আহমাদ মাযহার
রাইসুর যখন পঞ্চাশ বছর বয়স হলো তখন অনেকেই তাকে নিয়ে লিখল। আমারও মনে হয়েছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের সময়ের একজন আলোচিত মানুষ হিসাবে আমারও লেখা দরকার তাকে নিয়ে, মানে তাকে প্রয়োজন আমার ঠিক মতো বোঝা! আমি তখন লিখব লিখব করেও লিখে উঠতে পারিনি! না লিখতে পারার কারণ শুধু যে সময়ের সংকট তা নয়, তাকে নিয়ে কী লিখব সে সম্পর্কে বোঝাবুঝির ধাঁধাও অন্যতম কারণ; ওকে নিয়ে যতটুকু বলা সম্ভব তা প্রকাশে আমার সাহস ও যোগ্যতা দুটো নিয়েই আস্থার অভাবও কিছুটা দায়ী। যে কথা আমার উপলব্ধিতে পরিস্কার নেই সে কথা আমি বলতে চাই না! আবার রাইসুর মতো কোনো মানুষের প্রশংসায় বা সমালোচনায় আমি অ্যাক্টিভিজমের অনুকূলে পলিটিক্যাল হতে চাই না। যা বলার তা বলতে চাই আমার নিজের দর্শনগত অবস্থান থেকেই।
ওর পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়টায় আমি সদ্য আমেরিকায় এসেছি। এসেছিলাম কিছুকাল থাকব বলে। এখানে অবস্থানের দীর্ঘতা সূত্রে জীবন যাপনের নতুনত্বে আমার মনোযোগ অন্য দিকে বেশি সরে গিয়েছিল। রাইসু সম্পর্কে লিখলে দায়িত্ব নিয়ে লিখতে হবে ভেবেও সময় নিচ্ছিলাম! লিখতে গিয়ে মনে হলো, লিখবার জন্য ঠিকমতো যেন ওকে বুঝে ওঠা হয়নি আমার! ওর অনেক কথায় আমার যেমন সায় আছে আবার কোনো কোনো কথায় নাইও! কখনো কখনো আমার মনে হয় সে যু্ক্তির আরোহী ও অবরোহী দুই পদ্ধতিই প্রয়োগে এমন একভাবে সিদ্ধান্ত টানে যে ওইখানে দাঁত বসানো সহজ হয় না! কিন্তু ওর বক্তব্য একেবারে যাকে বলে মর্মমূলে আঘাত করে। অনেক সময় সহ্য করাও কঠিন হয়ে পড়ে সেই আঘাত। পাল্টা যুক্তি দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় আঘাত পেয়েও চুপ করে থাকে অনেকে, টু শব্দটি করে না! এমনকি অনেকে বুঝতেও দেয় না যে আঘাত পেয়েছে! যাদের যুক্তির অস্ত্র দুর্বল তারা জানে যে রাইসুর সঙ্গে পেরে উঠবে না, তারা তাকে প্রকাশ্যে বা আড়ালে গালাগালি করতে থাকে! আমি যুক্তিতে হেরে গেলেও কাউকে গালাগালি করতে চাই না, চাই না আমার কথায় কেউ অপ্রস্তুত হোক!
রাইসু মাঝে মাঝে এমন ভাবে তার সিদ্ধান্ত জানায় যে তাতে অনেকে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে! ওর সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিকে মনে হতো মানুষকে অপ্রস্তুত করাতেই বুঝি ওর আনন্দ! আর ওর এই কাজটা ছিল আমার ঘোরতর অপছন্দ।
সাজ্জাদ (শরিফ) ওকে খুব পছন্দ করত তখনই। প্রথম দিকে রাইসুকে ওর সঙ্গেই ঘোরাফেরা করতে দেখতাম। রাইসুর প্রাথমিক বিচরণ কালের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হতে পেরেছিল প্রধানত সাজ্জাদের প্রশ্রয়েই। কখনো কখনো রাইসুর কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে সাজ্জাদকে বলতাম সে রাইসুকে এত লাই দেয় কেন? সাজ্জাদ কিছু বলত না, তার স্টাইলের এক ধরনের হাসি দিত। মোটকথা রাইসুকে সামাল দিতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে অসুবিধা হতো আমার। এর মূল কারণ বোধ হয় আমার ভদ্র ছেলে মার্কা নিরীহ নির্বিষ স্বভাব আর ওর ক্ষিপ্র প্রত্যুৎপন্নমতি ব্যক্তিত্ব।
ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে থাকতে চেষ্টা করতাম। ফলে আমার ভাবমূর্তি যাকে বলে ‘কাউকে সে কাটে না’, ‘করে নাকো ফোঁসফাঁস’ মার্কা! তার ওপর আমি চলতাম বেশ আদব কায়দা মেনে। প্রতিষ্ঠিত বলে পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের কথা অপছন্দ হলেও বেশি মূল্য দিতাম আদবকে। এখনও যে তার বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। এখন অবশ্য কখনো কখনো আমার কথাবার্তাও বেয়াদবির মতোই হয়ে যেতে চায়। কিন্তু নিজে ছোটখাট বেয়াদবি করলেও বোঝা যাওয়ার মতো বেয়াদবি সাধারণত তা হয়ে ওঠে না! মানে মানুষের সঙ্গে আচরণে আমার ন্যূনতম মাত্রাজ্ঞান আছে মনে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বভাবে আমি বোধ হয় একদিকে হেলে-থাকা মধ্যপন্থী। আর রাইসু যেদিকে ঝোঁকে সেদিকে বেশি করেই ঝোঁকে।
বয়সে আমি রাইসুর চেয়ে কয়েক বছরের বড়! ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় সে প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসা-যাওয়া শুরু করে। তার ভাষ্য মতে বন্যার কারণে শুকনা জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে করতে একদিন সে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছেছিল! কেন্দ্রের কলেজ কর্মসূচিতে নাম লিখিয়েছিল কিনা মনে পড়ছে না! দু একটা কবিতা কি তখন পড়েছিলাম নাকি আরেকটু পরে তাও ঠিক মনে নাই এখন। কিন্তু যখন থেকে ওর লেখা পত্রিকায় বের হতে শুরু করে তখন থেকেই আমার কাছে সেগুলো বেশ অন্য রকম লাগতে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি ওর কবিতা ভালো লাগা উচিত কিনা তা আমার তখনকার কবিতা বোঝার স্কেল দিয়ে ঠিক মাপতে পারতাম না।
১৯৮৯ সালের শেষের দিকে রাইসু ভিড়েছিল মঈন চৌধুরীর সঙ্গে। মঈন ভাই তখন ‘প্রান্ত’ নামে একটা পত্রিকা বের করতে শুরু করেছেন। পেশাগত ভাবে মঈন ভাই বোধ হয় ‘ভূতত্ত্ববিদ্যা’র লোক! সিভিল ইনজিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষজ্ঞতার কোনো সম্পর্ক আছে! তাঁর বিশেষজ্ঞতা সম্পর্কে আমার বিদ্যা দিয়ে হয়তো বোঝাতে পারব না! কিন্তু প্রায়ই তাঁর সঙ্গে কথা হতো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সায়ীদ স্যারের বন্ধু হিসেবে কেন্দ্রে এলেও আমাদের মতো তরুণদের সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ভাবে সবসময়ই তিনি মেশেন। এখন হয়তো মনে হবে না, সে সময় তাঁকে আমরা বিত্তশালীই মনে করতাম। এখন তো নয়ই, তখনো চারপাশের মানুষদের মধ্যে সাহিত্যিক নিষ্পাপতা নিয়ে তাঁর মতো বিত্তশালী আমাদের সমাজে দু একজনও দেখা যেত না! তিনি কবিতা লিখতেন, ছবি আঁকতেন; কিন্তু সত্যি বলতে কী দুটোর কোনোটাই তেমন ভালো লাগত না আমাদের! এর পেছনে শিল্প আস্বাদনের বোধের চেয়ে হয়তো আমাদের সময়ের সেরা বলে যারা নিজেদের ভাবত তাদের মনোভঙ্গিরও একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি সজ্জন ও উদার এটা সব সময় মনে হতো। সকলের মনোভঙ্গির নেতিবাচকতা বুঝেও আমাদের সঙ্গে তিনি মিশতেন সহজ ভাবে। রাইসু তাঁর সঙ্গে সে সময় বেশ ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁর সম্পাদিত ‘প্রান্ত’ পত্রিকাতেও এর প্রভাব পড়ল। মঈন ভাই নিজে ছবি আঁকতে যেমন চেষ্টা করতেন তেমনি আবার যথার্থ অর্থেই ভালো শিল্পরসিক এবং সংগ্রাহকও; তিনি রাইসুর ড্রইংয়ের গুণগ্রাহী হয়ে ‘প্রান্ত’র প্রচ্ছদে একটা ব্যবহার করলেন। সত্যি বলতে কি আমার দারুণ লেগেছিল ‘প্রান্ত’র সে প্রচ্ছদে রাইসুর ড্রইং। যদ্দুর মনে পড়ে ধ্রুব এষও রাইসুর প্রচ্ছদের ড্রইং সম্পর্কে আমার কাছে প্রশংসা করেছিল। রাইসুর ড্রয়িং ভালো লাগার পেছনে যে আমার একটা শিল্পবোধ ক্রিয়াশীল এবং এটা যে ফেলনা নয় সে বিষয়ে নিজের ওপর আস্থা এসেছিল ধ্রুবর কথা শুনে। তারপরও রাইসুকে আমি পছন্দ করে উঠতে পারিনি ওর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য তখনও পুরো মানতে পারি নাই বলে। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার নিয়মিতই বিভিন্ন জায়গায় দেখা হতো। খুব একটা পাত্তা না দিলেও তাকে বেশি নেতিবাচক মনে হয়নি আমার ব্যাপারে! বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত থাকায় নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হতো। আবার এমন অনেকেই সেখানে যেতেন আমার ব্যস্ততা হেতু তাদের সঙ্গে দেখা হওয়া বা আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হতো না তেমন। কিন্তু এমন অনেকের সঙ্গেও রাইসুর সূত্রেই আমার পরিচয়ের গাঢ়তা। শুধু তাই নয়, যাদের সঙ্গে রাইসুর তখন জানাশোনা ছিল এমন অনেকের সঙ্গে আমার কথা হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ওর সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া সূত্রে আমারও পরিচয় হয় তাদের সঙ্গে! বলা যায়, রাইসুর কল্যাণে আমারও পরিচিতির সীমানা কিছুটা বাড়ে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বা এ ধরনের কাজের সমাজ-সংগঠন সূত্রে প্রাসঙ্গিক কারো কারো সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে রাইসু। যেমন আমেরিকায় আসার পরে শামস আল মমীনের সঙ্গে আমি যে নিয়মিত আড্ডা দিই তার পটভূমিও রাইসুরই তৈরি করা। রাইসুই একদিন আজিজ মার্কেটে শামস আল মমীনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিনধর্মী পত্রিকা ‘আকার ইকারে’র কপিও তুলে দিয়েছিল আমার হাতে।
১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে আমি আন্ওয়ার ভাইয়ের (আন্ওয়ার আহমদ) সঙ্গ মানে তাঁর পত্রিকাগুলির দেখাশোনা ছেড়ে দিয়েছি। ১৯৯২ সালের দিকে রাইসু যুক্ত হয়েছিল আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে। রাইসুকে কীভাবে আন্ওয়ার ভাই তখন সামলাতেন সেটা ভেবে আমার এখনও অবাক লাগে। কারণ আমার মতো অ-বেয়াদবকেই আন্ওয়ার ভাইয়ের সামলাতে হিমসিম খেতে হতো! জানি না অন্যেরা কী বলবেন, আন্ওয়ার ভাই লেখা গ্রহণের ব্যাপারে উদার থাকা সত্ত্বেও আমার সময়ে তাঁর পত্রিকা ‘রূপম’, ‘কিছুধ্বনি’, বা ‘সাহিত্য সাময়িকী’ পত্রিকাগুলোতে তখনকার লিটল ম্যাগাজিনীয় ভাব আনা সম্ভব হয়েছিল। যদিও আশির দশকের লিটল ম্যাগাজিন প্রতিভূরা সেটা বোধ হয় স্বীকার করে না। আমি ছেড়ে দেয়ার পর রাইসু যুক্ত হলে কবিতার পত্রিকা ‘কিছুধ্বনি’ আরো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল লিটল ম্যাগাজিন স্বভাবে। ‘কিছুধ্বনি’র কোনো একটা সংখ্যার প্রচ্ছদে সে ‘ইহা লিটল ম্যাগ’ কথাটাও লিখে দিয়েছিল।
রাইসু তখন প্রচুর পেন্সিল ড্রইং করত। ওর ড্রইংয়ে এমন সব অবয়ব থাকত যা খুব চোখে পড়ার মতো। প্রকৃত শিল্পী না হলে ঐ সময়ের খ্যাতিমান সব শিল্পীদের কাল্পনিকতার বাইরে গিয়ে এমন স্বতন্ত্র অবয়ব সে আঁকতে পারত না! খুবই অপছন্দের মধ্যেও ওকে আমার একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করল ওর কবিতায় বলা কথার ব্যতিক্রমী ধরন ও ড্রইংয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখে। সেসময় ওর কাছে ওর ড্রয়িংয়ের প্রশংসাও করেছিলাম একদিন।
রাইসু এখনও হঠাৎ হঠাৎ ফেসবুকে ওর ড্রয়িং পোস্ট করে। ইদানিং কম্পিউটারের ভর্চুয়াল রঙতুলিতেও দারুণ ড্রয়িং করছে। আমেরিকায় এসে বিভিন্ন আর্ট গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে অনুভব করেছি, এখানকার পেশাদার শিল্পী হলে ওর ড্রয়িংকে পেশাদার কিউরেটররা এমনভাবেই কিউরেট করত যে ওর কাজের স্বাতন্ত্র্যের আলাদা মূল্য হতো। জানি এই ধরনের বাজারজাত প্রবণতা আমাদের দেশে প্রশংসিত হয় না! রাইসু নিজেকে মার্কেটিং করার ভাব করে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোঝা যায় যে বাংলাদেশের অবিকশিত মার্কেটিং ব্যবস্থায় সে বেশিদূর এগোতে পারে না। কারণ মার্কেটংয়ের প্রচারণা অংশে যেরকমের সৃজনশীলতা দেখাতে পারে সরবরাহের ব্যবস্থাপনায় ততটা পারে না! শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তার সৃজনশীল ভাবমূর্তিই প্রধান হয়ে ওঠে। ইয়োরোপ-আমেরিকায় এই ধরনের মানুষেরা নিজেদের এমনভাবেই বিকশিত করে যে নিজেদের গুণগত অবস্থাকে কাঙ্ক্ষিত গ্রহীতার কাছে পৌঁছতে পারে। এই পৌঁছানোর প্রক্রিয়াতে বাণিজ্যিকতা আছে। এই বাণিজ্যিকতা যেমন দাতার তেমনি গ্রহীতারও। ফলে দাতার মধ্যে করুণা করার বোধ যেমন থাকে না, তেমনি গ্রহীতারও থাকে না করুণা গ্রহণের বোধ। দাতা যেমন নিজেকে পৌঁছাতে চায় গ্রহীতাও তেমনি প্রাপ্তিকে মূল্যায়ন করে। আমাদের সমাজে প্রকৃত শিল্পগ্রহীতাই সৃষ্টি হয়নি তো কিউরেট করবে কার জন্য! ফলে রাইসুর আঁকা ছবির শিল্পমূল্য থাকলেও গ্রহীতা না থাকায় তাকে মূল্য দিয়ে দেখার কেউ নেই। দু-একটা ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম থাকলেও এতে নেই কোনো ধারাবাহিকতা!
কবিতা রাইসু প্রতিনিয়ত লেখে বলে মনে হয় না। কিন্তু নিয়মিত বিরতিতেই যে কবিতা লিখেছে তা বোঝা যায়। কখনো কখনো মনে হয় বিরতি একটু দীর্ঘ হয়েছে, কিন্তু বিরতিশেষে কবিতা হয়ে উঠেছে নতুন জাতের। ওর কবিতার বই বেশি বের হয়নি। কবিতার ক্ষেত্রেও ওর অবস্থা ছবির মতোই। কবি হিসেবে রাইসুর নিজস্বতাকে চিনতে হলে বিচিত্র ধরনের কবিতা আস্বাদনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা যে রুচিসম্পন্ন পাঠক দরকার তা আমাদের সমাজে নেই। যে স্বল্পসংখ্যক পাঠকের কাছে ওর কবিতার স্বাদ গ্রহণীয় তারাও বাংলাদশি-স্বভাবে মূক হয়ে থাকে। মানে কেউ চুপ থাকে অন্যের সম্পর্কে কথা বলার সংস্কৃতিতে অনভ্যস্ত বলে, কেউই বলতে চায় না অন্যের মূল্য বিচারে নিজের কোনো লাভ দেখে না বলে। ইংরেজিতে ক্রিটিক মানে ব্যখ্যা, কেবল ভালো-মন্দ বিচারই নয়, আমাদের সমালোচনা শব্দটি পরিপূর্ণ ভাবে তা বহন করতে পারে না। আবার পর্যালোচনা শব্দটির মধ্যে যেহেতু প্রশস্তি বা নিন্দা নেই তাই আমাদের মন তাতে উজ্জীবিত হতে পারে না। রাইসুর ব্যক্তিত্বে ও কাজে প্রশস্তি ও তিরস্কার, ইশারা-ইঙ্গিত ও রূঢ়তাপ্রকাশ, কৌতুক-প্রবণতা ও গাম্ভীর্য প্রভৃতি পরস্পর বিরোধিতা একত্রে থাকে। আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি এই জটিলতাপূর্ণ জীবনবোধের প্রকাশ ঘটবার অনুশীলনে এখনো উত্তীর্ণ হয়ে ওঠেনি আমাদের সমাজে প্রকৃত বুর্জোয়া বিকাশ না ঘটায়।
ব্রাত্য রাইসুর প্রথম বই ‘আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি’ রচনাবৈশিষ্ট্যে যেমন নামেও তেমনি আলাদা। মনে পড়ছে প্রচলিত বইয়ের তুলনায় ওর বইটার দাম ছিল অনেক বেশি! বইটার গায়েলেখা দাম ছিল ১০০ টাকা। আমি তখন কিনিনি। কিনেছিলাম কিছুকাল পরে। রাইসু তখন বইয়ের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। মূল্যের জায়গায় সিল মেরে লিখে দিয়েছিল বর্ধিত দাম। ২০০, ৩০০, ৫০০ থেকে দাম বাড়াতে বাড়াতে ১০০০ টাকা পর্যন্ত উঠিয়েছিল। বেশি দাম দিয়েই (যদ্দূর মনে পড়ে কোনো রকম কমিশন ছাড়া গায়ের দামে ২০০ টাকা দিয়ে) কিনেছিলাম। পরে যখন ওর দ্বিতীয় কবিতার বই হালিকের দিন বের হলো সেটার দাম রেখেছিল ৪০০ টাকা। কবিতার বইয়ের এই রকম বেশি দাম রাখা অস্বাভাবিক। বইয়ের দাম বেশি রাখার মাধ্যমে রাইসু বাণিজ্যিক পণ্যায়নকে নয় সৃষ্টিশীলতার মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিয়েছিল। এর পেছনে রয়েছে ওর ভিন্ন এক বাস্তবতার বোধ। বাস্তব বুদ্ধি দিয়েই রাইসু জানে ওর কবিতার বই কোনো জনপ্রিয় পণ্যের মতো খুব বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণীয় হবে না।
১৯৯১ সালের দিকে সে ধানমণ্ডির সংগীত ভবনে গান শিখতে যেত। কয়েক বছর যত্ন করে গান শিখেছিল কলিম শরাফীর কাছে! ঐ সময় শিরীন বকুলও গান আর নাচ শিখতে চেষ্টা করেছিল সংগীত ভবনে। ওর সূত্রেই জানতে পেরেছিলাম যে রাইসু গান শেখে। রাইসু কখনো আমাকে পুরো গান না শোনালেও ওর গুন গুন শোনা হয়েছে। মনে হয়েছিল, গান যদি ও নিয়মিত করত তাহলে আমাদের অনেক ভালো শিল্পীদের চেয়ে ভালো গাইতে পারত। আমি ঐ সময়ই টের পেতে থাকি রাইসু হিন্দুস্তানি আর ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যালও বেশ মনোযোগ দিয়ে শোনে। ১৯৮২ সাল থেকে আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লংপ্লে রেকর্ড সংগ্রহের হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল ওস্তাদদের অনেক মিউজিক শুনতাম। কেন্দ্রে তখন ভারতের বড় বড় ওস্তদেরাও শুদ্ধসংগীত প্রসার গোষ্ঠীর দাওয়াতে আসতেন। ফলে তখন ভারতের বিখ্যাত ওস্তাদ বাহাদুর খান, পণ্ডিত যশরাজ, পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী, ডাগর ব্রাদার্সের মতো বড় বড় ওস্তাদের গানবাজনা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছোট্ট ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে বসে কখনো কখনো সারা রাত জেগে শুনতাম। আমদের দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ল্যাসিক্যাল শিল্পীদেরও আমি তখন সামনা সামনি বসে শুনেছি। কিন্তু রাইসু নিজ উদ্যোগে খুঁজে খুঁজে অনেক শুনত। আমি যেসব ওস্তাদদের নাম জানতাম কিন্তু তাঁদের পরিবেশনা শুনিনি, মাঝে মাঝে টের পেতাম তার জনসংযোগ নেটওয়ার্ক থেকে সেসবের অনেক কিছু সংগ্রহ করে শুনে নিয়েছে! ওর এই সামর্থ্যের প্রতি আমার কিছুটা ঈর্ষাও জন্মেছিল তখন।
আমাকে যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নানা লিখিত-অলিখিত নিয়মের দায় মেনে চলতে হতো তখন রাইসুর চলাফেরা দায়মুক্ত; আমি যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বন্দি থেকেই নানা কিছু আহরণ করি তখন সে মুক্ত ভাবে বিচরণশীল হয়ে তার চেয়ে বেশি আহরণ করে নেয়। তবে এটা ঠিক যে, আমাদের সমাজ রাইসুর ব্যক্তিত্বের এ রকম মুক্ততাকে ঠিক সহ্য করতে পারে না!
এখানে আরো স্মরণীয়, রাইসু চাকরি করতে গিয়েও আনুষঙ্গিক অনেক কিছু থেকে নিজেকে অনেকটা দায়মুক্ত রাখতে পেরেছে। মেধায় অন্যদের চেয়ে অগ্রসর বলে চাকরিদাতারা ওর অনেক উপেক্ষা সহ্য করেছে। আবার যখন ওর মেধার বিকল্প পাওয়া যায় তখন মনে হয় তারা আর ওর নির্মোহতাকে সহ্য করে না। ওকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয় বা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যার ফলে সে নিজেই চাকরি ছেড়ে দেয়। চাকরি করেও নিজেকে চাকরির অনেক প্রতিকূল উপজাত থেকে মুক্ত থাকতে পারা তার ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। একই সঙ্গে এটা হয়তো দুর্বলতাও। শক্তি এখানে যে, এর ফলে নিজেকে পরিপ্রেক্ষিতের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম থাকায় নানা ক্ষেত্রে নির্মোহ হতে পারে তার বিচারও। দুর্বলতা এখানে যে, এ ধরনের মানুষকে নিজেদের অননুকূল বিবেচনায় অনেকেই দায়িত্ব দিতে খুবই অস্বস্তি বোধ করবে।
সত্যি বলতে কী, ছবি আঁকা আর গান শেখায় ওর স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে ওর প্রতি আমার বিরূপতা ধীরে ধীরে অনুরাগে রূপ নিতে থাকে। তখন থেকে রাইসুর যে ধরনের আচরণকে আমাদের সমাজে বেয়াদবি মনে করা হয় সেগুলোও একটু একটু সহনীয় লাগতে শুরু করে; ওর কোনো কোনো আচরণে প্রতিহত হলেও আগের মতো কূপিত হয়ে পড়ি না! এখনও ওর কোনো আচরণে প্রতিহত হলে মন খারাপ হয়; তখন ওর আচরণের কার্যকারণ খুঁজতে চেষ্টা করি। অনেক ক্ষেত্রে ওর বিবেচনা হয়তো আমার সঙ্গে মেলে না, কিন্তু অনুভব করি এই অমিল ওর দিক থেকে তুচ্ছ ব্যক্তিস্বার্থে চালিত নয়, বরং মনে হয় ওর সব বিবেচনা নিজের দার্শনিক তাৎক্ষণিক অবস্থান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত!
আমাদের সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ যে সময়টায় বিত্তশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছে সেই সময়ের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গেই রাইসুর ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। কিন্তু ঐ ঘনিষ্ঠতা ব্যবহার করে অধিকাংশ মানুষ যেমন আর্থিক বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক সুবিধা নিতে চায় রাইসু তা চায়নি। রাইসুর যদি কোনো চাওয়া থাকে তবে তা ওর কোনো না কোনো সৃজনশীলতার জন্য; ভোগের স্থূলতা নয়, উপভোগের সূক্ষ্মতা ওর আরব্ধ। তাই ওর চাহিদা সাধারণত কোনো উপভোগের বস্তুরই অনুকূলে। ওর সেই চাওয়ায় বৈষয়িকতা যতটুকু আছে তা ওর সৃজনশীলতার সাপেক্ষ বিষয়! ওর বৈষয়িকতা যদি সম্পন্ন ভাবে থাকত তাহলে তা দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হতো।
নব্বইয়ের দশকে আমি যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কর্মরত তখন কম্পিউটার সুলভ হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটের সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকলেও তখনও তা পাওয়া আমার পক্ষে সহজ ছিল না। ১৯৯৭ সালের দিকেই আমাকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলেছিল রাইসু। বলেছিল এনসাইক্লোপিডিয়ায় যা পাওয়া যায় না সেরকম নানা সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কেও নানা তথ্য সে ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করতে পারে। যদ্দূর মনে পড়ে তখনো সার্চ ইঞ্জিন গুগুল আসেনি, কিন্তু কোনো ভাবে কিছু টেক্সটের প্রিন্ট সে সংগ্রহ করে এনে আমাকে দেখিয়েছিল। ইন্টারনেট সুবিধা তখনো বড়লোকি ব্যাপার বলে মনে করতে দেখেছি বেশিরভাগ মানুষকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ নিতে আমার কর্মকালে সায়ীদ স্যারকে রাজি করাতে পারিনি তখনো পর্যন্ত একে তিনি বিলাসিতা মনে করতেন বলে। কিন্তু রাইসুকে দেখতাম বড়োলোকি ব্যাপারে ওর নিজের সংযুক্তিকে খুবই স্বাভাবিক মনে করত। মনে পড়ছে রাইসু গান শোনার ডিভাইস আইপড রাখার বিলাসিতা (?) সে অনেক আগে থেকেই করে। মনে পড়ছে দীর্ঘকাল সে মিউজিক শুনতে আইপড ও হেডফোন বহন করত।
আমাদের সাহিত্য সমাজের খুব বেশি মানুষকে বিচিত্র শিল্পমাধ্যমে কৌতূহলী দেখতে পাই না! বিভিন্ন শিল্পকলা প্রদর্শনীতে, নাটকের শো-তে বা গানের আসরে বহুবার আমার দেখা হয়েছে রাইসুর সঙ্গে। রাইসুর ব্যক্তিত্বের এই সর্বগ্রহিষ্ণুতা খুব বড় গুণ; ব্যক্তিত্বের এই সর্বজ্ঞানানুকূলতার সূত্রেই পণ্ডিতম্মন্যের ভান না করেও সে জ্ঞানী।
১৯৯৮ সালে আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দায়িত্ব ছেড়ে দিই। যোগ দেই বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান একটি প্রেস ও প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিতে। কাছাকাছি সময়ে রাইসু যুক্ত হয় প্রথম আলোতে সাজ্জাদ শরিফের সঙ্গে। কয়েক বছর প্রথম আলোর সাময়িকীতে কাজ করার সময় ওর কার্যকলাপ বাহ্যত কিছুটা সংহত মনে হতো।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়া-আসা-করা হাসি খুশি মেধাবী মেয়ে সোহানা শফিক সোমার সঙ্গে ওকে মাঝে মাঝে দেখতাম। অনুমান করতাম ওদের মধ্যে প্রণয়সম্পর্ক গড়ে উঠছে। সোমা তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। পান্থপথের কাছে এক ফ্ল্যাটে রাইসু আর সোমা সংসার পাতলে রাইসু একদিন আমাকে নিয়ে যায় সেখানে। সেদিন ওদের ফ্ল্যাটে আড্ডা দিয়ে আনন্দময় সময় কাটিয়ে খেয়ে দেয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিছুকাল পরে জানতে পারি সোমা আইসিডিডিআরবিতে গবেষক হিসেবে কাজ করছে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই জানতে পারলাম, কয়েক বছরের জন্য উচ্চশিক্ষার্থে সোমা অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছে; সঙ্গে রাইসুও। রাইসুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় সে-সময়।
বেক্সিমকোর যে অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে আমি যোগ দেই সেখানে তখনও ইন্টারনেট সুবিধা ছিল না। সাইবার ক্যাফেতে নিয়মিত যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়নি তখনও। কিছুকাল পর সেখানে ইন্টারনেট সুবিধা যুক্ত হলে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত রাইসুর খোঁজ পাই। এখন মনে পড়ছে না কীভাবে রাইসুর ইয়াহু গ্রুপ ‘কবিসভা’র খবর পেয়েছিলাম। ফেসবুক আসার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আভাস পাওয়া গিয়েছিল ‘কবিসভা’য়। কীভাবে কীভাবে যেন রাইসু আমার ইমেইল ঠিকানা যোগাড় করেছিল। তখনই প্রায় ৭০০ জনের সঙ্গে যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল রাইসু। যথারীতি ঐ গ্রুপে যাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম তাদের বেশিরভাগেরই সঙ্গে আমার আগে পরিচয় ছিল না! ওখানে যাঁদের পাওয়া গেল তাঁরা আমার চোখে তখন বেশ ব্যতিক্রমী মানুষ। সাহিত্যকে আমি যে চোখে দেখতাম তাঁদের অনেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি তার চেয়ে খানিকটা আলাদা মনে হতো। অন্তত আমার চেয়ে চিন্তায় যে কেউ কেউ বেশ ভিন্ন দৃষ্টিতে এগিয়ে থাকা মানুষ তা বুঝতে পারি! ইয়াহু গ্রুপের নানামুখি তর্ক আমার মধ্যে নতুন কৌতূহলের জন্ম দেয়। আমার চিন্তা চর্চায় খুলে যায় নতুন নতুন জানালা! এই ধরনের যোগের জন্য আমার চেতনাপ্রবাহে রাইসুর প্রতি প্রীতি চলমান থাকে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে ২০০৪ সালে রাইসু যোগ দেয় যায়যায়দিনে; ওখানে ছিল ২০০৭ পর্যন্ত। পরে মাসদুয়েক ছিল ইটিভিতে। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে যোগ দেয় আর্টস ডট বিডিনিউজটুয়েন্টিফোরডটকম-এ। তখনও ওয়েব পোর্টালের ধারণা আমাদের দেশে বেশ নতুন। ওয়েবপোর্টাল পরিচালনা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা আমি পাই রাইসুর কাছ থেকেই। আর্টসে কয়েকটি রচনাও লিখি ওর পরামর্শে! আগে আমার প্রবন্ধের বই বের হলেও সে সম্পর্কে তেমন জানা ছিল না বেশি মানুষের। বলা যায় কিছু পাঠকদের কাছে মোটামুটিভাবে আমার প্রাবন্ধিক সত্তার পরিচয় বিস্তৃত হতে থাকে বিডিনিউজে আমার লেখা প্রকাশের আমল থেকেই।
সোমার সঙ্গে সংসারের সম্পর্ক ছেড়ে রাইসু যখন একা থাকতে শুরু করেছে তখনও ওর ফ্ল্যাটে আমি গেছি। ওখানে এমন কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়েছে যাদের সঙ্গে কেবল আগে নামপরিচয় মাত্র ছিল, রাইসুর কল্যাণে তাদের সম্পর্কে জানাশোনা গভীরতর হয়েছে!
বিডিনিউজ ছেড়ে তারপর রাইসু স্বাধীন ভাবে পোর্টাল চালাতে চেষ্টা করে। ‘সাহিত্য ডটকম’ বা ‘কুতর্কের দোকান’ জনপ্রিয়ও হয়। রাইসু একদিন হঠাৎ সাহিত্য ডটকমের জন্য আমাকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে ধারাবাহিক স্মৃতিচারণ লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দিনগুলি’ নামে প্রস্তুতিহীন ভাবে লিখতেও শুরু করি আমি। প্রকাশিতও হয় দুটি কিস্তি। পরে অন্য দিকে মনোযোগ চলে যাওয়ায় আর শেষ করা হয়নি লেখাটা!
২০০৬ সালে বেক্সিমকো ছেড়ে এসে ফরিদুর রেজা সাগরের আহ্বানে আমি যুক্ত হই ইমপ্রেস গ্রুপের সঙ্গে। এখানে গড়ে তুলি একটি প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠান। ওখানেও মাঝে মাঝে আসত সে; পুস্তক প্রকাশনা নিয়ে অনেক কথা হতো তখন। মুদ্রণ ও পুস্তক প্রকাশনা নিয়ে ওর সঙ্গে আমার তখন বেশ নিয়মিতই ভাবনা বিনিময় হতে থাকে। বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায় হিসাবে কেমন তা নিয়েও কথা হতে থাকে মাঝে মাঝে। টের পাই এ নিয়ে ওর ভাবনা-পরিকল্পনা বাংলাদেশের পক্ষে বেশ ব্যতিক্রমী। বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজ জ্ঞান বা বিদ্যাকে দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ভাবতে পছন্দ করে। কিন্তু একজন মানুষকে যে জ্ঞান চর্চার জন্য অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় থাকতে হয় এবং অনেক বেশি মনোযোগী হতে হয় বলে আপাত বিমূর্ততার পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয় তাদের তা আমাদের অর্থবিত্তশালী সমাজ, রাষ্ট্রসমাজ, এমনকি বিদ্বৎসমাজও উপলব্ধি করে না! নিউ ইয়র্কে এসে আমেরিকার পুস্তক-প্রকাশনার অতীত বাস্তবতা সম্পর্কে খানিকটা খোঁজ-খবর করে অনুভব করতে সক্ষম হই যে, বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চায় সামাজিক বিনিয়োগ এ কারণেই আসে না! রাইসু আমাকে তখন এমন একটা ধারণাকল্প দেয় যে, তার প্রকাশনার বইয়ের কাগজ বাঁধাই যেমন ভালো হবে তেমনি সেগুলো যেন নির্ভুল হয় তার প্রতি যত্নশীল থাকবে। একটা বইকে নির্ভুল ও সৌষ্ঠবময় করতে হলে সময়, অর্থ ও দক্ষতার যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয় তাতে অনেক মূল্যযোগ ঘটে। সেজন্যই বেশি রাখতে হবে ওর প্রকাশনার বইয়ের দাম।
কিন্তু আমি ওর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়ে বলি সে মূল্য দিতে আমাদের সমাজ একেবারেই প্রস্তুত নয়। আমি ওর পরিকল্পনাকে অবাস্তব ঘোষণা করি। রাইসু জানায় যে তার প্রকাশনার বইয়ের বিষয়বস্তু স্বতন্ত্র ও কৌতূহলোদ্দীপক বলে মূল্য বেশি রাখা যুক্তিসংগত হবে। লোকে বেশি দাম দিয়েই ওর প্রকাশনার বই কিনবে। বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে বলে সংখ্যায় হয়তো কম বিক্রি হবে। আর কম বিক্রি হওয়াকেই সংগত মনে করছে সে। কারণ প্রকৃত পাঠক আমাদের সমাজে তো আসলেই বেশি নেই। যে পাঠক নয় তাকে কম দামে কেন বিনামূল্যে দিলেও সে পড়বে না! আর পাঠক বেশি নেই বলে বাস্তবতা হচ্ছে ব্যবসা হিসেবে তা সফল হতে পারে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ওর সঙ্গে তর্ক করে আমিও এই উপলব্ধিতে উপনীত হই যে, কম বিক্রি থেকেই যদি বস্তুগত ও অবস্তুগত মূল্যের বিনিময় করা যায় তাহলে তো ব্যবসায় হিসেবে সেটা সফল হবার কথা। আমিও ওকে বললাম, সে ক্ষেত্রে আমার প্রতিষ্ঠানে গুণগত উৎকর্ষের জন্য সহযোগিতা যেমন পাবে তেমনি তোমাকেও পেশাদার হতে হবে। আমি কিছুটা সংশয়ী হয়েও ওর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওকে খুব একটা এগোতে দেখিনি। নানান বাস্তবতায় আমিও প্রেসের দায়িত্ব ছেড়ে দিই; ২০১৭ সালে তো আমি দেশই ত্যাগ করি। এখনো আমি ওর পুস্তক প্রকাশনার ধারণাটাকে সমর্থনযোগ্য মনে করি। তবে একথাও ঠিক যে ব্যবসা হিসেবে রাইসুর পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা ‘বহিঃপ্রকাশ’ যদি ধারাবাহিকতা না রাখতে পারে তার জন্য ওর সৃষ্টিশীল মনই দায়ী। কারণ এ ধরনের কাজে কাউকে কেবল সৃষ্টিশীল হলেই হয় না, স্থিতিশীলও হতে হয়। পুরো দায়মুক্ত মন হলে চলে না, যুগপৎ দায়বদ্ধতাও থাকতে হয়; সেখানে রাইসুর দুর্বলতা রয়েছে।
চল্লিশ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আমি সাহিত্য নিয়েই আছি। সাহিত্য আমার সৌখিনতার বিষয় নয়! কিন্তু তাই বলে তা নয় জীবিকাও! সাহিত্য নিয়েই আমি চৈতন্যে বাঁচি। আমার দার্শনিকতা থাকে সাহিত্যের সঙ্গে দ্রবীভূত অবস্থায়! কিন্তু রাইসু এই দুটিকে সমান্তরালে অনুশীলন করে। আমার সাহিত্যলগ্নতার সূত্রেই কিঞ্চিদধিক রাইসুর পরিমণ্ডলে হয়তো আমি পড়ে গেছি। লেখক হিসেবে ওর কাছে আমার কতটা গুরুত্ব আছে সে ব্যাপারে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। আমার কোনো কোনো মত সম্পর্কে কখনো কখনো ওর পরিহাস বা কটাক্ষমূলক কথা প্রকাশ করেছে। সব মিলিয়ে ওর পরিমণ্ডলের মানুষদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কেউ বলে আমাকে মনে করে বলেও মনে হয় না। কিন্তু এর বিপ্রতীপে লক্ষ্য করেছি, আমার সুদীর্ঘ আবদুল হক চর্চায় রাইসুর সমর্থন আছে; যদিও বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আমার লেখা আবদুল হকের জীবনী বইটি সম্পর্কে প্রথম আলোতে ২০০১ সালের দিকে ও এমন একটা বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ করেছিল যা আমাকে প্রতিহত করে রেখেছিল কিছু কালের জন্য। ঐ সমালোচনার বক্তব্য ছিল অনেকটা একপেশে ও পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় তা ছিল কিছুটা সংকীর্ণ। ঐ সমালোচনা বের হবার পর খানিকটা ভাটাও পড়ে গিয়েছিল আমার আবদুল হক চর্চায়। পরে অবশ্য অপরাপর পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া ধারাবাহিক ইতিবাচক সাড়া অনুপ্রাণিত করেছিল আমার সেই স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে। ঐ ঘটনার প্রায় ১৫ বছর পরে, ২০১৫ সালে, ঐ আবদুল হক চর্চাকেই উৎসাহ দিয়ে আমাকে খানিকটা অবাক করেছিল রাইসু। ওর এরকম একটা পোর্টাল ‘সাম্প্রতিকে’র জন্য আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যবস্থা করেছিল আবদুল হক চর্চার বিষয়ে! সেই সাক্ষাৎকার ইউটিউবে বা ফেসবুকে কয়েক হাজার মানুষ দেখেছে। বলা যায়, সেই সূত্রে আমার আবদুল হক চর্চার খবর এমন কিছু মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছে যাঁদের কাছে হয়তো আবদুল হকের চেনা হবার কোনো উপায় ছিল না।
ব্রাত্য রাইসু যে রকম সম্পর্কের দায়মুক্ত ভাবে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে সেরকম মানুষকে আমাদের সমাজ সহজভাবে নিতে পারে না। ফলে চারপাশের অনেকের অপছন্দের অদৃশ্য তালিকাতেই তার নাম আছে। আবার ওর এই মুক্ততাই চক্রব্যুহ হয়ে যেমন ওকে রক্ষা করে তেমনি আবার অনবরত আঘাতও করতে থাকে! এই রকম আক্রমণ ও রক্ষণপ্রক্রিয়ার মধ্যেই ওকে টিকে থাকতে হয়।
রাইসু বলে যে সে বেশি পড়ে না! ওর পরিহাসমূলক এই কথা যদি বিশ্বাস করি তাহলে ছাপা বইয়ের পৃষ্ঠার হিসেবে সে হয়তো কম পড়ে থাকতে পারে, কিন্তু এটা অনুভব করি জীবনকে সে পড়ে অনেক বেশি করে। সেজন্যেই রাইসু জীবনকে দেখতে পারে প্রজ্ঞাবানের চোখে!
বয়সে রাইসু আমার চেয়ে কিছুটা ছোট হলেও বুদ্ধিতে, জীবনকে দেখার ভিন্নতায়, সৃষ্টির কল্পনায়, অনুভূতি প্রকাশের ভড়ংহীনতায়, অপ্রাতিষ্ঠনিকতার বোধে, অযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিকতাকে উপেক্ষার সামর্থ্যে, প্রাণবন্ত বন্ধুত্বে রাইসু আমার তুলনায় অনেক তীক্ষ্ণ! রাইসুর এইসব শ্রেয়োত্ব আমি ক্রমশ আমার অজান্তেই মেনে নিতে থাকি! রাইসুর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এ কথা প্রকাশে আমার তাই কোনো সংকোচ নেই! তাই দ্বিধাও নেই ওর নামে জয়ধ্বনি দিতেও!
[এটি বছর দেড়েক আগের লেখা! তথ্যগত ভুল কারো চোখে পড়লে জানতে পারলে লেখকের জন্য ভালো হবে।
রাইসুর এই ফটো গত ফেব্রুয়ারির বাংলা একাডেমির বইমেলায় আমার তোলা। মূল ছবিতে আরেকজন ছিলেন। সে ফটো থেকে কেটে পোরট্রেট মোডে এডিট করা।]
লেখাটি খুব পরিচ্ছন্ন মানসিকতার।
আমার অজ্ঞতা অপরিসীম। আহমাদ মাযহার সম্বন্ধে, বলতে কী, আমি কিছুই জানি না। আন্দাজ করি, তিনি আমার সমসাময়িক। তাই আমার না-জানাটুকু আরো বিচ্ছিরি।
ব্রাত্য রাইসু সম্বন্ধেও আমার ধারণা অস্পষ্ট। ১৯৯০ সালে ঢাকা যাই। ওই একবারই বাংলাদেশে যাওয়া। উঠেছিলাম নারিন্দায় ফরিদ কবিরের আর মৌচাক মোড়ে তুষার দাশের বাড়ি।
সম্ভবত ফরিদের বাড়ি থাকার সূত্রেই একটা দিন কাটিয়েছিলাম ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে। বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম। ঢাকায় একটা অন্য হাওয়া যেন। কলকাতার কাছাকাছি? এটা বললে বাড়াবাড়িই হবে। কলকাতায় ফিরে এসে মৃদুলের (দাশগুপ্ত) কাছে শুনি রাইসুদ্দিন থেকে রাইসু হয়ে ওঠার কথা।
ওর লেখা পড়েছি, বলব না। আঁকা দেখিনি। গানও শুনিনি। তাহলে ঢাকার ওই দিনটি এত বছর পরও মনে আছে কেন? বোধহয়, এটাই ব্রাত্য রাইসুর বিশেষত্ব।
একবার কী-একটা বিষয়ে ফেসবুকে সে আমাকে বেশ খারাপ-খারাপ কথা লিখেছিল। সেসব সম্পূর্ণ ভুলে গেছি।
আহমাদ মাযহারের এই লেখাটা আমার সেই ভুলে যাওয়াকেই সমর্থন করছে।