আমার মাতৃভূমির নাম ভালোবাসা
ভালোবাসার চাইতে তীব্র আর কোনো মাতৃভূমি নেই,
আজ তাই আমার মাতৃভূমির নাম প্রেম।
এটা কি অসুখ কোনো, শারীরিক, মনের প্রব্লেম?
যে শিশু আহত হলো,
নিহত হলো যে নারী ফিলিস্তিনে গতকাল,
তারা কী কেউ না আমাদের? সেই শিশুটি আমার পুত্র;
দুশ্চিন্তার সহস্র বলিরেখায় ঢাকা যে মৃতার মুখ,
সেই বৃদ্ধা আমার জননী;
আগুনের নিচে রোজ জেগে ওঠে আমার সকাল।
বিভীষিকার ভেতরে আতঙ্কে লুকায় প্রতিটি রক্তিম সন্ধ্যা,
সন্তানের কপালে পিতার চুমুগুলো আজ পথহারা,
নারীরা তাদের ভালোবাসার লোমশ বুক ভুলে গেছে বহু আগে,
পায়ে পায়ে মৃত্যুর আতঙ্ক, কোথাও দেখি না সম্ভ্রমের সামান্য পাহারা।
উচ্ছেদের গ্লানি আজ দূরের অতীত,
চারদিকে কেবল মৃত্যুর হট্টগোল, ভয়াবহ শীত;
অনিবার্য কুয়াশার সুবিশাল কাফন জড়িয়ে আছে
একশ একচল্লিশ বর্গমাইলের গাজা উপত্যাকা;
অস্তমিত সূর্যের কার্নিশ থেকে ঝরে পড়ে ভয়াবহ আগুনের ফুল্কি,
গৃহে, মসজিদে, বিদ্যালয়ে, হাসপাতালের শুভ্র বিছানায়,
শিশুদের স্বপ্নহীন চোখে।
প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতি ইঞ্চি ভূমি
মৃত্যুর ভয়াল ফাঁদ ছাড়া আজ আর কিছু নয়।
জাতিসংঘের এক নারীকর্মী সাহারের গোলগাল মুখখানি
খুব মনে পড়ে আজ,
ওর চোখে রামাল্লার আগুন দেখেছি,
ছোটো ভাই ওমরের হাসি কী নির্মম পুড়ে যাচ্ছে হিংসার আগুনে;
খুব জেনে নিতে ইচ্ছে করে
সাহার হাঞ্জুরি কী এখনও স্বপ্ন দেখে গাজার গোলাপ,
মায়ের হাতের সুস্বাদু আঙুর পাতার দোলমা,
আঠালো হুমুস, ফালাফল?
ও কি এখনও গ্রেগরিয় ক্যালেন্ডারে প্রতীক্ষার দাগ কাটে,
একদিন ফিরে যাবে তার খুব প্রিয় সেই জয়তুন গাছটির নিচে?
না, সাহার জেনে গেছে
ওমরের কচি পা দুটো জয়তুন-গাছের নিচে রোপন করা হয়েছে অনেক আগেই;
ওর মা এখন এক উদ্বাস্তু উকুন; মৃত সন্তানের স্মৃতি বুকে নিয়ে
নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে আম্মানের রাজপথে।
ওমরের কিশোর পা দুটো থেকে উঠে দাঁড়াবে না একদিন
সুবিশাল এক বৃক্ষ মাথা উঁচু করে,
যে বৃক্ষের পত্র-পুষ্প সম্প্রীতির সুবাস ছড়াবে মধ্যপ্রাচ্যে?
যে বৃক্ষের সবুজ পত্রালি ঢেকে দেবে হিংসার আগুন, যুদ্ধের দাবানল?
যখন তাকিয়ে দেখি আট কোটি উদ্বাস্তু মানুষ পৃথিবীর পথে পথে,
অচেনা ধূলিকনায় খুঁজে ফেরে নিজের স্বদেশ,
কী করে নির্দিষ্ট এক ভূ-খন্ডকে এখনো নিজের
মাতৃভূমি জ্ঞান করে অহঙ্কারে মাথা উঁচু করি আমি?
তাই আজ আমার কোনো মাতৃভূমি নেই
তাই আজ আমার কোনো মাতৃভাষা নেই
যখন যুদ্ধের বিভীষিকা লক্ষ লক্ষ শিশুকে করেছে পিতৃহারা,
যখন সহস্র বিধবার চিৎকারে কাঁপছে পৃথিবী,
ভালোবাসা নির্বাসিত,
প্রেম পুড়ে গেছে লোভের এসিডে,
পুঁজির ধোঁয়ার নিচে দমবন্ধ মানবতা,
তখন আমার মাতৃভাষার নাম প্রেম,
তখন আমার মাতৃভূমির নাম ভালোবাসা।
হলিসউড, নিউইয়র্ক।
পকেট ভরা নদী
পকেটে যাদের মুদ্রার ওঠানামা
মুদ্রাস্ফীতি-মূল্য তারাই বোঝে
জলাশয়ে ভরা আমার পকেট-জামা
জোয়ার-ভাটার ছন্দ কেবল খোঁজে।
গোমতি-তিতাস বুক পকেটের দুই
যমুনা লুকাই জ্যাকেটের তলদেশে
পদ্মা হঠাৎ উচ্ছাসে বলে শুই
বাংলাদেশের বুকটাকে ভালোবেসে?
ভর্তি পকেট নদ-নদী খাল-বিলে
ভেজা বাংলার চুম্বনপ্রিয় ভূমি
রাক্ষুসে ঢেউ প্রতিদিন খায় গিলে
ঝড়ের দাপট অহরহ মৌসুমি।
কাশফুল দোলে পকেটের কার্নিশে
মাঝরাতে ডাকে বিরহী ডাহুক একা
সাত’শ নদীর মোহনারা মিলেমিশে
এই বুকে আঁকে স্মৃতিময় কত রেখা।
তোমাদের জেব স্বর্ণ-ডলারে ভরা
আমার পকেটে বুড়িগঙ্গার জল
ঝিকিমিকি ঢেউ নাচে প্রতিবিম্বরা
ছন্দের ধারা বয়ে চলে অবিরল।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৪ অক্টোবর ২০২৩
মধ্যরাতের কফি
ঠোঁট রেখেছি কাপের সিরামিকে।
অন্ধকারে চুমুক দিলে কাপে,
কাপ গলে যায় কাপেরই উত্তাপে।
ঝড় উঠেছে রাতের চারিদিকে।
উষ্ণ কফি গভীর গিরিখাতে
ছলকে ওঠে প্রহর ভাঙা রাতে।
মধ্যরাতে কফির কাপে সাপ
জিহ্বা দিয়ে পান করে আস্বাদ।
স্বর্গচ্যুত সুপ্রাচীন এক পাপ
সাপ-ময়ুরীর বিবাদ-বিসম্বাদ।
স্বর্গের আলো উস্কে দিয়েছিল
ক্রোধের রিপু, ঘৃণার বিষে নীল
আজকে ওরা পাপের পৃথিবীতে
অন্ধকারে আনন্দে বর্ণিল।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সংবিধান
বিধান কিছু লিখে দিলেই সংবিধান হয়?
মানুষের কি হয় কখনো গ্রন্থে পরাজয়?
ভয়শূন্য জ্যোৎস্না রাতে শিশির-ভেজা ঘাস
মানুষ লেখে গ্রন্থ-খাতা, রক্ত-ঘামে চাষ।
রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-বাদলে যুদ্ধ, বসবাস।
বিধান লেখে শ্রমিক-চাষা মজুর বারোমাস।
প্যাডেল মেরে পথের বুকে লেখে রিক্সাঅলা
কৃষক লেখে স্বপ্নবীজে মাটির সে না-বলা।
কারখানাতে শ্রমিক লেখে ঘামের ইতিহাস
কুমার জেলে কামার মুচি লিখিছে বিন্দাস।
মগ, চাকমা, গারো, মুরং পাহাড়ি ভাই-বোন
যাপিত দিন রাত্রি লেখে ঝরণা-স্রোতে, শোন।
গৃহকর্মী লিখছে কোটি সেলাইকলে নারী
ঘরের কোনে লিখছে বধু নীরবে সংসারী।
বেকার লেখে দরখাস্তে অশ্রুজলে রোজ
পথের শিশু লিখছে কী-যে কেউ রাখে না খোঁজ।
জেল-হাজতে নির্যাতিতা লিখছে আহাজারি
মিছিলে দুই মুষ্ঠি তুলে লেখে স্বপ্নচারী।
এইসবই তো জনপদের রচিত আখ্যান
গ্রন্থে লেখা বর্ণ, যতি না দিলে কল্যাণ
কুড়িয়ে আনো রক্ত-ঘামে লেখা সংবিধান।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
রক্তের রেখা
রক্তে আঁকা মানচিত্রে দেশ
পুকুর পাড়ে নিজের গড়া বাড়ি
উঠোনে হাঁস, শালিক সমাবেশ
আমি কৃষক, যোদ্ধা-সংসারী।
রক্তরেখা আঁকে না বিশ্বাস
ভিন্ন গাছে ডাকে মায়ার বাসা
তবু মানুষ জন্মাবধি দাস
দাম দেয় না নিজের ভালোবাসা।
দূরের পাখি উষ্ণ ছোঁয়া দেবে
ডানার নিচে দেখাবে তার ওম
ঝড়ের রাতে বক্ষে টেনে নেবে
যখন ভাঙে সকল কচিদ্রুম
প্রতিশ্রুতির এমন প্রলোভন
চিরটাকাল করেছি সন্দেহ
আঁকড়ে ধরে রেখেছি বন্ধন
রক্ত-বীজে অঙ্কুরিত দেহ।
মানচিত্র রক্তে এঁকে দিলে
হয় কখনো প্রত্যাশিত দেশ?
লাল পতাকা হয়ত ওড়ে নীলে
স্কন্ধে খাড়া অচেনা নির্দেশ।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
শুধু ছবি আঁকা
মানুষেরা শুধু দিনরাত ছবি আঁকে
ছবি ঝুলে আছে নারীবৃক্ষের শাখে।
রাস্তায় ছবি হেঁটে হেঁটে নদী-তির
পাড়ভাঙা ছবি নিদারুণ অস্থির।
ছবিরাই দেশ, রেখাগুলো কাঁটাতার
মাঠে মাঠে ছবি শস্যের সম্ভার।
বিভেদের দাগ, ধর্মের বিভাজন
বর্ণিল রঙে কত কী-যে অর্জন।
স্পন্দনহীন কত ছবি মুছে যায়
কিছু উজ্জ্বল, বিদ্যুৎ চমকায়।
হেঁটে গিয়ে ছবি গড়ে তোলে লোকালয়
তুলির আঁচড়ই পৃথিবীর বিস্ময়।
গৃহহীন ছবি ফুটপাতে শুয়ে থাকে
মানুষেরা তবু দিনরাত ছবি আঁকে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩।