম পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি দেয়। বহু হিন্দু পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। সরকারিভাবেও তাদের সুবন্দোবস্ত করা হয়। সমস্ত রকম রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। ভারতীয় নাগরিক হিসেবেও স্বীকার করা হয়। ভারতের তথা বাংলার মুসলিম জনসংখ্যার সিংহভাগ কিন্তু দেশ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। কিংবা ত্যাগ করতে চাইলেও তাদের আশ্বস্ত করা হয় এদেশীয় নাগরিক হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করার জন্য। যেহেতু ভারত সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশ হিসেবে পরিগণিত হয় সেহেতু এখানে মানবিক উদারতার বাতাবরণ রাষ্ট্রীয়ভাবেই গণ্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমরাও আশ্বস্ত হন। এই ইতিহাস প্রায় সকলেরই জানা।
কিন্তু স্বাধীন ভারতে মুসলিমরা বারবার তাদের অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান এবং চলনবলনকে ভারতীয়ত্বে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে নিয়েও শুধু ধর্মের কারণেই ঘৃণা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে। যারাই শাসক হিসেবে ক্ষমতায় এসেছে তারাই ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তাদের উন্নয়নের জন্য আলাদা করে কোনো কিছু যেমন করেনি, তেমনি সবকিছু থেকে তাদেরকে দূরে রাখতে চেয়েছে। ফলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষিত মুসলিম তরুণরা অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়েছে। শাসকশ্রেণি মূলস্রোত থেকে বিচ্যুত করে মুসলিমদের পাইকার, চটিদার, হকার, শ্রমিক, খুদে ভাগচাষি, মুটেমজুর, ঠেলা-ওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, বিড়িশিল্পী ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণির পেশাদারীতে তাদের সিংহভাগকেই সংযুক্ত রেখেছে। সুতরাং সমাজে নিম্নস্তরের জীবিকা নির্বাহী এই মানুষেরা এক প্রকারের তাচ্ছিল্য, ঘৃণা ও অবহেলা নিয়েই তারা জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। খুব পরিকল্পিত এবং সুচারুভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে হীন ও জঘন্য করে তুলবার প্রচেষ্টা বহুদিন থেকেই চলে আসছে। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানকে খাড়া করে এবং পরবর্তীকালে ওসামা বিন লাদেনকে তুলে ধরে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের চরিত্রকেই নির্ধারণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ইসলামী ধর্মীয় সংগঠন এবং মাদ্রাসাগুলির শিক্ষা ব্যবস্থা ও মুসলিমদের ধর্মপালনের প্রতিও কটাক্ষ করা হচ্ছে ‘দেশদ্রোহী কাজ’ বলে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে নাটক ও উপন্যাসে মুসলিম সম্রাটদের চরিত্রগুলিতেও হিন্দু বিদ্বেষী এবং পরনারী লোভী মনোভাব আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়েও মুসলিমদের প্রতি অন্যান্য সম্প্রদায়ের দূরত্ব বাড়ানোর ব্যাপারটি সম্পন্ন করার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বারবার বোঝানো হচ্ছে মুসলিমরা এদেশের নয়, তাদের আসল দেশ পাকিস্তান। তারাই ভারতকে ভাগ করেছে। তারা ভারতকে ভালোবাসে না। তারা ভারতের ক্ষতি করতে চায়। মুসলিম ছাড়া তারা অন্যান্য সম্প্রদায়কে কাফের বলে গণ্য করে। অতএব অন্যান্য সম্প্রদায়কে হত্যা করার নির্দেশ তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনে আছে—ইত্যাদি এইসব ভ্রান্ত বার্তা যেমন তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি একটা সম্প্রদায়কে সর্বদা দেশদ্রোহী হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম ভালোবাসার বিয়েকে ‘লাভ-জিহাদ’ নাম দিয়ে প্রবলভাবে উগ্র বাতাবরণ তৈরি করছে। কোথাও কোথাও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে: মুসলিমদের সঙ্গে লেনদেন করবেন না, মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনোকিছু কিনবেন না, মুসলিমদের কাছে জায়গা-জমি বিক্রি করবেন না ইত্যাদি আরও কত কিছু আছে। কয়েকজন চোর বা দুষ্কৃতী মুসলিম নামধারী হলেই তাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে মিডিয়াগুলিতেও ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। সুতরাং ভারতে প্রেমকরা, ঘর তৈরি করা, জায়গা-জমি কেনা-বেচা, গোমাংস ভক্ষণ করা, ধর্ম পালন করা, উৎসবে শামিল হওয়া, জীবন-জীবিকার জন্য কর্মপ্রার্থী হওয়া সবেতেই খুব সাবধানে মুসলিমদের অগ্রসর হতে হয়। সামান্য ভুলের কারণেই এইসব ব্যাপারে হয়তো প্রাণও যেতে পারে তার। অনেক জায়গাতেই মুসলিমদের নামধাম পরিচয় গোপন করতে হয় শুধুমাত্র বাঁচার জন্যই।
ভারত সব সম্প্রদায়ের জন্যই একটা দেশ। একটা জন্মভূমি।এই জন্য একটা সংবিধানও প্রণীত হয়েছে। এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য মুসলিমরাও রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। দরকার হলে আজও প্রাণ দেবে। এই দেশে বসবাস করতে তবে কেন তারা ভয় পাবে? ভারতে বসবাসকারী সকলের একটাই পরিচয় তারা ভারতীয়। কেন সকলকে মানুষ ভাবা হবে না? কেন জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ে ভাগ করা হবে? এই প্রশ্ন বহুদিনের। আজও এর সদুত্তর মেলেনি। ব্রিটিশরা খুব সচেতনভাবেই হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে ঐক্যবদ্ধ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যায়। তাদের এই নীতি বজায় রেখেই সরকারও ক্ষমতা লাভ করতে চেয়েছে। দেশের বহু সমস্যাকে ধামাচাপা দিতে এই নীতির কোনো বিকল্প নেই। ভারতে মুসলিমদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থান জানার জন্য
৯ই মার্চ ২০০৫, ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এক উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে এবং এক রিপাের্ট তৈরি করার দায়িত্ব সেই কমিটির হাতে দেয় । এই কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার। এই কমিটি এক বছরের মধ্যেই ৪৫০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট জমা দেয়। তাদের রিপোর্ট থেকে জানা যায় মুলমানদের সাধারণ অবস্থা কত করুণ। ২০০১ সালের লােকগণনায় ভারতের লােকসংখ্যা ছিল ১০২ কোটি ৮৬ লক্ষ, যার মধ্যে ১৩.৪ শতাংশ ছিল মুসলমানদের অংশ। অর্থাৎ ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৭৮ লক্ষ। এঁরা ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদ দিলে ভারতেই সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস। এই বিপুল সংখ্যক জনগােষ্ঠী যদি স্থায়ী দারিদ্র্যে,শিক্ষাহীনতায় ও বুভুক্ষার মধ্যে বসবাস করে তাহলে যে এক বিরাট মানব-সম্পদের অপচয় ঘটছে শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে এই বিশাল জনগােষ্ঠীর নিজেদের ভিন্ন বলে ভাববার বাস্তব ভিত্তিও থেকে যাচ্ছে। এতে জাতীয় ঐক্য যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে এবং সমাজের রূপান্তরের পথেও বাধা তৈরি হচ্ছে। অপরদিকে অন্য জনগােষ্ঠীর মানুষদের মধ্যেও মুসলমানদের সম্পর্কে নানারকম বিদ্বেষমূলক ধারণা গড়ে উঠছে। এটা সবারই জানা যে ভারতীয় সমাজের মুসলমানরা কীরূপ বঞ্চনার শিকার। কিন্তু সেই জানা বিষয়টার একটা সরকারি হিসাব এতদিন পর্যন্ত অনুপস্থিত ছিল। ১৯৮২ সালের গােপাল সিং কমিটির রিপাের্টেও এত তথ্য ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই এই রিপাের্টটিকে মুসলিম বঞ্চনার উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবেই ধরা হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে “মুসলমানরা দু ধরনের অসুবিধার মধ্যে রয়েছেন। একদিকে শিক্ষার স্তর নিম্ন, অপরদিকে শিক্ষার গুণগত মানও নিম্ন। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মুসলমানদের আপেক্ষিক অংশীদারি দীর্ঘকাল ধরে জাতিব্যবস্থার শিকার তপশিলি জাতির মানুষদের চেয়েও খারাপ।” উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার হার সব থেকে কম। আবার স্কুলছুটের সংখ্যাও সব থেকে বেশি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসাগুলিরও অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার মুখে। পরিকাঠামো ও অর্থ একেবারেই শূন্য। তাই অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ছেড়ে জীবিকার তাগিদে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হয়। অর্থনৈতিকভাবেও মুসলিমরা সব থেকে বেশি পিছিয়ে। সাচার কমিটির হিসেবে দেখা যায় দারিদ্র্যরেখার নিচে প্রায় ২৮.৫ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। এক তৃতীয়াংশ মুসলিম গ্রামগুলিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। চল্লিশ শতাংশ গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অভাব। ব্যাংক ঋণেও তাদের সুযোগ খুব কম। সরকারি চাকরি এবং বড় কোম্পানি ও রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলিতে মুসলিমদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। মুসলিম শ্রমিকরা বেশিরভাগই ম্যানুফ্যাকচারিং ও ব্যবসায় স্ব-নিযুক্ত। এই পরিস্থিতি সাচার কমিটির পর্যবেক্ষণে যতটা উঠে এসেছে বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে কোথাও কোথাও তার রূপ আরও ভয়াবহ। ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে তুলনা করলে মুসলিমরা সবারই পেছনে। জীবন-জীবিকার উৎকর্ষ শিক্ষার উপরই নির্ভর করে। শিক্ষা নেই বলেই পিছিয়ে পড়েছে সবকিছুতেই। অধিকাংশ গরিব মুসলিম পরিবারগুলিতে পুরুষদের তুলনায় নারীদের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। খাদ্যগুণ সম্পন্ন খাবারের যেমন অভাব আছে, তেমনি সচেতনতাও তাদের নেই বললেই চলে। তাই অনেক নারী পুরুষকেই বাইরে গিয়ে ঝি-চাকরের কাজ করতে হয়। দারিদ্র্য,অশিক্ষা, কুসংস্কার তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে পড়ে। কলহ-বিবাদ-বিচ্ছেদের মধ্যেই মনুষ্যেতর জীবনযাপনের ছবি লক্ষ করা যায়। রাজমিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে বেশিরভাগ সময়েই তারা বাড়ির বাইরে থাকে। পাথর খাদানগুলিতেও কুলিকামিনের কাজে নিযুক্ত থাকে। সবমিলিয়েই এক কঠোর কঠিন জীবনসংগ্রামের ছবি।
যখন অর্থনৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে এই সম্প্রদায় পীড়িত ও বঞ্চিত, তাদের উত্তরণের কোনো আলোই আর চোখের সামনে নেই, তখন তারা কিছুটা ধর্ম,ঈমান ও সুন্নাহের পথেই আত্মসন্ধানের রাস্তা খুঁজেছে। তাদের উন্নয়নে ওয়াকফ সম্পত্তিরও সদ্ব্যবহার হয়নি। পরোক্ষভাবে সরকারই তা শোষণ করেছে। স্বাধীনতার পঁছাত্তর বছর পরও নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা তৎপর হতে পারেনি। বরং বলা যেতে পারে রাষ্ট্র তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাদের স্বাধীনতার বা অধিকার আদায়ের সামর্থ্যকেই নানা কৌশলে বিড়ম্বিত করেছে। বারবার বোঝাতে চেয়েছে তারা উদ্বাস্তু। এদেশে তাদের কোনো অধিকার নেই। পথেঘাটে, ট্রেনে-বাসে-ট্রামে, বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়, হাটেবাজারে, এমনকী মঞ্চে মঞ্চে বক্তৃতায় ঘোষণা করেছে ‘পাকিস্তান চলে যান’। গত কয়েক বছর থেকেই জয় ‘শ্রীরাম’ স্লোগান তুলে এবং গোমাতা রক্ষার নামে গোরক্ষক কমিটি গঠন করে সারাদেশে একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দেশের সব নাগরিক তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী না হলেও সমস্ত দেশজুড়ে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তা থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে রক্ষা করা বেশ কঠিন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই উগ্র সম্প্রদায়িক ঝড়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। প্রতিটি সচেতন মুসলিম জনমানসে একটা আতঙ্কের ছবি ফুটে উঠেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা সম্প্রদায় এই সংখ্যালঘুদের যদি সুখ-দুঃখে কাছে টানার প্রয়াস চালাত, এবং মানুষ হিসেবে গণ্য করত তাহলে হয়তো এই অবিশ্বাস এবং আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হত না। কিন্তু এই দেশেই লালন ফকিরের বাউল যেমন বেজে উঠেছে, তেমনি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কবি চণ্ডীদাসের ঘোষণার পারম্পর্যও অস্বীকার করা যায় না। তেমনি আল্লামা ইকবালও গেয়েছেন ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্থান হামারা’। শত শহিদের শত কাফনের রক্তাক্ত দিনগুলি দেশ স্বাধীনতার ইতিহাসে কখনোই মুছে যাবে না। এই মাটিতে মিশে আছে তাদের রক্ত। এই বাতাসে মিশে আছে তাদেরও দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু কী তাদের ভবিষ্যৎ? কী পেয়েছে তারা? কে তাদের কথা ভাববে? এসবেরই উত্তর গভীর নিরাশাজনক।
তবু মারখাওয়া একটা সম্প্রদায় অনবরত বঞ্চনার আঘাত সহ্য করেও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে। কেউ তাদের ত্র্যাতা নেই। যোগ্য নেতৃত্বদানকারী নেই। এমত অবস্থায়ও কিছু সংস্থা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তুলে এনেছে তাদের আস্তাকুঁড় জরাজীর্ণ পরিবেশ থেকে। গভীর অধ্যাবসায় ও নিষ্ঠা সহকারে শিক্ষাদানের প্রয়াস চালিয়েছে। আর তাতেই উঠে দাঁড়াবার অবলম্বন পেয়েছে। এরকমই একটি প্রতিষ্ঠান হল আল-আমিন মিশন। প্রতিবছরই এখান থেকে কিছু সংখ্যক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপকের উত্থান সম্ভব হচ্ছে। এটাই ক্ষীণ আশার আলো। এছাড়াও কিছু মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী প্রচণ্ড সংগ্রামের মধ্যদিয়েই নানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য পাচ্ছে। যদিও বৃহৎ কর্মস্থলে তাদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এমনকী সরকার পক্ষ থেকেই তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সেক্ষেত্রে কারও কারও বক্তব্য হল: ‘লাদেনও মেধাবী ছিল’, ‘আফজল গুরুও ধার্মিক ছিল’ ইত্যাদি। ধর্ম-জাত-সম্প্রদায় যখন রাজনীতির পুঁজি, যখন মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করার প্রচার হচ্ছে এবং হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা হওয়ার অপেক্ষায় সমর্থকবৃন্দ— তখন কী করে মুসলিমরা আর নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারে? নিরাপত্তা তাদের কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের গবেষক-অধ্যাপক-ছাত্র-ছাত্রীরা যখন সরকারি পক্ষপাতমূলক আইনের বিরোধিতা করে, অথবা সরকারকে মানবিক হবার আবেদন জানায়— তখন তাদের বিনাবিচারে আটক করা হয়, কিংবা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয় দেখানো হয়, হয়তো সারাজীবনই বন্দি থাকতে হয়—তখন কোথায় আইনের শাসন? বিশেষ করে এনআরসি,সিএএ-এর প্রতিবাদীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়। সরকারের বিপক্ষে কথা বললেই তাকে সন্ত্রাসবাদী সাব্যস্ত করা হয়। প্রতিটি মুসলিমকেই এই দেশে ন্যায়বিচারের আশা ত্যাগ করতে হয়। স্বাধীনভাবে কথা বলার জন্যও দু’বার ভাবতে হয়। যেমন ভাবতে হয় ধর্মপালন করার ক্ষেত্রেও। কোথায় নামাজ পড়বে, কোথায় পড়বে না, আজান মুখে দেবে, না মাইক ব্যবহার করবে তারও অনুমতি নিতে হয়। প্রশাসনিক পদে মুসলমানদের সুযোগ নেই বললেই চলে। সারাদেশে কতজন এম এল এ, এমপি নির্বাচিত হন তা বলে দিতে হবে না। এত বছর পরও, একসঙ্গে বসবাস করেও যে অন্তরায় ছিল তা আরও বেড়েছে। দেশ মানবিক হয়নি। মানুষ ক্রমশ মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে সাম্প্রদায়িক ঘেরাটোপের মধ্যে নিজেদের বন্দি করে ফেলেছে। রাজনৈতিক নেতারা এই পরিবেশকেই কাজে লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসার ঔপনিবেশিক ছলাকলার প্রয়োগ করেছে। সুতরাং স্বাধীনতার পঁছাত্তর বছর পরও উদ্বেগ অস্থিরতায় এক হতাশাজনক পরিবেশ আমরা পেয়েছি।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. ইতিহাস কালের দর্পণ।
    অসাধারণ দক্ষতায় লেখক তুলে ধরছেন
    মুসলমানদের প্রতি বঞ্চনা ও উপেক্ষার ইতিহাস।

    ধন্যবাদ জানাই লেখক ও সম্পাদককে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা