মনিজা রহমান
আনোয়ার দাঁড়িয়ে আছে এক পান-সিগারেটের দোকানের সামনে। শোভন চেষ্টা করে যাতে আনোয়ার ওকে দেখতে না পায়। কিন্তু ঠিকই ওর নজরে পড়ে যেতে হয়। গাড়িটা উল্টো দিকে রেখে হাতিরপুল বাজারের সঙ্গে ফলের দোকানে নেমেছিল শোভন। মেয়ে অদ্রির জন্য কমলা কিনবে। এমন সময় হঠাৎ চোখ চলে গেল পানের দোকানে। আনোয়ারের মুখে পানের রস ঠোঁট গড়িয়ে পড়ছে। কেমন বুড়োটে ছাপ পড়ে গেছে চেহারায়।
‘তুই এখানে।’ শোভন চেহারায় আন্তরিকতা আনার চেষ্টা করে।
‘মানববন্ধনে অংশ নিতে এসেছিলাম।’ আনোয়ার পকেট থেকে রুমাল বের করে পানের লাল রস মোছে। ‘তোর সঙ্গে দেখা হওয়াতে ভালো হলো। অনেক কথা আছে।’
শোভনের ভালো লাগে না আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলতে। ওর সঙ্গে গল্প করা মানে অনেকগুলো খারাপ খবার শোনা। তবে একবার যখন দেখা হয়ে গেছে, আনোয়ারের কথাগুলো শুনতেই হবে। প্রয়োজনে ও সারাদিন পেছনে লেগে থাকবে সেগুলো শোনানোর জন্য।
ফলওয়ালাকে টাকা দিয়ে মানিব্যাগ পকেটে ঢোকায় শোভন। ইশারায় আনোয়ারকে বলে গাড়িতে ওঠার জন্য। ড্রাইভার গাড়ি ঘোরায়। আনোয়ার এক টানা বকবক করতে থাকে। নানা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ও। সারাদিন সেই কাজে ব্যস্ত থাকে। বাবা ধানমন্ডেিত বিরাট বাড়ি রেখে চলে গেছে। বড় ভাই স্ত্রী-সন্তানদের
নিয়ে এক ফ্ল্যাটে থাকে। আনোয়ারের সঙ্গে থাকে তার মা। সমাজসেবক ছেলের জন্য রাত জেগে ভাত নিয়ে বসে থাকতে হয় বুড়ো মাকে। অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল আনোয়ার। বছর ঘুরতে এক সন্তানও হয় ওদের। কিন্তু তিন দিনের সন্তানকে রেখে ঘর ছাড়ে আনোয়ারের বউ। আগে থেকে খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে প্রেম ছিল। আনোয়ার প্রচন্ড আঘাত পায় ঘটনায়। একটা মেয়ে এভাবে প্রতারিত করতে পারে ওকে মাথায় ঢুকতেই কয়েক মাস কেটে যায় আনোয়ারের। উদভ্রান্তের মতো অবস্থা তখন ওর। তবে ও ছেড়ে দেয়নি। বউকে ধরতে লন্ডন পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিল। দেখা করতে পারেনি। তারপর থেকে নারী জাতির ওপর আনোয়ারের প্রচন্ড ঘৃণা। শিশুটিকে আনোয়ারের বড় ভাইয়ের বউ নিজের সন্তানের মতোই লালন পালন করছেন।
‘দেখ সীটটা এখন বেশ গরম, তাই না?’ আনোয়ারের চেহারায় কেমন অশ্লীল হাসি। ইস্টার্ন প্লাজার পাশে এক স্নাক্সের দোকানে বসেছে ওরা। শোভন প্রথমে আনোয়ারের কথার মানে ধরতে পারে না। ওরা বসার আগে এই চেয়ারে খুব সুন্দরী আর স্মার্ট এক মেয়ে বসেছিল। আনোয়ার কি কোন নোংরা ইঙ্গিত দিচ্ছে ?
শোভনের এই সব আলোচনা ভালো লাগে না। ‘সৌরভের কথা মনে আছে ?’
শোভনরে তরফ থকেে গরম সীটরে ব্যাপারে কোন সাড়া না পয়েে আনোয়ার প্রসঙ্গ পাল্টায়।
‘থাকবে না কেন? খুব মেধাবী ছাত্র ছিল ও। সৌরভ এখন কোথায় ?’ শোভন প্রশ্ন করে।
‘বিসিএস দিয়ে ট্যাক্সেশনে ঢুকেছে। বড় অফিসার। গাড়ি-বাড়ি ফ্রি। বিয়ে করেছিল ফিজিক্সের যুথীকে। ওর ওয়াইফও সরকারী কর্মকর্তা। নয় বছরের বিবাহিত জীবনে এক ছেলে এক মেয়ে আছে ওদের।’ আনোয়ার দম নেয়।
‘ভালোই আছে তাহলে সৌরভ। ওর মোবাইল নম্বর আছে তোর কাছে ?’ শোভন জানতে চায়।
‘মোবাইল নম্বর নিয়ে কি করবি ? সৌরভ তো এখন সারাদিন লজ্জায় মোবাইল বন্ধ
করে রাখে।’ হা হা করে হাসতে হাসতে বলে আনোয়ার। দারুণ মজার কোন ঘটনা বলছে যেন ও ! ‘যুথী কি করেছে জানিস ?’
চুপ করে থাকে শোভন। জানতে ইচ্ছা করে না। আনোয়ার নিশ্চয়ই এমন কিছু শোনাবে যেটা সুখকর নয়।
‘যুথী গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায় স্কলারশিপ নিয়ে। সেখানেই এক ফরেনারের সঙ্গে পরিচয়। এখন নাকি তার সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে যুথী। দেশে চলে এসেছে সেই খবর। সৌরভ তো এখানে কাউকে মুখ দেখাতে পারছে না। পারলে গলায় দড়ি দেয়।’
আনোয়ার খুব উৎসাহের সঙ্গে বলতে থাকে।
সব কথা কানে যায় না শোভনের। ওর মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায় সৌরভের জন্য। রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়ে ওঠার কারণে ছোট বেলা থেকে ও কিছুটা সংস্কারপ্রিয়। কারো ঘর ভাঙ্গার কথা শুনলে শোভনের মন কেমন যেন হয়ে যায়।
আনোয়ার বলেই চলে। বউ ভেগে যাবার কারণে ও ভীষণ নারীবিদ্বেষী হয়ে গেছে। পরিবার থেকে অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল আনোয়ারকে আবার বিয়ে দেবার জন্য। ভালো বেশ কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাবও আসে। কিন্তু আনোয়ারকে রাজী করানো
যায়নি।
‘আমাদের আরেক বন্ধু রাকিব…। ওই যে মফু রাকিব। তোর মতো মফস্বলের ছেলে।
রাকিব তো মডেল-অভিনেত্রী দেখে বিয়ে করল। কি সুখ পেল তাতে ? কত পুরুষের সঙ্গে যে ওই… কি যেন নাম … আইরিনের সম্পর্ক, হিসাব করে বলা কঠিন। রাকিব বেচারা সামাজিকতার ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না। এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। বললে বিশ্বাস করবি না, এমন পাতলা শাড়ি পরেছে যে সব দেখা যায়।
কথায় কথায় শাড়ির আঁচল ফেলে দিচ্ছিল গা থেকে।’ শেষের কথাগুলো বেশ জোরে জোরে বলে আনোয়ার।
শোভনের অস্বস্তি লাগে। কেউ কান পাতলেই শুনতে পাবে ওদের কথাবার্তা। ‘একটু আস্তে কথা বলতে পারিস না !’ শোভন বলে।
‘আমাদের সংগঠনের সভাপতির সঙ্গে আইরিনের দৈহিক সম্পর্ক আছে। জানিস, আমি নিজে রাকিবের বউকে আমার সভাপতির বাসায় রাতে দেখেছি’ এবার গলা একদম খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলে আনোয়ার। পাকা অভিনেতার মতো। হাসি পায় শোভনের। এসব পরচর্চা ছেড়ে দিয়ে নাটক করলে আনোয়ার আরও ভালো করতো।
‘বাদ দে এ সব’। শোভন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে।
হাঃ হাঃ করে আসে আনোয়ার। কোনভাবে শোভনকে বিল দিতে দেবে না। টাকা-পয়সার ব্যাপারে খুব উদার। কাউকে খাওয়াতে কৃপণতা নেই। সবই ভালো ওর। কেবল একটা ব্যাপার ছাড়া। আনোয়ারের সঙ্গে কথা বললেই মনের মধ্যে কোথায় যেন বিষণ্ণতা এসে ভর করে শোভনের।
স্নাক্সের দোকান থেকে বেরিয়ে আবার পানের খিলি হাতে নেয় আনোয়ার। মনের ভার কাটাতে শোভন একটা সিগারেট ধরায়। প্রীতির জোরাজুরিতে ধূমপান একদম বন্ধ করে দিয়েছে। ডাক্তার স্ত্রী হলে যা হয় ! তবু মাঝেমধ্যে দুই একটা টান দেয়।
তখনই ভোজবাজির মতো একটা কান্ড ঘটে। প্রীতি ইস্টার্ন প্লাজার সামনে একটা মেরুন রঙের গাড়িতে উঠছে। ও এখানে ! এত অবাক হয় শোভন যে ওর ঠোঁট থেকে সিগারেট নিচে পড়ে যায়। প্রীতির পাশে লম্বা একটা লোক। বেশ
ফর্সাও। লোকটাকে চিনতে পারে না শোভন। প্রচণ্ড বিস্মিত হয় লোকটার সঙ্গে প্রীতির ঘনিষ্ঠতা দেখে। ওই লোক গাড়ির দরজা মেলে ধরে। প্রীতি খুব কায়দা করে হেসে গাড়িতে ওঠে।
শোভনের চেহারার বিস্ময় চোখ এড়ায় না আনোয়ারের। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকায়। বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে ওর চেহারায়। ‘ভাবি না ! তোকে আগেই বলেছিলাম কোন নারীকে বিশ্বাস করতে নেই। সব এক রকম দেখলি তো এবার ? ’
২.
সারাদিন আনোয়ারের কথাটা মাথায় ঘোরে শোভনের। ‘সব এক রকম’। কোন কাজে মন বসাতে পারে না। গার্মেন্টস, সিএনজি পাম্পসহ বেশ কয়েক ধরনের ব্যবসা আছে ওর। কম বয়সে আর্থিকভাবে বেশ উন্নতি করেছে। তবু স্ত্রী ডাক্তার
বলে কিছুটা হীনমন্যতায় ভোগে। নিজেকে স্ত্রীর তুলনায় কম যোগ্যতাসম্পন্ন মনে হয়। কোথাও গিয়ে মনের ভার কাটাতে পারে না শোভন। শেষ মেষ সন্ধ্যা হবার আগে বাসায় ফেরে। ঘণ্টাখানেক পরে মেয়েকে নিয়ে আসে ওর স্ত্রী। এই ফ্ল্যাটের দুটি চাবি থাকে দু’জনের কাছে। সাধারণত প্রীতিই আগে ঘরে ফেরে। সকালে হাসপাতালে ডিউটিতে যাবার আগে অদ্রি আর কাজের মেয়েটাকে মায়ের বাসায় রেখে যায়।
শোভন একটু বেলা করে ধীরে সুস্থে বের হয়। বাসায় ফেরেও একটু রাতে। ততক্ষণে প্রীতি রান্না সেরে গোসল করে মেয়েকে নিয়ে পড়াতে বসে। সংসারের সব কাজে দারুণ দক্ষ প্রীতি। কেউ ওর কোন দোষ বের করতে পারবে না। এই নিয়ে বেশ
গর্বও ছিল শোভনের। মনে হয় কোথায় যেন ঘুণ ধরেছে।
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে শোভন। প্রীতি খুব অবাক হয় এ সময় ওকে বাসায় দেখে।
‘তুমি বাসায় ! শরীর খারাপ নাকি ?’ প্রীতির কণ্ঠে নির্ভেজাল উদ্বেগ।
‘না আমি ঠিক আছি।’ শোভন বুঝতে পারে না কি বলবে। ওর আসলে এখন প্রীতির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
‘কি হয়েছে বল তো ? মাথা ধরেছে ? ওষুধ খাবে?’ প্রীতি একের পর এক প্রশ্ন করে যায়।
‘না না। ওষুধ খাবার মতো কিছু হয়নি।’ আরেক পাশে কাত হয়ে শুতে শুতে বলে শোভন।
প্রীতি হাল ছেড়ে দিয়ে প্রতিদিনের মতো কাজ করে যায়। রাতে খেতে বসে কিছু ভালো লাগে না শোভনের। সামান্য খেয়ে উঠে যায়। বিষয়টা খেয়াল করে প্রীতি।
‘তোমার জিভ আর চোখটা দেখি।’ প্রীতি প্রশ্ন করে বেড রুমে ঢুকে।
‘আজ তুমি হাসপাতাল থেকে কোথায় গিয়েছিলে?’ বলবে না ভেবেও মুখ ফুটে কথাটা বের হয়ে যায় শোভনের।
‘কোথায় যাব। ওহ্! একটা ওষুধ কোম্পানির লাঞ্চের প্রোগাম ছিল ইস্টার্ন প্লাজার দোতলায় এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। সেখানে গিয়েছিলাম।’
প্রীতি বলে যায়। ‘কেন বল তো ? তুমি দেখেছিলে নাকি আমাকে ? ডাকনি কেন ?’
‘আমি না আমার এক বন্ধু তোমাকে ওখানে দেখেছে।’ মিথ্যা কথা বলতে গলা কাঁপে না শোভনের। ‘ওখান থেকে বের হয়ে কার গাড়ীতে উঠেছিলে তুমি ?’
‘কার গাড়ীতে ?’ মনে করার চেষ্টা করে প্রীতি। শোভনের আশঙ্কা হয় অভিনয় করছে না তো ও? ‘জাভেদ ভাই গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। ও তুমি তো ওনাকে চেন না ?
আমাদের ওখানে নতুন জয়েন করেছেন। কি যে আন্তরিক ভাবতেই পারবে না।’
শোভন খুব বেশি ভাবতে চায় না। তবু ভাবনা ওর মাথা থেকে যায় না।
‘তুমি কি জাভেদ ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে গাড়িতে চড়তে শুনে মাইন্ড করেছ ?’
সরাসরি প্রশ্ন করে প্রীতি। ‘উনি তো আমার কলিগ। বীণা, ফারহানার সঙ্গে গাড়িতে ঘুরলে তুমি কিছু বল না!’
‘আরে না মাইন্ড করব কেন ? আমার বন্ধু তোমাকে ওখানে দেখে বলল তো, তাই
জিজ্ঞাসা করলাম।’ শোভন কথা এড়াতে বাথরুম ঢোকে।
প্রীতি ভালোই ব্যাখা দিয়েছে। তবু সারা রাত ঘুম আসে না শোভনের।
৩.
সারাক্ষণ একটা সন্দেহের কাঁটা মনের মধ্যে খচখচ করে শোভনের। ওইদিন আনোয়ারের সঙ্গে দেখা না হলে এটা হত না। ওরই বা দোষ কি ? প্রীতি এখানে চাইনীজ রেস্টুরেন্টে আসবে, তাতো ও জানতো না। কিন্তু সব ঘটনা কেন আনোয়ারের সামনেই ঘটবে ! আসলে ব্যাটা একটা কুফা !
ইদানিং প্রীতির কিছু ব্যবহারও শোভনকে খুব বিস্মিত করে। আগের তুলনায় প্রীতি যেন ওর খোঁজ খবর বেশী নিচ্ছে। দুপুর না হতেই ফোন করে জিজ্ঞাসা করবে, খেয়েছ কিনা ? শোভন যদি বলে, খাইনি, তখনই তাড়া লাগাবে দ্রুত খেয়ে
নেবার জন্য। শোভনের অফিসে বাবুর্চি রান্না করে। দুপুরে সবাই অফিসে খায়।
তিন-চারটার দিকে আবার ফোন করে খোঁজ নেবে কি দিয়ে খেয়েছে ? কয় পদ ছিল ? আগে অফিস থেকে ফিরে কাজ সব শেষ করে অদ্রিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মোটা একটা বই নিয়ে বসতো প্রীতি। এখন শোভনের খুব গা ঘেষে বসে নানা
গল্প জুড়ে দেয়। মনে হয় যেন নব দম্পতি। মাঝেমধ্যে এখন বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরায় শোভন। প্রীতি কিছু বলে না। ওর এই সমস্ত উদারতা স্বাভাবিক নিতে পারে না শোভন।
এক সপ্তাহের মধ্যে শোভন ধরতে পারে কি কারনে প্রীতির এই পরিবর্তন। তিন/চার দিনের জন্য কুয়াকাটা যাবে প্রীতি একটি সামাজিক সংগঠনের হয়ে। ঘুর্নিঝড় দুর্গতদের জন্য বিশেষ চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে কুয়াকাটা ও তার আশে পাশে। প্রীতি জানাল, ওর কলিগরা সবাই যাবে।
শোভনের মুখে এসে পড়েছিল,‘জাভেদ সাহেব যাবে না’। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করেছে। প্রীতি এমনিতে রাগে না। কোন কারনে হঠাৎ রেগে গেলে ওকে সামলানো কঠিন। আর ওর জেদও ভয়ংকর। একবার যখন বলেছে, কুয়াকাটা যাবে।
গিয়ে ছাড়বে। নিজের লক্ষ্য পূরণে খুব স্থির ও।
শোভন জানে, কুয়াকাটা যাবার জন্য প্রীতির অনুমতি চাওয়া আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সিদ্ধান্ত ও আগেই নিয়ে ফেলেছে। শোভন যাতে তিন দিন খেতে পারে সেই রকম রান্না বান্নাও করে রেখেছে। অদ্রিকে ওর নানীর কাছে রেখে যাবে।
‘তুমি তো যাবে, জানি। আর কে কে যাবে ?’ শোভন একটু ঘুরিয়ে জানতে চায়।
‘বীনা, ফারজানা যাবে। আমাদের বিভাগের প্রধান মেসবাহ ভাই যাবেন। ওনার স্ত্রীর যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কেন ? তুমি যাবে নাকি ? প্রীতি ভ্রু নাচায়।
‘না এমনি।’ প্রীতির দেয়া তালিকা শুনেও শোভন নিশ্চিত হতে পারে না।
৪.
প্রীতি চলে যাবার রাতেই শোভনের মোবাইলে আনোয়ারের ফোন আসে।
‘হ্যালো… কি রে, আমি না করলে আর কল দিতে পারিস না !’ আনোয়ারের কণ্ঠে অভিযোগের সুর।
‘তুই দেশসেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকিস। তাই ফোন দেয়া হয়নি। ভালো আছিস ?
শোভনের একটু খারাপই লাগে। এক সময় অসম্ভব বন্ধুত্ব ছিল দুজনের। দিন রাত এক
সঙ্গে ঘুরতো। ক্যাম্পাসে ওদের নামকরণ করা হয়েছিল মানিকজোড়।
‘আমি ভালো থাকলেই কি, আর না থাকলেই বা কি ?’ আনোয়ার বেশ বিষণ্ণ সুরে উত্তর দেয়। ‘মরে গেলে কাঁদবে শুধু বুড়ী মা। আত্মীয়-স্বজন খুশী হবে।
তাদের চোখে আমার মতো অপদার্থ পৃথিবীতে নাকি আর কেউ নেই !’
‘কেন তোর তো একটা ছেলে আছে।’
‘ছেলের কথা বলিস না। আমার ধারণা ছেলেটা আমার নয়।’
‘মানে ?’
‘যে মেয়ে আমাকে কোনদিন ভালোবাসেনি। সে কিভাবে আমার সন্তান গর্ভে ধারন করবে বল ?’
‘তবে বাচ্চাকে ফেলে চলে গেল কেন ?’
‘চিন্তা কর কতখানি নিষ্ঠুর মহিলা যে তিন দিনের দুধের বাচ্চাকে ফেলে যেতে পারে !’ আনোয়ারের কণ্ঠে এখন সত্যিকারের বিষণ্ণতা। ‘ বাচ্চাটা ফেলে দিয়ে যাওয়ার কারণ হল ওই বেটি সারাজীবন আমাকে মনে করিয়ে দিতে চায়, আমি কত বড় গর্দভ।’
‘বাদ দে তো এসব।’ শোভন প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে।
‘পেপারে রঁসু খায়ের কাহিনী পড়েছিলি না ? খুব ইচ্ছা করে একজন বিশ্বাসঘাতিনীকে নিজের হাতে হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলি।’
শোভন চমকে যায় আনোয়ারের কণ্ঠের দৃঢ়তা দেখে। প্রীতি যদি সত্যিই অবিশ্বাসের কাজ করে, তবে ওরও কি আনোয়ারের মতো ইচ্ছা জাগবে মনে ?
কি ভয়ংকর চিন্তা ! শোভনের মুখটা তেতো তেতো লাগে। হঠাৎ মোবাইলে নেটওয়ার্কেও সমস্যা দেখা যায়। শোভন লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রাখে।
কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। প্রীতি ঠিকমতো পৌছাল কিনা সেই খবরও রাখা হয় না।
পরদিন সকালে উঠেই শোভন শ্বশুরবাড়ী যায় অদ্রির খোঁজ নিতে। ওখান থেকে বের হয়ে মোবাইল সুইচ অন করে। ভাবতে থাকে কি বলবে প্রীতিকে ! যাওয়ার পর কোন ফোন করেনি বলে নিশ্চয়ই মন খারাপ করেছে প্রীতি। তারপর শোভন আবার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। এখন আবার প্রীতি ব্যস্ত নাতো?
শোভনের পকেটে মোবাইল হঠাৎ বেজে ওঠে। চমকে ওঠে ও। প্রীতিই তাহলে নিশ্চয়ই আগে ফোন করেছে।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় শোভনের। আনোয়ারের ফোন। ব্যাটা কি সেই রাত থেকে ওর মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছে।
‘কি রে তখন মোবাইল কেটে দিলি। তারপর থেকে মোবাইল বন্ধ রেখেছিস কেন ?’
আনোয়ারের অধীর জিজ্ঞাসা। ধৈর্য্য আছে ব্যাটার।
‘মোবাইলে কি যেন সমস্যা হয়েছিল। তুই কি তখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছিস?’
‘না..হঠাৎ লাইন কেটে গেল। ভাবলাম তোর কোন সমস্যা হল কিনা ?’
‘না না আমি ঠিক আছি। তোর ভাবী কুয়াকাটা গেছে কাল। এখনও ফোন করা হয়নি। ওর এখন একটু খোঁজ নেই কেমন ?’
‘দাঁড়া..দাঁড়া .. ভাবীর সঙ্গে সেই চশমা পরা ফর্সা লোকটা কি গিয়েছে সেখানে? খোঁজ নিয়েছিস?’
‘কিভাবে খোঁজ নেব?’ শোভনের এই নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। খুব কুৎসিত মনে হয় এই চর্চা।
‘ভাবীর হাসপাতালে ফোন কর। ওই ডাক্তারের নাম জানিস তো? সে অফিসে আছে কিনা জিজ্ঞাসা কর। আগে হয়ত হাত ধরাধরি ছিল। এখন সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে সেটা বিছানায় গিয়েছে কিনা কে জানে ?’ এরপর আর শোনার রুচি হয় না।
মোবাইল বন্ধ করে শোভন। মাথাটা ঘুরতে থাকে। কি করবে বুঝতে পারে না।
অফিসে গিয়েও প্রচন্ড মেজাজ খারাপ থাকে। সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে ও। প্রীতিকে আর ফোন করা হয় না।
ডান হাতটা বার বার টেলিফোন সেটের দিকে যেতে চায়। এক সময় ছোট নোটবুক থেকে নম্বর বের করে প্রীতির হাসপাতালে ফোন করে।
‘হ্যালো।’ ওই প্রান্ত থেকে একজন মহিলা কণ্ঠ বলে ওঠেন।
‘জি। আমি ড. নাজনিন নাহার প্রীতির মামাতো ভাই বলছি। উনি কি আছেন?’ শোভন জিজ্ঞাসা করে ব্যগ্র স্বরে।
‘না উনি তো কুয়াকাটা গেছেন।’ অপর প্রান্তের মহিলা উত্তর দেন।
‘আমার কাছে প্রীতির মোবাইল নম্বর ছিল। সম্ভবত ওখানে নেটওয়ার্ক সমস্যা।
আমাকে কি ওরা যে হোটেলে উঠেছে তার নম্বর দেয়া যাবে ? আমার বাবা খুব অসুস্থ। প্রীতির পরামর্শ দরকার। একটু কষ্ট করবেন প্লিজ।’
‘একটু হোল্ড করুন..।’
মহিলা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রেখে প্রীতির হোটেলে নাম ও নম্বর দেয় শোভনকে।
ওর খুব খারাপ লাগে এভাবে গোয়েন্দাগিরি করতে। কিন্তু সত্যিটা তো ওকে জানতে হবে।
‘কিছু মনে করবেন না ড. জাভেদকে কি পাওয়া যাবে ?’
‘উনি তো ছুটিতে আছেন।’
শোভনের মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ে। কি বলছে ওই মহিলা ! জাভেদ ছুটিতে ! তার মানে আগে থেকে ওরা পরিকল্পনা করে নিয়েছিল সব। জাভেদ আগে ছুটি নেবে। তারপর প্রীতি যাবে কুয়াকাটা। সেখানে সবার অলক্ষ্যে মিলিত হবে দুইজন !
শোভনের মাথার মধ্যে যেন রক্ত ছোটাছুটি করছে। প্রেশার মাপলে বোঝা যেত কি অবস্থা ওর ! সারা দিন স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে পড়ে থাকে। এই কি হল ওর জীবনে ! এত দিন আনোয়ারের কাছে নানা জনের গল্প শুনতো। এখন তবে ওর ঘটনাও রসিয়ে রসিয়ে আনোয়ার বলবে সবাইকে। আর ভাবতে পারে না শোভন।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ঘুরে শোভন। মেয়েটার খোঁজ নেওয়া হয় না। সব কিছুর ওপর প্রচন্ড বিরক্তি এসে যায়।
সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। বমি বমি ভাব নিয়ে রাতে বিছানায় পড়ে থাকে।
কিছু ভালো লাগছে না ওর। সারা জীবনে এমন ঘটনা ওর জীবনে আগে কখনও হয়নি।
রাত দশটার দিকে হোটেলের নম্বরে ফোন করে শোভন। পুরুষ রিসিপশনিস্ট ড. নাজনিন প্রীতির নাম শুনে বলে ৮০২ নম্বর। তারপর সেই রুমে লাইন দেয়। ফোন ধরে এক পুরুষ কণ্ঠ। কয়েক বার হ্যালো হ্যালো শোনার পর ফোন কেটে দেয় শোভন। আর বুঝতে বাকী থাকে না ওর।
৫.
শোভন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ও কি করবে ! কিভাবে যে ও সময় পার করছে জানে না। অসুস্থ হয়ে সারাদিন বাসায় পড়ে থাকে। অদ্রিকে পর্যন্ত দেখতে যায় না।
মোবাইল বন্ধ দেখে প্রীতি বেশ কয়েকবার বাসার ল্যান্ড ফোনে কল দিয়েছে। প্রীতির কণ্ঠ শুনলেই রিসিভার নামিয়ে রাখে শোভন। এখন ফোনের লাইন খুলে দিয়েছে। নিজেকে প্রচন্ড প্রতারিত মনে হয় ওর। কি দোষ করেছিল ও জীবনে ?
ব্যবসা করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত কাউকে ঠকায়নি। তবু কেন এভাবে ওকে ঠকাল প্রীতি ! শোভন তো স্ত্রীর কোন আশাই অপূর্ণ রাখেনি। প্রীতির পরিকল্পনা মতো জীবন যাপনে সাহায্য করেছে।
একবার শোভন ভাবে নিজের জীবন শেষ করে দিলে কেমন হয়। একটু পরে মনে হয় নিজের জীবন শেষ করার আগে প্রীতিকে খুন করতে হবে। সেটাও খুব নৃশংসভাবে। আবার মনে হয়, দুইজন মরে গেলে কি হবে অদ্রির? নিস্পাপ ওই শিশু তো কোন দোষ করেনি। তবে কি ডিভোর্স দেবে প্রীতিকে। এছাড়া সামনে কোন পথ দেখতে পায় না ও। একজন প্রতারক স্ত্রীর সঙ্গে এক মুহূর্ত থাকার ইচ্ছা নাই ওর।
শোভনের সারাক্ষণ মনে হতে থাকে, ছুটির দিনগুলি জাভেদের সঙ্গে কিভাবে কাটাচ্ছে এখন প্রীতি। ওকে বোকা বানিয়ে ওরা দুইজন এক রুমে পর্যন্ত আছে। প্রীতি এতটা দুঃসাহস কিভাবে পেল ভেবে উঠতে পারে না শোভন।
৬.
তিন দিন পর রাতে বাসায় ফেরে প্রীতি। সঙ্গে ওর কলিগ ফারহানা। রাতে এখানে থাকবে ফারহানা। সকালে এখান থেকে হাসপাতালে যাবে। ফারহানা একটা মহিলা হোস্টেলে থাকে। রাত হয়ে গেছে বলে এখন আর সেখানে যাবে না ও।
বাসায় আসার আগে প্রীতি মেয়েকে মায়ের ওখান থেকে নিয়ে এসেছে। অদ্রি ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাতে ঘরে ফিরে মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা হু হু করে ওঠে শোভনের।
এই কদিন মেয়ের কোন খোঁজই নেয়নি। বাথরুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে শোভন। শোভনের সঙ্গে খুব বেশী কথা বলে না প্রীতি। ওরও মুখ ভার। শোভন বুঝতে পারে,
এটা প্রীতির অভিনয়। ভাব দেখাচ্ছে, শোভন ফোন করেনি বলে রাগ করেছে। রাতে দুইজন এক বিছানায় শুয়েও কোন কথা বলে না। শোভনের মাথায় ঝড়ের মতো চিন্তা বইতে থাকে কিভাবে প্রসঙ্গ তুলবে ও ! বাসায় একজন বাইরের মানুষ আছে বলে চুপ করে থাকে ও।
সকালে নাস্তার টেবিলে ফারহানা প্রীতির কাছে ওদের রুম ভাড়ার রিসিট চায়।
রিসিট দেখিয়ে বিল করবে। পাশের চেয়ারে বসে শোভন চমকে ওঠে রুম নম্বর দেখে।
৮০৫ রুম নম্বর লেখা আছে। যাবার আগে প্রীতি বলে গিয়েছিল ফারহানার সঙ্গে এক রুমে থাকবে ও। তবে কি জাভেদের কারনে নম্বর পরিবর্তন করেছে !
‘ফারহানা, তুমি আর প্রীতি এক রুমে ছিলে না ?’ শোভন অনেক দিন পর একটা পুরো বাক্য উচ্চারণ করে।
‘হ্যা ছিলাম তো। আমি, বীনা আপু আর প্রীতি আপু এক রুমে তিন বেডে ছিলাম। কেন ?’ ফারহানা জানতে চায়।
‘প্রীতির মোবাইলে লাইন যাচ্ছিল না বলে আমি হাসপাতালে ফোন করলাম। ওখান থেকে বলল, প্রীতির রুম নম্বর ৮০২।’
‘ও এই ঘটনা’। কথাটা বলে হাসতে থাকে ফারহানা। প্রীতির মুখের কোনাতেও হাসির আমেজ দেখা যায়।
‘কি হয়েছে জানেন না শোভন ভাই। আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান মেসবাহ স্যার তো সস্ত্রীক গিয়েছেন, জানেন বোধহয় আপনি। ওনার স্ত্রীর আবার আমাদের রুমটা খুব পছন্দ হয়ে যায়। রুমের জানালা থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল তো তাই।’
ফারহানা হাসতে থাকে। ‘ওই ভদ্রমহিলা জানেন না ভাইয়া, আমরা যা করি, যা কেনাকাটা করি, তাই পছন্দ করে ফেলেন। এই নিয়ে আমরা এ কদিন খুব মজা করেছি।’
শোভন চুপ হয়ে যায়। তাহলে এই ঘটনা। ওই পুরুষ কণ্ঠটি ছিল মেসবা স্যারের ! হ্যা কণ্ঠটা বয়স্ক লোকেরই ছিল।
‘তোমাদের আরেক কলিগ … কি যেন নাম জাভেদ সাহেব… উনি কোন রুমে ছিলেন ?’ শোভন বলেই ফেলে শেষ পর্যন্ত।
‘জাভেদ ভাইতো যাননি আমাদের সঙ্গে। ওনার ভাইয়ের ক্যান্সার হয়েছে। আমরা কুয়াকাটা যাবার আগেই উনি ভাইকে নিয়ে সিঙ্গাপুর গিয়েছেন।’ ফারহানা জানায়।
এবার নজের প্রতি প্রচন্ড রাগ হয় শোভনের। কি ভেবেছে ও গত তিন দিন তিন রাত ধরে। ছি: ছি: ছি :
ফারহানা যাবার জন্য রওনা হয়। যাবার আগে প্রীতির হাত ধরে বিদায় নেয়। ‘শোভন ভাই, প্রীতির খুব মন খারাপ। আপনি তিন দিন কোন ফোন করেননি ওকে। এজন্য প্রতি রাতে ও কাঁদতো। সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকতো।’ ফারহানার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায় প্রীতি। শোভনের বুকের মধ্যে মোচড়াতে থাকে। ভুল বুঝে
কি আচরণটাই না করেছে ও প্রীতির সঙ্গে। অদ্রির সঙ্গে। দরজা লাগিয়ে শোভন ফিরতেই ওর মোবাইল বেজে ওঠে।