১. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোন টি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
আমার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ‘পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে।’ এইটা প্রকাশ হয় ২০০৩ সালে। আসলে এই বইয়ের আগেও ২টা বইয়ের পান্ডুলিপি ছিল আমার হাতে। সেইগুলারে প্রকাশ করি নাই। প্রথম বই অত্যন্ত আবেগঘনিষ্ট হয় যেকোনো লেখকের কাছে। বইটার অনেক কবিতা আজও আমি পড়ি। অনেক অদেখা ও অবলা মানডেন জিনিসপত্র কবিতায় রিভিল হইছিল।
নিজের কাব্য শৈশবরে পিছে ফিরে দেখার মতো আনন্দ দেয়। বোধ ও আবেগের গভীরতা, ভাবালুতা, বাংলার ঐতিহ্যচিন্তার পুনর্গঠন, নতুন সাহিত্য করার যে নিয়ত ও বীক্ষা ঐ বইতে ছিল। বইটা আমার নিজের প্রকাশনা হাউজ থাকি বার করছিলাম।বইটা পাঠকের অনেক আগ্রহ জাগানিয়া প্রতিক্রিয়া আছিল। প্রথম আলোতে আমার বইটার একটা রিভিউ করছিল। ঐ রিভিউটা বইয়ের কবিতার অনেক অনেক দিক উন্মোচন করছিল।
২. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
হাজার বছরের বাংলা কবিতার ঐতিহ্য আমাদের সাহিত্য কবিতায় সক্রিয় আছে। চর্যাপদ, মধ্যযুগের পুথিসাহিত্য, ভাবান্দোলনের মরমি কবি, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, পদাবলি সাহিত্য আমারে বাংলার ভাব রসের দিকে যাওয়ার প্রেরণা দিছে। রবীন্দ্র-নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন, ফররুখ, আল মাহমুদ, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদারসহ আরও অনেক শক্তিশালী কবি আমারে জাগায়ে রাখছেন। এছাড়া উর্দু ও ফারসি কবিতার ঐতিহ্য আমার বড়ই প্রিয়। তাদের কবিতার স্টাইল, ভাবসৌন্দর্য্ থাকি শিখনের ও বুজের অনেক ব্যাপার আছে। অনেক সিক্রেট তারা রাখি গেছেন কবিতায়। এই যে সরণি তা বাঙলা কবিতার অনেক রূপ রসের সাধনার পথ। এদের কবিতার রসদ আগামী কবিতারে ডিকটেইট করবে। সিরিয়াস পাঠকদৃষ্টি নতুন কবিদের জন্য সবসময়ই পাথেয়।
৩. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
এ যাবত আমার কবিতার বই ১২টা, চিন্তামূলক বই ২টা, অনুবাদ ১টা ও সাক্ষাৎমূলক বই ১টা প্রকাশিত হইছে। আমার কবিতার বইগুলি হইল: পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩, গোস্তের দোকানে (২০০৭),ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০), পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১২), খড়কুটো পাশে (২০১৪), আয়না বিষয়ে মুখবন্ধ (২০১৬), আম্মার হাঁসগুলি (২০১৭), বউ কয় দেখি দেখি (২০১৮) বকুলগাছের নিচে তুমি হাসছিলা (২০১৯), আম্মার আরও হাঁস (২০২০), আমি ও জহির (২০২১) ও রইদের ডাইরি (২০২৩)।
’আম্মার হাঁসগুলি’ বইটা পাঠকের হাতে বেশি গেছে। অনেকেই বইটা নিয়ে বলে আমারে। কিন্তু অন্য বইগুলা পাঠকের কাছে ঠিকমতো হয়ত যায় নাই। কবির কাছে কোন বইটি সবচাইতে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলা সত্যিই কঠিন। নিজের দিকে আলো ফালাইলে চোখে অন্ধকার দেখি। সব কবিতা শিল্পই একদিন ধূসরিত হয়। বাঁচি থাকে হয়ত হাতেগোনা কয়েকটা কবিতা। পাঠকেরও কবিতার ভারবহনের দায় হয় কঠিন। এত কবিতার ভিড়ে ভালো কবিতা বাছাই করা ছাড়া উপাই থাকে না। তাই সকল কবিই সবসময় উপযুক্ত পাঠকের অনুপস্তিতি ফিল করতে থাকেন।কবিদের আসলে কোনো সন্তুষ্টি বলি কিছু থাকা ঠিক না!
৪. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
’রইদের ডাইরি’ আমার নতুন কবিতার বই। গত মেলায় বার হইছিল। অস্তি-নাস্তি, শূন্যতা ও মৃত্যুবোধ, অস্তিত্বের টেমপোরাল জিনিসটার পীড়া ইত্যাদি এই বইয়ের কবিতাগুলাতে আসছে।
৫. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
নব্বই দশক হইতে আমি লিখতেছি। এখনও লিখি। কবিরা সব দশকেই ভ্যালিড। এমন কি মৃত কবিও!
৬. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
আমার সমকাল আমারে পীড়া দেয়।আবার অনেক আশা দেখায়। চারদিকে নানা চিন্তার রঙবৈচিত্র উদগিরণ লক্ষ্য করতেছি। নতুন কিছু করার তাড়না অনেকের মধ্যেই আছে। চিন্তা-শূন্য লিখা শুকনা রসকষহীন লিখাও লিখতেছে অনেকে বেশি । ফেইসবুক এই রোগবালাই ছড়াইছে। তবে মানুষকে তার বর্তমান দিয়া বিচার করা ঠিক না। হয়ত কেউ হঠাৎ জ্বলি উঠে। অনেক খারাপ লিখত আগে, এখন অনেক ভালো লিখতেছেন এমন অনেক লিখক আছেন। অতএব সমকাল নিয়া কিছু বলা কঠিন। অনেক অনেক লিখা বাংলাদেশে এখন লিখা হইতেছে যা বাংলাদেশের কবিতা, সাহিত্য , শিল্পকলা সেই ভাবটা আসছে। কলকাতা কেন্দ্রিকতা এখন বাংলাদেশের সাহিত্যে নাই। এইটা ভালো লক্ষণ। স্বাতন্ত্র না থাকলে বাচনের দরকার কী!
৭. স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্য–কোন ধারায়? কিভাবে প্রবাহিত হয়েছে– হচ্ছে–বলে আপনি মনে করেন?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব ও পরের সাহিত্যের ভিতর দুই ভিন্ন ধারা। ফররুখ আহমদ সৈয়দ আলী আহসান আবুল হোসেনদের কবিতার দিকে তাকান। স্বাধীনতা পূর্ব সাহিত্যের ভিতরও নানা রং বৈচিত্র ছিল । প্রচ্ছন্ন একক পাক্স্তিানের যেমন স্বপ্ন ছিল , তেমনি পূর্ব বাংলার আলাদা হওয়ার চিন্তা আকুতিও ছিল পাকিস্তানের সাহিত্যে। উর্দু ও বাংলা সাহিত্যের একটা গভীর লেনদেন হওয়ার আগেই যেন পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে গেল। প্যান-ইসলামিক ভাব ধারার সাহিত্য আর মাথা তুলি দাড়াইতে পারলো না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন একটা সাহিত্য আমরা পাইলাম। পশ্চিম বঙ্গ কেন্দ্রিক একটা বাংলা সাহিত্য হইতে আমাদের বাহির হইতে যদিও বেশ দেরি হইছে। এখন আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্য বলি একটা জিনিস তৈয়ার হইছে যেইখানে আপনি নিজের স্বপ্ন কল্পনা আবেগ জমা রাখতে পারেন।
৮. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনার কাজ বড়ই কঠিন ।
মনে হয় একবার যৌথভাবে একটা ম্যাগাজিন করছিলাম। পরে আর সেটা হয় নাই। আসলে আমি গোষ্ঠী ভালোবাসি কিন্তু নিজের লনলিনেসটারে বেশি গুরুত্ব দিয়া ফেলাই। ফলে সমাজ সংঘ আমারে আটকাইতে পারে না, অথচ সমাজসংঘের প্রতি আমার দারুন একটা মাথাব্যথা ও মায়া কাজ করে। ঘরের বাহিররে কী আছে তার দিকে আমার কঠিন টান কাজ করে।তবে সামনের দিনগুলাতে সংকলন সম্পাদনার কিছু কাজ করবো ভাবতেছি। অন্যের দায়িত্ব নেওয়ার ভিতর আপনাবিলয় ঘটে বটে।
৯. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
লিটল ম্যাগাজিন হইলো একটা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা। এইটার দরকার আছে। একটা মতাদর্শের সাথে আরেকটা মতাদর্শের সংঘর্ষ হয় সমাজে। লিটল ম্যাগাজিন নিজেদের মতাদর্শরে প্রচার করে। নিজেদের বিকাশ ধরি রাখে। তবে লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের বেইরে কী ঘটতেছে তা জানা জরুরি। যদিও অনলাইন যুগে এই সীমানা আর থাকতেছে না!
১০. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
অনেক ভালো খবর এখন আমরা ইচ্ছা করলেই এক ক্লিকে পৃথিবীর সকল দেশের সাহিত্যের খবর নিতে পারি। কিন্তু বই হচ্ছে বই! তার বিকল্প অনলাইন নয়। তবে সাহিত্য চর্চা ও প্রচার প্রসারের জন্য ওয়েব ম্যাগাজিন অতুলনীয়। অনেক অচেনারে চিনায়ে ফেলে দ্রুত। এইখানে অপেক্ষা বিরহ জিনিসটা কম। ফলে প্রেমের ধরনও বদলাই গেছে। বইপ্রেম মানুষের কাটবে কিনা জানি না!
১১. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
দেশে দেশে জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেছে। অনেক বেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাহুবল দেখাইবে। ন্যায় ও মানবাধিকার লণ্ঠিত হইবে। অন্ধ মানুষরা বেশি চোখে দেখবে। সামাজিক নিরাপত্তা না রইরে।ধর্মের মর্মবাণী মানুষ নিবে না। অহং এর চিৎকারে কান বিদীর্ণ হইবে। রাষ্ট্র ব্যক্তির উপর অনেক বেশি ত্রাস সৃষ্টি করবে। বড় দেশগুলার বলয় ছোট দেশগুলার দখল নিবে নানা ভাবে। ক্ষুধা দারিদ্র শরণার্থী সমস্যায় ভুগবে পৃথিবী। এই গ্রহে মানুষই মানুষের বড় শত্রু। পরিবেশ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের ঘটনায় লোভী অহংকারী মানুষরা কিছুই শিক্ষা নিবে না।অসহায় মানুষের কান্নায় আকাশের মেঘগুলা আরও উপরে উঠি যাইবে। আগামী দিনের সাহিত্য এই জিনিসগুলারে ধরবে । কবিদের অন্তর কষ্ট পাবে ক্ষণে ক্ষণে। প্রতিবাদী সাহিত্য, দায়িত্বশীল সাহিত্যের উদ্ভব ঘটবে বেশি বেশি আমার মনে হয়। মানুষের অস্ত্বি ও অস্তিত্ব এই গ্রহে আর কতদিন আছে মানুষ তা নিয়া মাথা ঘামায় না। রাষ্ট্রের অংশীদারিত্বের জঘন্য অভাব ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলার লিখকদের কন্ঠ রুদ্ধ করবে। একটা ভালো দিক ইউরোকেন্দ্রিতা আমাদের সাহিত্যে কম থাকবে, উত্তর উপনিবেশি সাহিত্যের একটা জোয়ার বইবে বলা যায়। লেখক ও লেখকের লিখার স্বাধীনতা রইবে কম।
গ্রহণে সাজ্জাদ বিপ্লব
[…] বাংলা রিভিউ এর মূল সাক্ষাৎকার […]