spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধপ্রাচী-প্রতীচীর মিলনবেলার পুঁথি

লিখেছেন মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

প্রাচী-প্রতীচীর মিলনবেলার পুঁথি

মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

পারসিক কবি হাফিজের কবিতাপাঠের উদ্দীপনায় বিশ্বকবি গ্যোয়েটে (১৭৪৯-১৮৩২) লিখেছিলেন তাঁর দিভান ‘West Ostlicher Divan’, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের অনুবাদে ‘প্রাচী-প্রতীচীর মিলনবেলার পুঁথি’। ১৮১৯-এ গ্যোয়েটে লিখিত এই বই বাংলা ভাষান্তর করেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ১৯৯৭ সালে। হাফিজের কবিতার অনুষঙ্গ ছুঁয়ে গ্যোয়েটের এই মহাকাব্য সর্ববিধ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে নান্দনিক এক প্রতিবাদ এবং একই সঙ্গে ‘প্রেমের সপক্ষে মৌলবাদের বিরুদ্ধে’ সার্বিক মিলনবাণী। গ্যোয়েটের ‘দিভান’ পারসি ‘দিওয়ান’ শব্দটি থেকে এসেছে; যার অর্থ কোনো কবির লিরিক এবং স্তুতি প্রশংসামূলক কবিতার সংকলন। তাঁর সত্তর বছরের জন্মদিনে গ্যোয়েটে এই দিভান প্রকাশ করে একে ‘বন্ধুদের জন্য পুঁথি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষায় ‘তাঁর কিছু প্রিয়জনের হাতে এ বই যখন তুলে দিয়েছিলেন, তাঁর অভিলাষ ছিল জগৎ ও জীবনের জন্য সপ্রশংস এই লিরিক সংকলনের দৌলতে তাঁর বন্ধুসংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়া।’ প্রাচ্যের কবি হাফিজের ‘দিওয়ান’-এর প্রেমের ভুবনের সঙ্গে গভীর সামীপ্য অনুভব করেছিলেন গ্যোয়েটে।

  হাফিজ চতুর্দশ শতকের ইরানি কবি। পারস্যের শিরাজ শহরে তার জন্ম। ‘বুলবুল-ই সিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত হাফিজ। তাঁর কবিতাকে বলা হয়ে থাকে ‘লিসান উল গায়েব’ (‘অজ্ঞাতের বাণী”) এবং ‘তরজমান-উল-আসরার’ (রহস্যের মর্মসন্ধানী)। আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তাঁর জন্ম এবং ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে এই কবির মৃত্যু। নিজের জীবনযাপন এবং সৃষ্টির প্রতি হাফিজ ছিলেন খুবই নিরাসক্ত– উদাসীন। ফলে তাঁর কবিতার কোনো সংগ্রহ তিনি নিজে করে যাননি। মৃত্যুর প্রায় একুশ-বাইশ বছর পর কবির বন্ধু মুহম্মদ গোলাবন্দ ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে হাফিজের কবিতার প্রথম সংকলন করেন। সেটিই ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ নামে পরিচিত। হাফিজের প্রায় পাঁচ শতাধিক কবিতা এই সংকলনে আছে। এবং মনে করা হয় এর বাইরে বহু কবিতা হারিয়ে গেছে। হাফিজের কবিতা গীতিকবিতা, গজল গান। লেখামাত্র তা মুখেমুখে গীত হত এবং ধর্মমন্দির থেকে পানশালা সর্বত্র তাঁর কবিতার ছিল অবাধ বিস্তার। হাফিজের কবিতা কাব্য ও দর্শন তত্ত্বের জন্য সারা বিশ্বে সমাদৃত। প্রাচীন গবেষকরা তাঁর কবিতার শুভ অশুভের ধারণার ব্যাখ্যা খুঁজেছেন। আর আধুনিক গবেষক- কাব্যপ্রেমীরা হাফিজের কবিতার ভাষার রহস্যঘনতায়  এবং দর্শনে আকৃষ্ট হয়েছেন। হাফিজের ‘দিভান’ লিরিক কবিতা অধিকাংশ পারসি ভাষায় রচিত এবং সামান্য অংশ আরবি গজল । ‘দিভান’-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল গজল। হাফিজকে পারসি গজল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়। তাঁর কবিতায় বসন্ত গোলাপ বুলবুল মদিরা যৌবনের সৌন্দর্য এবং প্রেমিকা ও প্রেমাস্পদের রূপসৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে। এসব বর্ণনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে তাঁর কবিতা ঐশ্বরিকতার আরতিতে নিবন্ধ। হাফিজের কবিতা অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতায় ভরা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি-প্রেম নিবেদন। প্রেম ও পূজা তাঁর কবিতায় একাকার। তাঁর কবিতা দ্ব্যর্থবোধক এবং পরোক্ষ ইঙ্গিতময়। প্রেমের শরাব পান করে তিনি প্রেমাস্পদের বা আরাধ্যের সমীপে উপস্থিত হবেন। এই উপস্থিতির জন্য চাই একটি যোগ্যতা। চাই নিজেকে প্রস্তুত করা এবং প্রেমিকার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের সমস্ত অর্জিত অধ্যবসায় নিমেষে মিথ্যে হয়ে যায়। হাফিজ একটি কবিতায় লিখেছেন :

‘দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সাধনায় আমার অন্তরে যে জ্ঞান-বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত হয়েছে

ভয় হয়, না জানি প্রেমিকার চোখের চাহনি

তা হরণ করে নিয়ে যায়’ …

হাফিজ যুক্তির বদলে প্রেমের পথকেই শ্রেষ্ঠ বলে বেছে নিয়েছিলেন। মর্ত- মানবতা তাঁর চোখে ছিল এক রহস্যময় জীবনময়তা। যে রহস্য অভেদ্য। মতের দিক থেকে হাফিজ সুফী সাধক। ঈশ্বরতত্ত্ব মঠ  মসজিদ দর্শন আচারবিচারের পথ তিনি এড়িয়ে গেছেন। হাফিজের  মৃত্যুর একশো বছরের মধ্যেও তাঁর কোনো জীবনী লেখা হয়নি। ফলে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত অনেক আলোআঁধারিতে ভরা। অনেক গল্পগাথা নির্ভর।

   মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন হাফিজের কবিতার  পাঠক। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত তিনি হাফিজের গজল আবৃত্তি করতেন। প্রার্থনাকালীন যে ঘন্টাধ্বনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যবহার করতেন তার গায়ে তিনি হাফিজের এই কবিতাটি খোদাই করে রাখেন :

‘বিচার পথে চলতে গিয়ে কিসের স্বস্তি

এখানে যে সর্বদা যাত্রার ঘন্টাধ্বনি নিরন্তর  করে   ফরিয়াদ 

                                                  চল চল’…

পারস্য ভ্রমণকালে১৯৩২-এ এক ভাষণে হাফিজ সম্পর্কে  রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমার পিতা ছিলেন হাফেজের অনুরাগী ভক্ত। তাঁর মুখ থেকে হাফেজের কবিতার আবৃত্তি ও তার অনুবাদ অনেক শুনেছি। সেই কবিতার মাধুর্য দিয়ে পারস্যের হৃদয় আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। (রবীন্দ্ররচনাবলি  দ্বাবিংশ খন্ড পৃ৫১২)।

   মধ্যপ্রাচ্য থেকে চতুর্দশ শতকের হাফিজ জার্মান অনুবাদে বিশ্বকবি গ্যোয়েটের হাতে পৌঁছয় ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে। হাইমারের রাজসভায় থিয়েটার ঘরের প্রযোজক-পরিচালক হিসেবে গ্যোয়েটে দীর্ঘ সাতাশ বছর কাজ করেছেন। এই সুবাদে তাঁকে অন্যদেশের নাটকেরও খোঁজ খবর রাখতে হচ্ছিল। সেই অন্বেষণের সুবাদে গ্যোয়েটে পড়ে ফেলেন কালিদাসের শকুন্তলা মেঘদূত, নল দময়ন্তী উপাখ্যান। এমন কী শিখতে শুরু করেন দেবনাগরী ভাষা। সেই গরজ থেকেই তাঁর হাতে আসে হাফিজের ‘দিভান’; প্রাচ্যবিদ যোসেফ ফন হামায় পূর্গস্টাল (১৭৭৪-১৮৫৬)-এর জার্মান অনুবাদে (১৮১১)। ততদিনে গোয়েটের প্রিয় বন্ধু শিলারের মৃত্যু তাকে ম্রিয়মান করে রেখেছে।এবং নেপোলিয়নের যুদ্ধযাত্রা গ্যোয়েটের ধ্রুপদি মূল্যবোধের জগৎটিকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। অতঃপর ১৮১৪ সালে নেপোলিয়নের এলবা দ্বীপে নির্বাসন ঘটলে মুক্তির আস্বাদ পেলেন গোয়েটে। স্বাধীনভাবে এবার সারা জার্মানির ভিতর অবাধ স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত সম্ভব হল তাঁর। হ্বাইমার শহর থেকে বেরিয়ে গ্যোয়েটে এ সময় ফিরলেন তাঁর স্বপ্নের বাসভূমি শৈশব কৈশোর স্মৃতিবিজড়িত রাইন মাইন অঞ্চলে।  তাঁর এই যাওয়া যেন  মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনায় যাত্রার মতো আনন্দময় শান্তি যাত্রা। তিনি এঁকে চিহ্নিত করে রাখলেন ‘হিজরা’ বা ‘হিজরি’ হিসেবে। ‘প্রাচী-প্রতীচীর মিলনবেলার পুঁথি’-র গ্রন্থ আরম্ভ হল ‘হিজরা’ শিরোনামে। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু তাঁকে নিরাশ্রয় করেছে আর নেপোলিয়নের দ্বীপান্তরের অনুকূল পরিবেশ তাঁকে মুক্ত করেছে। এই পরিসরে গ্যোয়েটে আশ্রয় খুঁজেছেন হাফিজের কবিতার ভেতর। হাফিজের ‘দিভান’ / ‘দিওয়ান’ পাঠের জন্য প্রস্তুত করছেন নিজেকে। পারসি ভাষায় পাঠ দিতে পারবেন হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন্ অধ্যাপক এ নিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকলেন গোায়েটে। এমনকী ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছিল হাফিজের ‘দিভান’ আবু তালিব শানের সম্পাদনায়—সেই আলোড়িত সাহিত্যিক সংঘটনের খবরও রেখেছেন গ্যোয়েটে। কলকাতার টিপু সুলতানের (১৭৪৯-১৭৯২) প্রাচ্য সম্পর্কিত গ্রন্থাগারে আসার কথাও তিনি ভাবছেন। ততদিনে তিনি আরবি ভাষা শিখে ফেলেছেন। তন্নতন্ন করে কোরান পড়ে ফেলেছেন। ভলতেয়ারের লেখা রূপক নাটক “মহম্মদ (১৭৭২) অনুবাদ করেছেন, এমনকী সে নাটক মঞ্চায়নেও তিনি হাত দিয়েছেন (১৮০০)। পয়ষট্টি বছর বয়সে গ্যোয়েটে আরবি ভাষা শিখে যেন ‘আরববিশ্বের সঙ্গে জীবনযোগ হল তাঁর।’ তারপর হাফিজের দিওয়ান / দিভান- এর প্রসাদে তিনি রচনা করলেন তাঁর দিভান ‘West-Oestlicher Divan’ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের বঙ্গানুবাদে ‘প্রাচী-প্রতীচীর মিলনবেলার পুঁথি’ তিটি গুচ্ছের মিলনবেলার পুঁথি’। এমনকী এই দিভানের তত্ত্ব পাঠককে বোঝানোর জন্য ১৮২৭-এ গ্যোয়েটে ‘অনুপুঙ্খ গদ্যময় টীকাটিপ্পনী’ লিপিবদ্ধ করেন।

এক সাক্ষাৎকারে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, ‘অনেকেই জানেন তাঁর সাহিত্যে কোরানের বিভিন্ন অংশের চূড়ান্ত প্রভাব লক্ষণীয়। তাঁর একটি মন্ত্র — ঈশ্বরের নিজস্ব এই প্রাচী! / ঈশ্বরের নিজস্ব এই প্রতীচী ! / যা কিছু রয় উত্তরে ও দক্ষিণাঞ্চলে / শান্তি নিয়ে জড়িয়ে আছে তারি তো করতলে’ (হিজরা / মন্ত্রপূত) –এই যে উৎসটা অনেকদিন জানতাম না। একদিন কোরান পড়তে গিয়ে দেখি, তার একটি বিশেষ সুরাতে দেখা যাচ্ছে, কোরান থেকে একেবারে এই অংশগুলি ছন্দায়িত করে তুলেছিলেন। হাফিজ অনুবাদ করতে গিয়ে ইসলামের বিশ্বপ্রেমের যে জায়গাটা সেটাকে গুরুত্ব দিতে কী অসামান্য পরিশ্রম করে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন গ্যোয়েটে।’  এই পরিশ্রমকে অলোকরঞ্জন বলেছেন একটি অনুবাদের জন্য ‘চ্যালেঞ্জসঞ্চারী’ প্রস্তুতি। হাফিজের ‘দিওয়ান’-এর প্রেমের ভুবনে গভীর সামীপ্য অনুভব করেছেন গ্যোয়েটে। তাঁর

 ‘দিভান-এ  গ্যোয়েটে কখনও নিজেই হয়ে উঠেছেন প্রেমিক হাফিজ, কখনও হাফিজ সৃষ্ট চরিত্র হাতেম। আর কবির প্রেমিকা মারিয়ানে যেন ‘জুলেখা’ (জুলাইখা) রূপে দেখা দিয়েছেন। গ্যোয়েটের হাতে এই যে ব্যক্তিত্বের বদল এ যেন স্থান-কাল- অতীত চিরায়ত প্রেমের পথে কালের যাত্রা। আজ  যখন রাজনীতি ধর্ম নিয়ে সংকীর্ণ সংঘর্ষের বাতাবরন চারিদিকে, আজ থেকে ২০০ বছর আগে গ্যোয়েটে জানিয়ে দিতে পেরেছেন ‘আমাদের ঐশ্বর্য ভালোবাসা।’ সেই ভালোবাসার ভুবন রচনা করতে গ্যোয়েটে বারবার স্মরণ করেছেন হাফিজকেই। সমগ্র কাব্য জুড়ে হাফিজের প্রতি মুগ্ধতা, হাফিজের কালজয়ী প্রেমের ভুবনে এবং দর্পণে গ্যোয়েটে যেন আত্মদর্শন করেছেন। তাঁর প্রেমিক সম্ভার—

১. তামাম দুনিয়া যদি বিলুপ্ত হয় রসাতলে

হাফিজ আমিও  তোমার সঙ্গে  সমধাবমান

আমরা দুজন সত্যিকারের যমযজ, তাহলে

তৃষ্ণা মেটানো হোক না আমার প্রাণের আধান’       (সীমাশুন্য/ হাফিজনামা)

২. ‘সন্ত হাফিজ ‘মরমী জিহ্বা মূল’

ওরা অভিহিত করেছে তোমায় ঠিক।

কিন্তু তোমার শব্দের মর্যাদা

ধরতে পারেনি কোন ভাষাতাত্ত্বিক।’

             ( বিশদ রহস্য/হাফিজনামা)

৩. ‘ওদের পক্ষে দুরূহ অনধিগত

  তোমার তত্ত্ব ছুঁয়েছে মর্মকেই

  ধর্মধ্বজ না হয়েও তুমি এক

  সিদ্ধ পুরুষ বোঝার মানুষ নেই।’

                           (বিশদ রহস্য / হাফিজনামা)

৪. ‘তাহলে হাফিজ তোমার গীতিমাধুরী

এবং তোমার দিব্য উদাহরণে

সুরাপাত্রের নিক্বনে যেতে পারি

যেন আমাদের বিধাতার নিকেতনে

             (সৃজন এবং প্রাণসঞ্চার /গায়েনপুঁথি)

  গ্যোয়েটের ‘দিভান’ ১২টি পর্বে বিন্যস্ত। গায়েনপুঁথি, হাফিজনামা, ইশকনামা, অবলোকনের পুঁথি, অসন্তোষের পুঁথি, প্রবচন মঞ্জুষা, তৈমুরনামা, জুলেখার পুঁথি, সাক্ষী-নামা, রূপক পুঁথি, পারসিক পুঁথি, বেহেশতের পুঁথি। এই ১২টি পুঁথিকে চারটি গুচ্ছে ভাগ করা যায়। প্রথম তিনটির উদ্দিষ্ট-ব্যক্তি হাফিজ, পরের তিনটি গুচ্ছের বিষয় চিন্তন। এবং সাত আট নয় পুঁথির বিষয় ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। শেষ তিনটি পরিচ্ছেদের বিষয় ধর্ম সমস্যা। অন্যদিকে কোনো কোনো অংশে চূর্ণ হয়ে মিশে আছে প্রাচ্যপ্রবচন দ্বারা প্রাণিত সূক্তিসমূহ। ‘হাফিজনামা’তে আছে হাফিজের প্রতি ‘জার্মান কবির ধন্যবাদ’। ‘পৃথিবীর যত শ্রেষ্ঠ পুঁথির সার প্রেমের এই গ্রন্থখানি।’ গ্যোয়েটের ভাষায় ‘গ্রন্থের গ্রন্থ’ হাফিজের ‘দিভান’। গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ শেষে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি টীকাটিপ্পনী অংশ সংযুক্ত করেছেন ‘কবিতাসূচি ও অনুষঙ্গ’ নামে। সেখানে গ্যোয়েটের অনুষঙ্গের পাশাপাশি হাফিজ এবং আরব সংস্কৃতির অনেক সুরম্যতার সংযোগ ঘটেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত ‘দিভান’ নারী-পুরুষের প্রেমের বৈজয়ন্তীতে গ্যোয়েটের হাতে ‘বিশ্বপ্রেমেরই’ ‘অনিবার্য অর্ঘ্য’ হয়ে উঠেছে।

সাহিত্য যে শুধু সাজানো গোছানো হরফের বিন্যাস নয়, আমাদের বাঁচার একটি উপকরণ উপচার এই প্রবর্তনা থেকেই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রেমের এই গীতিগুচ্ছ বাংলায় অনুবাদ করার প্রয়াসী হয়েছেন। বাংলা অনুবাদগ্রন্থে র ভূমিকায় অলোকরঞ্জন জানান, ‘এক এক সময় সত্য ঘটনাকেও কল্পকথার মতো মনে হয়….। হাইডেলবার্গে ইকবাল নামাঙ্কিত সৈকতে বেড়াতে বেরিয়ে কবির সঙ্গে পরিচয় হয় এক তরুণ যুগলের। মেয়েটির জন্ম শহর লক্ষ্ণৌ, আর ছেলেটি ভিয়েনার। ওদের হাতে ইকবালের উর্দু কাব্যগ্রন্থ ‘পয়গাম-ই-মশরিক’ (প্রাচ্যবাণী / (১৯২৩) এবং গ্যোয়েটের কালজয়ী মহাকাব্য ‘West-Oestlicher Divan’ (‘প্রাচী-প্রতীচীর দিভান’ / ১৮১৯)। এই দুই বইয়ের অনুরণনে তাদের সঙ্গে আলাপের নিবিড়তা গড়ে ওঠে।

 তারপর বাড়িতে নিয়ে এসে মুখে মুখে গ্যোয়েটের বইটি থেকে অনুবাদ করে বেশ কয়েকটি গীতিকবিতা শোনান, অলোকরঞ্জন।  যাবার সময় সেই যুগল অনুরোধ করে— ‘এ বই আপনি বাংলা ভাষায় আমাদের মতো অন্যান্য আরো নবীন যুগলের জন্য অনুবাদ করুন।’ ‘প্রেম ও বিশ্বপ্রেমের সম্পন্ন’ সেই বইয়ের বাংলা  তর্জমার হাতছানি তখন থেকেই শুরু।… তারপর একদিন খবর এল  পরিণয়ের প্রাক্কালে জাতিদাঙ্গা মেটাতে গিয়ে সেই তরুণ তরুণী   খুন হয়ে যান ‘এথনিক শিবিরতন্ত্রের’ শিকার হয়ে। সেই বিষাক্ত মৌলবাদের বিরুদ্ধেই গ্যোয়েটের ওই বই যেন এক অঙ্গীকারবদ্ধ প্রতিবাদ। একদিন মরমি কবি হাফিজের অনুষঙ্গ ছুঁয়ে গ্যোয়েটে জার্মান ভাষায় এই বই লেখেন বন্ধুত্বের এষণাকে আরও বাড়িয়ে দিতে, সেই সঙ্গে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে নান্দনিক প্রতিবাদ জানাতে।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এ-বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘প্রাচী-প্রতীচীর মিলনবেলার পুঁথি’ উৎসর্গ করেন ‘মৌলবাদের বিরুদ্ধে, প্রেমের সপক্ষে।’ সেলিমা-পিটার লক্ষ্ণৌ আর ভিয়েনার তরুণ তরুণী—যাঁরা মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার সংক্রাম আটকাতে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদেরই মতো দুঃসাহসিক প্রেমিক-প্রেমিকার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন এই অনুবাদ। এবং এই এষণা ব্যক্ত করেন একদিন ইকবাল- হাফিজ- গ্যোয়েটের যৌথ পৌরোহিত্যে পৃথিবীতে সংস্কৃতির ‘খণ্ড ক্ষুদ্র মানচিত্র’ মুছে যাবে এক বৃহৎ বিশ্বনিখিলের মিলন দ্যোতনায়। এমনই স্বপ্ন দেখেছেন অনুবাদক বিশ্বপথিক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প
নয়ন আহমেদ on যুদ্ধশিল্প