কাজী জহিরুল ইসলাম
কবি নয়, এককভাবে বাংলা ভাষার সর্বাধিক পঠিত কবিতা যদি খুঁজতে যাই, দুটি কবিতার নাম উঠে আসে সবার ওপরে। একটি কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী“, অন্যটি জীবনানন্দ দাশের “বনলতা সেন“। এই দুটি কবিতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আলোচনাও হয়েছে সবচেয়ে বেশি। জসীম উদদীনের “নিমন্ত্রণ“ এবং “কবর“, রবীন্দ্রনাথের “সাধারণ মেয়ে“, সুনীলের “কেউ কথা রাখেনি“, আল মাহমুদের “সোনালী কাবিন“, শামসুর রাহমানের “স্বাধীনতা তুমি“, রফিক আজাদের “ভাত দে হারামজাদা“, সৈয়দ শামসুল হকের “পরাণের গহীন ভিতর“ প্রভৃতিও বহুল পঠিত কবিতা। তবে জীবনানন্দ দাশের “বনলতা সেন” শুধু বহুল পঠিতই নয়, এই কবিতা নিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক কৌতুহল। ভিঞ্চির মোনালিসার মত বনলতা সেন হয়ে উঠেছে বাঙালির এক রহস্যময় নারী চরিত্র। অনেকেই অনুসন্ধান চালিয়ে বের করার চেষ্টা করেছেন কে এই বনলতা সেন? আদৌ কি নাটোরে কোনো অনিন্দ্য সুন্দরী বনলতা সেন ছিলেন, যিনি কুহেলিকাময় কবি জীবনানন্দ দাশকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন?
আমলা, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক আকবর আলী খান লিখেছেন, নাটোরে চাকরি করতে গিয়ে ব্রিটিশ আমলের নথিপত্র ঘেঁটে তিনি আবিস্কার করেন একসময় নাটোরে বারবনিতাদের আখড়া ছিল এবং বনলতা সেন তাদেরই একজন। যে স্নিগ্ধ, অনিন্দ্য, মায়াবী ইমেজ বনলতা সেন নামের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে বাঙালি-মানসে, আকবর আলীর এই অনভিপ্রেত আবিস্কারে তাতে বড়োসড়ো একটি ধাক্কা লাগে। কবিতায় লেখা বনলতা সেন বা নীরাকে যদি আমরা এভাবে খুঁজি তাহলে বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। নাটোর এবং বনলতা সেন দুটোই মেটাফোরিক। মেটাফোর বলেই থেমে যাওয়া যেত হয়ত। কল্পনায় এক সুন্দরী বনলতা সেনের ছবি এঁকে নেওয়া যেত। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ এমন এক কবি যিনি তার প্রায় সমস্ত সাহিত্যকর্মে নিজেকেই এঁকেছেন। তাই কোনো এক রক্তমাংসের বনলতা সেন যে তাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন এটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। কিন্তু কে সেই বনলতা সেন? শাহাদুজ্জামান রচিত জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক-জীবনীগ্রন্থ “একজন কমলালেবু“ পড়তে পড়তে আমি মনে হয় বুঝে ফেলেছি কে সেই বনলতা সেন। তিনি আর কেউ না, তারই কাকাত বোন শোভনা দাশ বেবী।
শোভনার নিবিড় সান্নিধ্য তিনি মাত্র একবারই পেয়েছিলেন। প্রথম বই “ঝরা পালক“ তিনি উৎসর্গ করেন কোনো এক নামহীন কল্যাণীয়াসুকে। ঝরা পালক বের হয় ১৯২৭ সালে। কে এই কল্যাণীয়াসু তা আমরা জেনে যাই জীবনানন্দের ডায়রি থেকে। বইটি প্রকাশের পর ডাকযোগে কলকাতা থেকে আসামে শোভনা দাশকে তিনি পাঠিয়ে দেন। শোভনা এতে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন এবং উৎসর্গপত্রে নিজেকে আবিস্কার করে বইটি লুকিয়ে রেখেছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে জীবনের শেষ দিককার অনুরাগী ভূমেন্দ্র গুহ খুঁজে বের করেন শোভনাকে। একদিন তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। লাঠিতে ভর দিয়ে বার্ধক্যে উপনীত, ফর্শা, ছিপছিপে, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার শোভনা ভূমেন্দ্রর সামনে এসে দাঁড়ান। এক পর্যায়ে শোভনা বলেন, ‘আমি নিজের জীবন নিয়েই তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, মিলুদার কবিতার খোঁজ-খবর আর রাখতে পারিনি…খুব মনে আছে তার প্রথম কবিতার বইটা আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন।’
পিতার ব্রাহ্মসমাজ-যোগসূত্রে প্রাপ্ত ব্রাহ্ম এডুকেশন সোসাইটি-প্রতিষ্ঠিত সিটি কলেজের চাকরি চলে গেলে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন। এ সময়ে তিনি হতাশ এক যুবক। বাগেরহাটের পিসি কলেজে মাস কয়েকের জন্য একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক নেয়া হবে জেনে তাতে যোগ দেন। কিন্তু মেয়াদ শেষে আবার ফিরে আসেন বরিশালে। আয়-রোজগার নেই, কবিতা লিখেও আশানুরূপ স্বীকৃতি কিংবা অর্থ কিছুই মিলছে না। বরং তার কবিতা ও তাকে নিয়ে কলকাতার বোদ্ধা সমাজ ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপই করছে বেশি। ঠিক এই সময়টাতে আসামের বন বিভাগের কর্মকর্তা তার কাকা অতুলানন্দ চিঠি লিখে মিলুকে আসামে যেতে বলেন। কত লোকই তো বনের কাঠ বেচে ধনী হচ্ছে। মিলু চাইলে কাঠের ব্যবসাও করতে পারে। জীবনানন্দের মনে যতটা না প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তার চেয়েও অধিক শোভনার সান্নিধ্য পাবার আগ্রহ মাথাচারা দিয়ে ওঠে।
আসামে গিয়ে শোভনার নিবিড় সান্নিধ্য তিনি পেয়েছিলেন। আসামের ডিব্রুগড়ে কাটানো সময়কালে তিনি যে শোভনার নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তা তার ডায়রিতে লেখা আছে। শোভনার প্রতি তার প্রেম ছিল তীব্র, সমস্ত জীবন এই প্রেমেই তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন, স্ত্রী লাবণ্য দাশের সঙ্গে তার একটি স্বাস্থ্যসম্মত দাম্পত্য সম্পর্ক কখনোই গড়ে ওঠেনি।
কনভেন্টে পড়া শোভনা আর সকলের চেয়ে আলাদা। তার হাঁটাচলা, কথা বলা, সাজ-পোশাক সবই ভিন্ন। গোল বা চৌকোনো নয়, তিনি পরেন সরু চশমা, মাথার মাঝখানে প্রচলিত সিঁথি নয়, তিনি সিঁথি করেন মাথার এক পাশে। জীবনানন্দদের বাড়িতে যৌথ পরিবারের একটি গ্রুপ ছবি আছে। সেই ছবিতে মিষ্টি মুখের তন্বী শোভনাকে দেখা গেছে সামনের দিকে ঝুঁকে বিশেষ এক কায়দায় তাকিয়ে আছেন ক্যামেরা তথা পৃথিবীর দিকে। এই দৃষ্টিই মিলুকে খুন করেছে।
শোভনা তখন হাই স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। নতুন বর্ষার উচ্ছলতা দেহ ও মনে। কনভেন্ট স্কুলের বাস এসে সকালে নিয়ে যায় শোভনা ওরফে বেবীকে। সারাদিন মিলু অপেক্ষা করে কখন ফিরবে তার শোভনা। স্কুল থেকে ফিরলে বাংলোর কোনো এক ঘরে দরজা বন্ধ করে গল্পে মেতে ওঠে দুজন। কথা ওঠে বই উৎসর্গ নিয়েও। শোভনা জানতে চায়, আচ্ছা মিলুদা তুমি আমাকে বইটা উৎসর্গ করতে গেলে কেন? জবাবে জীবনানন্দ তাকে শুনিয়ে দেয় একটি কবিতা ‘তুমি এই রাতের বাতাস,/ বাতাসের সিন্ধু-ঢেউ,/ তোমার মত কেউ/ নাই আর।/ অন্ধকার – নিঃসাড়তার/ মাঝখানে/ তুমি আনো প্রাণে/ সমুদ্রের ভাষা,/ রুধিরে পিপাসা,/ যেতেছ জাগায়ে,/ ছেঁড়া দেহ – ব্যাথিত মনে ঘায়ে/ ঝরিতেছে জলের মতন,-/ রাতের বাতাস তুমি, – বাতাসের সিন্ধু- ঢেউ/ তোমার মতন কেউ/ নাই আর।’
এই কবিতা পড়ার পরে কী মনে হয় না যে কবি, প্রেমিক তৈরি হচ্ছেন ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি লেখার জন্য? সেই সময়ে জীবনানন্দ দাশ তার ডায়েরিতে লেখেন, “A (blind) love does so much injury”. তিনি তখন শোভনার প্রতি অন্ধ প্রেমে নিমজ্জিত। এরপর তার ডায়েরিতে পাওয়া যায়, ” Love & Kiss & everything – but all she refuses on her health ground, hot water bag and all that”. এই সাংকেতিক ইংরেজি নোটের অর্থ এরকম হতে পারে, ডিব্রুগড়ের বাংলোতে কোনো এক নির্জন কক্ষে জীবনানন্দ শোভনাকে চুমু খেয়েছিলেন। তিনি আরো ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে শোভনা বাঁধা দিয়েছিলেন ঋতুস্রাব চলছিল বলে। শোভনা পেটে ব্যাথার কারণে হট ওয়াটার ব্যাগ ব্যবহার করছিলেন সেটি উল্লেখ করে তার শরীর খারাপের কারণ স্পষ্ট করেছেন।
ডিব্রুগড়ের স্মৃতি নিয়ে জীবনানন্দ আরো লিখেছেন — ‘এই তো সেদিন/ ডিব্রু নদীর পাড়ে আমরা ঘুরছিলাম/ মনে হয় যেন হাজার বছরের ওপারে চলে গিয়েছ তুমি/ শুধু অন্ধকারে বাবলা ফুলের গন্ধ যখন পাই/ কিংবা কখনও কখনও গভীর রাতে ঘাস মাড়িয়ে/ তারার আলোয় সেই ব্যথিত ঘাসের শব্দ যখন শুনি/ রক্তের বিমূঢ় উত্তেজনায়/ যখন তোমাকে আমি পাখির মত পাখিনীর কাছে পাই’
শোভনাকে তিনি কিছুতেই পাবেন না। এক পরিবারের হলেও আর্থিক সঙ্গতির দিক থেকে মিলু শোভনার স্বামী হবার যোগ্যতা রাখে না। তা ছাড়া হিন্দু সমাজে এ-ধরণের বিয়ে গ্রহনযোগ্য নয়।
শোভনার ছবি হৃদয়ের কেন্দ্রে নিয়েই তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ততদিনে শোভনাও এই ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। মিলু দাকে স্বাভাবিক করতেই তিনি চিঠি লিখে জানান, দাদার বিয়েতে অনেক আনন্দ করতে তিনি বরিশালে আসছেন। বিয়ে বাড়িতেও জীবনানন্দ নানান অজুহাতে শোভনার সান্নিধ্য পেতে চেয়েছেন।
বাকী জীবনেও শোভনার সান্নিধ্য পাবার অনেক চেষ্টা তিনি করেছেন কিন্তু শোভনা খুব কমই সাড়া দিয়েছেন। সমস্ত জীবন এই একটি নারীই তার অস্তিত্ব জুড়ে বর্তমান ছিল। ডিব্রুগড়ের বাংলোতে শোভনার সঙ্গে কাটানো দুদণ্ড সময়ই ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ক্রিস্টোফার মার্লোর সেই বিখ্যাত লাইনের মত, ‘হেলেন হে প্রিয়তমা, আমাকে অমর করো একটি চুম্বনে’, শোভনার ঠোঁটে ঠোঁট রাখাই হয়ত জীবনানন্দকে অমর করেছে। তিনি লিখেছেন,
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
ডিব্রুগড়ের ঘটনার প্রায় ৬/৭ বছর পরে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ১৯৩৫ সালে ছাপা হয় ‘বনলতা সেন’। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং অধ্যাপক ছিলেন। পশ্চিমের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা, প্রচুর পড়তেন। অ্যাডগার অ্যালান পোর ‘টু হেলেন’ কবিতাটি তার না পড়বার কথা না। নানান সময়ে ডায়েরিতে তিনি যেসব বিদেশি কবির কথা লিখেছেন তাদের মধ্যে পো-এর নামও পাওয়া যায়। অনেকে বলেন, পো-এর টু হেলেন পড়েই তিনি বনলতা সেন কবিতাটি লিখেছেন। আমি মনে করি, সেই কবিতাটির দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারেন তবে অ্যালান পো’র টু হেলেনের চেয়ে জীবনানন্দের বনলতা সেন অনেক বেশি উঁচু মাপের কবিতা। আজকের এই রচনায় বনলতা সেনকে আবিস্কারের খানিক চেষ্টা করলাম মাত্র। অন্য আরেকদিন কবিতাটির সাহিত্য-মূল্য নিয়ে আলোচনা করবো।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২১ এপ্রিল ২০২২।