খসরু পারভেজ
ঘুম ও অস্থির ইচ্ছের পাখি
অস্থির ইচ্ছের পাখিরা মাতাল বাতাসে জেগে আছে
অদৃশ্য শয্যায় ছড়ানো-ছিটানো ঘুমের খোসা
স্বপ্ন, ভালোবাসা গলা জড়িয়ে জেগে থাকে দুঃসহ রাত
ভয় ও ভর্ৎসনাও গিলে খেয়েছে ঘুমহীন ঘুমের আরক
একটি বসন্ত বালিশের খোঁজে
আমি ঘুমগুলো পকেটে নিয়ে পালিয়ে বেড়াই
খুঁজে ফিরি একটি মুমুক্ষু বিছানা
যেখানে ঘুমকে শান্তিতে শুইয়ে রাখা যায়
মায়ের স্পর্শে জেগে থাকা শিশুর হাসির মতো
কোথাও আমার ঘুমগুলোর শান্তির ঠিকানা নেই
আমি যখন ঘুমুতে যাই
তখন লাইনচ্যুত রেলগাড়ি ছুটে আসে চোখের ভেতর
দুর্ঘটনা কবলিত অগণিত বাস – ট্রাম
অ্যাম্বুলেন্সের বিষণ্ন সাইরেন অনায়াসে ঢুকে পড়ে
মস্তিষ্কের অলিতে গলিতে
ভয়ানক ভেঁপু বাজিয়ে কাঁদতে থাকে অগ্নিপোড়া ইষ্টিমার
আমার বুকের ভেতর গুমরে মরে পৃথিবীর লক্ষ-কোটি
কবিতায় অনুচ্চারিত শব্দগুলো
পান্থপথের ঘুমঘর হাতছাড়া হয়ে গেছে অনেক আগেই
আমার অনিদ্রা অসুখে জর্জরিত ঘুম
কোথায় একটু হাত- পা মেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে
বোধের দোকানে ভালোবাসা বিক্রি হয়ে যায় বাকি দামে
আমি শান্তির বিছানা কিনতে পারিনি
ঘুমের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে স্বপ্নের
আমি জানি, ঘুমোতে গেলেই সময়ের দৈত্য এসে
চুরি করে নিয়ে যাবে আমার স্বপ্ন ও ঘুম
তাই আমি হাতের মুঠোয় ঘুমকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াই
দিন শেষে রাত আসে আবার রাত্রি শেষে ভোর হয়
অথচ আমার পালিয়ে বেড়ানোর কোনো শেষ থাকে না..
ঘুম ও কঙ্কাল
ঘুম থেকে জেগে দেখি
আমার শরীরে কঙ্কাল ছাড়া কিছুই নেই
আমাকে খুবলে খেয়েছে মরমি ঘুম
যাকে জড়িয়ে ধরে আমি ঘুমিয়েছি
ঘুম ভেঙে গেলে দেখি সেও আমার কঙ্কাল
ঘুমোনের আগে আমি মানুষ ছিলাম
ঘুমোনের পর আমি স্বল্পদৈর্ঘ্য মৃত্যুপাখি
ঘুমের ঘোরে আমি স্বপ্নের ভাটিখানায়
ঘুমের সাথে মৃত্যুকে মিশিয়ে সামান্য চুমুক
ঘুম থেকে জেগে আমি পাষাণ পুরুষ
তুমি যদি ঘুমকে ঘৃণা করতে পারো
তাহলে তোমার কোনো স্বপ্নভঙ্গ নেই
আমার কঙ্কাল কবিতা লেখে
পৃথিবীর পাদপীঠে রেখে যায় কলঙ্ক কুর্নিশ
কবিতার শব্দগুলো তখন সলেমানী কিতাব!
বারবিকিউ পোয়েম
এই বারবিকিউ সময় আমাকে নিয়ে এসেছে একটি খাদের কিনারে,একটু ধাক্কা দিলেই আমি পড়ে যাবো! এখানে কবাব সন্ধ্যা গিলে খেয়েছে ক্যাফে কাল! ফোয়ারার মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে ম্রিয়মান আলোয় ভোজের আনন্দ! আমাকে খাদের কিনার থেকে হাত ধরে নিয়ে এলে তুমি হ্যাভেন প্যালেসে! আমাকে নিয়ে বসালে জমজমাট সেই রেস্টুরেন্টে! তুমি মেনু দেখে খাবার অর্ডার দিলে! আমি পাশের টেবিলে তাকিয়ে দেখি, কাঁটা চামচে যে যার মতো মুখে তুলে নিচ্ছে নিজের কলিজা, নিজের হৃদপিণ্ড! যখন আমাদের টেবিলে খাবার এল, কী আশ্চর্য! আমি স্যুপের বাটিতে দেখি তোমার থেতলে যাওয়া মুখ, প্লেটে সাজিয়ে রাখা রক্তমাখা তোমার দুটি চোখ! বিস্ময় ও আতঙ্কে আমি যখন ঘামছি, তখন এক অদ্ভূত ওয়েটার আমার সামনে দাঁড়িয়ে। একপেয়ে অন্ধ ওয়েটার জিজ্ঞাসা করল– স্যার কোল্ড জুস না ব্লাড ড্রিংকস? তুমি আমার পাশে তখনও বসে ছিলে।
অপরাহ্নের বারান্দা থেকে
মেঘের বেদনা বুকে নিয়ে যদি
মুখ ভার করে বসে থাকে পৃথিবী পুরুষ
তার সাথে কখনো কি কথা বলে আকাশের মেয়ে
এক টুকরো আলোর বৃষ্টি – রৌদ্রের গান
তোমাদের দিয়ে যাবো তাই আমি রৌদ্রপাখি
মেঘের কুটিরে লুকিয়ে থাকে আলোর শস্য
এখানে আসবে বলে
পথ ভুলে ফিরে যায় যখন প্রমিথিউস
তখন আমিই ঠুকরে ঠুকরে ভেঙে ফেলি পথের খাঁচা
জীবন পোড়ানো আগুন রঙ ছাই থেকে
নতুন করে জন্ম নিই
তোমাদের জন্য বেঁচে থাকি ফিনিক্স পাখির মতো
অপরাহ্নের বারান্দায় ম্লান আলো
সন্ধ্যার সভায় একটু পরেই শুরু হবে অন্ধকার উৎসব
নৃত্যরত নীলরাত গিলে খাবে শাদাঘুম
উন্মাদ রাতের শেষে বেজে উঠবে নিঃসঙ্গ নূপুরের গান
তবু নক্ষত্রের গর্ভ থেকে জন্ম নেবে বিদেহী সুন্দর
তুমি দেখবে আলোর শস্য হাতে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি
কবিতাময় এক নতুন ভোরে।
অদৃশ্য এপিটাফ
পালিয়ে যাবার ইচ্ছে নেই, তবু যদি চলে যাই
মনে রেখো আমি আছি তোমার বুকের ভেতর
নিরিবিলি কান পেতে রেখো বুকের চাতালে
শুনতে পাবেই আমার জনান্তিক পদধ্বনি
জেনে রেখো, তোমার ভার্জিন দুচোখে
কবিতার কিছু নক্ষত্র-কুচি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে
আমি এসেছিলাম শুধু তোমারই জন্য
অদৃশ্যের হাতছানি কখনো কখনো দৃশ্যমান হয়
অন্ধ চোখের তারাও হোমারের চোখ হয়ে জ্বলে ওঠে
স্পষ্ট দেখতে পায় লুকিয়ে থাকা পৃথিবীর মহাকাব্য
কখনো কখনো বিদায়ের পথে জাগে আনন্দ উৎসব
ফিনিক্স পাখির মতো অগ্নি ছুঁয়ে নেচে ওঠে মহাকাল
হয়তো শুনতে পাবে সেই নিরন্তর ঘুঙুরের ধ্বনি
মৃত্যুকে নাচিয়ে যেভাবে জীবন এসেছিল একদিন
জীবন কি শুধু অন্নহীন ভিখারির মতো
পুষ্টিহীন পায়ে হেঁটে আসে রাজতোরণের দিকে
কতটুকু দিয়ে যায় আর কতটুকু নিয়ে যায়
কজন তা দেখতে পায় ম্যাজিক মাখানো দুচোখে
প্রকাশ্যে হোক অথবা অপ্রকাশ্যে হোক
যেভাবে যাই না কেন আমার যাওয়ার কোনো শেষ নেই
আমাকে খুঁজবে তুমি পাথরের বুকে- শিলালিপি সম্ভাষণে!
জেনো,কখনোই লেখা হবে না আমার কোনো এপিটাফ!
রহু চণ্ডালের হাটে
হাটের ভেতর মজমা দেখে আমি দাঁড়িয়ে যাই। আমার বেসাত করার কথা মনে থাকে না। হয়তো আমার বধু দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন বাজার থেকে ফিরবো এক থলি আকাশ নিয়ে!আমার সন্তানেরা পথ চেয়ে বসে আছে পকেট ভরা সমুদ্র নিয়ে কখন ঘরে ফিরবো! আমি আকাশ কিনতে এসে যাদুর খেলা দেখে দেখে মুগ্ধ হই! আমি বাড়ি ফেরার কথা ভুলে যাই। আমি সমুদ্র কিনতে এসে বাজিকরের বাজিতে খেলি! গণ্ডি দিয়ে আমাকে বেঁধে রাখে রহু চণ্ডাল। মাটিতে থাবা দিয়ে আকাশ থেকে নামিয়ে আনে কামরূপ কামাখ্যার দৈত্য। আমার মাথায় বুলিয়ে দেয় দুর্দান্ত ম্যাজিকের হাড়। আমি এক ঘোরের ভেতর শুধু ঘুরতে থাকি – নাচতে থাকি।
আমি আনাজের দোকান ফেলে চায়ের দোকানে আসি। চায়ের দোকান থেকে আবার ফিরি খেলনার দোকানে।ভিড়ের ভেতর উড়তে থাকে সোনালি বেলুন। আমি বিস্ময়ে তাঁকিয়ে থাকি সেই বেলুনের দিকে। কোকাব শহর থেকে ভেসে আসে অচেনা পরীর গান!
বাবা বলতেন, পায়ের নীচে বাবুই পাখির বাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে যাদুর রহস্য বুঝতে পারবি! আমার পায়ের তলায় বাবুই পাখির বাসা, তবু ধরতে পারি না, বুঝতে পারি না রহু চণ্ডালের ভেল্কিবাজী-যাদুর খেলা।
এ কোন হাটের ভেতর আমাকে নিয়ে এলে তুমি? জীবন জঞ্জালে ভরা এখানে শুধুই মোহ! চারপাশে আশা-ভালোবাসার বিফল দোকান। হাটশেষে এক এক করে ভিড় কমে যায়। যে যার মতো বেসাতি নিয়ে ফিরে যায় বাড়িতে । আমি শুধু জনশূন্য হাটের ভেতর একগুচ্ছ হাহাকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি – দাঁড়িয়ে থাকি!
মায়ের মৃত্যুদিনে
আমাদের ছোট্ট উঠোন আরও ছেটো হয়ে গেছে
দেয়াল উঠেছে ভেতর বাড়িতে
মনের মাঠে ছড়িয়ে আছে মৃত প্রজাপতির পাখনা
তাইতো তোমায় ভুলে আছি মা!
তোমাকে কখনো গন্ধতেল মাখতে দেখিনি
কিন্তু কী এক অনন্য সুগন্ধে ভরা ছিল তোমার চুল!
বাবা কখনো তোমার জন্য বডি স্প্রে কিনতে পারেননি
অথচ তোমার বুকে কী আশ্চর্য আতরের গন্ধ ছিল!
আমি এখন তোমার সুগন্ধ ভুলে যাচ্ছি, মা!
ওরা বিষের বোতলে আমার আঙুল ডুবিয়ে রেখেছে
আমি নীল হয়ে যাচ্ছি, মাগো!
এ জন্ম-জীবন, পৃথিবীকে এনে দিলে তুমি
কবিতায় কবিতায় ভরিয়ে দিলে আমার সারাবেলা
অথচ আমি আমার জন্মদিন নিয়ে এতটা ব্যস্ত যে
তোমার জন্মদিন বা মৃত্যুদিনের কথা ভুলে যাই!
আমার ভেতরে অনেক ময়লা, মাগো!
আমি মানুষ হতে পারিনি
কে আমাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে!
দ্বিখণ্ডিত কবি ও মাজারতত্ত্ব
একটা সোনার আপেল
তোমরা তাকে ভাগ করে ফেললে
যতই দ্বিখণ্ডিত করো আপেল আপেলই থাকে
মানুষ যখন অমানুষ হয়ে যায়
তখনই মানবসত্তার বিচার-বিশ্লেষণ নিয়ে
আমরা মেতে উঠি
নকল পণ্যে যখন ভরে ওঠে সারাদেশ
তখনই তো খাঁটি শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে
অথচ এসবের প্রয়োজন ছিল না
কবির কবরকে তোমরা মাজার বানালে
সেই মাজারে বসেই তোমরা বাজাও বিষের বাঁশি
অথচ কবির নামে কোনো অগ্নিবীণা আজ বাজে না
মাজার মানুষের জন্য নয়
মাজার শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে থাকে সম্প্রদায়
মনে রেখো, কবি কখনো পীর নয়।
অসমাপ্ত কবিতা
সবটুকু লিখে রেখে যেতে চাই
অথচ লেখা হয় না — লিখতে পারি না
কখনো লিখতে লিখতে কলম ভেঙে যায়
নতুবা ফুরিয়ে যায় কলমের কালি
অথবা লবণজলে চুপসে যায় শাদা কাগজ
চৌদ্দশ’ শতক থেকে একটি অসমাপ্ত কবিতা
পড়ে আছে বুকের উঠোন জুড়ে!
পিতামহদের মতো বৃক্ষের বাকলে লিখব
অথচ আমার ছোঁয়া পেলে
বৃক্ষগুলো দুহাতে ভরিয়ে দেয় ঝরাপাতা
ওদের কান্নার কাছে আমার কবিতা মূল্যহীন
ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপে যখন লিখতে যাই
আমার দুহাতে লুকিয়ে থাকা ব্যর্থতার আগুনে
পুড়ে যায় কিবোর্ড – মাউস – হার্ডডিক্স
কখনও আমার হাতের আঙুল কলম হয়ে
সমুদ্র তীরের বালিতে লিখে রাখে অমর কবিতা
কিন্তু ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যায় সবকিছু
তারপর বুকের পাঁজরে লিখি
কিন্তু মরমি পাঁজর, সেখানেও লোনাজল
কবিতার শব্দগুলো নুনবিষে গলে গলে
মিশে যায় বিরহী রক্তের অলিগলিতে
অতঃপর আমি ছন্দের ছুরিতে ফালাফালা হই
শব্দের শাবলে ক্ষত-বিক্ষত হই
জ্বলন্ত চুল্লিতে মাথা ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করি
আত্মহত্যাই যেন অসমাপ্ত একটি কবিতা!
ল্যান্ডস্কেপ
এখানে ওরা নতুন মুখ
আমরা হয়তো ওদেরকে চিনতাম, হয়তো না
ওদের নতুন পরিচয় ওরা সবাই ক্ষুধার্ত
তুমি কবিতার কথা বলছো
তোমার কবিতা কি ওদের মুখে তুলে দিতে পারে অন্ন
তুমি তোমার গল্পের কথা বলছো
কিন্তু তুমি কি জানো অনেক রূপকথার গল্প ওরা শুনেছে
কোনো গল্প দুধহীন শিশুর কান্নার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে
অনেক কেঁদেছো তুমি
চারপাশে তাঁকিয়ে দেখ কত নিরন্ন মুখ,ভাসমান কান্না
ওদের জন্য কখনো তুমি এক ফোঁটা অশ্রু ফেলেছো কী
আজ তোমার আঁচল ভিজে যায় কৃত্রিম কান্নায়
জীবনে যারা খবর দেখেনি তারাই এখন খবরের শিরোনাম
যারা কোনোদিন ফুটপাত চিনতো না
দেখ, তারা আজ ফুটপাতে ঠিকানা পেতেছে
মাথার ওপর ঘোলাটে আকাশ নিয়ে
বেদনার্ত দালানের পাশে সারি সারি ওরা বসে আছে
ওদেরকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে অবাক পৃথিবী
নির্বাক ঈশ্বর!
আগ্রাসন
খুব ধীরে ধীরে জড়িয়ে ধরে সবুজ সর্বনাশ
কঠিন কুঠারও তাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না
খুব শক্ত করেই তুমি জড়িয়ে ধরেছো আমাকে
আমি ক্রমাগত ঢুকে যাচ্ছি তোমার সঙ্গম গৃহে
তোমার বুকের ভেতরে আমার সমস্ত শরীর
কী অসহ্য ভালোবাসা, কী সর্বগ্রাসী এই বন্ধন
নিঃশব্দে নিঃশেষ হয়ে যাই আমি তুমুল চুম্বনে
যেভাবে নদীর নীলস্রোত ভাঙনকে ভালোবাসে
জীবনকে ভালোবাসে কবরের মাটি, তেমনই
তুমি জড়িয়ে নিচ্ছ,জাপটে নিচ্ছ অস্তিত্বের আয়ু
প্রেমের গেলাসে মুখে তুলে দিচ্ছ গরল গৌরব
এমনি করেই মুছে যাবে কি আমার ইতিহাস
আমার শেকড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি
আমার জন্ম, নিজস্ব কোনো মৃত্যুও কী থাকবে না
ভালোবেসে কখনো কেউ জড়ায় মুগ্ধ আলিঙ্গনে
প্রেমিক জড়িয়ে ধরে, দুঃসময়ও জড়িয়ে ধরে
ঘাতক অন্ধকার, ঘৃণা, প্রতারণাও জড়িয়ে ধরে
তাই জড়িয়ে ধরা মানেই প্রেম- ভালোবাসা নয়
সুন্দরকে ডেকে ফেরা
ঐশ্বর্যের পাশে হাহাকার বসে আছে
সভ্যতার সিঁড়িতে স্খলন
আমার দুটি সন্তান — স্বপ্ন আর সম্ভাবনা
গুরুগৃহে যাওয়ার পথে তারা হারিয়ে গেছে
তাদের নিখোঁজ সংবাদ বাতাসে উড়ছে
দুঃখের বাজেট অধিবেশন চলছে
সম্পূরক প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই
সমৃদ্ধির পাশে মিথ্যা বসে আছে
হাট থেকে অবিশ্বাস কিনে নিয়ে
আমরা যার যার মতো বাড়ি ফিরে যাচ্ছি
হাটকুড়ানি মেয়েটি অভাব কুড়িয়ে নিচ্ছে
ওর জন্য ওৎ পেতে বসে আছে আতঙ্ক
চৌরাস্তার নীল বেঞ্চিতে
পাশাপাশি বসে আছে আস্থা ও বিচ্ছিন্নতা
গন্তব্যের সাথে হেঁটে যাচ্ছে সর্বনাশ
প্রত্যাশার পাশে অন্ধকার
আমি সুন্দরকে ডেকে ডেকে ফিরছি।
খসরু পারভেজ
বাংলাদেশে আশির দশকের অন্যতম প্রধান কবি খসরু পারভেজ। তাঁর সময়ে তিনি স্বতন্ত্র ও নিজস্বতায় অনন্য। অসত্য, অসার, অপ্রেম, অমানবিকতার বিরুদ্ধে কবিতায় তিনি সোচ্চার।
খসরু পারভেজের জন্ম, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার শেখপুরা গ্রামে। পিতা মৃত খন্দকার মকবুল আহমেদ। মাতা মৃত লুৎফুন্নেছা লতা।
বাংলা ভাষা-সাহিত্যে পড়াশুনা করেছেন। একসময় সংবাদপত্রের সাথে জড়িত ছিলেন। দেশের বৃহত্তম রাষ্টায়ত্ব ব্যাংকের চাকুরি থেকে সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন।
প্রতিষ্ঠা করেছেন মধুসূদন স্মারক সংস্থা ‘মধুসূদন একাডেমী’ ও কবি সংগঠন ‘ পোয়েট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ‘।
কবিতা চর্চার পাশাপাশি গান লেখেন। গদ্য চর্চা ও গবেষণাধর্মী কাজে নিবেদিত। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে গবেষণাকর্মে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
কাব্য : পালক খসা বলাকার আর্তনাদ ( ১৯৮৩), নিহত বিভীষিকা নিরুদ্দেশে (১৯৮৬ ),
মুক্তিযুদ্ধে কুকুরগুলো ( ১৯৯৪ ), ভালোবাসা এসো ভূগোলময় (১৯৯৭, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১১), পুড়ে যায় রৌদ্রগ্রাম (১৯৯৯, কলকাতা), ধর্ষণমঙ্গল কাব্য (২০০১, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০২১ ), রূপের লিরিক ( ২০০৫ ), প্রেমের কবিতা (২০০৫ ), জেগে ওঠো প্রত্নবেলা (২০০৭), জিন্নাহর টুপি (২০১৮), হৃদপুরাণ (২০১৯), খসরু পারভেজের নির্বাচিত কবিতা (২০১৯, কলকাতা ), যশোর রোডে দাঁড়িয়ে (২০২১), সুবর্ণগ্রামে লকডাউন ( ২০২১ ), সক্রেটিসের সাথে ( ২০২২ ), কুড়িয়ে পাওয়া কবিতা ( ২০২৩ ), শ্রেষ্ঠ কবিতা ( ২০২৩ ), হিন্দুবাদী কবিতা অথবা একবিংশ শতকের প্রার্থনা ( ২০২৩ )।
গদ্য ও গবেষণা : মাইকেল পরিচিতি (১৯৯৫, চতুর্থ সংস্করণ ২০১৬), কবিতার ছন্দ (২০০২, পঞ্চম মুদ্রণ ২০১০), আমাদের শিল্পী এস এম সুলতান (২০০২), সাধিতে মনের সাধ (২০০৫), আমাদের বাউল কবি লালন শাহ (২০০৯), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২০১০, এগারোতম মুদ্রণ ২০২১, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০২২), এস এম সুলতান (২০১১), মধুসূদন : বিচিত্র অনুষঙ্গ ( ২০১৩, তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৭)।
অনুবাদ : মধুসূদনের চিঠি (২০০৭, অষ্টম মুদ্রণ ২০২০)।
সম্পাদনা : সাগরদাঁড়ী ও মধুসূদন (১৯৮৩), মুখোমুখি সুলতান (২০০৫, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৯) ফুটি যেন স্মৃতিজলে ( মধুমেলা স্মারক গ্রন্থ ২০০৬ ), মধুসূদন : কবি ও কবিতা ( ২০০৯,অষ্টম মুদ্রণ ২০২০), মধুসূদন : নিবেদিত পঙক্তিমালা (২০১৫), আরো এক বিপন্ন বিস্ময় ( করোনাকালের কবিতা ২০২১ ), বাঙালির বিস্ময় : মেঘনাদবধ কাব্য ( ২০২২ )
সম্পাদনা করেছেন দুই ডজনের বেশি মধুসূদন বিষয়ক সাময়িকী ও স্মরণিকা। মধুসূদন স্মরণ বার্ষিকী ‘মধুকর’ সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। ছোটকাগজ ‘অববাহিকা’ ও ‘ভাঁটফুল’ এর সম্পাদক।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিষয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনায় কৃতিত্বের জন্য তৎকালীন অর্থমূল্যে বাংলাদেশের শীর্ষ পুরস্কার ‘আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার’ (২০১৩) ও ‘মহাকবি মধুসূদন পদক’(২০১৪) অর্জন করেছেন। গান রচনায় সাফল্যের জন্য পেয়েছেন ‘মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান পদক’ (২০০৮)।
এছাড়াও সার্বিক সাহিত্যে অবদানের জন্য প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সুকান্ত পদক (১৯৮৯), মনোজ বসু স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭), বিবেকানন্দ পদক (২০০৩), কণ্ঠশীলন সম্মাননা পদক (২০০৫), মাইকেল মধুসূদন সাহিত্য পদক (২০০৯), স্বরগম সংগীত একাডেমী গুণীজন সম্মাননা(২০১২), জীবনানন্দ স্মৃতি সম্মাননা (২০১২), ফেডারেশন হল সোসাইটি সম্মাননা, ভারত (২০১৩), বিপ্রতীপ ছোটকাগজ সম্বর্ধনা (২০১৪), কপোতাক্ষ সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা পদক (২০১৬), কাদামাটি সাহিত্য পদক (২০১৮), অমিয় চক্রবর্তী পুরস্কার (২০১৮, ভারত ), নজরুল স্মারক সম্মাননা, ভারত (২০২২ ), আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র স্মৃতি পদক (২০২২) ।
কবি খসরু পারভেজকে পড়ি।।
কবি খসরু পারভেজকে অনেকদিন আগে থেকেই পড়ছি, অন্তত যতদূর মনে পড়ছে নব্বইয়ের শুরুর দিক থেকে পড়ছি। তার কবিতায় কাব্যের বিষয় হতে পারে এমন নানা অনুষঙ্গের ব্যবহার আমাকে তার লেখা পড়তে উদ্বুদ্ধ করতো। আমার এই কথার মধ্যে তার লেখার ব্যাপারে সমালোচনার ইঙ্গিত আছে, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সমালোচনা নয়।
দুর্বলতা কোন লেখার অলংকারেরই অংশ। খাদ মিশ্রিত না হলে সোনা মানুষের ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে না। গহনায় মিশ্রণটা শিল্পের জন্য জরুরী। কিন্তু সাহিত্যের শিল্পে খাদ কে কঠিন চোখে দেখা হয়। সেটি আজকের এই পরিসরে আলোচনার বিষয় নয়। সবল হয়ে ওঠা বিষয়গুলো দুইভাবে তুলনা করি, এর একটি হল লেখকের নিজের অন্য লেখার সাথে এবং তার প্রতীয়মান শক্তিমত্তার সাথে সুবিচার করতে পেরেছেন কিনা। আর দ্বিতীয় টি হল তার সময়কার এবং পূর্বেকার লেখকদের সাথে (প্রতিযোগিতায়) কতটুকু পা চালাতে পারছেন এবং এই পদচারণা ভবিষ্যতে সাহিত্যের মর্যাদায় কোন ধরনের স্থান তৈরি করবে এবং সাকুল্যে তার লেখনী কতটুকু পাঠের উপযোগিতা তৈরি করবে।
কবিতায় সাহিত্যের যেসব পরিচিত অবকাঠামো রয়েছে সেগুলো পাঠক হিসেবে আমরা কমই খুঁজি। সমালোচনা যারা করেন তারা তা করেন কারণ ওটা তাদের কাজের অংশ। নানাবিধ আঙ্গিকে কোন একটি লেখাকে দেখা এবং দেখানো তাদের পারদর্শিতার প্রমাণ রাখে।
বহু বিচার বিবেচনা, তুলনা প্রতি-তুলনা কোন একটা লেখাকে মানদন্ড প্রদান করে। পাঠক হিসেবে সেই মানদন্ড অধ্যয়নের পর আমরা কবিতা পড়তে বসি না। কবিতা পড়ি নিতান্ত ভালোলাগা থেকে। একথা গল্প ছড়া এমনকি উপন্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে মনে হয়।
অনেক লেখক আছেন যাদের কাছে আমরা বারবার ফিরে যাই, কিন্তু তাদের সব লেখার কাছে ফিরে যাই না। কোন কোন লেখার কাছে ফিরে যাই। তা কিন্তু সাহিত্যের একাডেমিক বিচারে উত্তীর্ণ বলে এসব লেখার কাছে যাই না, যাই এর মধ্যে প্রকটিত শক্তিমত্তার জন্য। প্রকৃত ব্যাপারটি কখনো কখনো শুধু পাঠকের ভালোলাগার উপরও নির্ভর করে। সাহিত্য কর্মকে দেখবার এটিও একটি বিচার।
উপরোক্ত বিবেচনা গুলো তার লেখাকে পড়বার কারণ হিসেবে বলিনি। আমি মূলত তার লেখা পড়া আমার জন্য কর্তব্য মনে করি, কারণ তিনি আমার সময়কার একজন উল্লেখযোগ্য লেখক। যদিও এই একই বিচারে আমি আরও অনেক লেখকের লেখাই পড়ি, কিন্তু যেহেতু তাকে অনেকদিন ধরেই পড়ছি, ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও মনে হয়েছে অনেক পরিচিত।
আর যেহেতু কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে এমন প্রচুর প্রনোদনা তার লেখায় পাই, সেহেতু তার লেখা আমাকে অতুষ্ট করে না। এ বিষয়টা তাকে অনেক লেখক থেকেই আলাদা করে রাখে। খসরু পারভেজ লেখা অব্যাহত রেখেছেন, তুলনামূলক ভাবে অন্য অনেকের চাইতে বেশি লিখছেন, এটি একটি সুখের বিষয়, লেখক হিসেবে একটি অঙ্গীকারেরও বিষয় তিনি বহন করছেন। কবিকে অনেক শুভেচ্ছা।