কিং সউদ
তর্ক
—–
সাগর নদীতে মেশে
আকাশ মেঘের বেশে
বাতাসে পাখিরা উড়ে
আগুনে কাগজ পোড়ে
কী সম্পর্কে?
সবুজ পাতারা ঝরে
শিশির রোদ্দুরে মরে
মাটিতে ফাটল ধরে
কী সম্পর্কে?
জোয়ার বইছে পলি
রঙিন হয়েছে কলি
কী সম্পর্কে?
তোমার আমার তর্ক
আমাদের;
কী সম্পর্ক?
তুমিময়
———–
কতোটুকু অন্ধকারে
কতোটুকু আলো নিলে
একটি দিনের শুরু?
দিন দিন প্রতিদিন এঁকে যাই
মৃত সাগরের ঢেউ!
ঢেউ ঢেউ রঙ দেখো না যে তুমি,
আমি অন্ধকার– না আলোর শিল্পী?
প্রচ্ছদ আঁকিয়ে যেমন জানে না
বাক্য গঠনের অনুষঙ্গ,
তেমনি জানি না আমারই প্রতিলিপি
প্রত্নরূপ হয়ে আছে কার সহৃদয়ে!
তুমি, কেবলই তুমিময়!
আয়নাদার
—————
এখন কুয়াশা কাল
ততোটা সহজ নয়
পাল তোলা…
নায়ের উনুনে সিদ্ধ করো
ফুলকপি; হলুদ, মরিচ মেখে
ঝাল করে নাও।
প্রবাহিত শীতল নিরব জলে
মাছেরা শ্যাওলা জড়িয়ে সামান্য
ওম নেয়!
কোথায় চেয়েছো যেতে?
সাপেরা এখন স্নানে নামবে না,
হাঁসের পালকে কাচা রঙ,
বেসামাল জেলে
জ্বেলেছে আগুন তীরে
জাল পুড়ে!
আর গাংশালিক চোখে
কাজল লাগিয়ে
জলকে করেছে আয়নাদার!
যাবে কিনা বলো?
মূল্য
——
শিশু জন্মানোর বীজ
আমার নিকট আছে।
এমন বাজারে
দোকান দিয়েছি কেউ
বীজ কিনছেন না!
পাশের বাজারে হরদম বিক্রি দেখে,
আমিও আশায় আছি বলে
দোকান গুটিয়ে নেই না।
কেবল আপনি মাঝে মাঝে
বীজ কিনছেন, আপনার
বীজতলায় বিষবৃক্ষও ফলে না!
কিন্তু আপনি করেন ঠিক ঠিক
মূল্য পরিশোধ…
আহা!
——
রেলগাড়ির কতোটি চাকা থাকে?
কতোটি দড়জা, কতোটি জানালা?
যে যারা গন্তব্যে চলে যায়
হিসেব না করে!
জংশনে দাঁড়িয়ে আছি
একটি পুরুষ জামা গায়ে
জামার তলায় একটি মহিলা ব্রা
কোমরে একটি হিন্দু ধুতি বাধা
ধুতির তলায় একটি হিজড়া আন্ডারওয়ার
পায়ে এক জোড়া খ্রিস্টান স্যান্ডেল
কোথায় চাইছি যেতে!
ভুলে গিয়ে গতিময় রেলের দেখছি মুখ
আহা! কি করুণ স্বরে হুইসেল দেয়
কালো কালো ধোঁয়া ছাড়ে
পাথর বিছানো কাঠের উপর রাখা পাতে
আর্তনাদ…
মেঘহীন নীল আকাশে একটি ডিম পারা পাখি
আমার মাথার উপর চক্কর দিচ্ছে ক্রমাগত
বিপরীত দিক থেকে আসছে একটি রেল
ফিসফিস করে কি জানি বলছে কানে
ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক
ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক
ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক
ঝিক ঝিক ঝিক
ঝিক ঝিক
ঝিক
অগোচরে
———–
কামনা কমে না- বাড়ে!
তিরিশেক দেহ লুটেপুটে নেয়
কে যে অগোচরে?
মন পড়ে থাকে ঘরে,
এ মনে কামনা নেই যে জমানো
বেদনারা থরে থরে।
মনের ঘরের পাশে,
একটি পাখির ঘর ভাঙা চলে
খুব যেনতেন ত্রাসে!
পাখিটি কোথায় যাবে?
পালকে- পলকে নেই কোন ছাপ
কি করে বুঝবো ভাবে!
নেই কোন প্রতিবেশী,
পৃথিবী আমার অচেনা এখন!
দিকে দিকে এলোকেশী!
হাহাকার
————
ছায়ার ভেতর আঁধার করেছে ভর
নদীর ভেতর জেগেছে আবার চর
আপনজনেরা নিরবে হয়েছে পর
নিজের ভেতর নিজেই বেধেছি ঘর
জানালা রয়েছে, দরজা রয়েছে খোলা
বিছানা, বালিশ, মশারি, চাদর তোলা
শিথানের পাশে ঝোলানো রয়েছে ঝোলা
এখানে ওখানে ঘোরে ফেরে আরশোলা
তেলের অভাবে জ্বলে না প্রদীপ আর
জোনাকি আসে না আলো নিয়ে কোন বার
কখন ছিঁড়েছে দোতারার এক তার
বাউল এ মনে নিশিদিন হাহাকার
সোনায় মোড়ানো প্রেমের লিপিকা ফেলে
পোড়ামাটি দিয়ে গড়ানো শরীর মেলে
আড়ালে আমায় মোহময় করে গেলে
জানতে চাইবো বিনিময়ে কি যে পেলে
যদি
—-
আমাকে একটি মেয়ে
বললো হঠাৎ এসে
–আপনাকে আমি চিনি।
আমি বললাম,
–কিভাবে চিনলে বলো?
একটু লাজুক হেসে,
মুদু মুদু কেশে কেশে
বললো মেয়েটি,
–কবিতা পড়েই চিনি।
আমি বললাম,
–শোন মেয়ে,
যদিও জাহাজ ঘোরে
এ বন্দর ও বন্দরে,
জাহাজ থাকলে ভেসে
ভেসে থাকে জাহাজীরা,
কবির কবিতা জাহাজ জানবে,
কবিকে জানবে জাহাজী-
কবিতা, কবির মাঝে থাকে
সাত সমুদ্র তেরটি নদী!
মেয়েটি নিরবে চেয়ে…
–ও মেয়ে তোমায় চিনি না বলেই
তুমি কী অচেনা?
তোমার মতন মেয়ে
হয়েছে অনেক চেনা
এমন চোখের পলক,
নাকের ডগার ঘাম,
পাতলা ঠোঁটের আলতো কাঁপন
দীর্ঘল চুলের ঝিলিমিলি উদ্দাম,
ভীরু ভীরু স্বর শুনেছি বলেই
তুমিও যে তেমনটি
কিন্তু তোমায় বলিনি আমি,
ভালোবাসি তোমাকেই!
–কবিরা কেমন ভালোবাসে
দেখার বড়ই স্বাদ,
কবির প্রেমিকা হতে যদি
বাড়াই আমার হাত
ফিরিয়ে দেবেন…?
হাওয়া
——–
আমার বুকের বাম পাশে
সবুজ সবুজ কচি ঘাসে
জমেছে শিশির অনায়াসে
কেন জানো?
বলি শোন,
রাতভর শুধু থাকি পড়ে
ঘরহীন হয়ে অনাদরে
চোখের ভেতর ঘুম মরে
কেন ঘরহীন?
আমি যে অধীন!
আঁধার আমায় কেনে বেচে
দেহ রস নেয় সেচে সেচে
মনের ভেতর নেচে নেচে
মাতাল নাচের তালে,
কাল মিলে যায কালে!
এমন কালের কম্পমানে
ভাবোতো তোমরা অনুমানে
থাকছে হাওয়া কেন প্রাণে
হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া
করো গো পূরণ এ চাওয়া
আমায় বানাও লু হাওয়া
চুপিচুপি
—–
বনের পাশে মানুষ বাড়ি
বাড়ির ভেতর নদী
নদীর জল বনের লাগে
শ্রাবণ হয় যদি
শ্রাবণ আসে বছর ঘুরে
মেঘের পালকি চরে
বনের তাই খড়ায় কাটে
কখনো আগুনে পুড়ে
যখন নদী জানালা দিয়ে
বনের দিকেতে চায়
গাছের সব হলুদ পাতা
একা একা ঝরে যায়
পশুরা নেই পাখিরা নেই
নেই কোন গুহালিপি
বনের মাঝে গাছেরা শুধু
কথা বলে চুপিচুপি
কবিতা ভাবনা
কবিতা লেখা এবং কবিতা ছাপা উভয়ই কষ্টসাধ্য কাজ। তবু এই কষ্টকে মেনে নিয়ে বিগত দিনগুলোর মতো এখনও কবিতাই লিখি। কেন লিখি? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আমি আনন্দ পাবার জন্য লিখি, আমি আমার ক্রোধ প্রকাশের জন্য লিখি। জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বকে বদলে দিতে লিখি, সাদা কাগজ দেখলে আমার নেশা ধরে, তাই নেশা কাটাতে লিখি। পাঠক আমার লেখা পড়ুক, গ্রহণ করুক, বর্জন করুক, আলোচনা সমালোচনা করুক সে জন্য আমি লিখি, কিছু অর্থ পাওয়ার জন্য লিখি। আসলে লেখা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কেউ কবি বলে ডাকলে আমি লজ্জা পেলেও মনে মনে খুশি হই তার প্রতি। আবার একই সাথে খারাপও লাগে, কেননা সে হয়তো আমার কোন কবিতাই পাঠ করেনি।
দেশ এবং বিদেশের উল্লেখ্যযোগ্য কবিতাগুলো পাঠ করে আমার মনে হয়, কবিতার ইতিহাস নিহিত রয়েছে উপস্থাপনার মধ্যে, কৌশলের মধ্যে; বিষয়বস্তুর মধ্যে নয়। কবিতার বিষয় নানাবিধ হতে পারে আবার একও হতে পারে। তাই বিষয় দিয়ে কবিকে মাপা যথাযোগ্য নয়। প্রত্যেক মৌলিক কবির কবিতার একটি নিজস্ব স্বর ও ভাষা থাকে। আমার সময়ের (শূণ্য দশক) কবিরা (খুব কম সংখ্যক) শুধু কবিই হতে চান। তাই ভাষার নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চান না কেউ। কেন্দ্র ছেড়ে তাই প্রান্তের দিকেই তাদের পদযাত্রা। বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতিকে সমসত্ব মিশ্রণ করেন কবিতায়। অনিদিষ্ট অনুষঙ্গাবলি কবিতায় গ্রহণ করেন অনায়াশে। ভাষা, ছন্দ আর নন্দনের সুনিদিষ্ট কাঠামো থেকে কবিতাকে স্বাধীন করার লড়াই চলছে এখন। শুধু সৃষ্টিই আজ একমাত্র কাজ। যদিও এ কাজ সকলের দ্বারা সম্ভব নয়। অসম্ভবকে সম্ভব করাই তো কবির কাজ।
এই অসম্ভব কাজ করার উন্মাদনায় নিজেকে নিমগ্ন রাখছি অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও। ভবিষ্যৎ অজানা। জানি না, যা লিখছি তা কোন কাজে লাগবে কিনা। কাজে লাগুক আর নাই লাগুক এ কথা ভেবে ভালো লাগে যে, পরবর্তী প্রজন্ম এ কথা অন্তত বলবে যে, লিখার চেষ্টা করেছি। সেই লোকগল্পের কচ্ছব আর চিতাবাঘের গল্পের মতো। চিতাবাঘ কচ্ছপটাকে ধরে ফেলে বললো, নাও, এখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। লড়াই করছে এমন ভাব দেখিয়ে, কচ্ছপ তখন পথের ওপর তার সারা শরীরে বালু ছড়াতে লাগল। চিতা বাঘ বিভ্রান্ত হলো। চিতা বাঘ বললো, এমন করছো কেন, কচ্ছপ উত্তর দিলো, আমার মৃত্যুর পর যারা এই রাস্তা দিয়ে যাবে, আমাকে দেখে বলবে, এই মৃতদেহটা যার সে তার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্ধী সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যভাবে বললে, দুজনেরর মধ্যে একটা লড়াই হয়েছিল, বিনাযুদ্ধে মৃত্যুকে সে মেনে নেয়নি।
জীবন বৃত্তান্ত
কবি কিং সউদ ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর বরিশাল বিভাগের মঠবাড়িয়া উপজেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি বরিশাল শহরের ২৪ নাম্বার ওয়ার্ডে। পিতা মোহাম্মদ রুস্তুম আলী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং মাতা আনোয়ারা বেগম সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
মঠবাড়িয়া থাকাকালীন তাঁর স্কুল জীবন শুরু হলেও কাউখালি উপজেলায় তাঁর প্রাইমারি এবং মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ হয়। এরপর বরিশাল আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিপ্লোমা এবং ঢাকার বনানীতে অবস্থিত অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি-ইন-টে´টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন। কিং সউদ দুই ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট।
লেখালেখির শুরু ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। দশক হিসেবে প্রথম দশকেই তাঁর বিকাশ ঘটতে থাকে। নানা বিষয় তাঁর লেখালেখির ক্ষেত্র। তবে কবিতাতেই তিনি নিমগ্ন। এ যাবত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : আত্মার অভ্যন্তরীণ আলো (২০০৯), কলমের কন্যা (২০১১), চুমু (২০১২) অপরূপ বহুরূপ কাণ্ড (২০১৩), পূর্ণ বয়স্ক একটি নদী (২০১৪), জোনাকি ধরি এখনো অন্ধকারে (২০১৫), কবিতা লিখলে হয় না সবাই কবি (২০১৬)।
তাঁর পেশা লেখালেখিই। অংশগ্রহণ করেছেন বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রশিক্ষণ কোর্স ২০১২ এর ৫ম ব্যাচে। সম্পাদনা করছেন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির পত্রিকা সন্ধ্যা। তিনি গান লিখেন এবং সুর করেন। রঙিন শিশির ডানা শিরোনামে তাঁর কবিতার গানের একটি অ্যালবাম কলকাতা থেকে এ বছরই (২০১৬ সালে) প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর লেখা উপন্যাস, গল্প এবং কাব্যনাট্য যা এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ আত্মার অভ্যন্তরীণ আলো এর জন্য ২০১০ সালে পেয়েছেন আড্ডা সম্মাননা।
কবি কিং সউদ একজন সুরুচি সম্পন্ন কবি।তার কবিতার সব কটি বই ই আমি মোটামুটি পড়েছি। আমার খুবই ভালো লেগেছে কবিতা গুলো।