প্রচ্ছদপ্রবন্ধহাসান আলীমের কবিতাচর্চা : কল্পনা ও পরিকল্পনা

লিখেছেন : ড. ফজলুল হক সৈকত

হাসান আলীমের কবিতাচর্চা : কল্পনা ও পরিকল্পনা

ড. ফজলুল হক সৈকত 

প্রাক-কথন : 

মানুষকে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় জীবনধারায় নানান অনুকুলতা-প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হয়। সে-পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রত্যেককেই অনুভব  করতে হয় বিচিত্র বিষয়; অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যুক্ত হয় আনন্দ ও বিষাদ। তখন  হয়তো কোনো কোনো মানুষকে শিল্পের আশ্রয় নিতে হয়। আবার কেবল, স্বভাবজ তাড়নায়ও কেউ কেউ শিল্পের পথে হাঁটেন। আমরা জানি, কবিতা মানুষকে চিন্তা ও কল্পনার উন্নত স্তরে পৌঁছুতে সহায়তা করে। এটি শিল্পের একটি প্রধান ধারা। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা ও জাতির সাহিত্যচর্চার মতো বাংলা ভাষায় কিংবা বাঙালি  জাতির জন্য কবিতাচর্চা সব সময় আনন্দের বিষয় হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল এবং  রয়েছে। আজকের আলোচনার মাধ্যমে আমরা দেখতে চাই– হাসান আলীমের কবিতা-সান্নিধ্যের কার্যকারণ ও লক্ষ্য। কী বলতে চান তিনি তাঁর কবিতার ভেতর দিয়ে? হাসান আলীমের কবিতার মূল্যায়ন-ভাষ্য : আমরা, নিবিড়পাঠের আগে, জেনে নিতে চাই হাসানের কবিতাকে প্রকাশের প্রথম দিকে বা পরবর্তীকালে সমকালের কবি ও সাহিত্য-সমালোচকগণ কোন দৃষ্টিতে দেখেছেন। 

প্রসঙ্গত আল মাহমুদকে প্রথমেই স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন : মেধাবী কবি হাসান আলীম। তত্ত্বময়, পরীক্ষা-নিরীক্ষাময় তাঁর কবিতা, চিত্রকল্পের বৈচিত্র্য তাঁর কবিতায় দেখা যায়। বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের কথা তাঁর কবিতায় সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। বিজ্ঞান পরাবাস্তবতা, যাদুবাস্তবতা তাঁর কবিতার নতুন দিক। বিভিন্ন রকম অলঙ্কারে সমৃদ্ধ তাঁর একটি আলাদা কাব্যগ্রন্থ রয়েছে যা আমাদেরকে আনন্দ দান করে। (আশির কবিতা)  

প্রখ্যাত সাহিত্য-সমালোচক, কবি ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ, বাংলাদেশের কবিতার গতিপথ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে, বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশের কবিতার ধারা নির্দেশ করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন—  

সত্তরের দশকের কবিতা হয়তো সময়েরই দোষে ও পরাক্রমে, দিকভ্রান্ত হয়ে  গিয়েছিল খানিকটা। অজস্র কবি, অসংখ্য কবিতা কিন্তু টেকনিকে রুধবার বাঁধ তৈরি হয়নি অনেক সময়। অশোধিত-অপরিণত কাব্যিক আবেগে ভেসে গেছে। আশির দশকে আস্তে আস্তে জোয়ার নেমে এলো, সময় থিতোয়, নতুন যে কবিদল জেগে ওঠেন, তুলনামূলকভাবে তারা অনেক সুস্থস্থির বুদ্ধিমান অনুভূতিশীল। প্রাণের চেয়ে প্রাণবীজে সংরক্ত কবিতা রচনার দিকে ঝোঁক পড়ে। আজ আশির দশকও পেরিয়ে গেছে; শুরু হয়ে গেছে নব্বই দশকের তরুণতম কবিদের উসখুসানি;– আর আশির দশকের কবিদের শেকড় চারিয়ে গেছে আরো খানিকটা মাটির ভেতরে। এ সময় এদের কাউকে কাউকে আলাদা করে চিনে নেওয়া দরকার।  

এদেরই একজন, যার কুঁড়ি ফুটে উঠেছে, তার নাম হাসান আলীম। (দৈনিক সংগ্রাম, ৩ জুলাই ১৯৯২)  

হাসান আলীমের সমকাল ও কবিতা-ভাবনা :

দশক-ওয়ারি বিবেচনায় বাংলা  সাহিত্যের কবিতা-পরিসরে হাসান আলীম (জন্ম : ১৩ মার্চ ১৯৫৭, খায়েরদিয়া,  সালতা, ফরিদপুর) বিশ শতকের আশির দশকে আত্মপ্রকাশ করেন। তখন  বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতার কাল। সাংস্কৃতিক অঙ্গণে বিচিত্রমুখী হতাশা-বিরোধী উন্মাদনা। নব্য-স্বাধীন রাষ্ট্রে অল্পকাল বিরতিতে দুজন রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনীর রাজনীতিলগ্নতা, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতির অস্বচ্ছতা এবং সর্বোপরি সেনাপ্রধানকর্তৃক রাষ্ট্র—তা দখল ও গণতন্ত্র হত্যার ষড়যন্ত্র– সবকিছু মিলিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ-পরিসরে তখনকার সময়ে বিরাজ করছিল এক বিরাট-ব্যাপক অনিশ্চয়তা। ওই ঘোর অমানিশার কবল থেকে, মায়ার চাদরে মুড়িয়ে স্বদেশ ও পরিজন-প্রতিবেশীকে শান্তির বারতা শোনাতে চেয়েছিলেন সাহিত্য-সাধকরা। তারা বিভিন্ন পথে জাতিকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিল আলোকশিখার উদার আহ্বানের রাজ-দরোজায়।

বিশ্বাস-মত ও দর্শনের পার্থক্য অবশ্য ছিল। তবে প্রায় সকল শিল্পী-সাহিত্যপথিক দেশের প্রতি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। নিজ ভাষা ও রাষ্ট্রভূমির প্রতি গভীরভাবে  দায়বদ্ধ কবি পরিবেশন-কায়দার দিকে অধিক মনোযোগী ছিলেন। সমকালকে উত্তরকালের পাটাতনে দাঁড় করাতে তাঁকে খানিকটা কৌশলীই হতে হয়েছিল, বোধকরি। বিজ্ঞান, ম্যাজিক রিয়ালিজম, সুরিয়ালিজম প্রভৃতি তাত্ত্বিক-বিবেচনার  সিঁড়িতে পা রাখতে হয়েছে হাসান আলীমকে। আর প্রকৌশলের পাশাপাশি উপস্থাপনভঙ্গিতে তিনি জুড়ে দিয়েছিলেন ইসলামি চেতনা ও জাতীয়তাবোধ। ছন্দ-অলংকার আর গণিত বিষয়ে বিশেষ প্রজ্ঞার অধিকারী এই কবির কবিতায় পাঠক অনায়াসে পেয়ে যাবেন এক ভিন্নতর অনুভবের উপাদান। ইতিহাস আর পুরাণের নব নব উপলব্ধির স্বাদও আমরা পেতে পারি বাড়তি পাওনা হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী থাকাকালে, ১৯৮৩ সালে, হাসান আলীমের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশু’ প্রকাশিত হয়। পরে  কবিতা  ছাড়াও গল্প লিখেছেন তিনি। শিশু-কিশোর-মনোতোষ ছড়াও রচনা করেছেন। কবিতাচর্চার বিভিন্ন প্রহরে, বিশেষত তত্ত্ব এবং নিরীক্ষা প্রয়োগের দিকে কবি  আলীমের নিবিড় মনোযোগ স্থাপিত হয়েছে। কবিতার ছন্দ, অলংকার, নন্দনত্তত্ব প্রভৃতি বিষয়েও তিনি আগ্রহী চিন্তকের ভ‚মিকা পালন করছেন। চিন্তা এবং শ্রম বিনিয়োগ করেছেন কাব্যনাট্যের রহস্যঘন কাঠামোতে। গদ্যকবিতা নির্মাণ কিংবা  বিমূর্ত ও প্রতীকী কাব্য-অবয়ব তৈরিতেও তার আগ্রহের কোনো কমতি নেই।  ফ্রেম-আঁটা কবিতা– সনেট রচনা নিজের যোগ্যতার খানিকটা যাচাই করারও  প্রয়াস আছে হাসানের রচনা-পরিসরে। নিজের কবিতাযাপনের প্রহর থেকে প্রহরান্তরে পারি জমানোর সময় তিনি ভাবনার চারধারে সাজিয়ে তুলেছেন চিরচেনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জাতীয় নেতৃত্বের সংকট ও সম্ভাবনা, ইসলামি চিন্তা প্রচার-প্রসারের শোভিত বারান্দা, ঐতিহ্য আর ইতিহাসের খবরাখবর এবং প্রাতিস্বিক পর্যবেক্ষণ। প্রথম গ্রন্থে ‘কিছু কথা’ অংশে কবি তার পাঠককে জানাচ্ছেন :  

কবিরা নবী নয়, নবীদের বুকে থাকে অহী, আর মৌমাছি কবিরা সেই অহী  পান করে। হাইড্রোজেন সালফাইডের উৎকট গন্ধের মধ্যে থেকেও চেয়ে থাকি সমুদ্রনাভী রাজপথে। শব্দের শরীর নিয়ে খেলা করি, কখনও নির্মাণ করে ফেলি কিছু কিছু ব্যক্তিগত হেরাগুহা। 

কবিরা অন্যসব সাধারণ মানুষের চেয়ে জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে খানিকটা বেশি  সতর্ক থাকেন। তাঁদের অনুভব ও নির্দেশনা সমকাল ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনেক সময় সুফলের বারতাও বয়ে আছে। কোনো কোনো কবি আবার সাধারণ জনতার বোধের জায়গাটিতে জুড়ে দেন নতুন দ্যোতনা। এই প্রসঙ্গে আমরা  হাসান আলীমের কাব্যযাত্রার প্রারম্ভকালের কাব্যের উৎসর্গপত্রের কিছু অংশ দেখে নিতে পারি–

সেইসব শিল্পীকে 

যারা ভেঙেচুরে পোড়োবাড়ি, 

গড়ে মনোরম ইমারত, 

যাদের চোখে জালালী কবুতর, 

শাহাদাৎ আঙুল ঘোরালেই 

ঝরে রহমত টপটপ করে–

সেইসব পাখিকে 

যারা উপহার দ্যায় মাংসল ঠ্যাং… 

যাদের নাসারন্ধ্রে 

করে সুড়সুড় ‘মান্না ও সালওয়া’…। 

আর লকলকে আগুন থেকে ফিরে যায় 

ঝলমল নগরীতে 

পুণ্য রমণীর পবিত্র ইশারায়…  

আলীমের কবিতার উপাদান :

হাসান আলীমের কবিতায় উৎপাদন-নির্ভর কৃষি-ব্যবস্থা, ফসলের মাঠের প্রতি মানুষের মায়া, নাগরিকের অধিকার, দেশের সার্বভৌমত্ব এবং মুক্তভাবে বাসিন্দাদের বিচরণের আকুতির কথা আছে। শাসক-শোষণের বিরুদ্ধে কোমল প্রতিবাদ আছে। মনে মনে বিপ্লবী এই কবি তার চেতনাকে রাজপথের হাতিয়ার না  করে কবিতার গীতল বিছানায় বিছিয়ে দিয়েছেন যেন। খেজুর পাতার পাটিতে পেতে রাখা আরাম-প্রিয় শরীর আর মাচায় পা মেলে বসে থাকা উদাসী মানুষগুলোকে মাটি ও মানুষের প্রতি  দায়বদ্ধ  করে  তুলতে  যে  নীরব  প্রেরণা  দরকার, সেই উৎসাহের বীজ রোপণ করেছেন কবি হাসান আলীম তার কবিতাজমিনে। ‘মুক্ত স্বদেশ’, ‘নাগরিকত্ব’, ‘জ্যোতির্ময় সাহস’, ‘জালিমের প্রাসাদ’, ‘অসংখ্য মজলুম’ আর ‘নিজস্ব খামারের সোনালী ফসল’ প্রভৃতি অনুভবকে হৃদয়ে লুকিয়ে রেখে তিনি চেয়েছেন নিবিড় এক আলিঙ্গন। তাই তো বন্ধুর প্রতি এক মাতৃরূপী নারীর আহ্বানকে প্রকাশ করছেন তিনি এভাবে—

হে বন্ধু! 

আমাকে এমন একটি আলিঙ্গন দাও 

আমার সিনা থেকে বের হোক 

নগর বিধ্বংসী আয়াত; 

আমাকে এমন একটি রাত উপহার দাও 

যেন আমার গর্ভের সন্তানেরা 

এক একটা বিপ্লবী আফগানীর মত 

উপল উপত্যকা পেরিয়ে আসে। 

        [‘আমাকে একটি আলিঙ্গন দাও’: শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশু]  

যুদ্ধ-বিগ্রহজর্জরিত এই বিশ্বে মানব শিশুর আগ্নেয় জন্ম, দগ্ধগ্রামের আর্তনাদ, গৃহের বাসিন্দাদের পরবাসী হওয়ার যাতনা,পানকৌড়িদের কোলাহল, সুজনদের সব দূরে সরে পড়ার ইতিহাস, অরণ্যে বসবাসের মতো নাগরিক যন্ত্রণা, অবারিত পথের অধিকার থেকে নিরন্তর বঞ্চনা  বা ছিটকে পড়া, চারিদিকের নেতিবাচকতার অন্তরালে হাসান আলীম ‘কালো পাথর চুম্বন’ শেষ করে ‘আরাফাতে খোলা আসমানের নিচে মিলনের মহা ময়দানে’ সকলকে সমবেত হওয়ার জন্য দরাজ গলায় ডাক দিয়ে চলেছেন যেন। অবশ্য খুব প্রিয় কিছু মানুষের জন্য সামান্য কিছু ‘নিঃসঙ্গ নিলয়’ বানাতে চেষ্টার কোনো অবহেলা করেননি। কী নির্দ্বিধায় বলছেন সে-কথা : 

‘কেবল তোমার জন্য নিঃশব্দ অপেক্ষা করে যাব,

বুকের সিন্দুক ভরে গচ্ছিত রাখব ভালোবাসা প্রেম,

আমি কাউকে হরণ করতে দেব না সোনার মোহর

পবিত্র যৌবন নষ্ট করতে দেব না

সর্পদংশন হবে না সোনালী শরীরে

সারাটা জনম ভরে কেবল তোমার জন্যই অপেক্ষা করে যাব।’ 

                (‘কেবল তোমার জন্য’ : নিঃসঙ্গ নিলয়) 

নারী-প্রেম-পরিণয়-সংসার— এসব বিষয়ে কবি হাসান আলীমের ধারণা ও প্রকাশ বেশ সরল। পবিত্রতো বটেই। নারী-পুরুষের সম্বন্ধকে পারস্পরিক সম্মান ও প্রেমবোধের ধারণায় প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের আমজনতার যে আপত্তি, তার বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান এই মানবতাবাদী ও নির্বিবাদী-নিরীহ-সংসারী কবির। স্বদেশ, নারী আর উৎপাদন-নির্ভর সভ্যতার বিকাশ যে একই সুতোয় গাঁথা, তা বুঝতে কবি হাসান আলীমের দেরি হয়নি।  লোকায়ত জীবনের  সৌকর্য আর চিরায়ত জীবনধারার অনিবার্য আনন্দবার্তা তিনি অনুভবজ্ঞান দিয়ে  ধরতে পেরেছিলেন; যেমন পেরেছিলেন ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ, ম্যাকিয়াভেলি, ওরহান পামুক, ফখরুদ্দিন ইরাকি, মারিও ভার্গাস, বিক্রম শেঠ, তেনজীন সিন্ধু, মো ইয়ান, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন, আল মাহমুদ। সমাজের সকল দুরাচারকে চিহ্নিত করে, প্রিয়তমা নারীর জন্য বাসযোগ্য ভূমি বন্দোবস্ত করতে কবিতা-কারিগর হাসান আলীমের যে প্রত্যয়, তা যদি জগতের সকল পুরুষের প্রত্যাশার ব্যাপার হতো, তাহলে তো আমরা পেয়ে যেতে পারি অনন্য এক উৎসবমুখর মানব সমাজ।  তা কবে হবে কে জানে! তবে আপাতত, কবি আলীমের সাথে সুর মিলিয়ে গান গেয়ে যাওয়া চলে : 

‘প্রিয়তমা, একসাথে জ্বলে ওঠে আমার আঙুল

দৃঢ় অঙ্গীকারে

একদিন এইসব শেকড়ের হবে সন্ধান’। 

হাসান আলীমের কবিতায় দাবি ও প্রার্থনা : 

নিয়তিতে পূর্ণ আস্থা আছে হাসান আলীমের। মানবিক বিপর্যয়কে স্বীকার করেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোয়। ‘আরশোলা’ হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে তিনি কোনো তাৎপর্য খুঁজে পান না। দীর্ঘজীবিতা নয়– এই কবির আরাধ্য কর্মময়তা ও কল্যাণকামিতা। আর তাই ‘কালনাগিনী’র ছোবল থেকে সমাজকে, সমাজের মানুষকে রক্ষা করতে অধিকার-প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অনায়াসে যেন যাপন করতে পারেন ‘শ্রাবণ নির্ঝর’ রাত। ‘হরণ’ শব্দটির আড়ালে তিনি স্থির রাখতে চেয়েছেন ‘সাতরঙা’ স্বপ্ন কিংবা সতর্ক ‘চোখ’। প্রতীক্ষার যন্ত্রণার কাল পার হয়ে ‘নদী’. ‘প্রিয়তমা নারী’, ‘সূর্যের সকাল’ কিংবা প্রত্যাশিত ‘একটি মুখের ছবি’ দেখে দেখে হাসান আলীম ‘নির্জন দ্বীপের অভিশাপ’ থেকে মুক্তির অবারিত আকাশকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। তার কবিতার শব্দে শব্দে, বাক্যের সব সাজানো দেয়ালে লেখা আছে ওইসব বাসনার কথামালা। ‘চাঁদ’ কিংবা ‘বৃষ্টি’র না-নামা ফোয়ারায়  তিনি  দেখেছেন নিজের প্রকাশচিন্তার সদর দরজা। ভাবনার গলিতত্ত¡কে অতিক্রম  করে সকলের সামনে হাজির থেকেছেন সব দাবি ও প্রার্থনার বহর নিয়ে। বলছেন : ‘যেহেতু আমার কোন নেই অভিসার… আপাত নির্মাণ করি দমনের হাতিয়ার।’ মাঝে মধ্যে বাস্তববাদী-বিজ্ঞানলগ্ন এই কবি পলায়নপরতাকে আশ্রয় করতে চেয়েছেন। রমণীদের ‘বিষের ঝিনুক’, প্রতীকী  সুখপাখি  কিংবা  নিমগ্ন  মাতালের  সান্নিধ্য  ছেড়ে  অন্য  কোথাও  চলে  যাবার  প্রস্তুতিও  হয়তো  গ্রহণ  করেছেন  ভেতরে ভেতরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপরাধের ‘তীরের ফলায়’ অঅক্রান্ত হয়ে কল্পনার সম্পানে চড়ে পরিকল্পনার প্রহর ধরে অতিক্রম করেছেন ‘জন্মান্ধ পথিক’ প্রদত্ত ‘দুঃখগুলো’। অবশেষে অমরা তার কণ্ঠে শুনতে পাই সেই শান্তির শিশুসুলভ উচ্চারণ–

তুমি আমার বুকের ব্যথা 

মধ্যরাতের চোখের তারা 

উজান ভাটির অস্থিরতা 

আউল বাউল গান,  

তুমি আমার আকুল করা 

ছোট্টবেলার খেলার সাথী 

আমার দেহের অখণ্ডতা 

বুকের পাঁজর খান। 

                [‘তুমি’: মৃগনীল জোসনা] 

‘নৈঃশব্দ্য’, ‘সুন্দর বদমাশ’, ‘রক্ত পলাশ’, ‘বৃক্ষের কাছে’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘হরিণ  কেঁদো না’, ‘অবতরণ’, ‘সুখের ঘর’, ‘সোনালী সমাজ’, ‘অবগাহন’ প্রভৃতি শিরোনামের কবিতা পাঠকের চেতনায় সামান্য হলেও আলোড়ন তোলে। ‘মৃগনীল জোসনা’র প্রহর পেরিয়ে ‘সবুজ গম্বুজের ঘ্রাণ’ স্পর্শ করার কালে কবিকে আমরা প্রার্থনানিমগ্ন হতে দেখি। তার সে আরাধনা নিবেদিত ইবাদতের মধুময়তায়। সাহাবী, বেহেস্ত, মহানবীর রওজা মোবারক, আবু লাহাবের হাত, ওহুদের পাদদেশ, রহমত প্রভৃতি শব্দ  কেবল  শব্দ  হয়ে  নয়, চেতনা  হয়ে  জেগে  থাকে  হাসান আলীমের কবিতার ক্যানভাসে। আর তারপর তিনি যেন সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমার কাছে সিজদায় মাথা নত না করে পারে না। ‘তোমার উপমা’ কবিতাগ্রন্থের নামকবিতা থেকে দেখে নেওয়া যাক কবির সেই অনুভবের কতক ছিটেফোঁটা:

বস্তুর ভেতরে দেখি বস্তু নেই। আলোর পাবন। 

প্রবল শ্রাবণ মেঘে তড়িৎ মাছ কেবলই সাঁতরায় 

অসীম কুয়োর মধ্যে নির্বিরোধ নন্দন গমন 

বড়শি ফেলে বসে আছি কত যুগ প্রণত সিজদায়। 

আলীমের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচিন্তা : 

বিজ্ঞানকে কবিতার বিষয় করে, কিংবা বলা চলে কবিতায় বিজ্ঞানের অভিজ্ঞান প্রবেশ করিয়ে কবি হাসান আলীম সমকালে এবং  উত্তরকালের  কবিতাপেমিদের  জন্য তৈরি করেছেন দারুণ আনন্দের উপাদান। জীবনকে বিজ্ঞান দিয়ে অথবা সৃষ্টিরহস্যের অসীমতাকে যুক্তি দিয়ে কবিতা-কাঠামোয় পরিবেশনের যে নবতর টেকনিক, তা আয়ত্ত করেছেন হাসান। অবশ্য বিশ শতকের তিরিশের দশকের কবি বিষ্ণু দে কবিতায় বিজ্ঞানকে স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার বিজ্ঞানচেতনা অনেকটা প্রযুক্তিনির্ভর ছিল। তবে সার্বিকভাবে বিজ্ঞানের প্রভাব ও পরিসরকে বুঝতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞান-বিষয়ক পঠন-পাঠনের। আমাদের জানামতে কবি  হাসান আলীম বিজ্ঞানের প্রয়োগিক পড়াশোনায় মনোযোগ স্থাপন করেছেন। তাই তার কবিতায় আমরা পাই বিজ্ঞান-সৃষ্টিরহস্য আর দেখা-অদেখা বাস্তবতার বিবরণ-ভাষ্য। লিখছেন কবি:  

মহাকাশ দ্বীপবিশ্ব উড়ে যাচ্ছে 

সীমাহীন গুহাগাত্রে অনন্ত গহ্বরে,

দ্রুতগামী অশ্বপৃষ্ঠে হারিয়ে যাচ্ছে আমার স্থিতি 

বাপ-দাদা, নামধাম কেন্দ্রমূল মহাশূন্যে  

সকলেই কানামাছি ভোঁ ভোঁ না ছুঁয়ে না ছুঁয়ে 

অনন্ত আঁধারে 

                [‘অনন্ত গহ্বরে’: তোমার উপমা]  

চিন্তার অসাড়তা কিংবা সামাজিক বৈষম্য-সৃষ্ট বিবর্ণতা অবলোকন করেছেন কবি হাসান আলীম। তিনি জানেন, আমাদের পরিজন-প্রতিবেশ ‘কালোছিদ্রে  মৃত্যুকূপে’ আচ্ছাদিত। আর তাই প্রত্যাশা করেছেন ‘নন্দন গমন’। চোখ আর মন সতর্ক রাখলেই যেন যে-কেউ অবলোকন করতে পারবেন, অনুধাবন করতে পারবেন ‘অদৃশ্য মানব’-দের দৃশ্যমান চলাফেরা, ‘রক্তের ভেতর কার্প’, ‘এলোমেলো জোছনায়’, জনারণ্যে কিংবা জনহীনতায় ‘আয়াত শোভিত পাখি’ আর প্রার্থিত ‘হরিণ ও মানুষের গল্প’। তিনি জানেন, ধ্বংসের বিপরীতে প্রতিদিন ঘটতে থাকে নির্মিতির অসীম সব ‘অন্তর্ভেদী লেসার বীমের আশ্চর্য সুন্দর হরিয়াল’। মরা জ্যোৎস্না, শেকড়বিহীন নদীর পেট, ‘রক্তের লোহার মধ্যে জীবনের নিঃশব্দ প্রপাত’, পানিশূন্য অক্সিজেন প্রভৃতিতে মন খারাপ করে কোনো একটি নক্ষত্র ঝরে গেলেও ‘গ্রহের আকাশ থেকে অন্যলোকে’ ‘স্মিতহাস্যে মূলবিন্দু অনন্ত সুন্দরে’ অপর কোনো নাম-না-জানা নক্ষত্রের প্রতিচ্ছবি হয়ে মস্তিষ্কের কোষে, যাবতীয় মিথ্যার বিরুদ্ধে, এক আঁধার আকাশ ও প্রাণকোষ জীবনের অণু-পরমাণুতে প্রোটনেরা জীবনের শেষবিন্দু দিয়ে সাজিয়ে রাখে ‘কবিতা তৈরির কারখানা’। অতএব, শিল্পের কোনো মৃত্যু নেই; যবনিকা নেই সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার অজ্ঞেয় রহস্যের। ‘তোমার উপমা’ পেরিয়ে এইসব অনুভবকে সামান্য সম্বল করে কবি হাসান যখন এগোতে থাকেন সামনে পানে, তখন তার নজরে আসে ‘ডানাঅলা অট্টালিকা’। ‘অশ্বখুর ধ্বনি’র অন্তরালে শুনতে পান কোনো এক দরবেশ বলছেন:

এখানে ছিল না কিছুই, থৈ থৈ পানি আর পানি, 

চারদিকে ঘন হীম পানির বহর। 

কেঁপে ওঠে পানি। বিশাল সমুদ্র 

সৃষ্টির আনন্দে দুলে ওঠে ভেতরের গহীন সাগর 

মৃত্তিকা উদর। 

ফুসে ওঠে পুঁজির জমাটবাঁধা উত্তপ্ত গহ্বর, 

প্রচণ্ড বিক্ষোভ, শিলারাশি 

গনগনে আগুনের লৌহশলাকা পাথর। 

কেঁপে ওঠে আনন্দ বিষাদে টেথিস সমুদ্র 

তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ জীবনের উৎসমুখ।

                [‘অশ্বখুর ধ্বনি’: ডানাঅলা অট্টালিকা]  

কল্পনার বিপুলতা ও হাসান আলীম : 

কবিতাকাঁথায় কবি আলীম জীবন-মৃত্তিকার অমল সোহাগ, সাগরের প্রমত্ত জোয়ার, নূহের নৌকার অনন্যতা,‘পরদেশী বিভাষী বিধর্মী ঘাতক’, আর্যদের সুদূর পারস্য-পারির ইতিবৃত্ত কিংবা অভ্রান্ত বাঙালির ভাষাবোধ– সবকিছুকেই তুলে ধরেছেন আপন বিবেচনার পাটাতনে। আর তা কেমন করে যেন পাঠকের নিজস্ব ভাবনার প্রাসাদ-প্রবেশ-পথের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। ইতিহাসের কঠিন সত্যাসত্য, ঐতিহ্যের রূপালি ডানায় ভর দিয়ে জোসনায় ফেরি করা কবিতায় তিনি ‘সুপ্তির অতল ঘুমগহ্বরে  লুকিয়ে থাকা ‘ক্লান্ত জনপথ’ খুঁজে দেখতে চেষ্টা করেছেন। মৌনমুখ চিত্ত, মাটির সোঁদা গন্ধ, ‘বসনিয়ার বন্দি শিবির’, আশাঘেরা ‘সহস্য  রজনী’, আমাদের চারপাশে বিচরণরত নিষ্পাপ শিশুদের দৌড়াদৌড়ি– সব, সব পেছনে ফেলে কবি ‘নতুন প্রভাতী’ সূর্যের প্রসব-বেদনা অনুভব করতে হাজির হয়েছেন ছনে-ছাওয়া গ্রামীণ বারান্দাবিহীন আঁতুড়ঘরের খোলা উঠানে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চলমান রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকটকে এড়িয়ে চলতে-না-পারা কবির অনুভবে তাই ধরা পড়ে মানবাধিকার-লঙ্ঘনের জ্বলজ্বলে কিছু ছায়া ও ছবি। আসুন ‘বসনিয়ার বন্দি শিবির থেকে’ কবিতার প্রতিবেশ-বর্ণনার কিছু পাঠ থেকে,  তার উপলব্ধির খানিকটা ছোঁয়া নেওয়ার প্রয়াস চালাই: (গভীর রাত্র। খট্-খট্ বুটের শব্দ। বাতি জ্বলে উঠলো। খুলে গেল শিবিরের বন্ধ কপাট। সশস্ত্র দস্যুরা ঢুকে গেল। ঠা-ঠা গুলি নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের বুকে-মুখে-পেটে-পিঠে। সুনসুন। দস্যুদের শক্ত নখরে ছিঁড়ে গেল নারীদের পোশাক। নির্মম ধর্ষণে আর্তচিৎকার করছে অসংখ্য নারী। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অসংখ্য বনি আদম।) 

কেবল বসনিয়া কেন, মুসলিম শাসিত ভারতবর্ষ, কাশ্মীর– যেখানেই মানবতা বিপর্যস্ত হয়েছে, সেখানেই প্রসারিত করেছেন তিনি তার কবিসুলভ চোখ। অবশ্য তিনি কিপন্নতা-বর্ণনার কবিতাকথক নন; মানবতা- প্রতিষ্ঠার  জন্য  পৃথিবীতে যে মহৎ মানুষ মোহাম্মদ (স.)-এর আবির্ভাব এর তার কার্যাবলি– সেসবের ভাষ্য-রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। পশ্চিমী-প্রাচ্য সনেটের মিশ্র আদলে ও সৌরভে হাসান আলীম তার ‘যে নামে জগত আলো’ কাব্যে তুলে এনেছেন মহানবী  (স.)-এর  জন্মপ্রহর,  বেড়ে ওঠা, আলাহ তা’আলার মহান বাণী প্রচার, সত্যপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ইসলামের প্রসার, মিরাজের গুরুত্ব ও বিশেষত্ব, সেনাপতি রসূল ও কাবা-মাহাত্ম্য, জেহাদ-যুদ্ধ ও বিজয়, অভিযান প্রভৃতি এবং বিদায় ভাষণ, মহানবীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাম্যবাদিতা এবং সর্বোপরি এই মুকুটহীন সম্রাটের দুনিয়াময় প্রভাবের ব্যাপারাদি। কাব্যটির ‘বিদায় ভাষণ’ কবিতা থেকে পাঠ নেওয়া যেতে পারে:

আরাফাত ময়দানে তোমার দরাজ কণ্ঠস্বর 

বেজে ওঠে, চিরতরে বন্ধ করে দিলে ঘৃণ্য সুদ

নিষিদ্ধ ঘোষণা দিলে খুন জখমের প্রতিশোধ, 

বন্ধ হলো মূর্তিপূজা, ভাস্কর্যের বাতিল ঈশ্বর।  

অবলা নারীকে দিলে অধিকার সোনালী সম্মান 

অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সাম্য সামাজিক নিরাপত্তা, 

পুরুষ দাসত্ব থেকে দিলে মুক্তি প্রিয় ব্যক্তিসত্তা 

স্বামী ও পিতার ধনে দিলে ভাগ সাম্যের বিধান।

আলীমের কবিতায় জাতিসত্তা ও বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য : জাতিগত শেকড়-সন্ধানে কবিরা দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন কখনো কখনো। কল্পনা থেকে তারা  পরিকল্পনায় ফেরেন মাঝে মধ্যে। প্রকৃতি, মানুষ, ধর্ম– সবকিছুর অন্তরালে ইতিহাস-ঐতিহ্যে অবগাহন করেন– খোঁজেন নিজস্ব বিবর; আত্মানুসন্ধানের এই পথে উঁকি দিয়েছেন আলীমও। তাঁর ‘দ্রাবিড় বাংলায়’ গ্রন্থটি তারই স্বাক্ষর বহন করে।   

আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আলীমের অনুভব : 

মানবতা, মানবতা বলে আমরা যতোই চিৎকার করি না কেন, পৃথিবীতে কালে কালে সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছে দরিদ্র- অসহায়-অশিক্ষিত মানুষ। ধনীরা, বিত্তশালীরা, শিক্ষিতরা বারবার তাদের ছোবলে আহত করেছে মানবতার শেষ ধাপকেও। এ সত্য কবি আলীম অনুধাবন করেছেন। বসনিয়া কিংবা কাশ্মীরে যা ঘটেছে, তা নিশ্চয়ই কোনো সভ্য মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বিষয় নয়। 

আলীমের কবিতায় মতবাদ : 

কবিতাচর্চার পাশাপাশি হাসান আলীম বিশ্ব-পরিসরে প্রচলিত শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তালাশ করেছেন। তুলনামূলক আলোচনা করেছেন লোকবিশ্বাস, ধর্মীয় বিধান ও আচার, বিজ্ঞানের সূত্রাবলি, সাহিত্যের কাঠামো ও ফর্মুলা এবং শিল্প প্রভৃতি চমকপ্রদ বিষয়াদির পরিবেশনশৈলী নিয়ে। পালতোলা ঘোড়া, জিনের পাগড়ি, জিনের স্তন, দেয়ালঘড়ির আর্তনাদ, ফেরেস্তার ডানা, দু’খণ্ড মোজেজার চাঁদ, বৃক্ষের যাতায়াত, আগুনের ফুল, খাবনামা প্রভৃতি বিষয় ও চিন্তার প্রতি কবি নিবিড় মনোনিবেশ করেছেন ঐতিহ্যিক-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভর করে। পাশাপাশি খাড়া রেখেছেন প্রাতিস্বিক বিবেকের বোধ ও মনন। পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা তিনি কেবল নিজের ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; যা বুঝেছেন, তার কিছুটা হলেও পাঠকের জন্য, উৎসাহী গবেষকের জন্য প্রকাশ করেছেন। চিন্তা বিনিময়ের  এই যে সাহিত্যিক ধারা– এটি কোনো নতুন বিষয় নয়; পুরনো ওই পথে হেঁটে হাসান বরং নতুন করে আমাদের ভাবনা-দরজায় কড়া নাড়তে চেষ্টা করেছেন মাত্র। বুঝাতে চেয়েছেন শিল্পের সত্য, অলৌকিকতা আর সৃষ্টিরহস্য ও ইসলামি-প্রজ্ঞার মধ্যকার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য। যেমন, ‘কাব্য মোজেজা’ গ্রন্থের ‘প্রাসঙ্গিকি’তে লিখেছেন:  

মোজেজা শব্দটি মুসলিম ঐতিহ্যের সাথে অনেকটা জড়িত হলেও এর আবেদন এবং বিকাশ প্রভাব প্রতিপত্তি সর্বসমাজের গ্রহণযোগ্যতার সাথে ব্যাপক সম্পর্কিত। মোজেজা নবী রাসূল কর্তৃক সর্বসাধারণে পরিস্ফুট হয়। মোজেজা  বা অলৌকিকত্বের মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানের স্ফুরণ বা বিকাশ, সত্যের উন্মোচন এবং প্রসারণ। নবী-রাসূল ছাড়া সমাজের সাধু- দরবেশ কর্তৃকও বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকে। সেগুলোকে কারামত বলা হয়।… মোজেজার জ্ঞানকে তত্ত্ব… এবং  সংগঠনের  রীতিকে  পদ্ধতি  হিসেবে  গ্রহন  করা  যায়। পক্ষান্তরে কারামত অর্জন… সাধনাসাপেক্ষ। সর্বসাধারণের জন্য অসংরক্ষিত। তাই এই জ্ঞানকে তত্ত¡ না বলে খানিকটা প্রকল্প হিসেবে চিন্তা করা যায়।… একটি কথা মনে রাখতে হবে, যাদুবাস্তবতার বিকাশ বিশ শতকে হলেও এর বিষয় ও উপাদান প্রকৃতিতে বহু পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। প্রকৃতি, পরা-প্রকৃতির বিষয়সমূহ সত্য সুন্দর করে লেখকেরা বিভিন্ন তত্ত্বের জারকে পরিবেশন করে থাকেন।… যাদুবাস্তবতা তত্ত¡গতভাবে রিয়েলিস্টিক হলেও এর বাস্তবায়ন কোথাও ঘটেনি, অন্যদিকে মোজেজাবাদ এবং কারামত তত্ত¡গতভাবে যতটা রিয়েলিস্টিক তার চেয়ে বেশি সত্য এক্সিকিউশন-এর ক্ষেত্রে।  

হাসান আলীম কবিতা-যাত্রায় ক্রম-পরিবর্তনে বিশ্বাসী। ফেম-আঁটার ক্ষেত্রে প্রবলভাবে নিরীক্ষাপ্রবণ। বিচরণে অগ্রগামী। পথে চলতে চলতে, পাঠ ও পর্যবেক্ষণ থেকে শিখতে শিখতে তিনি কেবল প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করে চলেন। নিজের সাথে তার নিজের যুদ্ধ। চিন্তার প্রকাশ আর প্রকাশের রীতি নিয়ে কবির বড় ভাবনা। কীভাবে কবিতাকে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করা যায়, কীভাবে কবিতাকে করে তোলা যায় সবধরনের পাঠকের অবশ্য-পাঠ্য-তালিকার আইটেম– সেসব নিয়ে তার যেন ভাবনার অন্ত নেই। তাই তো ইতিহাস-ঐতিহ্য-ধর্মচেতনা, সত্য-অন্বেষা, কবিতার কাঠামো ও ছন্দ-বিষয়ক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি মনোযোগ স্থাপন করলেন অলঙ্কারনির্ভর কাব্যশরীর নির্মাণের অভিমুখে। ‘কোথায় রাখি এ অলঙ্কার’ গ্রন্থটি কবির ওই বোধের আনন্দঘেরা ফসলের ক্ষেত। তারপরও কথা থেকে যায়। কী কথা? দেখি কবি এই গ্রন্থটির পাঠে প্রবেশের আগে ভূমিকায় কী বলছেন: 

‘না, কেবল অলঙ্কার নয় ওতে প্রাণ সঞ্চার করার চেষ্টা করা হয়েছে। অলঙ্কার শাস্ত্রের জটিলতা নয়– কবিতাকে প্রাণময়, কাব্যময় করাই বড় কাজ। খুব যত্নের সাথে লক্ষ্য করলে অলঙ্কারের রত্নঋভু কারো কারো চোখে ধরা দিতে পারে। তবে কবিতাগুলোকে কবিতাই করা হয়েছে। না কোনটাই জোর করে নয়, শব্দগুলো, অলঙ্কারগুলো পায়ে পায়ে চলে এসেছে। …আমি কেবল তাড়নায় কারো নির্দেশে সাজিয়ে ফেলেছি, লিখে ফেলেছি এবং খাঁচায় পুরে ফেলেছি।’ 

কবি আলীমও যেন খাঁচায় বন্দি কোনো এক কবিতা-কারিগর। নিবিড়মনে বানিয়ে চলেছেন কবিতার হাত-পা-মাথা; দেহভঙ্গি-রূপ-স্পট; মৃত্যুজড়তা ও আশাবাদের ম্লানমুখো হাসি। 

‘জ্বর নামে ঝড়বৃষ্টি গুমোট হাওয়ার  পাল

আকাশ ছুঁয়েছে নীল  মিনারের চূঁড়ো

প্রশান্তির পায়রা।’ 

কথাগুলো বলেন যে কবি, তার চারপাশে চলমান থাকে 

‘রোদেলা দুপুর

বৃষ্টিভেজা নিঃসঙ্গ প্রেমিক

নৈঃশব্দ্য চিৎকার’।  

ছড়ায় আলীমের আকুলতা : 

‘ছোট্ট পাখি চন্দনা’ কিংবা ‘বাংলা ভাষা’ ছড়ায় তিনি খুব সহজে বাংলা মায়ের প্রতি নিমগ্নতাক ধারণ করতে পেরেছেন। নিজেকে বিশ্বপরিসরের ভেতরে রেখেও মানুষ কীভাবে মাতৃভাষার দিকে ঝুঁকে থাকে, এসব ছড়া তারই নিদর্শন।

শেষ কথা : 

হাসান আলীম প্রখর-চেতন কবি। চিন্তা, কল্পনা আর পরিকল্পনার রঙিন ডানায় ভর করে তিনি সাজিয়ে তোলেন নিবিড়–অনুভবের কথামালা। ভ্রান্তির ভ্রমরলোক থেকে কষ্টের লবণ ও আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফুল কিংবা মায়ার হরিণ দেখতে দেখতে অথবা কোনো চন্দ্রমুখীর প্রতি প্রবল আসক্তির টানে তিনি হেঁটে চলেছেন কবিতাগঞ্জের শিল্পবাড়ির সন্ধানে। হয়তো তাঁকে হাঁটতে হবে আরো কিছুটা কাল।  বিষম সুন্দর ভেঙে ভেঙে  লক্ষ বছর টিকে থাকতে হয়তো এই কবিকে পাড়ি দিতে  হবে অসঙ্গতির ঝুঁকিময় সাঁকো। কিন্তু তিনি বোধ করি অপ্রস্তুতের পর্ব পেরিয়ে এখন দাঁড়িয়েছেন আক্ষেপ-প্রক্ষেপণের সদর দরজায়। ক্রমে ক্রমে কিরণমালা গলায় পড়ে বিপ্রতীপ চিত্রে হয়তো তিনি ঠাঁয় বসে পড়বেন কোনো এক কবির মৃত্যুর কষ্টমাখা নীরব শহরের অজস্র সড়কের নিয়ন আলোয়। আর বিষণ্ণ ও ক্লান্ত পথিক যদি কিছুটা আলো, কিছুটা যন্ত্রণা, সামান্য কিছু উন্মাদনা সেখান থেকে চুরি  করে পালিয়েও যায়, তো যাক না! আলীমের যে কল্পনা, পরিকল্পনা ও বিশ্বাস কবিতায় প্রকাশ হচ্ছে, তার ভেতর থেকে খুঁজে নিতে হবে পথ-পাড়ি দেওয়ার উপাদান। বিশ্বাসী মানুষ কিংবা ধার্মিকেরা যে জীবনের সাধনা করেছেন, সেই পথের সন্ধানে প্রসারিত হয়েছে হাসান আলীমের কবিতার ধারা।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. পড়লাম। ভীষণ ভালো লাগল। আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা, হাসান ভাই।

  2. কবি হাসাম আলীম গত শতকের আশির দশকের প্রধানতম কবিদের শীর্ষজন। কবি ও কবিতা বিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ একটি লেখা। কবি হাসান আলীম ও তার কবিতা সমন্ধে সম্যক ধারণা পেতে তার এই লেখাটি দারুণ সহায়ক।কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক তিনজনকেই শুভেচ্ছা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা