spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধআসাদ চৌধুরীর 'এই ফুলটির অন্তত দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা' কাব্যগ্রন্থের বিষয় বৈচিত্র্য ও...

আসাদ চৌধুরীর ‘এই ফুলটির অন্তত দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা’ কাব্যগ্রন্থের বিষয় বৈচিত্র্য ও শিল্প ভাবনা 

ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান

বিশ শতকের ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি আসাদ চৌধুরী (জন্ম, ১১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৩, বরিশাল)। ‘স্বল্পবাক, ঋজু এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সতত সঞ্চরণশীল এ কবির কবিতায় ঐতিহ্য, শ্লেষ, প্রেম, সৌন্দর্য ও সমাজভাবনা প্রবলভাবে উপস্থাপিত। সমকালীন সমাজভাবনা কবির অন্যতম নিরীক্ষাকেন্দ্র। এই ফুলটির অন্তত দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা কাব্যগ্রন্থে কবির বিচিত্র ভাবনা প্রকটিত হয়েছে। মহান স্রষ্টার প্রতি কবির অবিচল বিশ্বাস, সমাজভাবনা ও স্বদেশপ্রেম, স্মরণীয় ব্যক্তিবর্গকে স্মরণ, মানব জীবনের অভিজ্ঞতা ও নানান গুণ এবং প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ে তাঁর ধারণা  আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে উদ্ভাসিত হয়েছে। 

২২টি কবিতার সমাহার ঘটেছে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে। কবিতাগুলির শিরোনাম ‘তাহলে কিসের ভয়’, ‘আমি কান পেতে রই’, ‘নগর বিজয়ের ইতিহাস’, ‘কীর্তনখোলার চোখে স্বপ্নের জোয়ার’, ‘মানাবে, তবু মানাবে’, ‘জয়তু মুক্ত ম্যান্ডেলা’, ‘তিন প্রহরের প্রবীণ প্রহরী’, ‘শান্ত চরাচরে’, ‘ডুবন্ত মানুষ’, ‘সংকোচ’, ‘হে গুণি, গ্রহণ কর, ‘দশমী’, ‘হেমন্ত কোলাজ’, হেমন্ত ১৪২০’, ‘দিচ্ছে টোকা নতুন বছর’, ‘বিস্ময়’, ‘বিবৃতি’, ‘কোনও বৃক্ষই’, ‘সব তোমাদের জন্য’, ‘চোখের বাহিরে’ ও ‘এই ফুলটির অন্তত দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা’।

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘তাহলে কিসের ভয়’-এ মহান স্রষ্টার প্রতি কবির অবিচল ও সুদৃঢ় বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত হয়েছে। এই কবিতায় কবি মহান রব্বুল ইজ্জতের গুণাবলি মহাগ্রন্থ আল কুরআনের দ্বিতীয় সুরা, সুরা আল বাকারার ২৫৫ নং আয়াত (আয়াতুল কুরছি) থেকে উৎকলিত করেছেন। যেমন কবি বলেছেন–

নিদ্রাহীন, জন্মহীন, একমাত্র মৃত্যুহীন তুমি

তোমার ইচ্ছায় এই সব আয়োজন / তাহলে কিসের ভয়

নয় দরজার সীমাবদ্ধ সত্তার অধিকারী মানুষের পক্ষে মহান স্রষ্টাকে চেনা বা তার মহিমা উপলব্ধি করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। বর্তমান সমাজে মানুষের কষ্ট অনেক বেশি। লজ্জা আর কৃতজ্ঞতা ক্রমাগত অপসৃত হচ্ছে, প্রতিগৃহে আসন গেড়েছে ভীতি আর প্রলোভন। এই অসুস্থ পৃথিবী প্রতি মুহূর্তে তার নিরাময়তা কামনা করে। 

হেরার হীরক দ্যূতি মহামানবের কণ্ঠে তাইতো মহান স্রষ্টার অমীয় বাণী ঘোষিত হয়। কুরআনুল কারিমের ১০৩ নং সুরা, সুরা আল আসরের সার-সংক্ষেপও কবি এ কবিতায় উল্লেখ করেছেন:

যারা বিশ্বাস এনেছে

ক’রে থাকে সৎকর্ম

সত্য আর ধৈর্য্য ধারণের কথা নিজে মানে,

সারাক্ষণ বলা-কওয়া করে ; তারা নয়,

তুমিই তো বলেছ, 

তুমি আছ

ধৈর্যশীলদের সাথে, / তাহলে কিসের ভয়

সমাজভাবনা ও স্বদেশপ্রেম আসাদ চৌধুরীর কবিতায় প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘আমি কান পেতে রই’, ‘নগর বিজয়ের ইতিহাস’, ‘সংকোচ’, ‘হে গুণি, গ্রহণ কর, ‘হেমন্ত কোলাজ’, হেমন্ত ১৪২০’ ও ‘নতুন বছর’ ও ‘পাশ ফিরে শুয়ে আছ’ কবিতাসমূহে সমাজজীবনের বিচিত্র বিষয় বর্ণিত হয়েছে। 

‘এই ফুলটির অন্তত দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা’ কাব্যগ্রন্থটি ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন ছিল অস্থিরতায় পরিপূর্ণ। সঙ্কট-সংঘাতের আবর্তে নিপতিত হয় বাংলাদেশের জনজীবন। কবি সেই সঙ্কট উত্তরণে সাহসী তারুণ্যের জন্য অপেক্ষার প্রহর অতিবাহিত করেছেন। 

শহরে ও গ্রামে …

প্রতিমার ভাঙা টুকরো

অর্ধদগ্ধ বাস- টেম্পপো

এলোমেলো মানুষের লাশ।

ক্ষমতা ক্ষমতা ক’রে 

ভুল রাজনীতি 

কোরাসে মেলায় গলা!…

গানে গানে 

শ্লোগানে-শ্লোগানে

আশার ভাষাটি 

শোনাবেন সে কোন তরুণ…  / আমি কান পেতে রই

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নগর বিজয়ের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায় বিজয়ী সেনারা প্রথমে কোন অভ্যর্থনা পায় না। কেউ তাদেরকে পুষ্পমাল্য দেয় না বা তাদেও জন্য প্রশংসাবাণী লেখে না। তথাপি জরাজীর্ণ, ভুতুড়ে ও নারীবর্জিত নগরে ক্ষুধার্ত, রাগী ও ক্ষিপ্ত যুবাদের আগমন ঘটে। তাদের পায়ের তলায় ক্যাডিলাক (আমেরিকার অত্যাধুনিক গাড়ি), মৃত শত্রুসেনা, জীবন্ত কার্তুজ, পরিত্যাক্ত পতাকা এবং মৃত্যুর ঘোর লাগা পৌরসভার অনুগত নাগরিক। আগত যুবকেরা ক্যাডিলাকে শহর ভ্রমণ শেষে তা ছুঁড়ে দেয় ব্যবহৃত কার্তুজের মত। মৃত সৈনিকদের দিকে তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কিন্তু কার্তুজগুলো তুলে নেয় পরম যত্নে। নগরের কম্পিত নাগরিকদের সঙ্গে ওরা চড়াগলায় বিভিন্ন বিষয়ে দরদাম করে। পরাজিতদের পতাকা দিয়ে ওদের জুতা পরিস্কার করে। আর অহঙ্কারকে অস্ত্রের মত যত্নে পালিশ করে। নিজেদের গুরুত্বকে  বিজয়ীরা উপলব্ধি করে  পরম নিশ্চিন্তে, যদিও সেখানে অন্য ইতিহাস হয়তো আছে। কবির ভাষায়–

নিজেদের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে

নবাগতরা প্রথমবারের মতোন ভীষণ চমকে উঠল।

নগর বিজয়ের অন্য ইতিহাস হয়তো আছে/ নগর বিজয়ের ইতিহাস

আলোর মূল্য অন্ধকারের বিপরীতে দেদীপ্যমান। প্রজন্মের তরুণেরা আলোর মশাল নিয়ে অগ্রসরমান। তাদের দেখে সংকোচে অমাবস্যা প্রকাশ্যে আসে না। 

অমাবস্যা তাহলে কি লজ্জা পায় 

প্রকাশ্যে আসিতে।

প্রজন্মের তরুণেরা রয়েছে

কালো চুল নিয়ে,

তাই কি সংকোচ অমাবস্যার ?/ সংকোচ 

সমাজের জ্ঞানী-গুণীকে সম্মান করা, শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা ও মেধার স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে মহৎ কর্ম সম্পাদন করা হয়। এভাবে একটি সুন্দর সমাজের ভিত্তি মজবুত হয়। এজন্য বিত্তের অভাব থাকলেও চিত্ত হয় বড় আর ভবিষ্যৎ হয় স্বর্ণময়। গুণিকে কবি তাই উদারভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। 

এ-উদ্যোগ বড়ো শুভ, বড়ো আনন্দের–

হে গুণি, গ্রহণ কর, শ্রদ্ধা আমাদের। / হে গুণি, গ্রহণ কর 

‘হেমন্ত কোলাজ’ কবিতায় কবি সারাদেশের খণ্ড খণ্ড চিত্র বর্ণনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের স্থিতিশীলতা কামনা করেছেন। রাঙামাটির পাহাড়ি সৌন্দর্য, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের অপরূপ শোভা, তামাবিলের জলের রেখা ও সীমান্ত ঘেঁষা সিলেটের সৌন্দর্যে কবি বিমোহিত। ধানের ক্ষেতে পাখির কলকাকলি, গ্রামাঞ্চলের পিঠার বৈচিত্র্য আবার দগ্ধ নরনারীর মিছিলে হাসপাতাল পরিকীর্ণ। স্বপ্নস্মৃতির এফোঁড়-ওফোঁড়, যশোর স্টিচের মিষ্টি শ্যাডো বা খেজুরগাছের দিগন্ত বিস্তৃত সারি ও খেজুর গুড়ের মন-মাতানো সৌরভ সবাইকে বিমোহিত করে। রাত-বিরাতে পরীক্ষার্থীর সজোরে পাঠের শব্দ যে পথে আছড়ে পড়ে, সে পথেই চকিতে মিছিল যায়। অবরোধ, ভাংচুর বা আগামী কালের নতুন কোন কর্মসূচি টিভির স্ক্রলে ভেসে ওঠে, ঠিক যেন একই গাছের ডালে  দুটি শালিকের দু প্রান্তে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকা ; একদিকে শান্তি-স্বস্তি, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ‘হেমন্ত ১৪২০’ কবিতায়ও গণতন্ত্র ও সন্ত্রাসের পাশাপাশি অবস্থানের কথা উল্লেখিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৪২০-এর হেমন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংঘাতে জর্জরিত ছিল। কবির ভাষায়–

দগ্ধদেহ জিয়ে

হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যারা যারা

আত্মীয়-স্বজন ছাড়া 

সাংবাদিক আছেন

মার্কামারা শোকার্ত ক্যাডার।/ হেমন্ত, ১৪২০

নতুন বছরে অতীতের জীর্ণতা বিদূরিত হবে, মানুষের স্মৃতির গাঙে ভেসে উঠবে স্বস্তি, নানা খাদ্যদ্রব্যে রমণীকুল গৃহস্থলী পরিপূর্ণ করে তুলবে, মিষ্টি বিতরণ করবে– এ প্রত্যাশা কবির রচনায় পরিষ্ফুটিত হয়েছে। 

কোন রূপসী উপোস থেকে

পণ্যিপুকুর ব্রতের শেষে

মিষ্টি বিলায় মৃদু হেসে ?

দিচ্ছে টোকা নতুন বছর–

এই তো এলো নতুন বছর। / দিচ্ছে টোকা নতুন বছর

কবি আসাদ চৌধুরী ‘কীর্তনখোলার চোখে স্বপ্নের জোয়ার’এবং ‘মানাবে, তবু মানাবে’  কবিতায় স্মৃতিচারণের মাধ্যমে তাঁর স্বদেশপ্রেম উপস্থাপন করেছেন। কবির স্মৃতিচারণের অন্যতম কেন্দ্র হলো বরিশাল। বরিশালের আলো-বাতাসে তাঁর শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের দিনগুলি অতিক্রান্ত হয়েছে। সেই বরিশালের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন তাঁর কবিতায়। 

বরিশালের অন্যতম নদী কীর্তনখোলা। কীর্তনখোলার খরস্রোতা দীপ্ততেজ তাঁকে স্মৃতির বন্দরে নিয়ে যায়। যদিও বর্তমান সময়ে নদীর আগের সে যৌবন আর নেই। বয়সের ভারে, মানুষের সীমাহীন লোভে নদীর সে চলৎশক্তি এখন ম্লান। 

পান্না লাল, সতু সেনের মত বংশীবাঁদক এই বরিশালেরই সন্তান, বালাম চালের ঘ্রাণ, খাল-বিল-নদীতে সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা সহজেই শিল্পীদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষ্যকার মীননাথের জন্মস্থান শঙ্করপাশা, বিশ শতকের ত্রিশ দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম রূপকার কবি জীবনানন্দ দাশের বিচরণভূমি, ডগলাস বোডিং, টিনের ঘর ; রাজবন্দী অশ্বিনী দত্ত হেঁটে যান সদর রাস্তা দিয়ে ; প্রবল ক্রোধে আন্দোলিত হয় আলেকান্দা ; মুকুন্দের সঙ্গীত মূর্চ্ছনা ছড়িয়ে পড়ে পদ্মার এপার-ওপার। চাখারের খোকা এ কে ফজলুল হক, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্যের খ্যাতিমান কবি বিজয়গুপ্তের জন্মস্থান এই বরিশালই, মাধবপাশার আহসান হাবিব, শায়েস্তাবাদের কিশোরী সুফিয়ার খেলাঘর- সবকিছুই আজ স্মৃতি।

আলতাফ মাহমুদ, গাফফার চৌধুরী, আব্দুল লতিফ, শহীদ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম ; নয় নম্বর সেক্টর, পাবলিক লাইব্রেরি– এসব ব্যক্তি ও স্থান তাঁর স্মৃতিতে অমলিন। এসব স্মৃতি যেন কীর্তনখোলার জীবন্ত আখ্যান। কিন্তু কীর্তনখোলা তথা বরিশালের করুণ দশা কবিকে আজ ব্যথিত করে–

কীর্তনখোলার নয়নের জলে 

মাটি ফেলে ফেলে বাড়ায় জমি,

বাংলার ভেনিস আজ খালশূন্য

একি বরিশাল ?

কণ্ঠ শুষ্ক, শুধূ স্বপ্ন ঘোরে

স্মৃতিতে কাতর নয় তরুণ প্রজন্ম

স্বপ্নের জোয়ার কীর্তনখোলার চোখে হুড়মুড় করে।/ কীর্তনখোলার চোখে স্বপ্নের জোয়ার

মাকে শাদা শাড়ি, বোনকে রঙীন শাড়িতে মানালেও কবিকে ঘরে মানায় না। পথে-ঘাটে হোটেলে হয় তার অবস্থান। বরিশাল শহরেই কবি ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও স্কুল শিক্ষকগণের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা পূর্বক আন্দোলন করেছেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেওএই নদীর ব্যথা কাতরতা তাঁকে স্পর্শ করেছে। 

ভেসে যাওয়া সহকর্মীর লাশের পাশে

লাশ হলেই কি আমাকে মানায়, হে নদী,

হে স্রোতস্বিনী ?

বিষণ্ণ এবং দুঃখিত স্বদেশ এবার আমাকে 

স্বাধীনতা উপহার দিয়েছে / মানাবে, তবু মানাবে

কবি আসাদ চৌধুরী আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে স্মরণীয় ব্যক্তিবর্গকে তাদের কর্মের মাধ্যমে স্মরণ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এবং কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে তিনি অকৃপণ ও উদারভাবে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণনায় তিনি বলেছেন, নয়নাভিরাম সুন্দও নিসর্গেও মাঝে তাঁর জন্ম। সমাজের সব জঞ্জাল বিদূরিত করার জন্য আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামের কারণেই তাঁকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। জীবনের অর্ধেকটা সময় তিনি অতিবাহিত করেছেনবিভিন্ন কারাগারে। এজন্য তাঁর বড় ছেলে শৈশবে বাবাকে চিনতে পারেনি। তাঁর নান্দীপাঠে কবি লিখেছেন–

ছেলে বুড়ো সবাই তাকে 

জাতির পিতা বলে

তারই জন্য সবুজ বাংলায় 

লাল সূর্যটা জ্বলে। / সব তোমাদের জন্য

নেলসন ম্যান্ডেলা তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর জীবনেও রয়েছে অসংখ্যবার কারাবরণ। সর্বশেষ ৭১ বছর বয়সে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আর এই ৭১ সংখ্যাটি বাঙালি জাতিসত্তার সাথে জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। 

তোমার বয়স যখন একাত্তর,

তখন তুমি বেরোলে কারাগার থেকে।

আর এই একাত্তর নিয়ে আমাদের কতো গর্ব,

কত অহঙ্কার। / জয়তু মুক্ত ম্যান্ডেলা 

আশির দশকের খ্যাতিমান কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্মরণে কবি লিখেছেন ‘পাশ ফিরে শুয়ে আছো’ কবিতাটি। আশরাফ হোসেনের লোকান্তরকে কবি প্রহরান্তের পাশ ফেরা ও অভিমান বলে উল্লেখ করেছেন।

আমরা তো জানি–

শুধু তুমি পাশ ফিরে

          শুয়ে আছ

ক্লান্ত অভিমানী।/পাশ ফিরে শুয়ে আছো

‘তিন প্রহরের প্রবীণ প্রহরী’, ‘কোন বৃক্ষই’ ও ‘ডুবন্ত মানুষ’ কবিতায় অভিজ্ঞতার সূত্র বিবৃত হয়েছে। গলায় মাফলার জড়ানো প্রবীণ জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। যে সব পর্যটক অরণ্য ভ্রমণে যান, চিড়িয়াখানায় তারা হাতি, হরিণ, ভালুক সহজে দেখতে পেলেও বন-বনানীতে সহসা তদেরকে দেখতে পান না। মেঘে ঢাকা চাঁদের মতই ওইসব প্রাণী হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে আবার হারিয়ে যায় দৃষ্টির অন্তরালে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় পর্যটককে নীড়ে ফিরে আসতে হয়। আর বন্য হিংস্র প্রাণীরা অন্ধকারকেই তাদের বিচরণের সময় হিসেবে বেছে নেয়। কবির ভাষায়–

ওরা অন্ধকারে 

ভালো দেখতে পায়

অন্ধকারে শত্রু চেনা দায়।

এমন কী অন্ধকার নিজে 

শত্রুমিত্র চিনতে পারে না।

অভয়ারণ্যের নিশি শুধু নয়

সবখানে মাতামহী অন্ধকার

এইভাবে পথ করে নেয়। / তিন প্রহরের প্রবীণ প্রহরী

বৃক্ষরা লেখাপড়া না করলেও ঋতু পরিচয়ে তাদের কৃতিত্ব বেশি। কেননা, ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ফল উৎপন্ন হয়। কবির ভাষায়–

কোনও বৃক্ষই

পড়া-লেখা শেখেনি

টিপসই দেয়নি কোনও দিন।

তবু 

ঋতু সম্পর্কে

সমবয়সী নারকেল গাছটির

অভিজ্ঞতা আমার থেকে বেশি। / কোনও বৃক্ষই

চলৎশক্তি বন্ধ হলেই বিপদ ঘনিয়ে আসে। নদীর জলে ডুবন্ত ব্যক্তি যদি তার সাঁতরানো বন্ধ করে দেয়, তাহলে তার মৃত্যু দ্রুত ঘনিয়ে আসে। সে কারণে দুঃসময়ে চলমান থাকাই জীবনের বৈশিষ্ট্য।

চারিদিকে বাঁকা জল 

খল-খল ক’রে

খলনায়কের হালি হাসে ?

জানি সুসময় নয়,

পাখা বন্ধ করতে নেই

এ-সময়। / ডুবন্ত মানুষ 

কবিদের বর্ণনায় প্রকৃতি ও প্রেম এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আসাদ চৌধুরীর কবিতায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ‘শান্ত চরাচরে’, ‘বিস্ময়’ এবং ‘এই ফুলটির অন্তত দশ দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা’ কবিতায় কবির প্রকৃতি ও প্রেমভাবনা প্রকটিত হয়েছে। শান্ত চরাচরে, নীরব নূপুরের নিক্বণ, বিধবা শাদা মেঘ আকাশে উড্ডীন, অবাক বিহঙ্গ, কাঁশবন, নদীর খরস্রোতা ঢেউ, শকটে নববধূর চকিত চাহনি, কিশোর যুবতীদের চঞ্চল নৃত্য কবির রচনায় অবলীলাক্রমে পরিস্ফুটিত হয়।

মেঘের সৌন্দর্যও কবির চোখে বিস্ময় সৃষ্টি করে।

মেঘটা কি পার্লার থেকে এলো ? 

খুব যত্নে এলোমেলো ভাব

ফুটিয়েছে দেহে। /বিস্ময়

প্রকৃতির অপার রহস্য পুষ্পমঞ্জরী। একটি চমৎকার ফুলের যেখানে দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা, অর্থাৎ দশজন পুষ্পপ্রেমীর হাতের পরশ পাওয়ার কথা ; সেখানে কোন রমণীও ফুলটিকে লক্ষ করেনি। অনাদর-অবহেলায় পড়ে আছে সে অরণ্য অভ্যন্তরে। অথচ বৈসাবি অনুষ্ঠানে লাল গোলাপ আর শান্তিবারি সবার কাম্য–

লাল গোলাপ আর শান্তিবারি

বৈসাবিতে কে না কামনা করে। / এই ফুলটির অন্তত দশ দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা

মানব চরিত্রের বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে ‘দশমী’, ‘বিবৃতি’ ও ‘চোখের বাহিরে’ কবিতায়। নার্সিসাস বা স্ব-সৌন্দর্যে মুগ্ধ মানুষের জীবন-যাত্রা বর্ণিত হয়েছে তার কবিতায়।

আগে-পিছে নার্সিশাস

           হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে

কোরাসের দলে নেই

শুধু মেঘ একাই বলেছে

দগ্ধ দেহে প্রতিধ্বনি গুনগুন করে

                       ‘যাব, যাব।’ /দশমী

পরচর্চা ও পরনিন্দা সমাজজীবনের দুষ্টক্ষত। তরুণ সমাজ এ রোগে আক্রান্ত ; অথচ সমাজ-সংস্কার ও ও স্বদেশপ্রেমের আত্মত্যাগে বলীয়ান হওয়া ছিল তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সময় নষ্ট হচ্ছে পরচর্চায়

মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে

জোয়ান পোলারা / বিবৃতি

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্পর্শে ও শব্দে বুঝতে পারে কে তার জনক-জননী বা প্রতিবেশি। ঝড়-বৃষ্টি, সকাল-সন্ধ্যায় সে পাঠে নিমগ্ন হয় ব্রেইলির মহান সৃষ্টির গুণে। ব্রেইলির বইগুলি ছাপতে অনেক খরচ, কে দেবে অতো টাকা ? তথাপি তাকেই মন দেওয়ার অনুরোধ কবির মানবিকতায়।

এই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী

এসো আজ তাকেই মন দি’। / চোখের বাহিরে

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে কবি প্রধানত গদ্যছন্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন–

কণ্ঠস্বরে নিজস্ব বার্তা, অবশ্যই একান্ত নিজস্ব,

শোকের কিংবা আনন্দের

উচ্চারিত হ’লে মানায়। / মানাবে , তবু মানাবে

কয়েকটি কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন–

রাত্রি এসে/ মিশলো যখন   = (৪+৪) মাত্রা

সোনার রবির / ছটায়       = (৪+২) মাত্রা

সব বাগানের / পুষ্প তখন = (৪+৪) মাত্রা

একটি খবর / রটায়        = (৪+২) মাত্রা / সব তোমাদের জন্য 

কবি মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দও ব্যবহার করেছেন। যেমন–

যে-জাতি সম্মান করে/ দেশের গুণীরে  = (৮+৬) মাত্রা

সে-জাতি মহৎ জানি।/ অশ্রুবিন্দু নীরে = (৮+৬) মাত্রা / হে গুণি , গ্রহণ করো

কবি বিভিন্ন কবিতায় অনুপ্রাস ব্যবহার করেছেন–

যেখানে সন্ত্রাসে, সংঘাতে, সংকল্পে, সংগ্রামে

আমরা এক ও অভিন্ন, / জয়তু মুক্ত ম্যান্ডেলা

কবি বিভিন্ন কবিতায় চমৎকার চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। যেমন–

পাতা থেকে ম্লান আলোকের 

শেষ চিহ্নটুকু চেটেপুটে নিয়ে 

বৃক্ষের দীঘল ছায়া  ধ’রে

ক্লান্ত হাত নেড়ে সন্ধ্যার প্রস্থান। / তিন প্রহরের প্রবীণ প্রহরী

উপমা ব্যবহারে কবির মুন্সিয়ানার পরিচয় পরিলক্ষিত হয়। যেমন–

ক্যাডিলাকে শহরটা ঘুরে, দেখে, ছুঁড়ে দিল

ব্যবহৃত কার্তুজের মত। /নগর বিজয়ের ইতিহাস

কবির কবিতায় রূপকের ব্যবহারও পরিলক্ষিত হয়–

আমি দেখি, আর দেখি

চোখের জলে, নদীর জলে দেখি,

ঘাসের শিশিরে দেখি, সাধ আমার মেটে না রে। / মানাবে, তবু মানাবে

আসাদ চৌধুরী  এই ফুলটির অন্তত দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা কাব্যগ্রন্থে বিচিত্র বিষয় উপস্থাপনের পাশাপশি আলঙ্কারিক পরিচর্যায়ও সচেতন ছিলেন। ফলে ছন্দ, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প, উপমা ও রূপক ব্যবহারেও তিনি সফলতা অর্জন করেছেন।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা