খসরু পারভেজ
অবিভক্ত বাংলার যশোরের সাগরদাঁড়ী গ্রাম। এই গ্রামের পাশ দিয়ে সুন্দরবনের দিকে খরস্রোতে ছুটে চলেছে কপোতাক্ষ নদ। প্রবহমান এই নদের অনতিদূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল অট্টালিকা। এখানে প্রতিপত্তিশালী দত্ত পরিবারের বসবাস। এই দত্ত বংশে জাহ্নবী দেবীর কোল আলো করে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পৃথিবীতে আবির্ভূত হন বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
পুত্রের জন্ম হওয়ায় জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত প্রজাদের একবছরের খাজনা মওকুফ করে দেন।
মধুসূদনের জন্মের সময়ের এই ঘটনা আজও সাগরদাঁড়ী এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
২.
মধুসূদন দত্তের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বালি গ্রামে। প্রথম পুরুষ শ্রী রামরাম দত্ত। তিনি হাওড়া থেকে পূর্ববঙ্গে এসে বসতি স্থাপন করেন তৎকালীন চব্বিশ পরগনার (বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার, তালা থানার) গোপালপুর গ্রামে। রামরাম দত্তের পুত্র রামকিশোর দত্ত। রামকিশোরের তিন পুত্র- রামনিধি দত্ত, দয়ারাম দত্ত এবং মানিকরাম দত্ত। রামকিশোরের মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রামনিধি দত্ত অন্য ভাইদের নিয়ে গোপালপুর ছেড়ে সাগরদাঁড়ী এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সাগরদাঁড়ী ছিল তাঁদের মাতুলালয়। সম্ভবত দারিদ্র্য এবং অভিভাবকের অভাবই তাঁকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিল।
সাগরদাঁড়ী এসে খুব সচ্ছলতার ভেতর দিয়ে রামনিধি তাঁর জীবন অতিবাহিত করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর পেশাগত পরিচয় আমাদের অজানা। ধারণা করা যায়, সাগরদাঁড়ী এসে তিনি মাতৃকুলের জমিজামা দেখাশুনা করতেন। আর সেই সামান্য জমিজমার আয় থেকেই সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। রামনিধির চার সন্তান রাধামোহন দত্ত, মদনমোহন দত্ত, দেবীপ্রসাদ দত্ত এবং রাজনারায়ণ দত্ত। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রাজনারায়ণ দত্ত মধুসূদনের গর্বিত পিতা।
অসচ্ছল হয়েও রামনিধি তাঁর সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম পুত্র রাধামোহন সেই সময়ের রাজভাষা ফারসি শিক্ষায় সুশিক্ষিত ছিলেন।১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে বিত্তবান বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীদের পক্ষে জমিদারি ক্রয় করা সম্ভব হয়। বিদ্যা ও প্রচেষ্টাকে পুঁজি করে উপার্জিত অর্থে রাজনারায়ণ এবং তাঁর ভাইয়েরা সাগরদাঁড়ী ও অন্যান্য এলাকায় জমিদারি ক্রয় করে নিজেদেরকে মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সাগরদাঁড়ীতে তাঁরা নির্মাণ করেন বিশাল অট্টালিকা, দেবমন্দির, পূজামণ্ডপ। তাঁদের বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতা সম্পর্কে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। জানা যায়, মধুসূদন দত্তের বড়ো জ্যেঠা রাধামোহন দত্ত তাঁর পুত্রের মঙ্গল কামনায় একবার ১০৮টি কালীপূজা করিয়েছিলেন। এই পূজার জন্য প্রয়োজনীয় পূজক-ব্রাহ্মণ,উপাচার, ঢাক-ঢোল প্রভৃতি ছিল প্রচুর। তারপরও ১০৮টি মহিষ, ১০৮ টি ছাগল, ১০৮টি ভেড়া বলির ব্যবস্থা ছিল। সঙ্গে ছিল ১০৮টি সোনার জবা ফুলের অঞ্জলি। অর্থ ও প্রাচুর্যে ভরা এই দত্ত পরিবারেই জন্ম হয়েছিল মধুসূদন দত্তের। ১
৩.
দত্তবাড়ির খুব কাছেই কপোতাক্ষ নদ। এ নদের তীরে পরিবারের অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সাথে খেলা-ধূলা,হৈচৈ করে কেটেছে তাঁর শৈশব। সাগরদাঁড়ীর স্নেহমাখা সবুজ প্রকৃতি, নদীর কুলকুল ধ্বনি, মাঝিদের গান, নদীবেষ্টিত বিভিন্ন শ্রেণির লোকজনের একান্ত সাহচর্যে গড়ে উঠেছিল মধুসূদনের প্রথম জীবন। পরবর্তীকালে তাঁর জীবন ও সাহিত্যে সেই নিবিড় সাহচর্যের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। সারাটা জীবন যশ ও খ্যাতির পেছনে ছুটে বেড়িয়েছেন কিন্তু কখনও ভোলেননি সাগারদাঁড়ী আর কপোতাক্ষ নদের কথা।
পরিবারেই মধুসূদনের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। তখনকার দিনে গ্রাম-গঞ্জে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন পাঠশালা, টোল, মক্তব-মাদ্রাসা ও গুরুগৃহ বা গৃহকুল। বাংলায় পাঠশালার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছিল মধ্যযুগে। যার সূচনা হয় সুলতানী আমলে। লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর শাসনামলে ব্যাপটিস্ট মিশনের পাদ্রী অ্যাডাম কতৃর্ক পরিচালিত এদেশের বেসরকারি শিক্ষা সম্পর্কে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলা ও বিহারের দেড় লক্ষ গ্রামের বেশিরভাগেই একটি করে পাঠশালা ছিল। সেখানে ধনী-গরীব, হিন্দু-মুসলমান সকল শ্রেণীর শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পেত। শিক্ষক থাকত মাত্র একজন। ২
দত্তবাড়ির আঙিনাতেই দত্তদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে পাঠশালা। মধুসূদনকে সেখানে ভর্তি করা হয়। এই বিদ্যালয় বা গুরুগৃহের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন সাগরদাঁড়ীর হরলাল রায়। তিনিও কবিতা রচনা করতেন। মধুসূদনের প্রতিভা,ভদ্রতা ও বুদ্ধিপ্রখরতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি লিখেছিলেন–
” নামে মধু, হৃদে মধু, বাক্যে মধু যার;
এহেন মধুরে ভুলে- সাধ্য আছে কার!”
হরলাল রায়ের কাছে মধুসূদন বাংলা, সংস্কৃত ও অংকের পাঠ গ্রহণ করেন।
লেখাপড়ার প্রতি বরাবরই শিশু মধুসূদন উৎসাহী ছিলেন। জানা যায়, পাঠশালায় সকলের ছুটি হলে অন্যদের মত মধুসূদন খাবার জন্য গৃহে আসতেন। তাঁর স্নেহময়ী মা বিভিন্ন উপাদেয় খাদ্য নিয়ে পুত্রের জন্য বসে থাকতেন। পুত্রকে সামনে বসিয়ে না খাওয়ালে তাঁর তৃপ্তি হত না। কিন্তু খাবার পরিবেশনে যদি কখনও দেরি হত, মধুসূদন অস্থির হয়ে উঠতেন। কখনও সবার আগে ক্লাসে পৌঁছনোর জন্য অল্প খাবার খেয়ে অথবা অর্ধসিদ্ধ খাবার খেয়ে উঠে যেতেন। ক্লাসে সবার চেয়ে কিভাবে শ্রেষ্ঠ হওয়া যায়, এ চেষ্টা তাঁর ছোটোবেলা থেকেই ছিল। “কি গ্রামস্থ গুরুমহাশয়ের পাঠশালায়, কি হিন্দুকলেজে, সহাধ্যায়িগণের মধ্যে কেহ তাঁহাকে লেখা-পড়ায় অতিক্রম করিবে, ইহা তিনি কিছুতেই সহ্য করিতে পারিতেন না। যেরূপ আদরে ও গৌরবে তাঁহার শৈশব অতিবাহিত হইয়াছিল, রাজপুত্রগণেরও, বোধ হয়, সেরূপ হয় না। তাঁহার বাল্যের ভোগ-বিলাসের কথা অবগত হইলে, তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবনের অমিতব্যয়িতার ও উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য তাঁহাকে দোষ দিতে প্রবৃত্তি হয় না। তিনি স্নানার্থে গমন করিলে, কি জানি যদি তাঁহার ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব হয়, এই আশঙ্কায়, একবারে ৫|৭ চুল্লীতে অন্ন প্রস্তুত হইতে থাকিত। প্রত্যাগমন করিয়া যে চুল্লীর অন্ন সর্বাপেক্ষা সুসিদ্ধ হইত; তিনি তাহা আহার করিতেন।”৩
এসব তথ্য অনেকটা গল্প-কাহিনির মত। মধুসূদনের প্রথম জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু অবশ্য এটিকে গল্পই বলেছেন।
তখন সরকারি ভাষা ফারসি থাকার জন্য সবাইকে ফারসি শিখতে হত। মধুসূদনকে ফারসি শিক্ষার জন্য পাঠানো হয় সাগরদাঁড়ী ( বর্তমানে শেখপুরা) গ্রামে বসবাসরত কলকাতা মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মৌলভি খন্দকার মখমল আহমেদের কাছে। এই শিক্ষকের কাছে ফারসি শিখতে আসতেন কপোতাক্ষ তীরের আরেক কৃতিসন্তান বিঞ্জানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পিতা হরিশচন্দ্র রায়। কেউ কেউ বলেন মধুসূদনের বাল্য শিক্ষকের নাম মুফতি লুৎফুল হক।
মৌলভি শিক্ষকের কাছে ফারসি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি মধুসূদন ফারসি সাহিত্য সম্পর্কে পাঠ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে মধুসূদন অনেক ফারসি কবিতা বা গজল মুখস্থ বলতে পারতেন এবং আবৃত্তি করতেন। মধুসূদন কতখানি ফারসি শিখেছিলেন, তা নিয়ে গবেষকের সন্দেহ আছে। গোলাম মুরশিদ বলেছেন,” ফারসী তিনি খুব বেশি শিখেছিলেন বলে মনে হয় না।”৪ গবেষকের এই ধারণা সঠিক নয়।
ফারসি ভালো জানা না থাকলে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রজীবনে তিনি শেখ সাদীর ওড ( ODE ) ইংরেজি ভাষায় কীভাবে অনুবাদ করেছিলেন! From the Persian of Sadi থেকে অনূদিত ode টি ছিল এরকম:
Oh! Come, gaze on that eye whose beam
It softer then ray, so bright,
That Iulls to Love’s ethereal dream
The maiden in her dewy bow’r,
At midnight’s soft and starry hour,
Shed by the moon,the pensive Queen of Night!… ৫
আর ফারসি ভালো জানতেন বলেই তাঁর কাব্য, নাটক-প্রহসনে তিনি ফারসি শব্দ অনায়াসে ব্যবহার করতে পেরেছেন।
সাগরদাঁড়ীতে মা জাহ্নবী দেবীর কাছ থেকে মধুসূদন রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি শুনেছেন। পরিচিত হয়েছেন–রাম,সীতা, লক্ষ্মণ, রাবণ, মেঘনাদ, প্রমীলা, মন্দোদরী, চিত্রঙ্গদা, সরমা, বিভীষণের মতো চরিত্রসমূহের সঙ্গে। সাগরদাঁড়ীর দত্ত বাড়ীতে বসেই তাঁর সখ্য হয়েছে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদা মঙ্গল’ ও ‘রসমঞ্জরী’ ;মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমণ্ডল’ ; জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’সহ বিখ্যাত সব কাব্যের সাথে। ৬
৪.
সাগরদাঁড়ীর জমিদার ও আইনজীবী রাজনারায়ণ দত্ত অন্য ভাইদের হাতে জমিদারির ভার ন্যস্ত করে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার খিদিরপুরে একটি বাড়ি ক্রয় করে বসবাস করতে শুরু করেন। এখানে এসে তিনি কলকাতার দেওয়ানি আদালতে ওকালতি করতে থাকেন। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্ত্রী ও পুত্রকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। মধুসূদনের বয়স তখন আট বছর। মধুসূদন কত বছর বয়সে কলকাতায় এসেছিলেন, এ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। মধুজীবনীর প্রথম লেখক যোগীন্দ্রনাথ বসুর বর্ণনা থেকে জানা যায়, “মধুসূদনের ১২/১৩ বৎসর বয়সের সময়ে তাঁহার পিতা তাঁহাকে, শিক্ষাদানের জন্য, কলিকাতায় আনিতে সংকল্প করিলেন।”৭
দ্বিতীয় জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ সোম এই মতামতকে সমর্থন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ ; এ গ্রন্থেও পূর্বোক্ত অভিমত গৃহীত হয়েছে। গবেষক সুরেশচন্দ্র মৈত্র বলেছেন, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের কথা। মধুর বয়স তখন আট বছর। গোলাম মুরশিদ জানিয়েছেন, জাহ্নবী দেবী তাঁর পুত্রকে নিয়ে ১৮৩৩-৩৪ সালের আগে কলকাতায় আসেননি।
”মধুসূদনের দুই ভাই মারা যাবার পর জাহ্নবী দেবীকে নিজের কাছে কলকাতায় আনতে বেশি দেরি করেননি রাজনারায়ণ দত্ত। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মারা যান মহেন্দ্রনারায়ণ দত্ত। কেউ কেউ বলেছেন ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ। যা হোক, আমার বিশ্বাস মহেন্দ্রর মৃত্যুর বছর খানেকের মধ্যে বা তার বেশি সময় না দিয়েই, রাজনারায়ণ দত্ত পুত্র মধুসূদনকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। কলকাতায় এনেই মধুকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করানো হয়, এটা সঠিক নয়। হিন্দু কলেজে ভর্তির আগে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রস্তুতিপর্বে চার-পাঁচ বছর সময় লাগাটা স্বাভাবিক। হিন্দু কলেজে ভর্তির বয়সের সীমা ছিল আট থেকে বারো বছর। মধুসূদন গ্রামের ছেলে, গ্রাম থেকে এসেই হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়া সহজ ছিল না। বয়সের ক্ষেত্রে উপযুক্ত হলেও দক্ষতা ও যোগ্যতা তৈরি করতে নিশ্চয় তাঁর সময় লেগেছে। যোগ্যতা তৈরি করতে তাঁকে ভর্তি হতে হয়েছে ভালো কোনো ইংরেজি স্কুলে। সেখানে চারটি বছর অন্তত শিক্ষা লাভ না করলে তিনি হিন্দু কলেজে নবম শ্রেণীতে ( উপর থেকে গুনলে ) অর্থাৎ এখনকার নিয়মানুসারে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারতেন না। তাই ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদনের কলকাতা আসাটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
পরপর দুটো সন্তান মৃত্যুবরণ করায়, সম্ভবত রাজনারায়ণ দত্ত একমাত্র সন্তান ক্ষীণকায় মধুসূদনের স্বাস্থের কথা ভেবে, উন্নত শিক্ষার কথা ভেবে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। কলকাতার খিদিরপুরের বাড়িতেই অতিবাহিত হয় মধুসূদনের জীবনের বিলাসবহুল শৈশবের দ্বিতীয় অধ্যায়।”৮
তখনকার দিনে যৌথ পরিবার ভেঙে ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন স্থানে বসবাসের দৃষ্টান্ত ছিল বিরল। রাজনারায়ণ দত্ত প্রথা ভেঙেছিলেন।
হিন্দু কলেজে পড়ার সময় মধুসূদন খ্রিস্টান হয়েছেন। পরে ভর্তি হয়েছেন বিশপস কলেজে। ছাত্রাবস্থায় কবিতা লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়। সেসব কবিতায় কোনো না ভাবে ফিরে এসেছে তাঁর সাগরদাঁড়ী।
১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজ গমন করেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেছেন। ‘Timothy Pen Poem’ ছদ্মনামে কবিতা লিখেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। সাংবাদিকতা করতে এসে লিখেছেন প্রচুর সম্পাদকীয় – উপসম্পাদকীয়। সেখানেও স্বদেশ-সাগরদাঁড়ী মূর্ত হয়ে উঠেছে।
মাদ্রাজ জীবনে মধুসূদন ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কাব্য ‘The Captive Ladie’ রচনা করেন। এ কাব্যেও সাগারদাঁড়ীর প্রকৃতি উদ্ভাসিত। ক্যাপটিভ লেডি কাব্যের সঙ্গে একই মলাটে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘Vusions Of The Past’ ; এই কাব্যে বর্ণিত শৈশবস্মৃতি তো সাগরদাঁড়ীরই। এখানে বর্ণিত কবির প্রিয় পাখি ফিঙা, কৃষ্ণকায় চঞ্চলা পাখিটিও সাগরদাঁড়ীর। তিনি লিখেছেন:
” As when, Bengala! on the sultry pkans
Beneath the Pillar’d and high arched shade
of sone proud Banyan-slumberoud haunt and cool-
Echo in mimic accents, ‘mong the flocks,
Couch’d there in noon-tide rest and soft repose,
Repeats the deafening and deep-thunder’d roar
oh him, the royal wanderer of thy woods!”
এখানে প্রকৃতির বর্ণনাসহ যে বড় বটগাছের কথা কবি বলেছেন, সেটা তো সেই কপোতাক্ষ তীরের বুড় বটগাছ। যেটা নিয়ে পরবর্তীকালে চতুর্দ্দশপদী কবিতা লিখেছেন তিনি। ৯
দ্বিতীয় কাব্য অসমাপ্ত ‘The Upsorie’ তেও আছে তমাল তরু, মলয় বাতাস, তুলসী গাছ। এখানেও সাগরদাঁড়ী।
মাদ্রাজের ‘Eurasian’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয় দিল্লীর সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়ার জীবন ও বীরত্বগাথা সম্বলিত ‘Rizia : The Empress of Indi’ নাটক। এখানে রিজিয়ার সখী লীলা গান গেয়ে শুনিয়েছে। পরিচয় দিয়েছে,–‘আমি এসেছি সেই দেশ থেকে, যে দেশ চির শ্যামল পত্রগুচ্ছে আচ্ছাদিত। আর যার নদী স্বচ্ছ সলীলা।’ এখানেও তিনি যেন বলেছেন সাগরদাঁড়ীর কথা,কপোতাক্ষের কথা।
বিলেত যাবার আগে রচনা করেছেন বাংলা ভাষায় প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। পৌরাণিক কাহিনি সম্বলিত এ কাব্যে স্বর্গের উদ্যানে মধুসূদন স্থাপন করেছেন সাগরদাঁড়ীর প্রকৃতিকে। তিনি লিখেছেনঃ
“…শল্মলী ; শাল ; তাল, অভ্রভেদী
চূড়াধর ; নারিকেল, যার স্তনচয়
মাতৃদুগ্ধসম রসে তোষে তৃষাতুরে!
গুবাক; চালিতা ; জাম, সুভ্রমররূপী
যার ফল ; ঊর্ধ্বশির তেঁতুল ; কাঁঠাল,
যার ফলে স্বর্ণকণা শোভে শত শত
ধনদের গৃহে যেন! বংশ, শতচূড়,
যাহার দুহিতা বংশী, অধর-পরশে,
গায় রে ললিত গীত সুমধুর স্বরে! ” ১০
‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ এর এই বৃক্ষরাজি তো কবির চিরচেনা সাগরদাঁড়ী!
‘ডাকিলা ফিঙ্গা; আর পাখি যত
পুরিল নিকুঞ্জ পুঞ্জ প্রভাতী সঙ্গীতে’
এই শ্যামল সবুজে স্নিগ্ধ নিকুঞ্জ, ফিঙ্গা পাখির ডাক- তো সাগরদাঁড়ীরই। কপোতাক্ষ নদের তীরে ছায়াঘেরা সুস্নিগ্ধ গ্রাম সাগরদাঁড়ী। এই গ্রাম অনবরত উঁকি দেয় ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ এর বিভিন্ন অধ্যায়ে। এখানকার শ্যামা,শালিক,ফিঙ্গে, দোয়েল, কাক, কোকিল, কপোত-কপোতী, চক্রবাক, বউ কথা কও সহ অসংখ্য পাখিদের ভিড় মধুসূদনের কাব্যে। সাগরদাঁড়ীর ফুল কেতকী, কদম,কমল,কামিনী, মাধবী, বকুল, গন্ধরাজ, জবা,অশোকা,শ্বেত কণিকা,ধুতুরা, পলাশ এ কাব্যে গন্ধ ও রঙ ছড়িয়ে মুখরিত করেছে। সেখানে রয়েছে শিমুল, শাল, সুপারি, তেঁতুল, তমাল, কাঁঠাল, কুল,নারিকেল, চালিতা, জাম, খেজুর, বাঁশ, অমলকী, গাম্ভিরা, দেবদারু প্রভৃতি গাছের অপরূপ শোভা। মধুসূদন সাগরদাঁড়ীর সন্তান বলেই তো প্রকৃতির এমন বিচিত্ররূপ আঁকতে পেরেছেন। বাংলার রূপ- প্রকৃতিকে স্বর্গের উদ্যানে উপস্থাপনের এমন দৃষ্টান্ত বাংলাকাব্যে একমাত্র ও অদ্বিতীয়। ১১
অন্যান্য কাব্য, নাটকেও কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছে সাগরদাঁড়ী। মধুসূদনের বিখ্যাত প্রহসন ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ তাঁর সাগরদাঁড়ী অঞ্চলের এক অর্থ ও নারী লোলুপ জমিদারের কাহিনি। প্রহসনের ভক্তপ্রসাদ, হানিফ গাজি, ফতেমা, পুটি, পঞ্চানন বাচস্পতি, গদা, আনন্দ, পঞ্চি সবাই এই সাগরদাঁড়ীর। বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের পথিকৃৎ মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের সংলাপ এরকম :
“হানিফ: ( হাস্যমুখে ) কত্তাবাবু, আমি ঘরে আস্যে ফতিরি তল্লাস্ কল্লাম, তা সকলে কলে যে সে এই ভাঙ্গা মন্দিরির দিকে পুঁটির সাতে আয়েছে, তাই তারে ঢুঁড়তি ঢুঁড়তি আস্যে পড়িছি। আপনার যে মোছলমান হতি সাধ গেছে, তা জানতি পাল্লি, ভাবনা কি ছিল? ফতি তো ফতি,ওর চায়েও সোনার চাঁদ আপনারে আন্যে দিতি পাত্তাম, তা এর জন্যি আপনি এত তজদি নেলেন কেন? তোবা! তোবা!”
অথবা
” ফতে : ( সচকিতে ) ও পুঁটি দিদি, ঐ দেখ্ দেখি কে দুজন আসচে, আমি ভাই ঐ মসজিদের মদ্দি নুকোই।”১২
প্রহসনের এই যে সংলাপ, তা একেবারে যশোরের সাগরদাঁড়ীর প্রান্তিক মানুষের।
১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় মধুসূদনের কালজয়ী সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এখানেও তাঁর জন্মভূমি, মায়ের মুখ উদ্ভাসিত। পুরাণাশ্রিত হলেও মায়ের প্রতি সন্তানের আত্মনিবেদন :
“হায়, মা, এ হেন পুণ্য আছে কি এ দাসে?”
সাগরদাঁড়ীর মাতৃজননী জাহ্নবী দেবী যেন বারবার ফিরে আসেন কাব্যে। বীরবাহুর মৃত্যুতে রাজমহিষী চিত্রাঙ্গদা রাজসভায় এসে ক্রন্দন করছেন। রাবণকে উদ্দেশ্য করে বলছেন :
“একটি রতন মোরে দিয়াছিল বিধি
কৃপাময়; দীন আমি থুয়েছিনু তারে
রক্ষাহেতু তব কাছে, রক্ষঃকুল-মণি,
তরুর কোঠরে রাখে শাবাকে যেমতি
পাখী। কহ,কোথা তুমি রেখেছো তাহারে,
লঙ্কানাথ? কোথা মম অমূল্য রতন। ১৩
বিরহিনী পক্ষীমাতা তার পক্ষী শাবককে হারিয়ে যেমন ক্রন্দন করে, ধর্মত্যাগী পুত্রকে হারিয়ে তেমনি কেঁদেছিলেন জাহ্নবী দেবী।
১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টিারি শিক্ষার জন্য মধুসূদন বিলেত গমন করেন। লণ্ডন থেকে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাককে একটি চিঠিতে মধুসূদন লিখেছেন: ” তোমার চিঠির উপরে তুমি যে ‘বাগেরহাট’ লিখেছ! একি আমার দেশের প্রিয় সুন্দর নদ কপোতাক্ষের তীরবর্তী সেই বাগেরহাট? তুমি তো জান,আমি সাগরদাঁড়ীতে জন্মেছি। এই বাগেরহাট থেকে তার দূরত্ব দুমাইলও হবে না।” ১৪
কপোতাক্ষ তীরে বাগেরহাট নয়, আছে বগার হাট। সাগরদাঁড়ীর অনতিদূরেই বগা গ্রাম। আর এই গ্রামের হাটের নাম ছিল বগার হাট; পরবর্তীকালে যা শুড়িঘাটা নামে পরিচিত। মধুসূদন হয়ত এই বগার হাটের কথা ভেবেছিলেন। গৌরদাস বসাক তখন খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার ( বর্তমানে জেলা ) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।
ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে স্ত্রী, কন্যা, পুত্রসহ অভাব অনটনের মধ্যেও তিনি একের পর এক রচনা করেছেন সনেট বা চতুর্দ্দশপদী কবিতা। সাগরদাঁড়ীর বুকে চিরে বয়ে চলা কবির শৈশবের খেলার সাথী এই কপোতাক্ষ নদ। প্রবাসে কবির স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে তার মুখ। তিনি লিখেছেন:
” সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত ( যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি ) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!-
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে!
আর কি হে হবে দেখা? — যতদিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি ; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ-জনের কানে,সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে! “
( কপোতাক্ষ নদ ).১৫
জন্মভূমির নদের প্রতি এই গভীর প্রেম দুর্লভ। বাংলা সাহিত্যে প্রথম নদী বা নদ বিষয়ক প্রথম কবিতা ‘কপোতাক্ষ নদ’।
মধুসূদনের ‘চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি’র অনেক কবিতায় তাঁর জন্মভূমি সাগরদাঁড়ী মূর্ত হয়ে উঠেছে।
তাঁর ‘কমলে কামিনী’ ; ‘বউ কথা কও’ ; ‘পরিচয়’ ; ‘সরস্বতী’ ; ‘যশের মন্দির’; ‘শ্মশান’; ‘দেব-দোল’ ; ‘শ্রীপঞ্চমী’ ; ‘আশ্বীন মাস’ ; ‘সায়ংকালের তারা’ ; ‘নিশাকালে নদী-তীরে বট-বৃক্ষ তলে শিব-মন্দির, ; ‘কুসুমে কীট’ ; ‘বটবৃক্ষ’ ; ‘নন্দন-কানন’ ; ‘বসন্তে একটি পাখীর প্রতি’ ; ‘নদী তীরে দ্বাদশ শিব-মন্দির’ ; ‘বিজয়া দশমী’ ; ‘কোজাগর লক্ষ্মীপূজা’ ; ‘উদ্যানে পুষ্করিণী’ ; ‘নূতন বছর’ ; ‘কেউটিয়া সাপ’ ; ‘শ্যামাপক্ষী’ ; ‘সমাপ্তে’ প্রভৃতি কবিতায় কোনো না কোনো ভাবে জন্মভূমি-সাগরদাঁড়ী প্রীতির পরিচয় ফুটে উঠেছে। জ্যোতির্ময় হয়েছে বঙ্গ।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন মামলা পরিচালনার কাজে ঢাকা আসেন। এখানে এলে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ঢাকার পোগোজ হাইস্কুলে কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সংবর্ধনার উত্তরে তিনি একটি সনেট রচনা করেন। ‘ঢাকাবাসীদের অভিনন্দনের উত্তরে’ শিরোনামের এই কবিতায় মধুসূদন ঢাকাকে ‘বঙ্গ-অলঙ্কার’ বলেছেন। তিনি লিখেছেন :
” নাহি পাই নাম তব বেদে কি পুরাণে
কিন্তু বঙ্গ-অলঙ্কার তুমি যে তা জানি
পূর্ব্ব-বঙ্গে। শোভ তুমি এ সুন্দর স্থানে
ফুলবৃন্তে ফুল যথা, রাজাসনে রাণী।” ১৬
এই প্রথম ঢাকাকে কোনো কবির পক্ষ থেকে এই উপাধিতে ভূষিত করা।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ফেব্রুয়ারি ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় মধুসূদনের সংবর্ধনার খবর প্রকাশিত হয়।
সেখানে বলা হয়, “শ্রীযুক্ত মাইকেল মধুষূদন ঢাকায় গেলে সেখানকার কয়েকজন যুবক তাঁহাকে একখানি আড্রেস দেন। তখন একজন বক্তৃতাকালীন বলেন যে, ‘ আপনার বিদ্যাবুদ্ধি, ক্ষমতা প্রভৃতি দ্বারা আমরা যেমন মহিগৌরবান্বিত হই, তেমনি ইংরেজ হইয়া গিয়াছেন শুনিয়া আমরা ভারী দুঃখিত হই, কিন্তু আপনার সঙ্গে আলাপ ব্যবহার করিয়া আমাদের সে ভ্রম গেল।’
মাইকেল ইহার উত্তরে বলেন: ‘আমার সম্বন্ধে আপনাদের আর যে কোনো ভ্রমই হউক আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারী অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার ঘরে একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার ইচ্ছা যেমনি বলবৎ হয় অমনি আর্শিতে মুখ দেখি। আরো আমি শুদ্ধ বাঙ্গালী নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটী যশোহর।” ১৭
বাংলার কবি, মধুসূদনের বাইরের আবরণ ছিল সাহেবের, আর ভেতরে ভেতরে তিনি এই মাটির, স্বদেশ-জন্মভূমির ধুলোমাটি মাখা খাঁটি বাঙালি কবি।
নিজেকে বাঙালির চেয়েও যশোরের বাঙ্গাল বলে পরিচয় দিতে তাঁর গর্ব অনেক। তাঁর এই আত্মপরিচয় আমাদের একান্ত বাংলার, যশোহর – সাগরদাঁড়ীর স্মৃতির পটে মমতার অক্ষরে লেখা।
তিনি তাঁর শেষ পরিচয়-শেষ ঠিকানা জানিয়ে গেছেন:
“দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
( জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম ) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী!”
( সমাধি-লিপি ) ১৮
মৃত্যুর আগে লেখা তাঁর সমাধি ফলকে উৎকীর্ণ এই এপিটাফ আমাদের জানিয়ে দেয় তিনি যশোরের সাগরদাঁড়ীর সন্তান। তাঁর ঠিকানা এখানেই।
তিনি সাগরদাঁড়ী ছেড়েছিলেন, কিন্ত সাগরদাঁড়ী তাঁকে ছাড়েনি।
তথ্যসয়াহক :
—–
১. মধুসূদন : বিচিত্র অনুষঙ্গ ; জননীর কোলে শিশু- খসরু পারভেজ। কথা প্রকাশ, ঢাকা। পৃষ্ঠা ২২-২৩
২.বঙ্গদেশে ইংরেজী শিক্ষা : বাঙালির শিক্ষাচিন্তা–সুখময় সেনগুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গ পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা।
৩.মধু-স্মৃতি- নগেন্দ্রনাথ সোম। বিদ্যোদয় লাইব্রেরি, কলিকাতা। পৃষ্ঠা-৪। যোগীন্দ্রনাথ বসুর ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত-এর উল্লেখসহ।
৪.আশার ছলনে ভুলি- গোলাম মুরশিদ। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা। পৃষ্ঠা ২৪
৫. মধুসূদন রচনাবলী- ক্ষেত্র গুপ্ত সম্পাদিত। শিশু সাহিত্য সংসদ লিমিটেড, কলকাতা। পৃষ্ঠা ৪৬৭
৬.মধুসূদন : বিচিত্র অনুষঙ্গ। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৭
৭.মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত- যোগীন্দ্রনাথ বসু। দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা। পৃষ্ঠা ২৪
৮.মধুসূদন : বিচিত্র অনুষঙ্গ- প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা ৩১
৯.প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা ১৪৯
১০.মধুসূদন রচনাবলী- প্রাগুক্ত, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য। পৃষ্ঠা ৬-৭
১১. মধুসূদন : বিচিত্র অনুষঙ্গ। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা ১৫০
১২.প্রাগুক্ত, বুড় সালিকের ঘাড়ো রোঁ। পৃষ্ঠা ২৬৭,২৬৫
১৩. মধুসূদন: বিচিত্র অনুষঙ্গ। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা ১৫২
১৪. মধুসূদনের চিঠি– খসরু পারভেজ অনূদিত। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৫৩
১৫. মধুসূদন রচনাবলী- প্রাগুক্ত। চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি। পৃষ্ঠা ১৬৬
১৬. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা ১৭১
১৭. মাইকেল পরিচিতি- খসরু পারভেজ। মধুসূদন একাডেমী, সাগরদাঁড়ী, যশোর। পৃষ্ঠা ৭৪
১৮.মধুসূদন রচনাবলী। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা ১৯৬
————–
লেখক : কবি ও মধুসূদন গবেষক। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক – মধুসূদন একাডেমী, সাগরদাঁড়ী, যশোর, বাংলাদেশ।
লিখেছেন : খসরু পারভেজ
জনাব, একজন মধুসূদন গবেষক হিসেবে আপনার লেখা অসাধারণ। কখনোই মধুসূদন সম্পর্কে এত সুন্দর করে লেখা পড়িনি, যেখানে আপনি তুলে এনেছেন যশোরের তথা সাগরদাড়ীর নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য। আর যে প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে বর্ণনা করা হয়েছে পাখপাখালী, গাছগাছালী, নদীতীরের সৌন্দর্য আর প্রবাহমান জলধারা।
আপনি অসাধারণ লিখেছেন। অত্যন্ত ধৈর্য ধরে মাইকেল মধুসূদন সম্পর্কে পড়তে গিয়ে সত্যি মুগ্ধ হয়েছি যে কত সুন্দর ভাবে দেশকে ভালোবাসা যায় তা মধুসূদন দেখিয়েছেন।
আর সবথেকে বড় কথা হলো সেই ভালোবাসাটার নব উত্থান ঘটিয়েছেন আপনি আপনার লেখায়। সত্যি অসাধারণ লেখনী।
আপনি আমি সবাই বাঙ্গাল।
সাগরদাঁড়ি কে ভালবাসলে, যশোরকে ভালবাসলে, প্রকৃতিকে ভালবাসলে আর মধুসূদনকে ভালবাসলে আমাদের সবাইকে বাঙ্গাল হতেই হয় এবং একজন বাঙ্গাল হিসেবে আমি আপনি সবাই গর্বিত।
হৃদয়টা স্পর্শ করে যায় যখন মধু বলে,
“আমি শুদ্ধ বাঙালী নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটিঁ যশোহর।”