হেলাল হাফিজ
আধুনিক বাংলা কবিতার ষাট দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি। আজকে আমরা কবির ” ইচ্ছে ছিলো”, ” কোমল কংক্রিট” ও ” নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় “ এই তিনটি কবিতা কথা বলতে চাইছি। হেলাল হাফিজের কবিতার আয়োজনের আড়ম্বরটাই বিরাট বহরের। আমরা চমকে উঠি। আমরা পাই তাঁর কবিতার লক্ষ্যভেদ তীরের ফলার মতো। যে কারণে, তাঁর কবিতায় যুক্তির পারম্পর্য ভেঙে এসেছে আবেগের পারম্পর্য। আবেগের প্রত্যক্ষ স্পর্শ তাঁর কবিতায় আমরা এমনভাবে খুঁজে পাই, আমরা আনন্দের পারদে ডুবে যাই। আমাদের চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলে তাঁর কবিতার পংক্তিরা। প্রেম, প্রকৃতির আর মানুষের জীবনে এক চিরায়ত বিষয়। প্রেমের মধ্যে দিয়ে মানুষ নতুনত্ব চায়। প্রেমের পাপড়িগুলো মানুষ সৌন্দর্য ও সৌরভের মধ্যে দিয়ে একান্তে কাছে পেতে চায়। এজন্য আকাঙ্খা আর স্বপ্ন দেখতে থাকে মানুষ। একজন কবি, চিরটাকাল স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। তাই স্বপ্ন দেখতে দেখতে কল্পনায় ভাসতে ভাসতে কবি তাঁর প্রেমকে সাজাতে চান। হেলাল হাফিজ যেভাবে বয়ান করছেন,
“ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বানাবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো
ইচ্ছে ছিলো সুনিপুণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো আহা তুমুল বাজাবো
ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দুচোখে।
ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে
শুধু তুমি অন্য ঘরে।
(ইচ্ছে ছিলো)
বিশাল ভালোবাসার ঢেউ সাঁতরে কবি যে সাম্রাজ্য গড়তে চেয়েছিলেন যেখানে তাঁর সম্রাজ্ঞী থাকবেন, সেটা তৈরি হওয়ার পর যখন চোখ মেলে তাকালেন, দেখলেন রাজ্য হয়েছে, রাজাও হয়েছে কিন্তু রাণী অন্য সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হয়ে গেছেন। এই কষ্ট এই বেদনায় কবি প্রেমে অবসাদ বোধ করছেন। কিন্তু যে চিত্রকল্প এঁকেছেন তা এক নিঃশ্বাসে পাঠ করা যায়। সে দৃশ্যের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। তাঁর কবিতার মধ্যে একটা যাদুময় আকর্ষণ আছে। এলোমেলো পাঠকও তাঁর কবিতা মনোযোগ সহকারে পাঠ করে।কারণ, তাঁর সব কবিতার মধ্যে ম্যাসেজ আছে। যা চিন্তার জগৎ, সামাজিক পরিস্থিতি এবং আশাভঙ্গের বেদনা মিশিয়ে দিয়ে আমাদের ঠেলে দেয় নতুন এক মাঠে। যে মাঠের স্থপতি স্বয়ং হেলাল হাফিজ। আমরা দ্বিতীয় কবিতা লক্ষ্য করি,
জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল
কী দিয়ে মুছবো বলো আগুনের জল
( কোমল কংক্রিট)
এই দু’লাইনের কবিতা। চিরকাল এই সত্য দেখা গেছে গোটা সমাজে যদি জীবনের কোনো চেহারাই না পাওয়া যায়,তাহলে কবিসত্তা মানস খোঁজে সেই সমাজের একটা জীবন্ত জীবনদর্শনের আশ্রয়। যা সংহতির কেন্দ্র। সমাজের ভবিষ্যৎ চেহারা কবির কবিতার পংক্তির মধ্যে দিয়ে পরিসফূটিত হয়। যুগের জটীল পরিস্থিতিতে কবি মনও দিশেহারা। কাব্যের নিজস্ব একটা জগৎ আছে। কাব্যের লজিক ও জীবনের লজিক আলাদা। প্রেমের আকুতি, সামাজিক আর্তিকে পরিস্ফুট করে তাকে মানবিক করে তুলতে কবি সমাজ বরাবর চেষ্টা করেন। কবিই একমাত্র সত্তা যিনি আক্রোশে আকাশটাকে ন্যাকড়ার মতো ছিঁড়ে ফেলতে চায় আবার কখনো কখনো চাঁদ কে চূর্ণবিচূর্ণ করে অতি আবেগীয় নাটুকে চিত্র হাজির করেন। যা আর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব নয়। মনের হতাশা, শূন্যতা, বিরক্তি, বিতৃষ্ণা, ক্ষোভ সম্পূর্ণভাবে কবিতায় রূপায়িত করেন কবি।আমরা হেলাল হাফিজের এই কবিতা লক্ষ্য করি–
“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কন্ঠ
পা এক নয়।
সেখানে সংসারী থাকে সংসার বিরাগী থাকে
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শ্বাশত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝেমধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহবানে
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়”
( নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়)
প্রত্যেক কবিই নিজস্ব ভাষা নিয়ে কাজ করেন। আমরা বলতে চাইছি, কবি একটা নিজস্ব রাস্তা নির্মান করতে চান।সে রাস্তার সব কিছুতেই কবির নিজস্বতা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দিন যেমন নিজস্ব রাস্তা নির্মান করেছেন, আমরা তাঁদের কবিতা পাঠ করলেই টের পাই, এ কবিতা কে লিখেছেন। প্রকৃতপক্ষে একজন কবি চিরটাকাল একটা রাস্তা নির্মাণের জন্য ধ্যান জ্ঞান এবাদত সবকিছুই উজাড় করে ঢেলে দেন। স্বকীয়তা অর্জনের জন্য। আমরা বলতে পারি আধুনিক বাংলা কবিতার আঙিনায় যে ক’জন কবি ইতোমধ্যে নিজের স্বকীয় পথ সার্থকভাবে নির্মাণ করেছেন, তাঁরা পূর্বসূরিদের মতো স্বাতন্ত্র্য কাব্যঐতিহ্য নির্মাণে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কবিতার স্বাদ ভিন্ন কিন্তু রচনায় প্রবীণতা অর্জন করেছেন। হেলাল হাফিজের কবিতা মানবসভ্যতার ইতিহাস, প্রকৃতির আধিপত্য ও প্রেমের ঘনিষ্ঠ আলপনা। আমরা তিনটি কবিতার সৌন্দর্য ও রাস্তা নির্মান নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি যা দীর্ঘ আলোচনার দাবী রাখে। আজ ষাট দশকের কবি হেলাল হাফিজের প্রিয়দিন জন্মদিন। তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা করছি।
ষাট দশকের আরো গুরুত্বপূর্ণ কবি আছেন। যাঁদের কবিতা ইতোমধ্যে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আমরা কয়েকজন কবিকে নিয়ে কিছু কথা বলেছি। কবি রফিক আজাদ, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি সিকদার আমিনুল হক, কবি হায়াৎ সাইফ, কবি মুস্তফা আনোয়ার, কবি জাহিদুল হক, কবি মহাদেব সাহা, যাঁদের কবিতার পথে হেঁটে গেছেন অসংখ্য তরুণ কবি। ষাটের কবি হায়াৎ সাইফ প্রসঙ্গে তাঁর সমসাময়িক কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলছেন, ” আমার নিজের গদ্যরচনায় ও মানসে সুধীন্দ্রনাথের যতোখানি প্রভাব ছিলো, ততোটা ছিলোনা আমার কবিতায়। সুধীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরবর্তী মুদ্রণ সেদিন দেখেছিলাম হায়াৎ সাইফের কবিতায়।’ পূর্বমেঘ’ কিংবা ‘ সলিমুল্লাহ হল বার্ষিকী’তে ( যে হলের অনাবাসিক ছাত্র ছিলাম আমি),নাকি কোনো লিটল ম্যাগাজিনে, হায়াৎ সাইফের কবিতা প্রথম দেখে আমার মনে হয়েছিল : আরে এ যে দেখছি সুধীন্দ্রনাথের ধারাবাহিকতা। একটু অবাকই হয়েছিলাম। কেননা ষাটের দশকের সেই প্রথম দিকে, আমরা তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যামন্দিরের চত্বরে ঢুকেছি, ছিলো জীবনানন্দ দাশের ও বুদ্ধদেব পরিস্রুত বোদলেয়ারের দোর্দণ্ড প্রভাব- প্রতাপ।না মেনে উপায় নেই, আমাদের পঞ্চাশ ও ষাটের সব উল্লেখযোগ্য প্রধান কবিই তখন জীবনানন্দ আর বুদ্ধদেন বাহিত বোদলেয়ারে অশরীরআত্মা পরিস্রুত। হায়াৎ সাইফ তখন সুধীন্দ্রীয় কবিতা লিখে তাঁর স্বকীয় সন্ধানের পরিচয় দিয়েছিলেন”( করতলে মহাদেশ, পৃষ্ঠা ১৯১)।
এই গদ্যে আমরা কয়েকজন ষাটের কবিকে নিয়ে ভিন্ন আলোচনা করেছি।
আক্ষরিক অর্থে বাংলা কবিতায় ষাট দশক বাঁক বদলের দশক। নতুন পৃথিবী নির্মাণে নতুন কবিতা সৃষ্টির মৌসুম। কবিতা এমন এক শিল্প যেখানে একবার যে তার দ্বারা স্পৃষ্ট হয়েছে, নিতান্ত পাষাণহৃদয় না হলে তাঁকে সেই মোহিনীর প্রতিরোধহীন মোহিনী ফাঁদের কাছেই আটকা পড়ে থাকতে হয় চিরটাকাল।